অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৬

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

কুয়াশায় ঢাকা মিষ্টি ভোর। দূর থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা পাখির কলতান। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়লো সুহা। অজু করে আগে নামাজ আদায় করে নিলো। সকাল বেলা বাড়ির পরিবেশ বেশ ঠান্ডা থাকে। শব্দহীন পায়ে রান্নাঘরে ঢুলো সে। চুলায় পাতিল বসানো। টগবগ করে পানি ফুটছে। কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। চা শেষ করে কয়েকটা জামা বের করে রাখলো বিছানার উপর।

তারপর একে একে শরীরের উপর মেলে ধরে দেখলো কোনটায় তাকে বেশি ভালোলাগবে! আজ ও-বাড়ির সবার সাথে শপিং এ যাওয়ার কথা তার। তরী আপু বারবার করে বলেছেন নিজের বিয়ের জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনতে। বিয়ে একবারই হয়। কনের শখ, আহ্লাদকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এদের সবার মানসিকতা দেখে সুহা মুগ্ধ হয়। কত ভালো একটা পরিবার পাবে সে। প্রফুল্লচিত্তে গোলাপি রঙের জামাটা আলাদা করে রাখলো। মনটা খুব হালকা লাগছে। এতদিন তার মাঝে একটা দ্বিধার দেয়াল ছিলো। যা ধীরে ধীরে সরে গিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শপিং করতে অরু, রামি, মিঠু আর সুহা ছাড়াও যাচ্ছে সাদাদ আর ইরা। মাহমুদ কলেজের জন্য বেরিয়ে গেল। তরী যাবে না বলে মনস্থির করলো। সবাই একসাথে বেরিয়ে গেলে বাসায় রান্না করবে কে? তাছাড়া মাহমুদ দুপুরে ফিরে একা বাসায় বসে থাকবে। সবদিক বিবেচনা করেই ইরা আর সাদাদকে ওঁদের সঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে নিজে শাশুড়ীর সাথে বাসায় থেকে গেল।

অরু আর মিঠু একসাথেই বের হলো বাসা থেকে। ইরা আর সাদাদ মিঠুর গাড়িতে পেছনদিকে উঠে বসলো। রামি বাইক বের করলো। সে অরুকে নিয়ে বাইকে যাবে। মিঠুকে বলল,“তোরা যা, সামনে থেকে সুহা ভাবিকে তুলে নিস। সবার তো আর জায়গা হবে না। আমি অরুকে নিয়ে বাইকে আসছি।”
“যা।”

মাঝখানে বিঘ্ন ঘটালো সাদাদ। হুঁশিয়ারি গলায় বলল,“খবরদার! দুজনে বিয়ের আগ পর্যন্ত দূরত্ব বজায় রেখে চলবি। কোন কাছে আসার গল্প হবে না।”
ধারালো চোখে তাকালো রামি। দরাজ কন্ঠে বলল,“বিয়ে করেছি আমি, বউ আমার। তুমি সাবধান করার কে?”
“ভুলে যাস না রামি, অরু আমার…..”
ইরার কটমট দৃষ্টির কবলে পড়ে ওখানেই বাকি কথা গিলে ফেললো সাদাদ। রামি এসবে পাত্তা দিলো না। অরুকে বলল,“দ্রুত আয়।”

অরু চুপচাপ রামির পেছন পেছন বাইকে চেপে বসলো। সাদাদ জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল,“এটা ঠিক করলে না অরু। আজ আমাকে পাত্তা দিতে, তাও মানা যেত। জীবনে একজন সুদর্শন পুরুষ পেতে।”
অরু নাকমুখ কুঁচকে বলল,“বয়সটা দেখেছো? বুড়ো হয়ে গিয়েও এখনো তোমার রঙঢঙ কমেনি।”
“আমার মন তো বুড়ো হয় নি। রঙঢঙ কমবে কীভাবে? রামিটা তো সেই আদিকাল থেকেই বুড়ো। তাই ওঁর মনে রঙঢঙ নেই। তোমার কথা শুনেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, রামিকে বিয়ে করে তুমি পস্তাচ্ছো। এখনো সময় আছে, সুদর্শন পুরুষের দিকে ফিরে এসো।”

