ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৫

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৫
সাইয়্যারা খান

রোদকে বাসায় আনা হয়েছে। আপাতত ঘুমাচ্ছে ও। আদ্রিয়ান কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। রোদকে বাসায় রেখেই বেরিয়েছে। ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা। রোদের পরিবারও এখানে আছে। রোদের মা মেয়ের ভালোবাসায় কিছুটা স্বার্থপরায়ণ হয়ে ভেজা গলায় বলে উঠলেন,

— ওদের তো দুটো সন্তান আছেই। আর কি দরকার?আমার মেয়েটা সুস্থ থাকুক।
আকুল আবেদন। মা হয়ে তার কাছে মেয়ের আগে কিছুই না। এটাই কি স্বাভাবিক নয়? রোদের বাবা মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর করে বসে আছেন। যেন তারও এই কথাই। বাকি সবারও একই মতামত যা বুঝা যাচ্ছে নাহলে কেউ কেন এখনও কোন প্রকার দ্বিমত পোষণ করছে না? সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নিশ্চিত আদ্রিয়ানের কিন্তু সে কোথায়? ঐ যে গেলো এখনও এলো না। রোদের পরিবার মেয়েকে দেখে চলে গেলেন। তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটুট।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আদ্রিয়ান বাসায় ফিরলো। কাল রাত থেকে ভবঘুরের মতো ঘুরছে ও।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গাইনোকলজিস্ট এর সাথে দেখা করেই মাত্র বাসায় ফিরলো৷ এটাই তো শেষ ভরসা ছিলো। ভেবেছিলো ভিন্ন কিছু শুনবে কিন্তু না কোন প্রকার ভিন্ন বাক্য শুনে নি ও। ড.মিহা যেই তিক্ত কথাগুলো বলেছিলো সেগুলোই আবার শুনেছে আদ্রিয়ান।

“এবোর্শন” শব্দটা কানে খুব জোড়ালো ভাবে বাড়ি খাচ্ছে ওর। ড.মিহা সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আলট্রা’তে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে ফিটাস দুটো। সেই রিপোর্ট হাতেই আদ্রিয়ান তখন হসপিটালে হতভম্ব হয়ে বসে ছিলো সহ বাকি সবার মুখে ছিলো আতঙ্ক। যেখানে সব দম্পতির জন্য টু ফিটাস শব্দটা আনন্দের। খুশির।

সেখানে আদ্রিয়ান-রোদের জীবনে শব্দটা হলো আতঙ্কের। হারানোর বেদনার। যেখানে রোদের বডি একটা বাচ্চার জন্যই প্রস্তুুত নয় সেখানে দুটি একসাথে। কোন ভাবেই এটা সম্ভব নয়। হাই রিক্স প্রেগ্ন্যাসি এটা। এমনকি শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদুটো আর মা বাঁচবে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। এমনকি মাঝপথেই ড্রপ হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা রোদ। ওর লাইফ রিস্কে আছে। ডেলিভারিতে জটিলতার সম্ভবনাই বেশি।

এমনকি জীবন ঝুঁকি যা আগে ছিলো তার থেকেও বেড়েছে। অথচ মেয়েটা বেখবর। হসপিটাল থেকে কতটা খুশি হয়ে এসেছে তা শুধু মাত্র রোদই জানে। কেউ ওকে বলে নি যে জমজ হবে। নার্সের কাছ থেকে শুনেছে। খুশিতে যখন আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলো তখন আদ্রিয়ান ও কেঁদেছিলো। রোদ ভেবেছে হয়তো রোদের মতোই খুশিতে কাঁদছে অথচ আদ্রিয়ান কাঁদছিলো দুটি না আসা সন্তানের প্রাণ আশঙ্কায়।

সাথে রোদের জন্য। এই রোদ ছাড়া আদ্রিয়ান বাঁচবে না। কিছুতেই না। আবার সন্তানের লোভ ও সামলাতে ব্যার্থ আদ্রিয়ান। যেখানে একটা সন্তান চলে গিয়েছে এটা শুনেই অতি শোকাহত ছিলো আদ্রিয়ান সেখানে আজ দুটো সন্তান আছে যাদের সাথে রোজ রোজ কথা বলে আদ্রিয়ান-রোদ। এই সন্তানদের কিভাবে কুরবান করবে আদ্রিয়ান?আর রোদ? ঐ পাগলটাকে কিভাবে সামলাবে আদ্রিয়ান?

