তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪০

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪০
হুমাইরা হাসান

রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালো হসপিটালের সামনে।
ভাড়া চুকিয়ে এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে ফলমূলের ঝুড়ি টা নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।
-তুই সিউর এই হসপিটালেই?
-হ্যাঁ, প্রথম দিন তো ও এই হসপিটালের কথায় বলেছিলো। তার পর থেকে তো ফোনটাই ধরেনাই গাধা টা।
ভ্রু কুচকে কাঠ কাঠ গলায় বলল ফারিহা,দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাদমানের উপর ভীষণ রাগান্বিত, এই দুইদিনে কম করেও পঞ্চাশ ষাট বার কল করেছে, বারবারই ফোন সুইচড অফ।

-আহ এভাবে বলিস না, হয়তো এতসব ঝামেলার চাপে ফোন চার্জ করার সময় হয়নি তাই বন্ধ
প্রত্যুত্তর করলো না ফারিহা, রিসিপশনে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্স এর সাথে কথা বলে তুরাকে ইশারা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কেবিনের দরজা টা খুলতেই সামনে পরলো সাদা শুভ্র বেডে শুয়ে মাঝবয়েসী রূগ্ন মহিলা, তার পাশেই চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে ঘুমে ঢুলছে সাদমান। নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো তুরা আর ফারিহা। সাদমানের পিঠ বরাবর দুম করে একটা কি ল বসিয়ে দিলো ফারিহা, আকস্মিক আক্রমণে নিভু নিভু ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠলো সাদমান, তার সামনে তুরা আর ফারিহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকিত হয়ে বলল

-ত তুই,তুমি। মানে তোমরা এখানে?
উসকোখুসকো চুল,লাল টকটকে চোখ যা প্রায় কোটরে বসে যাওয়া। গায়ের শার্ট টাও কুচকানো।
বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে আছে তুরা আর ফারিহার দিকে। উচ্চস্বরে কিছু বলতে গেলেও পাশে শুয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গিয়ে ফিসফিস করে বলল
-তোমরা দুজন? এখানে? কি করে
তুরা কিছু বলবে তার আগেই ফারিহা এগিয়ে গিয়ে দুম করে আরেকটা চা পড় বসিয়ে দিলো সাদমানের বাহুতে, চাপা স্বরে বলল

-ইতর,বদমাশ টিনম্যানের বাচ্চা তোকে কতবার ফোন দিয়েছি বল, ধরিস নি কেনো বেদ্দপ
তুরা সাদমানের সামনে দাঁড়িয়ে ফারিহাকে থামিয়ে বলল
-আরে থাম, কি করছিস আন্টি জেগে যাবে তো
-আমাকে থামাচ্ছিস,এই গদ্ধপ টাকে বল আগে, এই দুইদিনে কতবার ফোন দিয়েছি কোনো আইডিয়া আছে?চিন্তা হয়না আমাদের!

দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল ফারিহা। সাদমান ফারিহার কথা শুনে মুখ ছোট করে বলল
-আসলে ফোনে চার্জ ছিলো না
-কেনো ছিলো নাহ, তোকে বলেছিলাম না সব আপডেট আমাকে বলতে তাও কেনো বলিস নি তুই?
এ পর্যায়ে সাদমান ফারিহার কথার উত্তর করলো নাহ, নিরবতা ভাঙলো তুরার প্রশ্নে
-এখন কেমন আছেন আন্টি?

-এখন আগের চেয়ে বেটার, ডক্টর বলেছে আরও কিছুদিন অবজারভেশনে রাখতে হবে
সাদমানের কথার সাথে সাথে নড়েচড়ে উঠলো বেডে শুয়ে থাকা মানুষটা, দেবে যাওয়া চোখের পাতা খুলে টিপটিপ করে তাকালো। মুখ থেকে মৃদু শব্দ করলেই সাদমান এগিয়ে গিয়ে ধরলো, শান্ত গলায় বলল
-উঠে বসবে মা?