সাদাদকে পাত্তা না দিয়ে রামি বাইক টে*নে মিঠুর গাড়ি পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল। অরু দু’হাত ছড়িয়ে বসেছে। বাতাসের ঝাপটায় চুল উড়ে বেড়াচ্ছে। সামনের মিররে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ বাইক থামালো রামি। অরু শুধালো, “কী হলো?”
রামি চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। কড়া ধমক দিয়ে বলল,“এক্ষুণি চুল বাঁধবি বে*য়া*দ*ব। হাত দুটো ছড়িয়ে বসেছে। এ্যাই তুই নায়িকা? হাইওয়েতে ম*রা*র শখ হয়েছে?”

অরুর মুখ চুপসে গেল। নায়িকা নায়িকা ফিলিংসটা একেবারে পিষে ফেলে চুল বেঁধে নিলো। রামি বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে বলে দিল,“শক্ত করে ধরে বসবি। তিড়িংবিড়িং করলে এখানে ফেলেই চলে যাব।”
অরু দাপুটে গলায় বলল,“আমি শপিংমল চিনি না ভেবেছো? তুমি শুনে রাখো, বেশি তিড়িংবিড়িং করলে তোমাকে বিয়েই করবো না। সোজা হোস্টেলে গিয়ে উঠবো।”

বাইক টা*ন দিয়ে রামি মৃদু হেসে বলল,“আর বিয়ে না করলেও চলবে। একবার তো বিয়ে করলি।”
“বিয়ে করেছি তো কী হয়েছে? একেবারে তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাব।”
মিটিমিটি হাসলো রামি। রগঢ করে বলল,“যেখানেই যাস না কেন, যাওয়ার আগে তোর একটা সতীন খুঁজে দিয়ে যাস।”
অরু বলল,“জীবনের প্রতি মায়া নেই? তোমার জন্য আমার বড্ডো আফসোস হচ্ছে! অল্প বয়সে প্রাণ হারাতে হবে ছেলেটাকে, আহারে!”
রামি নিটোল হাসলো। চোখদুটো ছোটো হয়ে এলো তার। অরু পেছন থেকে দেখলো না। তবে শুনতে পেল রামির প্রেমময় স্বর।

“মন তো সেই কবেই হারিয়েছি, এবার নাহয় প্রাণটাও সঁপে দিলাম।”
অরু ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হলো। দু-হাতে আঁকড়ে ধরলো রামির শক্ত বুক। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“আমার মাঝেই তোমার কল্যাণ নিহিত। তাই আমার মাঝেই তোমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। আমি বলবো না আমার চেয়ে উত্তম কাউকে পেতে তুমি। কারণ আমিই তোমার জন্য উত্তম। সেজন্যই সৃষ্টিকর্তা আমাদের এক সুতোয় জুড়ে দিয়েছেন। আমি তোমার প্রাণ চাই না, স্বচ্ছ মনটাই চাই।”

সুহার মামার বাসার সামনে গাড়ি থামালো মিঠু। ফোন হাতে মেসেজ পাঠালো সুহাকে। একটু পরই তাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। একটা গোলাপি রঙের জামা পরে এগিয়ে আসছে। চোখমুখ উজ্জ্বল। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দিল মিঠু। সুহা পেছনে বসে থাকা ইরা আর সাদাদকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সালাম দিতেই সাদাদ আর ইরা হাস্যজ্জ্বল মুখে কথা বলল তার সাথে। সুহা আড়ষ্ট চোখে তাঁদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মিঠুর দিকে তাকালো। উনাদের সামনে মিঠুর পাশে বসতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। মিঠু শান্ত চোখে সুহার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল বলল,“পেছনে না তাকিয়ে উঠে আসুন।”