রুমে ডুকার আগেই আদ্রিয়ানের মা ডেকে উঠলেন। আদ্রিয়ান আসছি বলে রুমে ডুকলো ফাইল রাখতে। রোদ তখন মিশি আর মিশানকে নিয়ে গল্প করতে ব্যাস্ত। ওরা চারজন হবে। বড় একটা দল হবে সহ কত কি। মিশি আর মিশানের খুশির শেষ নেই। দুই জনই প্রচন্ড এক্সাইটেড জমজদের জন্য। আদ্রিয়ানের বুকটা হু হু করে উঠলো। খালি খালি লাগছে সব। আলমারি খুলে কাপড় নিতেই কানে এলো রোদের কন্ঠ,

— কোথায় ছিলেন আপনি? খেয়েছেন দুপুরে? কল করলাম কত? ধরেন নি কেন হ্যাঁ? আমরা পাঁচজন টেনশনে ছিলাম।
আদ্রিয়ানের এখন কান্না আসছে। কিন্তু সেটা করা যাবে না। কাপড় হাতেই ওয়াসরুমে ডুকে পড়লো। রোদ ভ্রু কুচকে মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমি কি আস্তে বলেছি? তোমার বাবা কি শুনে নি?
— শুনেছে তো।
রোদ চিন্তিত হলো। আদ্রিয়ানের একটুও অবহেলা যে সহ্য হয় না। আবার ভাবলো হয়তো টায়ার্ড। মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— বাবা নিচে দিদা’কে বলো বাবা’র জন্য খাবার বেড়ে দিতে। রুমে নিয়ে আসবে।

ঘাড় দুলিয়ে মিশিকে সহ মিশান রুম ত্যাগ করলো। রোদের কথা মত আদ্রিয়ানের জন্য খাবার রুমে দিয়ে মিশান গিয়েছে। রোদ প্লেট হাতে অপেক্ষা করছে আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান প্রায় ঘন্টা খানিক পরই বের হলো। রোদ তবুও ধৈর্য হারা হলো না। আদ্রিয়ান বারান্দায় টাওয়াল মেলতে গেলেই রোদ বললো,
— আমার পাশে বসুন চুপচাপ।

আদ্রিয়ান টাওয়াল রেখে চুপচাপ তাই করলো। চোখ,মুখ ফুলা আদ্রিয়ানের। নিশ্চিত কাল রাত ঘুমায় নি। রোদ ভাত মেখে আদ্রিয়ানের মুখে তুলে দিতেই আদ্রিয়ান খেয়ে নিলো। খাওয়াতে খাওয়াতেই রোদ বলতে লাগলো,
— মুখের কি অবস্থা? বাবুরা এসে আমাকে বলবে আমি তাদের আব্বুর খেয়াল রাখি নি৷ আর কল যদি আর এমন রিসিভ না করেন তাহলে আমি আর কথা বলব না। চিন্তা হয় না আমার?

অভিমানী সুর রোদের। আদ্রিয়ান খেতে খেতে আর কোন প্রতিত্তোর করলো না। রোদের হাতে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ক্ষুধা লেগেছিলো প্রচুর। গত রাতের পর আর খাওয়া হয় নি। খাওয়া শেষ হতেই রোদ বললো,
— কখনো শুনেছেন কেউ নিজেদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকি এভাবে পালন করে? সারাদিন কোথায় ছিলেন? বলুন? বাসার কেউ তেমন ভাবে উইস ও করলো না। শুধু ফেসবুকে উইশ করেছে সবাই। একসাথে দুটো খুশির খবর। একেতো বিবাহ বার্ষিকি তার উপর আমাদের টুইন হবে। সেলিব্রেশন নাহয় ছোট করে করতাম।

আদ্রিয়ান রোদের সব অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনলো। রোদ তো করলো অভিযোগ কিন্তু আদ্রিয়ান কোথায় করবে? ওর অভিযোগ শুনার কে ই বা আছে?
আদ্রিয়ান এগিয়ে রোদের ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নরম কন্ঠে বললো,
— আম্মু ডেকেছিলো। কথা বলে আসি।
রোদ মাথা দুলালো। আদ্রিয়ান প্লেট হাতে বের হলো।

