প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৭

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৭
তানিশা সুলতানা

গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে থাকে ইফাদ। কনুই হতে গোটা হাত জমিনে পড়ে আছে। সাদা ফ্লোর র ক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। ইফাদের গগণ কাঁপানো আর্তনাদে গোটা কক্ষ মুখরিত। যন্ত্রণা বোধহয় সয্যের সীমা পেরিয়েছে। বাঁচার তাগিদে তার এই ছটফটানি।

পূর্ণতা দুই হাতে কান চেপে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুক কাঁপতে তার। মৃত্যুকে ভয় পায় সে। ভীষণ ভয় পায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটা কবিতার লাইন বরাবরই পূর্ণতা মনে রাখে। যখন চোখের সামনে কারো মৃত্যু দেখে, সাদা কাফনে মুরানো কোনো লা শ দেখে, নিজের মৃত্যুর কথা স্বরণ হয়। অস্থির হয়ে ওঠে। তখনই সে লাইন গুলো আপন মনে আওড়ায়

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে”
অভি এগিয়ে আসে। চোখ দুটো লাল রং ধারণ করেছে। কপালের রগ গুলো ফুলে উঠেছে। ঝাঁকড়া চুল গুলো এলোমেলো। বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা, শার্ট ঘামে ভিজে আছে। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝড়ছে। দ্রুত নিঃশ্বাস চলছে। হয়ত অতিরিক্ত রাগের কারণে।
এক হাতে পূর্ণতাকে জড়িয়ে নেয় অভিরাজ। পরিচিত ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে পূর্ণতা। অতিপ্রিয় স্বামীর স্পর্শে ঠোঁট উল্টে কান্না করে ফেলে।

“নারী জাতি বরাবরই আহ্লাদী।
তবে তার প্রিয় মানুষদের কাছে”
এই যে শক্ত মনের অধিকারী পূর্ণতা। বরাবরই সে সকলকে দেখিয়ে এসেছে তার চঞ্চলতা এবং সাহসীকতার নমুনা। কিন্তু এই সাহসী মানবীর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ভীতু নরম এক খোলশ। যেটা অভি ব্যতীত কারো সামনে প্রকাশ করা হয় নি।

পুরুষালি লোমশ যুক্ত বুকে ঠাঁয় নেয় পূর্ণতা। সুগন্ধি এবং ঘামের সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ নাকে লাগছে অভির বুক হতে। যে ঘ্রাণ পূর্ণতার অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে সফল হয়। হৃদয়ে দোলা দেয়। সুখ সুখ অনুভূতী হয়।
ইফাদের চিৎকার কমে এসেছে। শান্ত হয়ে জমিনে লুটিয়ে রয়েছে জড়োসড়ো হয়ে। হয়ত জ্ঞান হারিয়েছে। কাটা স্থান হতে এখনো র ক্ত গড়াচ্ছে।
অভিরাজ পূর্ণতার চুলের ভাজে চুম্বন এঁকে দেয়। নরম আদুরে গলায় বলে

“আমি আছি পূর্ণ। যতখন আমার দেহে প্রাণ রয়েছে ততখন কেউ তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না কথা দিলাম।
শান্ত হয় পূর্ণতা। শান্তিও পায়। মৃ ত্যুর ভয় কাটে। এই বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলে মন্দ হবে না। বরং শান্তিতে দুনিয়া ত্যাগ করতে পারবে।
গলায় আটকে থাকা কান্না গিলে পূর্ণতা সুধায়
“কোথায় ছিলেন এমপি সাহেব?
আমার যে বড্ড ভয় করে।
বউকে আশ্বস্ত করতে অভিরাজ শান্তনা মূলক বানী আওড়ায়
“ভয় পেয়ো না বউ। আমি আছি তোমার কাছাকাছি।

শহর হতে ইফতিয়ারে মা আমিনা বেগম, বাবা ইসমাইল, এবং বড় ইরিন এসেছে ইফতিয়ারকে দেখতে।
বরাবরই ছেলে তাদের অবাধ্য। প্রাণ প্রিয় ছেলেকে সর্বক্ষণ কাছাকাছি রাখতে চায় আমিনা বেগম। কিন্তু ছেলে তাকে গুরুত্ব দিয়ে কাছে থাকে না।