ইরা মৃদু হেসে বলল,“উঠে পড়ো।”
সাদাদ বলল,“রামি, মিঠু, মাহমুদ, সবগুলো জিতে গেল। অথচ আমি বেশি সুদর্শন হয়েও ঠকে গেলাম। এমন একটা সুন্দরী তো আমিও ডিজার্ভ করি।”
ইরা চোখ রাঙিয়ে বলল,“আজ শুধু বাসায় যেতে দাও। তারপর তোমার সুন্দরী ডিজার্ভ করা বের করছি।”
আমতা আমতা করলো সাদাদ। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,“আমি তো স্বয়ং পরী পেয়েছি। যতো সুন্দরীই আসুক না কেন, তোমার ধারে পাশেও যেতে পারবে না।”

“তোমার মিষ্টি কথায় গলছি না আমি।”
সুহা বাইরে দাঁড়িয়ে ওঁদের দুজনের ঝগড়া দেখে চলেছে। মিঠু গম্ভীর স্বরে বলল,“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
সংবিৎ ফিরে পেল সুহা। গাড়িতে চড়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। মিঠু পুরো রাস্তা চুপচাপ রইলো। ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে ঠিকই সুহার উপর নজর রেখেছে। আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। লুকোচুরি দৃষ্টিতে মিঠুকে দেখতে গিয়েই চোখাচোখি হলো। সুহা দৃষ্টি সরিয়ে সোজা রাস্তায় তাকালো। আর ভুলেও তাকালো না। মুখ আড়াল করে হাসলো মিঠু।

বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা করে বের হলো সবাই। অরু যেটাই কিনতে চেয়েছে, সবটাই কিনে দিয়েছে রামি। অরু বলল,“আমার খিদে পেয়েছে।”
মিঠু বলল,“চল, খেয়ে নে সবাই।”
সবাই একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। সবাই পছন্দের খাবার অর্ডার দিলো। অরু সুহাকে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কী খাবে ভাবি?”
সুহা বলল,“কিছু একটা হলেই হবে।”
“সেটা কী করে হয়। বলো কী খাবে?”
মিঠু সুহার পাশেই বসলো। নিচু স্বরে বলল,“কফি খাবেন?”

বিষম খেলো সুহা। মিঠু ঠোঁট টিপে হেসে পানি এগিয়ে দিলো সুহার দিকে। ঢকঢক করে পানি পান করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। মেসেজের কথা সে ভুলেই বসেছে। কোন কুলক্ষণে যে ওমন মেসেজ পাথাতে গেল! মিঠু নিজ থেকে সুহার জন্য খাবার অর্ডার করে দিল।

খাওয়ার মাঝেই রামি বলল,“সবাই মিলে আরেকটু ঘুরাঘুরি করে তারপর বাসায় যাই।”
ইরা বলল,“তোরা চারজন থাক। আমরা চলে যাব। বাড়িতে তরী একা হাতে সব সামলাচ্ছে।”
সাদাদও তাতে সহমত হলো। সে রামির উদ্দেশ্যে বলল,“তুই মিঠুর সাথে ফিরিস। আমি বাইক নিয়ে যাচ্ছি।”
দ্বিরুক্তি না করে সাদাদকে বাইকের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে খাওয়া শেষ করলো। ইরা আর সাদাদ চলে গেলে ওঁরা চারজনও বের হলো। আসার পথে যেমন ইরা, সাদাদ পেছনে ছিলো, এখনও রামি আর অরু পেছনে বসলো।

মিঠু জানতে চাইলো,“কোথায় যাবি?”
অরু বলল,“চলো আজ ভাবিকে আমার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখাই।”
সুহার দিকে তাকিয়ে বলল,“যাবে?”
সুহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। রামি অরুকে রাগানোর জন্য বলল,“বুঝলেন ভাবি, মানুষ যে ডাক্তারি পড়ে সেটা জনে জনে ঢোল পিটিয়ে জানাতে চাইছে। যেন দেশে একমাত্র তিনিই ডাক্তারি পড়ছেন। আর বাকি সবাই ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙছে।”