পাশাপাশি বসে আছে আদ্রিয়ানের পরিবারের সবাই। সবার কথার মূলে রয়েছে একই ইঙ্গিত। বাচ্চাগুলোকে মারার কথা বলছে। হ্যাঁ এটাই তো বলছে। সহ্য হচ্ছে না আদ্রিয়ানের। অতি দুঃখে হাতটা মুঠ করতেই রগ গুলো ফুলে উঠলো। আদ্রিয়ানের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে কাতরতা অনুভূতিপ্রবণতা সহ বলে উঠলেন,

— রোদের পরিবার ও এটাই চাইছে আদ্রিয়ান। দুটো সন্তান তো আছেই। তার তাছাড়া রোদের লাইফ সেফ থাকবে না। এটা তো জানোই। আর যত দেড়ীতে করা হবে রোদের রিক্স বেড়ে যাবে।
আদ্রিয়ান মাথা তখনও নীচু করে আছে। আরিয়ান ছোট ভাইকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য শব্দের খুব অভাব। কি বলবে? আদ্রিয়ান উঠে চলে গেলো। পেছনে আরিয়ানও গেলো। এমন মুহুর্তে ভাইকে একা কিভাবে ছাড়বে?

দিশা এখন আর কিছু বলে না। আজ হঠাৎ শরীর হালকা খারাপ লাগছে ওর। রাত ভর ঘুম হচ্ছে না। রাতুলের সাথে জেগে থাকতে হচ্ছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে দিশা। মনকে হাজার বুঝ দিয়ে রাতুলের জন্য ভালোবাসা জন্মাতে চাইছে। কিছুটা হয়তো হয়েছেও। আল্লাহর দেয়া পবিত্র বন্ধন বলে কথা। মায়া,টান আল্লাহ নিজে সৃষ্টি করে দেন স্বামী স্ত্রী’র মাঝে। নিজেকে সামলাতে যথেষ্ট চেষ্টায় আছে দিশা। কি হবে ধোঁয়াশার পেছনে ছুটে? বর্তমানটা নিয়েই না হয় একটু খুশি থাকুক। সেই থেকে রাতুলের প্রতি ধ্যান দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে দিশা। ঘন্টাখানিক আগেই রাতুলকে কল করেছিলো রিসিভ হয় নি। দিশা ব্যাস্ত ভেবে আর কল করে নি। শাশুড়ীকে সঙ্গ দিতে ছুটেছে তার রুমে। এখন থেকে নিজের সুখ চাইবে দিশা। রাতুলকে নিয়ে ভালো থাকবে। আর কত বিষাদে মাখামাখি হবে ও? সুখ নিশ্চিত এবার ধরা দিবে ওর দারে।

রাতুল বাসায় ফিরতেই দিশা রোজকার ন্যায় সব গুছিয়ে দিলো। পানিটাও রাতুলকে ঢেলে খেতে হয় না। বউ তার সব করে দেয়। রাতুল একমনে খাচ্ছে। পাশেই দিশা বসা। দিশা ভাবলো রাতুল হয়তো দিশাকেও খেতে বলবে কারণ দিশা তো রাতুলের অপেক্ষায় ছিলো। খায় নি এখনও কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। নিজে খেয়ে উঠে গেলো রাতুল। দিশা ঠাই বসে। একটু কি রাতুল জিজ্ঞেস ও করতে পারলো না যে দিশা খেয়েছে কি না?