আলিসান মখমলে শয়নকক্ষে ইফতিয়ার শুয়ে রয়েছে। তারই পাশে বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে যাচ্ছেন আমিনা। কয়েকদিনের জ্বরে নাজেহাল অবস্থা তার নাড়ি ছেঁড়া ধনের। অতিমাত্রায় সুদর্শন পুরুষটি নুয়িয়ে পড়েছে জ্বরের প্রতাপে। আদলে দেখা মিলেছে ক্লান্তির ছাপ। ইরিন থার্মোমিটার দ্বারা জ্বর মাপছে। পেশায় সে একজন ডাক্তার।
চিন্তিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ইসমাইল।
জ্বরের প্রতাপ ভালোই। তবে ছুটে যাবে কিছুক্ষণে। নিশ্চিত হয়ে থার্মোমিটার রাখে ইরিন। ভাইয়ের আদলে নজর রেখে শুধায়

“ভাই আর কতো?
ফিরে চল।
তোকে ছাড়া আমাদের ভালো লাগে না।
ইফতিয়ার মৃদু হেসে মায়ের হাত জড়িয়ে নেয়। মাথা তুলে মায়ের কোলে মাথা রাখে। শান্তি মেলে। মায়ের কোলে জাদু আছে।

“ পূর্ণতাকে দেখার লোভে পড়ে আছি এখানে। কি করে ফিরি বল?
একটু থেমে আবার বলে
আপু জানিস
কি দারুণ মায়া ওর মুখে। আমার দৃষ্টি ফেরে না। তৃষ্ণা মেটে না। মন ভরে না। কলিজা ঠান্ডা হয় না রে।
যেদিন তৃষ্ণা মিটবে সেইদিন ফিরবো।।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন ইসমাইল। আমিনা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলে
“আমরা কেউ না? আমাদের কথা তোমার মনে পড়ে না?
“তোমরা তো আমাকে না দেখে থাকতে পারো মা। একটু চিন্তা হয় আমাকে নিয়ে পরমুহূর্তে মানিয়ে নিতে পারো। কিন্তু আমি তো পারি না।

আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে। ওকে না দেখতে পেলে আমি ম রে যাবো।
ছেলের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত আমিনা বেগম। নিজেও ভালোবাসা হারিয়ে ইসমাইলের হাত ধরেছেন। ত্রিশ বছর সংসার করছে। তবুও কি পুরোনো ভালোবাসা ভুলতে পেরেছে?
নাহহ পারে নি।
মনের কোণে এখনো উঁকি দেয় সেই কিশোরী বয়সের আবেগ। অস্থির হয়ে ওঠে মস্তিষ্ক। অসয্য লাগতে থাকে দুনিয়া। ঠিক তখনই দুটো সন্তানের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আবেগ পালিয়ে যায়। দায়িত্ব মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

“আব্বা তুই একবার বলে দেখ। পূর্ণতাকে আমি তোর কাছে নিয়ে আসবো।
চমকায় ইফতিয়ার। ভীতি নয়নে তাকায় বাবার মুখপানে। বিচলিত হয়ে বলে
“না বাবা
অভিতেই পূর্ণ পূর্ণতা। তাকে অভি হারা করো না।
আমার ভাগ্যে ও নেই। আল্লাহ বুঝেছে আমি পূর্ণতার জন্য সঠিক নই। অভির বা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করেছে তাকে।

আমি দূর থেকেই তৃষ্ণা মেটাবো।
বিশ্বাস আছে আমার। আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে ঠকাবে না। উত্তর পরিকল্পনা করেছেন তিনি আমার জন্য। শুধু ধৈর্য ধরতে হবে।
ইফতিয়ারের কথার প্রসঙ্গে কেউ আর পাল্টা জবাব দিতে পারে না। শুধু মনে মনে আফসোস করে “এতো ভালোবেসেও ভাগ্যের কাছে হেরে গেলো। আল্লাহ ইফতিয়ারে মঙ্গল করুক”

চটে আছেন জমিদার সাহেব। মেজাজ বিগড়েছে জমিদারের তিন পুত্রেরও। মনোয়ার ছেলের কার্যক্রমে বিরক্ত। বউয়ের জন্য ভাইকে আঘাত করবে?
দিন দিন কাপুরুষে পরিণত হচ্ছে তার ছেলে। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ইফাদকে। আপাতত বৈঠক ডেকেছেন জমিদার। কড়া কিছু কথা অভিরাজকে শোনাতেই হবে। আজকের সভায় জমিদার বাড়ির গিন্নিদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই সুবাদে পূর্ণতাও স্থান পেয়েছে সেখায়। মিষ্টির পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। এখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি।