মৃদু মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন ভদ্রমহিলা। বেশ জীর্ণ শীর্ণ রূগ্ন শরীর, সামনের ঢেউ খেলা চুলে পাক ধরেছে বেশ অনেকটা। উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের মহিলাটির চেহারার সাদমানের মুখাবয়বের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। ভার হয়ে আসা চোখের পাতা খুলে পুরোপুরি তাকানোর চেষ্টা করলে পাশ থেকে চশমা টা তুলে চোখে পরিয়ে দিলো সাদমান। ঘোলাটে দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো দুটো কৌতুহল ভরা মেয়েলী চেহারা।

-আসসালামু আলাইকুম আন্টি, কেমন আছেন?
ঠোঁট নাড়িয়ে খুব শান্ত স্বরে সালামের উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে ফারিহা আবারও বলল
-আমি ফারিহা আর ও তুরা, আমরা সাদমানের ফ্রেন্ড
সামান্য হাসলো মহিলা, কুচকে আসা গালের চামড়া মৃদু প্রসারিত হলো। নমনীয় ভাষায় বলল
-আমি তোমাদের আজ প্রথম দেখলেও চিনতে পেরেছি, সাদমান তোমাদের কথা অনেক বলেছে। কতবার বললাম তোমাদের বাড়িতে নিতে কানেই নেয়না

ফারিহার মেজাজে উস্কানি লেগে গেলো সাদমানের মায়ের কথায়। এগিয়ে গিয়ে একগাদা ফলমূল আর হেলথ ড্রিংকস এর ঝুড়িটা টেবিলের উপরে রেখে পাশে বসে খিটমিট করে বলল
-ও বাড়িতে কি নিবে এত কিছু যে হয়ে গেছে। জানানোর প্রয়োজন টুকু বোধ করেনি। আজ দুদিন ধরে ফোন উঠাই নাহ। আজ কত খোঁজ করে করে খুঁজে এসেছি এখানে
একদমে হড়বড়িয়ে বলল ফারিহা, তুরা এগিয়ে গিয়ে চোখের ইশারায় ফারিহাকে থামতে বলে। তবুও যেনো তাতে রা নেই ফারিহার ও তো পারলে সাদমানকে এখন ছাদ থেকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

-এখন কেমন আছেন আন্টি? হঠাৎ এতটা অসুস্থতা কি করে হলো?
তুরার প্রশ্নে ভদ্রমহিলা ক্লান্তির প্রশ্বাস ফেলল। ম্লান কণ্ঠে বলল
-হঠাৎ আর কই মা, অসুস্থতা তো লেগেই আছে। আমার জন্যেই তো সব ঝামেলা, আমি না..
-মা তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে

মায়ের কথা সম্পূর্ণ না করতেই সাদমান থামিয়ে দিলো। তার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট যে ওষুধ খাওয়ার নামে সে মায়ের কথাটা বন্ধ করলো। মহিলা আলতো হেসে বলে উঠল
-আর কত ওষুধ খাবো বাবা, আমার জন্যে তোর জীবনটা ক্ষয় হচ্ছে। এভাবে কতদিন আমার জন্যে এত ঝামেলা সহ্য করবি
সাদমানের চোখে মুখে অস্বস্তি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে মায়ের এহেন কথায় সে বিরক্ত, আর তার চেয়েও বেশি বিব্রত তুরা আর ফারিহার সামনে এসব বলায়। তুরা এক পলক চাইল দুজনের পানে, যেনো তাতেই অনেকটা বুঝে গেলো,এগিয়ে বসে হাতের উপর হাত রেখে বলল

-এভাবে কেনো বলছেন আন্টি, সাদমান আপনার জন্যে করবে না তো কার জন্যে করবে,আপনিই তো সব ওর
-আর কতই বা করবে গো মা, ওর বাবা মারা গেছে তখন ছেলে আমার সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর থেকে আমিও প্রায় শয্যাশায়ী, এতদিন ধরে নিজের উপর চাপ দিয়ে সবটা সামলাচ্ছে ও একা।
সাদমান ট্যাবলেট টা মায়ের হাতে ধরিয়ে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলো। ওষুধ খাওয়া হলে পানির গ্লাস টা হাতে নিতে নিতে বলল

-এসব বাদ দাও মা,কতবার বলেছি এগুলো বলবে নাহ
সাদমানের কথার সাথে তুরাও বলল
-ও ঠিকই বলেছে আন্টি। আপনি এতটা চিন্তা করবেন নাহ। শুধু দোয়া করবেন যাতে সাদমান আরও অনেক বছর আপনাকে আগলে রাখতে পারে, আপনিই তো ওর সব।

-একদম ই তাই, আর এইটাও বেশি বেশি দোয়া করবেন যাতে ওর মাথার গোবর গুলো কমে বুদ্ধি সুদ্ধি হয়
ফারিহার কথা শুনে হেসে উঠলো সাদমানের মা। মেয়েটা ভারি চঞ্চল এটা সেও জানে। তুরা আর ফারিহা আরও বেশ খানিকটা সময় বসে গল্প করলো৷ ঘড়ির কাটায় তিনটা পেরোলে সাদমানের মাকে বিদায় জানিয়ে বেরোলো কেবিন থেকে সাদমান ওদের এগিয়ে দিতে আসলে ফারিহা দাঁড়িয়ে বলল