অরু তেজ নিয়ে বলল,“ প্রয়োজনে মাইক ভাড়া করে সবাইকে জানাবো আমি ডাক্তারি পড়ছি। তাতে কার কী?”
রামি ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“বুঝলেন ভাবি, আমাদের ভবিষ্যৎ সচেতন ডাক্তার দাঁত ব্রাশ না করেই ছোটোবেলায় খাবার খেতে চাইতো। কী বিচ্ছিরি কাজ ভাবা যায়! এই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া রোগীর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে।”

অরু ছ্যাৎ করে রেগে গেল। চোখমুখ শক্ত করে বলল,“আর তুমি তো বড়ো হয়েই ব্রাশ করো না।”
রামি ভাব নিয়ে বলল,“প্রমাণ আছে?”

দমে গেল অরু। এভাবে ভাইয়ের সামনে বলা তো যায় না সকালে ব্রাশ না করেই রামি তাকে চুমু খায়। রামির সাথে আর কথা বললো না। গাল ফুলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। সুহার ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। সে কখন থেকে এদের দুজনের ঝগড়ায় মনোনিবেশ করে আছে। এদিকে মিঠুর মনোযোগ তার উপর। বারবার তাকেই দেখছে। সুহার ধ্যান ভাঙলো ফোন কলের শব্দে। মামি কল করেছেন। কথা বলার পর মিঠুকে বলল,“আমি বাসায় যাবো। মামি তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছেন।”

রামি বলল,“আজ আর ঘুরবেন না?”
“না, আরেক সময় ঘুরবো।”
অরু চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লো। মিঠু গাড়ি টা*ন*লো সুহার বাসার দিকে। ঘাড় কাঁত করে ঘুমাচ্ছে অরু। পরে ঘাড় ব্যথা হতে পারে ভেবে ওঁর পিঠের পেছন দিকে হাত রেখে নিজের সাথে আগলে নিলো রামি। সুহা আরেকবার মুগ্ধ চোখে তাকালো। একটু আগেই দুজন ঝগড়াঝাটিতে মেতে ছিলো। অথচ এখন কেবল যত্ন আর ভালোবাসারা ঠাঁই পেল।

মাহমুদ প্রতিদিনের মতো কলেজের পর বাসার জন্য রওনা দিলো। তরী সবার সাথে যায়নি সে জানে। পা চালিয়ে গাড়িতে চড়ার আগে একবার ছেলের জন্য চকোলেট কিনে নিলো। সাথে ছেলের মায়ের জন্য ফুল। বাসায় পৌঁছে বেল দেওয়ার পরপরই তরী এসে দরজা খুলে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। প্রত্যুত্তরে মাহমুদও হাসলো। তরীকে পেছনে ফেলে ঘরে পা রাখতেই বিছানার উপর তার বাসায় পরার জামাকাপড় দেখতে পেল। তরী প্রতিদিন ওঁর বাসায় আসার সময় হলেই সব হাতের কাছে এনে রাখে। মাহমুদ আগে বাইরের পোশাক পরিবর্তন করে নিলো। তরী ঘরে এসে বলল,“আমি খাবার দিচ্ছি, খেতে আসুন।”

মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,“অমি কোথায়?”
“ওঁর দাদুআপুর কাছে।”
মাহমুদ এগিয়ে এলো তরীর কাছে। বাহু ধরে ঘুরিয়ে দিল তাকে। চুলের খোঁপায় যত্ন করে ফুলের মালাটি আঁটকে দিল। কোমল স্বরে শুধালো, “সবার সাথে গেলে না কেন?”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৫

তরীর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। চুলে হাত ছুঁইয়ে বলল,“গেলে যে এই সুন্দর মুহূর্তটি মিস করে যেতাম।”
মাহমুদ হাসলো না। তবুও যেন তার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। ছোটো ছোটো কিছু মুহূর্ত দিয়েই সে তাদের ভালোবাসাটাকে তরতাজা করার চেষ্টা করে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৩৭