তবুও মনকে বুঝ দিলো দিশা হয়তো রাতুল টায়ার্ড বা অতটা খেয়াল করে নি। তাই আর ঘাটলো না। সব গুছিয়ে নিজে না খেয়েই রেখে দিলো। শাশুড়ী অবশ্য অনেক বলেছিলো খেতে। দিশাই খায় নি। বলেছে রাতুলের সাথে খাবে কিন্তু হলো না।
সব গুছিয়ে রুমে ডুকলো দিশা। কপালে হাত ঠেকিয়ে রাতুল চোখ বুজে আছে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো দিশা। রাতুলের পাশে পা উঠিয়ে বিছানায় বসে হাত রাখলো রাতুলের কপালে। চোখ মেলে এক পলক তাকালো রাতুল। দিশা সুন্দর করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

— মাথা ব্যাথা?
— হুম।
রাতুলের ছোট্ট উত্তর। দিশা হাত দিয়ে সুন্দর করে রাতুলের মাথা টিপে দিলো। আরাম পাচ্ছে রাতুল। রোদের চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। হসপিটালে শুনেছে আজ রোদের অবস্থা। যত যাই হোক না কেন রাতুল সবসময় ই চায় রুদ্রিতা ভালো থাক। সুখে থাক। যার সুখের আশায় রাতুল ছটফট করতে ব্যাস্ত সেখানে রাতুলেরই সিয়রে বসে তার স্ত্রী নিজের সুখ খুঁজতে ব্যাস্ত রাতুল থেকে। অথচ সে বেপারে বেপরোয়া রাতুল।

জাইফা’কে নিতে চেয়েছিলো ওর পরিবার অনেকবার কিন্তু বরাবরই রাদ না করেছে। বউ কাউকে দিবে না সে। বউ তার বাচ্চা তার তাহলে কেন অন্য বাসায় থাকবে? এতদিন এটা বলে আসলেও আজ রাদ অন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাইফার ডেলিভারি ডেট এগিয়ে আসছে। আর আপাতত বাসার অবস্থা আর রাদের নিজের অবস্থা কতটা ভঙুর তা রাদ ই জানে। প্রিয় তার ছোট্ট বোনটার সাথে কি থেকে কি হচ্ছে তাই বুঝে উঠতে পারছে না ও। জাইফা ভরা পেটটা নিয়ে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। রাদ আস্তে করে উঠলো। নিজেই চুলগুলো বেঁধে দিয়ে জাইফা’কে ধরে বেডে বসালো। নিজে বসলো হাটু গেড়ে ওর পাশে। মলিন হাসলো জাইফা৷ রোদটা যে সবার ই প্রিয়। রাদ উঁচু হওয়া পেটে চুমু খেয়ে হাত বুলালো। জাইফা রাদের গালে হাত রেখে বললো,

— আল্লাহর কাছে দোয়া ছাড়া কিছু করার নেই রাদ। ভরসা রাখুন।
রাদ মাথা রাখলো আলতো করে জাইফার উঁচু পেটে পরপরই মাথা উঠিয়ে বললো,
— কাল তেমাকে তোমাদের বাসায় রেখে আসব জায়ু। আমি রোজ যাব দেখা করতে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। বাবু তো এসেই যাবে ইনশাআল্লাহ।
জাইফা হাসলো। বললো,

— আপনি কিভাবে ভাবলেন আমি চলে যাব?
— এখানে তোমার যত্ন নেয়া সম্ভব হবে না জান। বুঝার চেষ্টা করো।
— আমার যত্নের কোন খোট থাকবে না এটা আমি জানি রাদ। আমাকে এতটা পর কেন মনে করেন? আমি তো আপনারই। আপনাকে আর এই পরিবার’কে এমন অবস্থায় একা ছাড়বো কিভাবে ভাবলেন আপনি?
রাদের চোখ গড়িয়ে কয়েক ফোটা পানি পরলো যা খুব যত্নের সাথে মুছে দিলো জাইফা।

আদ্রিয়ান নিজেকে শক্ত করেছে। বহু কষ্টে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। এটা ব্যাতিত কোন উপায় ও তো নেই৷ ঠেলে ঠুলে পা চালিয়ে রুমে ডুকলো। আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিলো। কথাগুলো সব সাজিয়ে এসেছে আদ্রিয়ান। রোদকে বুঝাতে হবে। বলতে হবে বাচ্চাগুলো রাখা যাবে না। ডক্টর তো সোজাসুজি বলেছে বেবিগুলো শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তার ভরসা নেই। ডেলিভারিতেও রোদের লাইফ রিস্ক। রোদের পড়াশোনা একেবারেই শেষ হয়ে যাবে কারণ ওর বেড রেস্টে থাকতে হবে। তাহলে পথটা কোথায়? যত দ্রুত করবে ততটা রোদের জন্য ভালো। এসব ভাঙতেই ভেঙে গেল আদ্রিয়ান। আবার নিজেকে শক্ত করলো। রোদ বেডেই হেলান দিয়ে বই পড়ছে। আদ্রিয়ান ওর পাশে বসেই ডাকলো,