-আমাদের সাথে আসতে হবে না হাত পা সবই ঠিক আছে, মায়ের দেখাশোনা কর আর গোসল কর। দেখে তো মনে হয়না দুইদিনে গোসল করেছিস, ছি ছি, তোর গায়ের দুর্গন্ধের জন্য ভার্সিটিতে টিকতে পারিনা আমি
ফারিহার অহেতুক কৌতুক শুনে সাদমান মুখ কুচকে তাকালো। পাশ থেকে তুরা পিঠের উপর চাপড় বসালেই মেকি হেসে বলল

-আ’ম জোওকিং
বলে এবার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করলো। সাদমানের দিকে তাকিয়ে বলল
-আন্টিকে তো আরও কিছুদিন রাখতে হবে এখানে, টাকা আছে তোর কাছে?
হাসি হাসি করে রাখা মুখ খানা চুপসে গেলো সাদমানের, তবুও ভঙ্গিমা অপরিবর্তনীয় রেখে বলল
-হ্যাঁ আছে তো, তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না
-মুখটা বন্ধ কর বেদ্দপ। আমি ভাববো না তো কি তোর গার্লফ্রেন্ড আছে যে সে ভাববে
বলেই ব্যাগ থেকে কতগুলো টাকা বের করে সাদমানের সামনে ধরে বলল
-এই টাকা গুলো রাখ, তোর কাজে লাগবে

মুহুর্তেই মুখ জুড়ে কালো আধার নামলো সাদমানের। চোখ শক্ত করে গম্ভীর গলায় বলল
-টাকা টা নিজের কাছেই রাখ ফারিহা,মায়ের চিকিৎসা আমি নিজেই করাতে পারব
ফারিহা আগেই জানতো সাদমান কিছুতেই টাকাটা নিতে চাইবে না। ওর মতো ব্যক্তিত্বের মানুষের কাছে এটাই কাঙ্ক্ষিত ছিলো। তবুও জেদ ধরে বলল
-এখন এসব বলার সময় না সাদমান, আন্টির জন্য টাকা গুলো যখন তখন লাগতে পারে। তোর টিউশনিও তো বন্ধ আছে কোথায় পাবি তুই?

-সেটা আমি বুঝে নেবো বললাম তো, তোকে ভাবতে হবে না
এবার পাশ থেকে তুরা সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বলল
-টাকা গুলো তুমি রাখো সাদমান, বিপদের সময় লাগতেও পারে। আর আমরা কি এতই পর যে আমাদের এতটুকু সাহায্য করতে দেবে না? আন্টিতো আমাদেরও মায়ের মতোই
সাদমান তুরার কথার প্রত্যুত্তর করবে তার আগেই ফারিহা স্পষ্টভাবে বলল
-আমাদের টাকা দেওয়াতে তোর নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে তাই তো? ঠিকাছে তোর যখন এতই সমস্যা তাহলে তুই ধার হিসেবে নে। আন্টি সুস্থ হয়ে গেলে আমাকে শোধ করে দিস,কেমন?

বলেই সাদমানের কোনো জবাব না শুনে ওর হাতে টাকা গুলো গুঁজে দিয়ে তুরার হাত ধরে হাঁটা ধরলো, সাদমান ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের হাতে দিয়ে যাওয়া টাকা গুলোর দিকে তাকালো। টাকাগুলোর আসলেই ভীষণ দরকার ছিলো তার। মায়ের একদিনের কেবিন ভাড়া এখনো বাকি তার উপর আরও দুটো দিন রাখতে হবে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো, সেই পাঠিয়েছে সাহায্য কারো মাধ্যমে,তবে সাদমান টাকা টা অবশ্যই ফেরত দিয়ে দেবে,আর তা খুব শীঘ্রই।

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ফারিহা আর তুরা নিজেদের গন্তব্য উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, বাস থেকে নেমে রিকশার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে আছে তুরা। আজকে বাসটা স্টপের অনেক আগে থামিয়েছে,এখান থেকে অন্যপথে যাবে, অগত্যা উপায়হীন হয়ে তুরার নেমে যেতে হলো। এখান থেকে রিকশা নিয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছাতেও প্রায় আধ ঘন্টা। বেশ অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও রিকশার দেখা না পেয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলো তুরা।

