তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৬০

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৬০
Lutful Mehijabin (লেখা)

জারাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। নিরব অনুভূতিহীন মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। জারা বুকে মাথা রেখে, কোথায় যেন তার দৃষ্টি পলক হারিয়েছে! স্তব্ধ, প্রাণহীন, নির্বাক মেয়েটার চোখ যুগল হতে বিসর্জিত হচ্ছে বাধাহীন অশ্রু! চিৎকার করে কাঁদতে ব্যর্থ মেহের। তার বাকযন্ত্র হতে টু শব্দ ও নির্গত হচ্ছে না। বাক্যহীন হয়ে পড়েছে সে। আজ সৃষ্টিকর্তার মহান কৃপায় বিশাল বিপদ হতে বেঁচে ফিরেছে মেহের। রাফু বিষাক্ত ছোঁয়া গভীর হওয়ার পূর্বে অনাকাঙ্খিত ভাবে আগমন ঘটেছে ইয়াদের। মেইন ডোর ভেঙে সমুদ্রের কক্ষে প্রবেশ করেছে সে। আকস্মিক ইয়াদ উপস্থিত মেহেরের নিকট অপ্রত্যাশিত! রাফুর নিকট ও অধিক বিষ্ময়কর ইয়াদের আগমন। অবশ্য মেহেরের কক্ষ প্রবেশ করার পর্বে রাফু ইচ্ছে কৃত ভাবে ইয়াদ কে বার্তা পাঠিয়েছে। যেখানে স্পষ্ট লিখা ছিলো, মেহেরের সঙ্গে কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু রাফু ধারনা ও করতে পারি নি, সে যেই মুহূর্তে ইয়াদ কে মেসেজ পাঠিয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই ইয়াদ সমুদ্রের ফ্লাটের নিকট গাড়ি পার্কিং করছিল। যার ফলে ফ্লাটে প্রবেশ করেই ইয়াদ দ্রুত সমুদ্রের কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলে।

বোনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রয়েছে জারা। ইয়াদের হঠাৎ অনুপস্থিতে ভীষণ পুলকিত তার অন্তরাল! ইয়াদের পায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা সবাই দ্রুত সমুদ্রের কক্ষে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ইসরাত বেগম এবং আলেয়া আসে নি তারা হয়তো চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ও শুনে নি। নিজের উপর শত ধিক্কার জানাচ্ছে জারা। আজ দায়িত্বজ্ঞানহীন বোনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে সে। তার তো উচিত ছিলো মেহেরকে আগলে রাখা। রাফুর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস তাকে বিষিয়ে তুলেছে! বিশ্বাস ভালো কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস মোটাও সুখ ময় নয়। বাক্য ছোট হলেও অত্যন্ত প্রগাঢ় যা আজ হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে জারা। তার চোখ যুগল বেয়ে আপনি আপনি জল গড়িয়ে পড়েছে। ভয়ে চুপসে যাবা বোনটার পরিস্থিতি তার হৃদয়ে আঘাত করছে বারংবার! বিষ্ময় নয়নে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রয়েছে ইয়াদ এবং রাফুর উপর। ইয়াদকে বাঁধা দেওয়া মতো সাহস তার হৃদয়ে জুটেছে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শুভ্র, স্বচ্ছ ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট! অতিরিক্ত ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠছে ইয়াদ। তার অন্তরালে অবস্থিত এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতা জেগে উঠেছে। তার মস্তিষ্কের কার্যকর ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। মুখের হতে বারংবার নির্গত হচ্ছে লাগামহীন নিকৃষ্ট বাক্য! হিংস্র প্রাণীর ন্যায় রাফুকে আঘাত করে চলছে অনবরত! ইতোমধ্যে রাফুর ললাট হতে রক্তের বন্য বইছে। তাও ইয়াদের হৃদয় কোমল হতে নারাজ!
— কুত্তা, তোকে আমার ভাই বলতে ঘৃণা করছে। ওই তোর শত্রুতা তো আমার সঙ্গে ছিল! ছোট বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে নিকৃষ্ট আচরণ করতে লজ্জা করলো না তোর?
ইয়াদের বাক্যগুলোর প্রেক্ষিতে রাফুর ঠোঁটের কোণে এক তাচ্ছিল্যের ফুটে উঠেছে। তার মুখশ্রীতে ব্যথাতুর ভাবটা দারুণ ভাবে স্পষ্ট! কিন্তু তবুও ক্ষান্ত হওয়ায় ছেলে নয় সে। সে ইয়াদের সঙ্গে অযৌক্তিক তর্কে ব্যস্ত! বিয়াদপের ন্যায় চিৎকার করে বলছে,

