ভালোবাসার ভিন্ন রং বোনাস পর্ব 

ভালোবাসার ভিন্ন রং বোনাস পর্ব 
সাইয়্যারা খান

রোদ নিজের বাসায় চলে যেতে চেয়েছিলো বাচ্চাদের নিয়ে। আদ্রিয়ান নির্বাক ই ছিলো৷ কিছুই বলে নি। কিন্তু কি মনে করে রোদ যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে না করে দিলো। ওর মন মানুষিকতার কথা চিন্তা করে কেউ আর দ্বিতীয় বার সাথে যাওয়ার কথা বললো না। রোদের পরিবার সেই মনে মেয়ের জীবনের অনিশ্চিয়তা নিয়েই গেলেন। অথচ রোদ কারো মনের খবর রাখলো না।

ওর এখন নিজের অনাগত সন্তানের জন্য লোভ হচ্ছে। কেন হবে না? ওর ভালোবাসার চিহ্ন এই দুটো বাচ্চা। কিভাবে মেরে দিবে এদের। এসবের মধ্যে রোদ এটা ভাবলো না রোদ ছাড়া বাকি এগুলো প্রাণ কিভাবে কিভাবে বাঁচবে? ওকে “মা” বলে আরো দুটি বাচ্চা আছে। আদ্রিয়ানের মতো পাগল করা স্বামী আছে। নিজের একটা পরিবার আছে যাদের জান রোদ আর এই যে শশুর বাড়ী যারা রোদকে কোনদিন ছেলের বউ হিসেবে দেখে নি। নিজেদের মেয়ের মতো ভালোভাসে। ঐ যে সব কথার এক কথা, মা। কেই বা এই লোভ সামলাতে পারবে? রোদ ও পারে নি। হোক সেটা নিজের জীবনের বিনিময়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদ্রিয়ান রুমে ডুকলো বেশ দেড়ীতে। রোদ ঘুমাচ্ছে তখন। এলোমেলো চুল, লাল হয়ে ফুলে আছে দুটো গাল। ফর্সা আর নাদুসনুদুস তো রোদ আগেরই। সেই গালে পুরুষের হাতের এতগুলো থাপ্পড় খেয়েই গালের এই বেহাল দশা। আদ্রিয়ানের ভীষণ খারাপ লাগছে। কিভাবে এতগুলো আঘাত করে বসলো ও ওর রোদকে? হাত দুটি ভেঙে ফেলতে মন চাইলো নিজের। দরজা আটকে ধীর পায়ে রোদের সামনে এসে বসলো।

গাল দুটো বাজে ভাবে ফুলে লাল হয়ে আছে। আদ্রিয়ান হাত বাড়িয়েও সরিয়ে নিলো যদি রোদ ব্যাথা পায়। হাত বাড়িয়ে রোদের পরিহিত ফ্রকটা সন্তপর্ণে তুলে নিলো আদ্রিয়ান। বেরিয়ে এলো আদ্রিয়ানের এতদিনের মোহময় ভালোলাগার স্ত্রীর বিশেষ অঙ্গ। যেই পেট এতদিন আদ্রিয়ানের নেশা লাগিয়ে দিতো সেই পেটে এখন শুধু অপেক্ষা। মায়া। ভালোবাসা। আতঙ্ক। এই বুঝি প্রাণ দুটি চলে গেল। সাথে বুঝি নিজেদের মা’কে ও নিয়ে গেলো।

বাবা’টার প্রতি তাদের এত কেন অনীহা? মনে থাকা চাপা কষ্ট গুলো উগরেই ফেললো আদ্রিয়ান। রোদের উন্মুক্ত পেটে চুমু খেল অনবরত। শক্ত হাত দিয়ে নরম ভাবে বুলিয়ে দিলো। এ যেন কেউ কোন নবজাতককে আদর করছে। রোদ তখন সজাগ হলো। আদ্রিয়ান’কে বুঝার চেষ্টা করলো। এমন ভাবে পেটে আদর করছে আদ্রিয়ান মনে হচ্ছে ছোট্ট বাচ্চাদের আদর করছে। পরপরই চুমু খাচ্ছে। ভেজা অনুভব করলো রোদ পেটে। আদ্রিয়ান কাঁদছে। হাত বুলাতে বুলাতেই অভিযোগ করতে লাগলো আদ্রিয়ান,