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ঘড়ির ছোট কাটা চারের ঘর ছুঁইছুঁই। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে আহান নিশ্চিত বকবে তুরাকে। যদিও তুরা আজ আহানকে বলে এসেছে সাদমানের মা কে দেখতে আসার কথা।আহান নিজেই তুরাকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু আহানকে দেখলে ফারিহা সাদমান দুজনের বিভ্রান্ত হয়ে যাবে বলে তুরা নিষেধ করেছিলো, কিন্তু তবুও প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটা দেরি করে ফেলেছে। আহান নিশ্চয় অনেক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো তুরা, যতদূর চোখ যায় কোনো অটো বা রিকশার নাম গন্ধ টুকুও নেই। কেমন একটা সুনসান জাগায় নামিয়ে দিয়েছে বাসটা। এদিক তো লোকজনের কলরব ও নেই বললেই চলে।
এক হাতে ব্যাগের হাতা চেপে ধরে দ্রুত পায়ে আগাচ্ছে তুরা ঠিক তখনই একটা গলার স্বর পেছন থেকে শুনলে পা দুটো থেমে গেলো

-এই যে সুন্দরী
ফিরে তাকাতেই কুণ্ঠিত মনে ভ্রু যুগল কুচকে ললাট স্পর্শ করলো তুরার। এই ছেলেটা? এখানে এভাবে? হুট করে বুকের ভেতর অজানা ভয় জেঁকে ধরলো তুরার। ব্যাগের হাতা টা আরও জোরে চেপে ধরে উল্টো ঘুরে আবারও হাঁটা শুরু করতে নিলে আবারও একই রকম গলা কর্ণকুহরে আসলো
-পালাচ্ছ কেনো, দাঁড়াও। সেদিন সাহায্য করলাম তোমাকে ধন্যবাদ টা তো বলে যাও!
ঘুরে দাঁড়ালো তুরা, চোখ মুখ শক্ত করে ঝাঝালো গলায় বলল

-কি সমস্যা!
-সমস্যা তো আমার না,সমস্যা তোমার। আমিতো কথাই বলতে চাচ্ছি তুমিই পালচ্ছ
বলতে বলতে এগিয়ে এলো ছেলেটি, সেদিনকার মতই গায়ে জড়ানো জার্সির মতো টি-শার্ট আর গলায় ঝুলানো চেইন। তবে আজ একা নাহ সাথে আরও একটা ছেলে আছে, দুজনকেই একই ধাচের মনে হলো তুরার। তবে ওরা যেমনই হোক তুরার মোটেও ভালো ঠেকছে না। বিকেল গড়াচ্ছে জনমানবশূন্য এই চিকন রাস্তাটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো যেনো৷ মনে মনে ভীতশঙ্কিত হলেও চোখে মুখে প্রগাঢ় ক্রোধ এনে বলল

-আপনাদের সাথে কথা বলতে আমি মোটেও ইন্টারেস্টেড নই
ফিচেল হাসি দিলো ছেলেটা, তার সাথে হলুদাভ দাঁত গুলো কেমন চিকচিক করে উঠলো, গলার চেইন টা ঘুরাতে ঘুরাতে তুরার সামনে এগিয়ে এসে বলল
-কিন্তু তোমার উপর আমাদের খুব ইন্টারেস্ট
বলেই তুরার একদম সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল
-চলো না আজকে আমাদের সাথে, খুব ফূ’র্তি করবো

গা গুলিয়ে আসলো তুরার এহেন জঘন্য বাক্য শ্রবণ হতেই, ঘাড়ের পেছনে ঠান্ডা হয়ে আসলো অপ্রতিভ বিপদের আভাসে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোনো মানুষ খোঁজার চেষ্টা করলেও কারো টিকি টিও চক্ষুগোচর হলো নাহ
-এদিক ওদিকে কি খোঁজো ডার্লিং, এখানে আমরা ছাড়া তোমাকে আদর সোহাগ করার কেও নাই
পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার কথা শুনতেই তুরার মাথা ঘুরে উঠলো, শরীর ঘামছে,গা গুলাচ্ছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা পা একেবারে বিবশ হয়ে গেছে। এক চুল নড়ার শক্তিও যেনো হারিয়ে গেছে। তবুও মনোবল হারালো না তুরা, ফোস করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়েই ছুট লাগালো , পায়ের উপর সর্বোচ্চ শক্তি চাপিয়ে উল্টো পথে দৌড় শুরু করলো
-ভাই মেয়ে তো পালাচ্ছে,