— রোদ?
বই থেকে মুখটা সরিয়ে রোদ বললো,
— জ্বি।
কি বলবে আদ্রিয়ান ভেবে পেলো না। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলো। বলতে তো হবেই। নিজেকে যথা সম্ভব সামলে আদ্রিয়ান রোদের হাত থেকে বইটা সরিয়ে পাশে রাখলো। রোদ ভ্রু কুচকে তাকালো। আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই রোদ বললো,

— চলুন না ডিনার বাইরে করি আজ? এমন এনিভার্সিরি হয় কারো? প্লিজ চলুন না। বাচ্চারা আমরা দুজন আর বাসার সবাই। আর ভাইদেরও আসতে বলি। নাহলে বাচ্চারা আসলে কি গল্প শুনাবো আমি? ওদের আব্বু এত কিপ্টে যে একটু ঘুরতেও নিলো না। আর…
রোদ আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। রোদ চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি? আদ্রিয়ান চোখ নামিয়ে নিলো। ঢোক গিললো। বলতে হবে। মুখ খুললো আদ্রিয়ান,

— রোদ। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনো।
— বলুন। শুনছি।
আদ্রিয়ান বহু কষ্টে বলে উঠলো,
— রোদ বাচ্চাদের রাখা যাবে না।
রোদ বুঝলো না। কোন বাচ্চাদের কথা বলছে আদ্রিয়ান তাও বুঝতে পারছে না ও। অবুঝ প্রশ্ন করলো রোদ,
— কোন বাচ্চাদের কোথায় রাখা যাবে না?
আদ্রিয়ান আর বলতে পারছে না। যেন কেউ গলায় চেপে আছে। তবুও জোর করে বললো,

— সোনা আমাদের বাচ্চাগুলো রাখা যাবে না। ওরা সুস্থ নেই। কিছু সমস্যা আছে। ডক্টর মিহা বলেছে যাতে দ্রুত করা হয়। আ..আমি অন্য ডক্টরদের সাথে ও কথা বলেছি। তারাও এটাই বলেছে। এ…এবো…এবোর্শন করতে হবে।
দম নিলো আদ্রিয়ান। বহু কষ্টে এতটুকু বলেছে। রোদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অবুঝ না রোদ আর নাই আদ্রিয়ান ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলেছে। আদ্রিয়ান সোজা করে বললো বাচ্চাগুলোকে মে’রে দিতে। রোদ তবুও ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

— বুঝলাম না? কি বললেন? আবার বলুন। আমি আসলে খেয়াল করি নি।
আদ্রিয়ানের কন্ঠনালী কেঁপে উঠল। দাঁত চেপে ধরে নিজেকে শক্ত করলো। আবারও বললো,
— বাচ্চাদের রাখা যাবে না।
— তো কি করবো?
সোজা প্রশ্ন করলো রোদ। ওর মাথায় ডুকছে না কিছুই। আদ্রিয়ান এবার কিছুটা ভরকালো। বললো,

— এবোর্শন।
রোদের মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ নাকের পাটা ফুলিয়ে জোর গলায় বললো,
— পাগল হলেন আপনি? কি বলেন এসব? কে করবে এবোর্শন? কি ধরণের মজা এসব?
রোদ আর বলতে পারছে না। দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে। ওর দুনিয়া ঘুরে উঠলো আদ্রিয়ানের কথায়। আদ্রিয়ান রোদকে ধরতে উঠলেই রোদ পিছিয়ে যায়। দরজা খুলে পেছনে না ঘুরে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়েই ভয়ে ভয়ে জোরে ডাকতে লাগলো,

— মামনি! বাবা! ভাইয়া!মামনি!
আদ্রিয়ান এগিয়ে আসতে নিলেই রোদ আবারও চিৎকার করে উঠলো। দৌড়ে সবাই আসতেই রোদ আদ্রিয়ানের মা’কে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপছে ওর শরীর। আদ্রিয়ান কি সব বললো মাত্র? রোদ কাঁদে নি এখনও। তেজী গলায় অভিযোগ করে বললো,