— এই? আমার সোনা বাচ্চা দুটো কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? ঘুমাও নি। আমি জানতাম তো ঘুমায় নি বাবাই’রা। তোমাদের মা তো ঘুম। তোমাদের বাবা’র ঘুম হারাম করে সে ঘুমাচ্ছে। তোমার বাবা’কে বুঝে না সে। পঁচা সে। বাবাই’কে একটুও ভালোবাসে না। একটুও না। কিন্তু তোমাদের অনেক ভালোবাসে আব্বুরা। তোমাদের মা তোমাদের অনেক ভালোবাসে। তোমাদের জন্য বাবা’কে ছেড়ে যেতেও রাজি সে।

এই বাবা’রা তোরা কি আসবি না? চলে যাবি? তোদের মা’কে ও কি নিয়ে যাবি? কথা বল? বাবা’র প্রতি তোদের এত কেন অনীহা?বাবা কি এতোই খারাপ। তোমাদের কিন্তু আরো দুইজন ভাই-বোন আছে। তারা কিভাবে থাকবে মা ছাড়া। আমি কিভাবে থাকব তোমাদের ছাড়া। বাবা ম’রে যাব তো সোনারা। প্লিজ মা’কে নিয়ে যেও না। তাহলে কিন্তু বাবা ও এসে যাব। তখন তোমাদের ভাই-বোনের কি হবে? তারা কিভাবে থাকবে বলো?
আমার বুকে এসো বাবাই’রা। বাবা অনেক কষ্টে আছি।
বলতে বলতে কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে। রোদের চোখ দিয়ে শুধু পানিই পরছে। আদ্রিয়ান পেটে আবারও চুমু খেতে খেতে বললো,

— মা’য়ের সাথে রাগ করে না। মা মে’রেছে। আমার বাবা’রা কি অনেক ব্যাথা পেয়েছে? মা আর মারবে না। বাবাই মা’কে বকে দিব। এই তোরা আয় না। বাবাই’কে আর কত জ্বালাবি? তোদের মা তো আমাকে বুঝে না। তোরা একটু বুঝ না। তোদের মা’কে নিয়ে যাস না প্লিজ। আমি যে তোদের মা ছাড়া থাকতে পারব না।

ছোট্ট বাচ্চার মতো নিজের অনাগত সন্তানদের কাছে অভিযোগ করলো আদ্রিয়ান। এতে মনটা একটু হলেও শান্তি লাগছে। পেট ঢেকে দিয়ে রোদের পাশে শুয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রোদও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এতে যেন আদ্রিয়ান বন্ধন আরো দৃঢ় করলো। রোদ কাঁদছে। আদ্রিয়ান রোদের গলায় মুখ গুজে কাঁদছে। রোদের কান্না আসছে কারণ ও শুধু নিজেরটাই দেখেছে। একটা বারও তো আদ্রিয়ানের কথা ভাবলো না। ওর তো দুটো বাচ্চা ও আছে। রোদের কিছু হলে ওর মিশি আর মিশানের কি হবে? মা ছাড়া থাকবে কিভাবে? ভাবতেই রোদ এবার জোরে কেঁদে দিলো। আদ্রিয়ান শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,

— এই রোদ? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
— উহু।
–সত্যি?
— হু।
— আমি থাকতে পারব না।
— আমিও।
— এই রোদ?
— হু।
— ওয়াদা কর।
— ওয়াদা।

এ যেন দুই জন অবুঝ মানব-মানবী একে অপরকে আবদার করছে। রোদ আদ্রিয়ান বেশ সময় নিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলো। দুজন দু’জনের কষ্টগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা চালালো। বেশ সময় নিয়ে শান্ত হলো দুজন। আদ্রিয়ান রোদের ঠোঁটে লম্বা একটা চুমু খেয়ে আবারও বুকে নিতেই রোদ বললো,

— উঠবো।
— কি দরকার?
— বাচ্চাদের কাছে যাব। মিশিটা একবার এলো না। মিশানকেও দেখি নি। খেলো কি না ঠিক মতো।
আদ্রিয়ান উঠে রোদকেও উঠালো৷ ওয়াসরুমে ডুকে ফ্রেশ করে বেডে বসিয়ে তেল আর চিরুনি এনে পেছনে বসলো। এলোমেলো চুলগুলোতে তেল লাগিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে বেঁধে দিলো। ভেজা মুখটা আস্তে আস্তে মুছিয়ে দিলো। গাল দুটো এমন ভাবে ভুলে আছে দেখেই আদ্রিয়ানের কেমন লাগছে। আস্তে করে ফুলা গালে চুমু খেয়ে বললো,