— তোর মুখে এমন কথা মানাই না ইয়াদ। মনে আছে, সেদিন আমি তোকে বারবার বলেছিলাম আমাকে আ্যরেস্ট করিস না। তুই সেদিন শুনিস নি। আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস।
ইয়াদের কথা প্রত্যুত্তরে অট্টহাসিটে ফেটে পড়ল রাফু। অতঃপর হাসির সহিত বলল,
— তুই জানিস আমি সফল! তোকে চার বছর যন্ত্রণা দিয়ে আমি কতোটা প্রশান্তিতে ছিলাম তুই বিশ্বাস করবি না। আমার তো এখন ভাবলেই হাসি পাই, জারা বেচারি জানেই না তুই ই বর্ষণ। আহ!
তৎক্ষণাৎ রাফুর উপর ফির হামলা চালালো ইয়াদ। যার ফলে রাফুও ইয়াদের উপর উল্টে আক্রমণ চালালো। কিন্তু সফল হলো না। ইতি, সারা, আলেকা রাফুকে বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে আলেকা বেগম মেহের কে উপেক্ষা করে নানান বাক্য শুনাচ্ছেন তিনি।

মেইন ডোর উন্মুক্ত লক্ষ্য করে সমুদ্রের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। নিজ কক্ষ হতে শোরগোলের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের হৃদয়ে অজানা আশঙ্কার আবিষ্কার হলো। দ্রুত পদে নিজ কক্ষে উপস্থিত হলো সে। আকস্মিক দুই ভাইয়ের লড়াই দৃশ্যমান হতেই সমুদ্র বিষ্ময়িত হয়ে উঠলো। রাফু এবং ইয়াদের সংঘর্ষ লক্ষ্য করে সমুদ্র দ্রুত পদে এগিয়ে গেল তাদের নিকটবর্তী। রাফুর দুর্বল পরিস্থিতি লক্ষ্যে করে, ইয়াদের টেনে ধরলো সে। অতঃপর উত্তেজিত হয়ে বলল,
— কী হয়েছে ইয়াদ? রাফুকে মারছিস কেন?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধের সহিত রাফু মেসেজ সহ বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলল। মেহেরের দুর্বোধ্য অবস্থার বর্ণনা দিলো সমুদ্র কে।

মেহেরের বিপদ সমন্ধে সমুদ্রের কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই তার দৃষ্টি নিবন্ধ হলো মেহেরের উপর। মেহেরের পরিস্থিতি লক্ষ্যে করেই সমুদ্রের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সমুদ্র এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করলো না। বা হাতের মুষ্ঠি দ্বারা আঘাত করলো রাফুর মুখ বারবার! লহমায় রাফুর দেহ লুটিয়ে পড়ল ফ্লোরে। মুহূর্তেই বিধংস্বী, হিংস্র হয়ে উঠলো সমুদ্র। ক্রোধে তার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠছে। পরপর লাথি লাগলো রাফুর পেট এবং বুকে। এলোপাথিড় আঘাত করেও ক্ষান্ত হলো না সমুদ্র! একপর্যায়ে অতিরিক্ত আঘাতের ফলে রাফুর গোঙ্গানির শব্দ প্রতিধ্বনি তুললো কক্ষ জুড়ে।

সমুদ্রকে থামানোর উদ্দেশ্যে আলেকা বেগম সমুদ্রের পা যুগল আঁকড়ে ধরে ক্রন্দনে মত্ত হলেন। সমুদ্র থামলো না বরং ফুফুকে সরিয়ে পুনরায় আঘাত করতে লাগল রাফুকে। পরিস্থিতি বেগতিক লক্ষ্য করে ইয়াদ দ্রুত সমুদ্রকে থামানোর উদ্দেশ্যে বলল,
— ভাইয়া আর মেরানা ওকে। তুমি বরং ভাবির কে সামলাও। দেখো ভাবির এখন তোমাকে প্রয়োজন।
লহমায় তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করে, শান্ত হলো সমুদ্র। রাফু কে ছেড়ে দিয়ে মেহেরের দিকে গভীর দৃষ্টি প্ররখ করলো। মুহূর্তেই মেহেরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সমুদ্রের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ দ্রুত পদে অপসারণ করলো মেহেরের নিকটবর্তী।

