অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বাড়িতে বিয়ের আমেজ। সকলেই হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে। আলাদা আলাদা বাড়িতে অনুষ্ঠান না করে কমিউনিটি সেন্টার বুক করছে তিন পরিবার। বিয়ের আনন্দ দ্বিগুণ করতে বিদেশ থেকে স্বামী, সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরলো আয়েশা সুলতানার একমাত্র মেয়ে। দেশে খুব কমই আসা হয় তাঁর। ছোটো ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান মিস দিতে চাইলো না। তাই ছুটে চলে এলো সকলের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। বিদেশে থাকলেও সকলের সাথেই তার ভিডিও কলে কথা হয়। সেই সুবাদে কারো সাথে নতুন করে পরিচিত হতে হয়নি।

অরু দু-হাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে। কী আশ্চর্য! এখন তার পিঠ চুলকাচ্ছে, মাথা চুলকাচ্ছে, ঘাড় চুলকাচ্ছে। দুনিয়ায় যত চুলকানি আছে, সব মেহেদী দেওয়ার পরই দলবল নিয়ে হানা দেয়। আশেপাশের সবাই ব্যস্ত। কাকে বলবে একটু চুলকে দিতে! চোখজোড়া তরীর খোঁজ করলো। পরক্ষণেই ভেবে দেখলো তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বেচারার ভাই-বোন, দেবর তিনজনেরই বিয়ে। ঘাড়ের উপর ট্রিপল দায়িত্ব। মিঠু পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। অরু তাকে ডেকে উঠলো।
“ভাইয়া।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পা থামিয়ে তাকালো মিঠু। সূক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করে বলল,“এমন বাইন মাছের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
অরু করুণ স্বরে বলল,“একটু মাথাটা চুলকে দাও। আমি মেহেদীর জন্য পারছি না।”
মিঠু যেন বেশ মজা পেল। সে মাথা চুলকে দিলো না, বরং বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। ঠোঁটে জ্বালাময়ী হাসি। অরু ছটফট করে বলল,“দাও না রে ভাই!”
মিঠু হাতের থাবা বসাতে নিলো অরুর মেহেদীর উপর। চেঁচিয়ে কয়েক কদম ছিঁটকে সরে গেল অরু।

“ভালো হবে না বলে দিলাম!”
“আচ্ছা! কী করবি তুই?”
“তোমার বউয়ের কানে বি*ষ ঢালবো। ছোটোবেলায় কী কী করেছো সব বলবো।”
মিঠু গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,“বলিস গে।”

অরু ক্রুর হেসে বলল,“সব তো বলবো না। যেগুলো বললে তোমার ইজ্জত যাবে সেগুলোই বলবো।”
“বড়ো ভাইয়ের সাথে বে*য়া*দ*বি করিস? তুই তো মহা বে*য়া*দ*ব। বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকলে নারী শিক্ষার পাশাপাশি মহা বে*য়া*দ*ব*কে মানুষ করার শিক্ষার প্রচলনটাও হয়তো করে ফেলতেন। আমার তো মনে হয় ভদ্রমহিলা তোকে দেখিবা মাত্র হার্ট অ্যাটাক করে বসতেন।”
অরু বাহুতে মাথা ঘষে চলেছে। চুলকাতে তো পারছে না। মিঠুর কথা শুনে বলল,“দুনিয়াতে আগে কে এসেছে? আমি নাকি তুমি?”

“অবশ্যই আমি। সেই রেসপেক্ট পর্যন্ত করিস না। পাশের বাসার আন্টিদের মতো সারাক্ষণ আমার পেছনে কূ*ট*ক*চা*ল শুরু করিস।”
অরু সুন্দর করে মিঠুকে বোঝালো,
“দুনিয়াতে তুমি আগে এসেছো, সবকিছু তুমি আগে করেছো। ছোটোরা কার কাছ থেকে শেখে? নিশ্চয়ই তার বড়োটার কাছ থেকে। আর আমিও তোমার কাছ থেকে শিখে মহা বে*য়া*দ*ব হয়েছি। তাই যা দো*ষ আমার, তার পুরোটা দায়ভারই তোমার।”

মিঠু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“কাল ভালোয় ভালোয় তোকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচি। শান্তিতে থাকা যাবে। দেখা গেল চু*রি করবি তুই, আর চো*র সাজা পেলাম আমি।”
অরু ফিচেল হেসে বলল,“কেন? বউয়ের হাতে খুন্তির মা*র খেয়ে ধামাচাপা দেবে বলে আমাকে বিদায় করতে চাইছো? কিন্তু আমি তো এই বাসায় আসা ছাড়ছি না। প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখবো। তারপর রমরমা ক্যাপশনে তুমি ভাইরাল। “দেখুন্, রাজনীতিবিদ ইবতেসাম মিঠুকে এ-কি করলেন তাঁর স্ত্রী”।

“তুই থাকতে আবার সিসিটিভি ক্যামেরা? যার ঘরে এমন একটা বোন আছে, তাঁর কপাল আমার মতোই পোড়া। বেচারা রামির জন্য আমার বড্ডো কষ্ট হচ্ছে! জেনে-বুঝে কুমিরভর্তি খালে সাঁতার কাঁটতে নেমেছে। প্রাণটা ঝুলে আছে তার। এই বুঝি কুমিরের পেটে গেল!”