— মামনি উনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। দেখো কিসব বলছে। ভাইয়া? দেখো। বাবা’কে ডাকো। উনি আমাকে আমাদের বাচ্চাদের ম…মা..মারতে বলছে। কি বলছে দেখো?
হাঁপিয়ে উঠেছে রোদ। আদ্রিয়ানের মা ওকে জড়িয়ে ধরে আছেন। আরিয়ান এগিয়ে এসে রোদকে ছাড়িয়ে নিলো। ধরে নিজের রুমে গেলো। বাকিরাও সেখানে গেল। আপাতত বাচ্চা বলতে আরিয়ানা বাদে কেউ নেই। জারবার সাথে পাশের বাসায় গিয়েছে। সাবা রোদকে জড়িয়ে ধরলো।

আরিয়ান রোদকে বুঝাতে লাগলো এবোর্শনের কথা। রোদ অবিশ্বাসের চোখে তাকালো সবার দিকে। হঠাৎ কি হয়েছে? বুঝতে অক্ষম রোদ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই’কে ওর নিজের সন্তানদের শত্রু মনে হচ্ছে। এরা কেন ছোট্ট দুটি জানের পিছনে লাগলো? সবার কথায় রোদ বুঝলো এরা সবাই এক জোট। রোদকে কেউ বুঝাতে পারছে না। ও বুঝতেই চাইছে না। সাবা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিলো রোদ। পেছনে আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানের গলা কানে আসছে রোদের,

— রোদ! দৌড় দিও না। রোদ! থামো।রোদ!
রোদ থামলো না। রুমে ডুকে হন্য হয়ে নিজের ফোন হাতে নিলো। আদ্রিয়ান ততক্ষণে রুমে ডুকলো। হাঁপাচ্ছে রোদ। কল করেছে রাদকে। রিসিভ হতেই রোদ কাঁদতে লাগলো। রাদ বিচলিত হলো। রোদ বলে উঠলো,
— ভাই! ভাই আমাকে নিয়ে যাও। আমি থাকব না এখানে। এরা আমার বাচ্চাদুটোকে মে’রে দিবে। সবাই এক হয়েছে। আমার বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। আমাকে নিয়ে যাও। ভাই? শুনছো? আমি থাকব না এখানে৷ নিয়ে যাও আমাকে। ভাই?
রাদ অনেক কষ্টে বলে উঠলো,

— বোন আমার ওদের কথা শুন। তোর ভালোর জন্যই….
রোদ সজোরে ফোন আঁছড়ে দিলো। কি শুনলো এটা? ওর ভাই ও তো একই কথা বলছে। আদ্রিয়ান দৌড়ে এসে রোদকে ধরলো। রোদ ঘামতে লাগলো। অতিরিক্ত ঘামছে ও। মাথা ঘুরাতেই বমি পাচ্ছে সাথে। মুখে হাত চাপতেই আদ্রিয়ান তারাতাড়ি ওকে ধরে ওয়াসরুমে ডুকলো। গলগল করে বমি করে দিলো রোদ। আদ্রিয়ান ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রোদ শরীর ছেড়ে দিলো আদ্রিয়ানের উপর।

মুখ ধুয়িয়ে রোদকে নিয়ে বের হলো আদ্রিয়ান। দরজা আটকে দিলো রোদকে শুয়িয়ে দিয়ে। রোদের পাশে বসতেই রোদ উঠে বসলো। আদ্রিয়ানের কোলে উঠে বসে দু হাত রাখলো আদ্রিয়ানের গালে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরলো। আদ্রিয়ানেরও একই অবস্থা। রোদ আদ্রিয়ানের চোখে চুমু দিলো। গালে দিলো। কপালে দিয়ে থুতনিতেও দিলো। আর কিভাবে আদর করবে ও আদ্রিয়ানকে? রোদ উন্মাদের মতো চুমু খেল আদ্রিয়ানের ঠোঁটে। সারা দিলো না আদ্রিয়ান। রোদ গলায় নামলো। চুমু খাচ্ছে অনবরত। শার্টের দুটো বোতাম খুলে চুমু খেল। যতটা পারলো আদর করলো রোদ। আর বলতে লাগলো,