জারার নিকট হতে নিমিষেই মেহেরকে আলতো করে টান দিলো সমুদ্র। আকস্মিক টান সামলাতে ব্যর্থ হলো মেহের। যার দারুণ তার মাথা স্থান পেল সমুদ্রের বুকে! তৎক্ষণাৎ সমুদ্র এক হাত দ্বারা মেহের কে আবদ্ধ করে নিলো এবং অন্য হাতের সাহায্যে মেহেরের গাল সিক্ত করা অশ্রু কণা মুছতে লাগল। মেহেরের অবিন্যস্ত অবস্থা, ঝড় তুলল সমুদ্র হৃদয়ে। সমুদ্রের বার কয়েক শুকনো ঢোক গিললো। অতঃপর নিম্ন কন্ঠে বলল,
— কি হয়েছে মেহু? ভয় পেয়েছ বুঝি? এইতো দেখো আমি এসে পড়েছি।
সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে পূর্বের ন্যায় নির্বাক রইলো মেহের। সমুদ্র ফির বলে উঠলো,
— এই যে পুচকি কথা বলছো না কেন? কথা বলো আমার সঙ্গে! তুমি কেন বুঝো না, তোমার নিরবতা আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে। একটু কথা বলবে প্লিজ?

সমুদ্রের শেষোক্ত বাক্যের প্রেক্ষিতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো মেহের। সমুদ্রের অচঞ্চল আঁখিতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। অবশেষে মেহের ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে উঠলো,
— আমি যে অপবিত্র হয়ে গিয়েছে। আমি কী জবাব দেব সৃষ্টিকর্তা নিকট!
সমুদ্র মুহূর্তেও মেহেরের মাথা চেপ ধরলো নিজ বক্ষ পিন্জরের সঙ্গে। সমুদ্রের ভরসার পরশ পেয়ে ক্রন্দনে ভেঙে মেহেরে। আলতো করে মেহেরের মাথা হাত রাখল সমুদ্র। অতঃপর কোমল এবং নিম্ন কন্ঠে বলল,
— তুমি এতটুকুতে ভেঙে পড়লে পুচকি! তুমি কী জান, আমাদের দেশের নারীরা রাস্তা ঘাটে চলাচল করে প্রায়ই এর চেয়ে দ্বিগুণ হয়রানির স্বীকার হয়। নিজকে প্রোটেক্ট করতে শিখো। এভাবে কাঁদে না মেহু!
মেহের মনযোগ সহকারে সমুদ্রের কথাগুলো শুনতে লাগল। সমুদ্রের পূর্বের ন্যায় ফির বলে উঠলো,

— তোমার উচিত সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করা। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আর তুমি সামান্য ছোঁয়াতে ভেঙে পড়েছো?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে মেহের ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল,
— ওই লোকটা আমার দিকে কূদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আপনি জানেন লোকটা আমার হাত ছুঁয়েছে। আমার নিকটবর্তী এসেছে।
মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে সমুদ্রের ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
— শুধু মাত্র হাত ছুঁয়েছে বুঝি?
— হুম।