অরু সকাল থেকে এখনো না খেয়ে আছে। তরী মামাতো বোনকে দিয়ে অরুর নাস্তা পাঠিয়ে দিল।
মামাতো বোন নাস্তা দিয়ে বলে গেল,“অরু তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নে।”
হাত দিয়ে কীভাবে খাবে? খিদেতে পেটও জ্বালা করছে। কিন্তু অরু কিছুতেই এখন মেহেদী তুলবে না। খিদে লাগলে লাগুক। বসে রইলো চুপচাপ। মিঠু কিছু না বলে অরুর সামনে বসলো। কাঁটা চামচে নুডলস আটকে বলল,“হা কর।”
অরু চুপচাপ হা করে খাবার মুখে নিলো। মুখের খাবার গিলে আবার হা করলো। কিন্তু মিঠু চামচ ঘুরিয়ে নিজের মুখে নিলো। পরপর কয়েক চামচে অর্ধেক নুডলস নিজের পেটে চালান করে অরুর দিকে তাকালো। শুধালো,“এমন তাকিয়ে আছিস কেন? খাবি? দেখ্ আমার আবার পেট ব্যথা করবে।”

অরু ক্ষ্যাপা স্বরে বলল,“আমার নুডলস আর আমাকেই জিজ্ঞেস করছো ‘খাবি’?”
“খেতে চাইলে হাত ধুয়ে এসে বাকিটুকু খা।”
বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে চলে গেল মিঠু। অরু বিড়বিড় করে বলল,“আমাকে সিরাজুদ্দৌলা পেয়ে মীরজাফরের পরিচয় দিয়ে গেল। না না, এমন চলতে দেওয়া যায় না। শীঘ্রই ঘষেটি বেগমের রূপ ধারণ করতে হবে।”

হলুদে খুব নাচানাচি করলো অরু। বিয়ের দিন সকালেই গাড়ি নিয়ে সুহার মামা বাড়িতে চলে গেল। সেখান থেকে সুহাকে নিয়ে সোজা পার্লারে গেল। নিজের কোন কিছুতেই ত্রুটি চায় না অরু। দু’জনকেই একইরকম সাজ দেওয়া হলো। সুহার মাঝে ভীতি, জড়তা থাকলেও অরু একদম স্বাভাবিক। হয়তো মানুষগুলো সব তার পরিচত, আর বিয়ের পর দূরে কোথাও যেতে হবে না বলেই এতটা স্বাভাবিক আছে সে। অরু আর সুহার সাজ কমপ্লিট হলেই ড্রাইভার তাদের নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেল। সবাই আগে থেকেই ওখানে উপস্থিত আছে।

রিয়াজ মিঠুর কানে ফিসফিস করে বলল,“ভাই, ভাবি এসে গেছে।”
সামনে তাকালো মিঠু। তার চোখদুটো আটকে গেল কারো মায়ায়। রামি আগে থেকেই আটকে আছে। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিলো মিঠু। রামি দৃষ্টি সরালো না। অরু আর সুহাকে রামি আর মিঠুর পাশে বসানো হলো। আগে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হলো।

ক্যামেরাম্যান বিভিন্ন পোজে মেয়েদের ছবি তুলছে। অরু কটমট চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,“বিয়ে আমাদের, ছবি তুলবে আমাদের। তা না করে অন্য মেয়েদের সাথে ঢং করা হচ্ছে!”
রামি নিচু গলায় বলল,“তোর সাজের সাথে এমন একটা এক্সপ্রেশন মানাচ্ছে না। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বসে থাক।”
অতঃপর ক্যামেরাম্যানকে ডেকে বলল,“এদিকে এসে বউদের ছবি তুলুন৷“

ছেলেটা ক্যামেরা হাতে একপ্রকার দৌড়ে এলো। অরু একবার এক পোজ দিচ্ছে। তার ছবি তোলা শেষই হচ্ছে না। কাপল ছবি তোলা হলো। এরপর চার বর-বউয়ের একসাথে তোলা হলো। অরুর এখনো আশ মেটেনি। ক্যামেরাম্যান মাত্রই যেতে নিচ্ছিলো। অমনি অরু বলল,“আমার আরো কয়েকটা ছবি তুলুন।”

ছেলেটার চোখমুখ কাঁদোকাঁদো। রামি নিজেও ক্লান্ত পোজ দিতে দিতে। ক্যামেরাম্যান যদি দেখায় একটা, অরু আবিষ্কার করে আরো পাঁচটা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“ভাই আমার বউ যত চায়, ছবি তুলে দিন। আপনার জন্য আমার তরফ থেকে উপহার থাকছে। বিয়ে তো একদিনই। আমার আজকের দিনটা মাটি করবেন না। দেখা গেল আজ নয়, মনমতো ছবি না তুলতে পারার দুঃখে আগামী একমাস আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।”
ক্যামেরাম্যান ছেলেটা মুহূর্তে ফিক করে হেসে ফেললো। নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বলল,“ঠিক আছে, তুলে দিচ্ছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”