— আমি অনেক সরি সোনা। আমার মাথা ঠিক ছিলো না। আমি….
— উমম। কিছু হয় নি। চলুন।
আদ্রিয়ান রোদের হাতটা ধরে ওকে নিয়ে মিশানের রুমে গেলো। মিশান একাই শুয়ে আছে। রোদ জিজ্ঞেস করার আগেই আদ্রিয়ান বললো,

— মিশি জারবার কাছে। জেদ করছিলো। তাই জারবা নিয়ে গিয়েছে।
রোদের বুকে মোচড়ানো শুরু করলো। কেমন মা ও? দুই সন্তানের কথা ভাবতে ভাবতে বাকি দুটোর কথা ভুলে গিয়েছিলো। কিভাবে ছিলো ওর মিশি মিশান? ভাবতেই চোখ ভরে উঠলো। আদ্রিয়ান রোদকে ধরতেই রোদ বলে উঠলো,
— আমি ভালো মা না। ওদের আমাকে দরকার ছিলো। আমি কেন অবহেলা করলাম? আমি মা ডাক শুনার যোগ্য না।
— এই শু..। তোমার পরিস্থিতি তে এটাই স্বাভাবিক। তোমার বয়সে কয়জন মা হয়েছে রোদ? কয়জন এই রকম দুটো বাচ্চা সামলায়?

রোদ এগিয়ে গেলো। আদ্রিয়ান তখনও দাঁড়িয়ে দরজার সামনে। রোদ জানে মিশান ঘুমায় নি। এই ছেলে কিছু হলেই চুপ করে যায়। গম্ভীর হয়ে উঠে। পুরোনো কষ্ট গুলো হয়তো ভুলে নি। যার কি না জন্মদাত্রী মা থাকতেও নেই সেই সন্তান কেমন ই বা থাকবে? কিন্তু মিশান রোদের মাঝে পুরো মা খুঁজে নিয়েছে। এখন এই মায়ে’র এমন অবস্থা দেখে নিশ্চিত ছেলেটা ভালো নেই। রোদ দাঁড়িয়ে থেকেই ডাকলো,

— মিশান?
মিশান নড়লো না। রোদ জানে মিশান জেগেই আছে। আবারও বললো,
— মিশু?
………
— আব্বু উঠবে না? মা দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু।

মাথা বের করলো মিশান কাঁথার নিচে থেকে। হাত বের করে রোদের হাতটা ধরতেই রোদ পাশে বসলো। মিশান মাথাটা রোদের কোলে গুজেই কেঁদে উঠলো। হকচকিয়ে গেলো রোদ সাথে আদ্রিয়ান ও। দ্রুত পায়ে ডুকলো আদ্রিয়ান। ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো,
— মিশান? বাবা? এই কি হয়েছে? উঠো।
মিশান উঠলো না। রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ও কিছু দেখেছে?
— জানিনা তো।
রোদ মিশানের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
— আব্বু? মা ঠিক আছি। কাঁদে না বাবা। মা-বাবা কষ্ট পাচ্ছি না?
— ওরা কি ঠিক আছে?
রোদ বুঝলো। বললো,
— তুমিই জিজ্ঞেস করো?
নাক টানলো মিশান। বললো,

— ওরা কি কথা বলতে পারে নাকি?
— পারে তো। এই যে এখন বলছে ওদের বড় ভাই কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।
— মা?
— হ্যাঁ বাবা।
— আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
— জানিতো বাচ্চা। মা ও অনেক ভালোবাসি।
— তোমার কিছু হবে না তো?
— ইনশাআল্লাহ বাবা। তুমি দোয়া করো।

আদ্রিয়ান ও ছেলেকে বুঝালো। সংসারে কিছু হলে সবচেয়ে বেশি এফেক্ট পড়ে বাচ্চাদের উপর। যদি সেটা হয় মা-বাবা জড়িত তাহলে তো কথাই নেই। রোদ আদ্রিয়ান এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া ও করে না৷ আজ কিভাবে যেন মিশান দেখে ফেলেছে। তাতেই এই অবস্থা।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৫

পরিস্থিতি যথেষ্ট স্বাভাবিক করতে রোদ আদ্রিয়ান মিশানকে সময় দিলো। ঘুমন্ত মিশিকেও নিজের কাছে নিয়ে এলো আদ্রিয়ান। মিশানকেও যথেষ্ট স্বাভাবিক করলো। আজ মিশানের রুমেই চারজন একসাথে ঘুমালো। মিশান তো বলেই ফেললো,
— আমরা ছয়জন এভাবেই থাকব একসাথে।
— ইনশাআল্লাহ বাবা।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৬