মেহেরের হ্যাঁ বোধক উত্তর পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। তার বুকের উপর থেকে পাহাড়ের ভর স্বল্প হয়ে এসেছে! স্বল্প ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও মেহেরের হৃদয়ের আতঙ্ক জেঁকে বসছে। হয়তো রাফুর অস্বাভাবিক কথা বার্তা, অদ্ভুত আচরণ তাকে দ্বিগুণ ভীত করে তুলছে। যার ফলে বিপদ স্বল্প কিন্তু ভয়ের উদ্ভাবন সীমাহীন!
— এভাবে ভেঙে পড়তে নেই পুচকি! আমি আছি তো। শুধু এতটুকু মনে রেখো, তুমি কখনোই আমার কাছে অপবিত্র হবে না। আমি সব ঠিক করে দেব। ট্যাস্ট মি।
সমুদ্রের কথাগুলো শুনে প্রশান্তির আবির্ভাব ঘটল মেহেরের অন্তরালে! ইতোমধ্যে তার ক্রন্দনের বেগ খানিক হ্রাস পেয়েছে। আবেশে সমুদ্রের বুকে চোখ বুঁজে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো মেহের। ক্লান্ত দেহে নিদ্রা এসে হানা দিয়েছে তার চোখ যুগলে। পরম শান্তির স্থানে ঠাই পেয়েছে মেহের। এই ধরণীর বুকে সবচেয়ে প্রশান্তিময় নিরাপদ স্থান। যেখানে একমাত্র স্বর্গ সুখ অনুভব করা সম্ভব!

রাফু কে হসপিটালে রেখে এসেছে ইয়াদ। বর্তমানে পুলিশের আয়ত্তে রয়েছে রাফু। অজানা এক রহস্যের উন্মোচন ঘটেছে আজ। সবাই জানতে পেরেছে রাফু মানসিক রোগী। দীর্ঘ পাঁচ বছর ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ নিজের মধ্যে পুষে বেড়াচ্ছিল রাফু। ব্যপারটা জ্ঞাত হতেই ইয়াদ আত্মগ্লানিতে ফেটে পড়ছে। তার তো উচিত ছিল রাফুর সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া। পক্ষান্তরে ইতি, সারা নিজের ভাইয়ের কর্মে ক্ষমা চেয়ে সমুদ্রের বাসা থেকে বিদায় নিয়েছে। আলেকা বেগম ছেলের অপকর্ম শুনে লজ্জায় এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করেন নি। অবশ্য মা মায়ই হন। এতো কিছু পরেও হসপিটালে ছেলের সান্নিধ্যে পরে রয়েছেন তিনি। নিজ শিক্ষায় ক্রটি তাকে ব্যাপক যন্ত্রণায় ফেলেছে। ব্যর্থ আলেকা বেগম। একজন মা হিসেবে ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়তে ব্যর্থ তিনি।

সমুদ্রের আর একটি বারের জন্যে রুম থেকে বের হয় নি। মেহের কে এক মুহূর্তেও জন্য একা ছাড়ে নিজের থেকে। জারা এবং ইসরাত বেগম এসে মেহেরকে শান্তনা দিয়েছেন। জারা নানান উপদেশ দিয়েছে মেহেরকে। এতটুকু সমস্যা ভেঙে পড়া মোটেও উচিত নয় তা ইসরাত বেগম ও মেহের কে বোঝাতে প্রচেষ্টা করেছেন। এই পৃথিবীতে বাঁচাতে হলে নিজেকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে শক্তিশালী পরিনত করতে হবে বিষয়টা পরিষ্কার মেহেররের নিকট!

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বারো। প্রগাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন শহরের প্রায়ই সকলে! অথচ নির্ঘুম জাগ্রত রয়েছে জারা এবং ইয়াদ। বর্তমানে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে জারা। তার ক্রন্দন যেন বিলুপ্ত হবার নয়! ইয়াদ যে তার বর্ষণ বিষয়টা তখন খেয়াল করেনি জারা। কিন্তু পরবর্তীতে পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাক্যটা বারংবার তার কর্ণপাত হচ্ছে। জারা বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যিই ইয়াদই তার বর্ষণ! পৃথিবীতে এর চেয়ে বৃহৎ পুরষ্কার বোধহয় কোনদিন ও পাইনি জারা। তার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইছে। খানিক পূর্বে ইয়াদ অতীত এবং বর্তমান ঘটিত সম্পূর্ণ বিষয় খুলে বলছে জারাকে। যার দরুন তার ক্রন্দন থামতেই নারাজ!