— কি হয়েছে আপনার? আমাকে বলুন। আমি জানি তো কিছু হয়েছে? বলুন না? আপনি তো এমন না। আমি জানি তো। বলুন না?
— কিছু হয় নি।
— উহু। আমি আপনার চোখ পড়তে পারি। বলুন। আপনার চোখ আর ঠোঁট তো এক কথা বলছে না। বলুন সব মিথ্যা? এই বলুন। অনেক আদর করব আপনাকে। বাইরের কিছু খাব না। প্রমিস। আর হ্যাঁ পড়ায় ও ক্ষতি হবে না। আমি সব ঠিক রাখব। আর… আর কি করব? ও হ্যাঁ আমি আপনার সব কথা শুনবো। আমার বাসায়ও যেতে চাইব না। এই যে পেট ছুঁয়ে বলছি কোন বন্ধু রাখব না। ইয়াজ ও বাদ। সত্যি বলছি।

আদ্রিয়ান কাঁদছে শুধু। পানি পরছে গাল বেয়ে বেয়ে। রোদ এবার না পেরে নিচে বসে পরলো। আদ্রিয়ানের পা দুটো নিজের বুকে চেপে ধরলো। আঁকুতি করতে লাগলো নিজের সন্তানদের বাঁচানোর। আদ্রিয়ান অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে রইলো। মনে পরলো এমনই এক সময় মাইশার পা ধরে বসে সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছিলো আদ্রিয়ান। আজ শুধু আদ্রিয়ানের জায়গায় রোদ। রোদ বলে উঠলো,

— এই আপনি কি ভাবছেন আমি মিশি মিশানকে অবহেলা করব? এটা কি সম্ভব বলুন? ওরা আমার বাচ্চা না? প্লিজ আপনি সিদ্ধান্ত বলদান। আমার বাচ্চাদের আমি আমি কিছুতেই মারব না?
আদ্রিয়ান ঝুঁকে রোদকে ধরে উঠায়। রোদ একবুক আশা নিয়ে তাকায়। আদ্রিয়ান সেই আশায় বালি ঢেলে রোদকে নিজের বাহুতে পুরে নিয়ে বললো,
— এটা সম্ভব না সোনা। তোমার লাইফ রিস্ক আছে।
রোদ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়েই রইলো। এ কোন আদ্রিয়ান? রোদ নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আদ্রিয়ান মাথা নিচু করে বসে আছে। রোদ ভেজা গলায় রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,

— ওদের রাখা যাবেই না?
— উহু।
আদ্রিয়ান মাথা না তুলেই বললো। রোদ লাল হওয়া চোখ দিয়ে আদ্রিয়ানকে দেখে বললো,
— ওদের অন্য কেউ কেন মারবে? আমার সন্তানদের আমিই মারবো?
— বাসায় করা সম্ভব না রোদ। হসপিটালেরই করতে হবে।
রোদ হতভম্ব হয়ে গেল। ও কি বললো আর আদ্রিয়ান কি বললো? রোদ তো রাগের মাথায় এটা বলেছে তাই বলে আদ্রিয়ান কি বললো? অতি রাগে,কষ্ট, দুঃখে, অসহায় হয়ে দুই হাত মুঠ করে নিলো রোদ। জোরে জোরে নিজের পেটে আঘাত করতে করতে বলতে লাগলো,

— মরে যা। ম’রে যা তোরা। আমার ভুল। আমারই ভুল হ’য়েছে। তোদের বাপ ই তোদের চায় না। ম’রে যা। তোদের মে-রে আমি নিজেও মরব।
আদ্রিয়ান রোদের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। রোদ জোরে জোরে নিজের পেটে আঘাত করছে। আদ্রিয়ান উঠে ছুটে ধরলো। রোদকে থামানোর চেষ্টা করলো কিন্তু রোদ জোর করেই যাচ্ছে। রোদ থামছে না। বারবার বলছে,
— মরে যা তোরা। তোদের মে’রে আমিও মরব।
আবার বলতে লাগলো,