-পালিয়ে যাবে কোথায়, সেদিন বাসের ভিতরে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে, আজ কিছুতেই ছাড়বো নাহ। ধর ওকে
বলে ওরা দুজন ও ছুটা শুরু করলো তুরার পেছনে। তুরা কাধের ব্যাগটা খামচে ধরে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, মাথায় শুধু এটুকুই আছে যে এখান থেকে দৌড়ে পালাতে পারলে সে বাঁচবে, নিজের সম্মান বাঁচবে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে গেলো তুরা, হাটুতে ভর করে চারপাশে তাকালো। তখনই পেছন থেকে ওদের আসার শব্দ হতেই কোনো কিছু ঠাওর করতে পারার আগেই আবারও ছুটা শুরু করলো

বারান্দায় বিরতিহীন পায়চারি করছে আর বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে আহান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়েছে, অথচ এখনো তুরার ফেরার নাম নেই, বলে তো ছিলো বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে তাহলে এখনো আসলো না কেনো। চিন্তায় উৎকণ্ঠায় আহানের নাভিশ্বাস উঠার জো। এক দন্ড স্থির বসতে পারছে নাহ,কোথায় আছে,কি করছে, এত দেরি কেনো হচ্ছে, কোনো বিপদ হলো না তো?

বিপদের নামটা মাথায় আসতেই সকল চিন্তা গুলো ধড়ফড়িয়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো।কোনো বিপদ হলো না তো রাস্তায়?
আর দুদন্ড দাঁড়ালো না আহান,গাড়ির চাবিটা নিয়েই বেরিয়ে পরলো। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে থামলো সিটি হসপিটালের সামনে। ভাগ্যবশত আহান গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকার পথেই দেখা হলো সাদমানের সাথে। হাত ভর্তি ওষুধের প্যাকেট নিয়ে ঢুকছিলো। আহানকে দেখেই হতভম্বিত হয়ে গেলো সাদমান। আহান স্যার? এখানে?
সাদমানকে দেখে আহান এগিয়ে গেলো ওর কাছে,কোনো প্রকার জড়তা ছাড়াই সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো

-তুরা কোথায় সাদমান, ও কি এখনো এখানেই আছে?
প্রসারিত ললাটে অসংখ্য ভাঁজ পরলো সাদমানের,৷ চমকিত হয়ে বলল
-তুরা তো দুই ঘন্টার ও আগে বেরিয়ে গেছে স্যার, কেনো বাড়ি ফেরেনি ও?
তড়িৎ গতিতে সারা বদনে ঠান্ডা জোয়ার বইয়ে গেলো আহানের, দুশ্চিন্তার পাল্লা ক্রমান্বয়ে ভারি হচ্ছে, অস্থিরচিত্তে ঘনঘন শব্দে বলল

-তুরা এখনো ফেরেনি সাদমান। ও কোথায়? তুরা কোথায়?
সাদমান আহানের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে ফোন বের করে কারো নম্বরে ডায়েল করে কানে ধরলো। তিনবার বাজার পর চতুর্থ বারে কলটা রিসিভড হতেই সাদমান সোজাসাপটা প্রশ্ন ছুড়লো
-তুরা কি তোর সাথে আছে ফারিহা?
ওপাশ থেকে কি উত্তর আসলো আহানের কান অব্দি সেটা পৌঁছায়নি তবে সাদমানের নিশ্চুপ অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে বলল
-কি বলল ফারিহা? তুরা কি ওর সাথেই আছে?

-ফারিহার সাথে নেই ও।তুরা নাকি আরও এক ঘন্টা আগে বাসার দিকে গেছিলো
সাদমানের কথায় আহানের সারা শরীর উত্তপ্ত রক্তের স্রোত বয়ে গেলো, আরও এক ঘন্টা আগে বাড়ির দিকে গেলে ফিরলো না কেনো ও, কোথায় গেছে তুরা! ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো, ফোস করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড়ালো

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৯

-কিছুই হয়নি, ও ঠিক আছে, আমি খুঁজে বের করব,এক্ষুনি খুঁজে বের করব আমি
বলেই দৌড়ে গাড়ির সামনে গিয়ে উঠে বসলো,স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঝড়ের চেয়ে তীব্র বেগে ছুটিয়ে নিলো গাড়িটা,ধুলো উড়িয়ে দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো মুহুর্তেই

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৪১