অভি বসেছে জমিদারের মুখোমুখি। ভয় ডর কিংবা অনুসূচনা কোনোটাই তার আদলে প্রকাশ পাচ্ছে না। যেনো সে যেটা করেছে ভালো করেছে।
রেশমা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে। দুটো সন্তানের জননী হলেও ইফাদের বেলায় সে একটু বেশিই যত্নশীল।
সভায় পিনপিন নিরবতার অবসান ঘটায় মনোয়ার।
সে কটাক্ষ স্বরে বলে

“বউয়ের জন্য ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা সুপুরুষে পরিচয় নয়।
বাবার চোখে চোখ রেখে অভিরাজ জবাব দেয়
“বউকে প্রতিতালয়ের বে…..শ্যা বানানোও সুপুরুষে পরিচয় নয়।
আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস করবেন না আপনি৷ চোখ তুলে নিবো।
থমথমে খেয়ে যায় মনোয়ার। ভয়ও পায় খানিকটা। এই ভয়ের কারণ অভির দেওয়া হুমকি নয়। “প্রতিতালয়ের বে…শ্যা” কথাটাই তার ভয়ের কারণ।

সাহেব ভাবে খানিকক্ষণ। অভিরাজের ভাবভঙ্গি ভালো নয়। বিচক্ষণ সাহেব ঢেড় বুঝতে পারছে তার তিলে তিলে গড়ে তোলা নারী পাচারের ব্যবসায় বিপক্ষ দল হয়ে দাঁড়াবে অভি। বউয়ের সঙ্গ পেয়ে মায়ের স্মৃতি চারণ ভুলতে বসেছে। অভিকে থামানো দরকার।
অতি গম্ভীর গলায় জমিদার সুধায়
“কি চাও তুমি দাদুভাই?
“মুক্তি
“ ঠিক আছে

বউ নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। মুক্তি দিলাম তোমাকে।
“যাওয়ার হলে আমি আরও আগেই চলে যেতাম। উদ্দেশ্য অন্য আমার।
জমিদার তার ছোট পুত্রকে চোখের ইশারা করে। বাবার ইশারা পেয়ে মামুন পূর্ণতার নিকট গিয়ে দাঁড়ায়। মিষ্টির পেছনে যায় পূর্ণতা। উদ্দেশ্য সঠিক নয় তার ঢেড় বুঝতে পারছে।
“শোনো পূর্ণতা

বয়স কম তোমার। যৌন চাহিদা সম্পর্কে ধারণা কম। আবেগে ভাসছো তুমি। তাই আগে থেকেই সাবধান করছি তোমায়।
পুরুষত্বে সমস্যা রয়েছে তোমার স্বামীর তাই নারীদের ভোগ করে মজা নিতে পারে না। মজা তোমাকেও দিতে পারবে না। তৃপ্তি মেটানোর ক্ষমতা তোমার স্বামীর নেই।
তাই ভালোই ভালোই বলছি। একে ছেড়ে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবো।
পবিত্র নয় তোমার আদরের স্বামী। অক্ষম সে।
কান গরম হয়ে ওঠে পূর্ণতার। ঘৃণায় দৃষ্টি নত করে জমিনে তাকায়। স্তব্ধ হয়ে যায় অভিরাজ। তাকিয়ে থাকে চাচার মুখপানে।

অকপটে কতোবড় অপবাদ দিয়ে ফেললো।
মিষ্টির আঁখিতে অশ্রু টলমল করে। মাথা নুয়িয়ে চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত সে। পরিবারের প্রতি দিন দিন শ্রদ্ধা কমে আসছে তার।
অভি কিছু বলতে উদ্ধত হবে তখনই মনা বলে
“ঠিক বলেছো মামা।
অভি পুরুষই নয়। অক্ষম
তবুও বড়বড় কথা বলে।

সে বোধহয় জানেই না পুরুষত্ব বিহীন পুরুষের মূল্য নেই।
সয্যের সীমা পেরিয়ে যায় অভির। তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
মনা তাচ্ছিল্য হেসে বলে
“ভাব খানা দেখো?
এখনো লজ্জা পাচ্ছে না সে। লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত তার।
কাপুরুষ একটা।
শেষের কথাটা বিদ্রুপ করে বলে মনা।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৬

আশ্চর্য হয় পূর্ণতা। নানা মামা মামী ভাই সকলের সামনে নিলজ্জের মতো কিভাবে কথা বলছে মনা?
তবে মানতেই হবে জমিদার বাড়ির পুরুষ নয় নারীরাও প্রতিতালয়ের বে***শ্যাদের দলে।
মামুন আবারও কিছু বলতে উদ্যাত হয় তখনই

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ২৮