— তুই ধরবি না আমাকে। ছাড়। মেরে দিব এদের। আমিও মরব। তুই শান্তিতে থাক। তুই তো এটাই চাস।
আদ্রিয়ান না পেরে রোদকে সজোরে চড় মারলো। এক চড়েই থামলো না। পরপর চার পাঁচটা থাপ্পড় পরলো রোদের গালে। আদ্রিয়ান চড়গুলো মারতে মারতে বলতে লাগলো,

— এই তুই আমার বাচ্চাদের মারলি ক্যান? ওদের কেন মারলি? এই ক্যান মারলি তুই? আমার বাচ্চাদের আঘাত ক্যান করলি?
আদ্রিয়ানের শক্ত হাতের চড় খেয়ে রোদ হেলে পড়েছে। ততক্ষণে বাইরে থেকে বাকিরাও চিল্লাচিল্লির আওয়াজে ছুটে এসেছে। আরিয়ান ছুটে এসে আদ্রিয়ান’কে থাপ্পড় মে’রে বললো,
— এই ওকে কি করেছিস তুই?
— ও….ও আমার বাচ্চাদের মেরেছে। মেরেছে মাত্র। কতগুলো আঘাত করেছে। আরিয়ান চেক কর। চেক কর না। আমার বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কি না।দেখ না।

বাকিরা ততক্ষণে রোদকে ধরেছে। রোদ জ্ঞান হারা তখন। আরিয়ান ক্ষ্যাপাটে কন্ঠে বললো,
— তুই তো এই বাচ্চাদের মারার জন্যই এতসব করছিস? তাহলে কি করছিস এখন? কি করেছিস মে’রে?
আদ্রিয়ান যেন হুসে ফিরলো। রোদের জ্ঞান ফিরে নি তখনও। আদ্রিয়ানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কি থেকে কি করলো ও? রোদকে কেন ই বা মারলো? অতি মানুষিক আঘাতে যা হয় তাই হয়েছে আদ্রিয়ানের। আরিয়ান চেক আপ করার কিছুক্ষণ পরই রোদের জ্ঞান ফিরলো। ততক্ষণে রাদ সহ রোদের মা-বাবা হাজির। রোদ উঠতেই আদ্রিয়ান কাছে আসতে নিলো ওমনি রোদ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,

— আমার বাচ্চা….. আমার বাচ্চাদের মে’রে ফেলেছে। উনি আমার বাচ্চাদের মে’রে ফেলেছে। মি….মিশি, মিশানকেও মে’রে দিবে। আমার সব বাচ্চাদের মে’রে দিবে। মে’রে দিবে।
রাদ বোনকে জড়িয়ে ধরলো। রোদ কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
— ভাইয়া আমার বাচ্চাদের মে’রে ফেলেছি।

আদ্রিয়ান কয়েক কদম পিছনে গিয়ে আলমারি ঘেঁষে বসে পরলো। এক পলকে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। মিশান দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কি হয়েছে তা সম্পূর্ণ না জানলেও যতটুকু দেখেছে বা শুনেছে তাতেই ছেলেটা নিস্তব্দ হয়ে গেল। রোদকে শান্ত করলে পারছে না কেউ। আরিয়ান রোদকে ধরে বললো,
— রোদ বোন আমার তোর বাচ্চারা ঠিক আছে।
— না না না আমি মে-রে দিয়েছি ওদের।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৪

অবশেষে ডক্টর ডেকে রোদের চেকআপ করানো হলো। ড.মিহা বলাতে রোদ বিশ্বাস করলো ওর বাচ্চারা এখনও আছে। রাদ এবার রোদকে বুকে জড়িয়ে রোদকে সবটা বললো শুধু আগের মিসক্যারেজের কথাটা বললো না। আদ্রিয়ান না করেছে।
রোদ বাচ্চাদের মারবে না। এতে যদি ও মরেও যায় তা ও না। সবাই শত বুঝালেও রোদের এক কথা ও ওর বাচ্চাদের মারবে না। হয় নিজে মরে যাবে তবুও বাচ্চাদের মারবে না। আদ্রিয়ান কিছুই বলে নি। আলমারি ঘেঁষে বসেই আছে। জীবনের এমন মুহূর্তে কি করবে ও এখন?

ভালোবাসার ভিন্ন রং বোনাস পর্ব