তরী আজ ভারী শাড়ি পরেছে। অমি কিছুক্ষণ হাসি-আনন্দে ছোটাছুটি করলেও এখন এসে তরীর কোলে চড়েছে। কিছুতেই নামতে চাইছে না। মাহমুদ এসে দু-হাত বাড়িয়ে দিলো ছেলের দিকে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল,“এসো, পাপা আর তুমি বর-বউ দেখবো।”
অমি ঝাপিয়ে পড়লো পাপার কোলে। মাহমুদ ছেলেকে কোলে নিয়ে তরীকে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি খেয়েছো?”

“না, পরে খাবো।”
মাহমুদ বলল,“পরে আর সময় হবে না। সবাই খেয়ে নিয়েছে। আমি খাবার নিয়ে আসছি। এখানে বসে থাকো।”
মাহমুদ চলে গেল। তরীর জন্য খাবার পাঠিয়ে সাথে সে-ও অমিকে কোলে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত স্বরে বলল,“আস্তে আস্তে খাও, কোন তাড়াহুড়ো নেই। ওদিকে কিছু লাগলে আমি সামলে নেব।”
তরী মাথা নেড়ে খাওয়া শুরু করলো। অমিকে বর-বউ দেখিয়ে তাদের সাথে ছবি তুলে পূণরায় তরীর কাছে এসে দাঁড়ালো মাহমুদ। ততক্ষণে তরীর খাওয়া শেষ। যত্ন করে তার একহাত মুঠোয় চেপে বলল,“এসো।”

তরীকে নিয়ে ক্যামেরাম্যানের সামনে দাঁড়ালো। অমিকে কোলে তুলে তরীকে বাঁ পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। একহাত সন্তর্পণে তরীর পিঠের উপর গিয়ে বাহু ছুঁয়েছে। পরপর ক্লিকে ক্যামেরাবন্দী হলো কিছু চমৎকার ভালোবাসার মুহূর্ত।
বিদায় মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুহা আর তার পরিবার। মা- মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছে। সবকিছু আনন্দে কেটে গিয়েও শেষে কেমন বিষাদের ছায়া দেখতে পেল অরু।

কাল থেকে তার বিন্দুমাত্র মন খা*রা*প ছিলো না। বিয়েতে সে কাঁদবে না। কেন কাঁদবে? নিজের মানুষগুলোর কাছেই তো থাকছে সে। এমন ভাবনা একটু আগ পর্যন্ত থাকলেও এখন কেমন বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। চোখে পানি টলমল করছে। হুট করেই বাঁধ ভাঙা কান্নায় যোগ দিলো অরুও। মায়ের কথা বড্ডো মনে পড়ছে। মা থাকলে নিশ্চয়ই দিনটি অন্যরকম হতো। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাবাকে খুঁজলো। কোথাও দেখা যাচ্ছে না বাবাকে। মিঠু বোনের কান্না দেখে সবাইকে সরিয়ে এসে অরুকে বুকে চেপে ধরলো। এতে অরুর কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। মিঠু হেসে বলল,“পাগলি কাঁদছিস কেন? তুই তো আমাদের কাছেই থাকবি। যখন ইচ্ছে আমাকে জ্বালাতে পারবি।”

তরীও এগিয়ে এলো। সাদাদ মাঝখানে বলে উঠলো,“যোগ্য ব্যক্তি হারালে, কাঁদতে হবে আড়ালে। আমাকে হারিয়ে এখন প্রকাশ্যে কাঁদছো তুমি। বুঝলে না অরু!”
সুহার মা মিঠুর খোঁজ করলেন। সেদিকে গেল মিঠু। মেয়েকে মিঠুর হাতে তুলে দিয়ে কান্নার জন্য আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। ইতিমধ্যে সুহা জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে। দ্রুত তাকে কোলে নিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দিলো মিঠু। সুহার মাথা কোলে নিয়ে বসলো। মাথা নিচু করে কপালের মাঝ বরাবর শুষ্ক ঠোঁটে চুমু খেয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল,“বিশ্বম্ভরা, প্রতিটি বস্তু কণা জানুক, আপনি শুধু আমার।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৬

রামি অরুকে নিয়ে গাড়িতে চড়লো। কান্নার ফলে প্রচন্ড মাথা ধরেছে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো অরু। কিছুক্ষণ পরই কপালে শীতল হাতের ছোঁয়া টের পেল। ঝট করে চোখ মেলে তাকালো। রামি মৃদু স্বরে বলল,“চোখ বুজে থাক। ভালোলাগবে।”
অরু দ্বিরুক্তি করলো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রইলো পুরো পথ।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৮