পক্ষান্তরে ইয়াদের চোখ যুগল সজল হয়ে উঠছে। দুর্বোধ্য রহস্যে বারংবার তার গাল যুগল সিক্ত করে তুলছে। ছেলেরা নাকি সহজে কাঁদে না কিন্তু তবুও ইয়াদ অযথাই কাঁদছে। এ যেন দু কাপোত কাপতীর আনন্দের বর্ষণ ঘটছে! নিরবতার মধ্যেই জারার গুমোট ক্রন্দন প্রতিধ্বনি তুলছে বারংবার।
ইয়াদ আধ ঘণ্টা যাবত প্রেয়সীর মুখ পানে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেছে। নয়ন তৃষ্ণা পূরণ করতে ব্যস্ত সে। এতোদিন অপেক্ষার প্রহরের অবশেষে সমাপ্তি ঘটেছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ফেলল ইয়াদ। নিম্ন এবং ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো,

— জেবু, এভাবে কাঁদে না। তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো।
ইয়াদের কথা ভিত্তিতে জারার ক্রন্দনের বেগ বৃদ্ধি পেলো দ্বিগুণ হারে। একরাশ অভিমান, অভিযোগে উদ্ভাবন ঘটেছে তার হৃদয়মনে! মুহূর্তে ইয়াদ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো জারার পায়ের নিকটবর্তী। অতঃপর চোখ যুগল বন্ধ করে ক্রন্দন মাখা কন্ঠ বলে উঠলো,

— হ্যাঁ মানছি, আমি মিথ্যাবাদী। আমি অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে। তুমি যে শর্ত দিয়েছিলে তা আমি ভঙ্গ করেছি। শর্ত দেওয়ার পূর্বেই তা ভঙ্গ করেছি। তুমি জান এক রমণী তার মায়াজাল আমাকে উন্মাদ করে তুলেছে! দীর্ঘ তিন বছর পূর্বে এক ব্যস্ত শহরের মধ্যে কলেজ ড্রেস পরিহিত এক রমণীর হঠাৎ আগমন ঘটে আমার দৃষ্টির সম্মুখে। প্রথম দর্শনে মেয়েটা জায়গা করে নেয় আমার অন্তরালে! প্রথম দেখাতেই দৃশ্যমান হতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম আমি আমার জেবুতে। প্রথম সম্মেলনই যে আমাকে উন্মাদ করে তুলবে তা ভাবতেই পারি নি। সেদিন থেকে তার খোঁজ নিতে আরম্ভ করি।আমার ভাগ্য ভালো ছিলো। দীর্ঘ তিন মাস পর একদিন রাফুর মাধ্যমে তার সন্ধান পাই। জানতে পারি রাফুর সঙ্গে তার বেশ ভাব। রাফু কে নিজের ভাইয়ের স্থান দিয়েছে মেয়েটি। রাফু আমাকে তার সন্ধান দিয়ে বাঁচিয়ে তুলে। তুমি জান তাকে যে কয়েক দিন আমি তন্যতন্য করে খুঁজেছি সে কয় দিন প্রতিটি রাত নির্ঘুমে অতিবাহিত করেছি। রাফু আমার পরিস্থিতি লক্ষ্যে করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দেই। এরপর আমি তার সঙ্গে মিথ্যা ছলনায় মেতে উঠি। আমি তাকে বলেনি যে আমি তার পূর্বেই তাকে দেখেছি। তার রূপে মুগ্ধ হয়েছি। বিশ্বাস করো আমি ভয় পেতাম যদি তোমাকে বলি যে আমি তোমাকে শর্তের পূর্বেই দেখেছি তাহলে যদি তুমি সম্পর্ক ভেঙে দেও। এই ভয়ে সত্য লুকিয়েছি তোমার থেকে।

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ইয়াদ। ফির জারাকে কিছু বলার মতো ভাগ্য হলো তার। জারা সবটা শুনেও নিজেকে শক্ত রাখল। তাকে এখন ভেঙে পড়লে একদমই চলবে না। মিথ্যাবাদীর শাস্তি পাওয়া উচিত। ইয়াদ তো তার সঙ্গে ছলনা করেছে! তৎক্ষণাৎ বেলকনিতে হতে প্রস্থান করা সর্বো উত্তম মনে করলো সে। ইয়াদ তখনও হাঁটু ভেঙে বসে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ইয়াদ। কিন্তু আফসোস জারার চক্ষু সেই অশ্রু কণা লক্ষ্যে করতে ব্যর্থ। নিজেকে পালাণভার রূপে রুপান্তরিত করলো জারা। অতঃপর দ্রুত অপসারণের করলো বেলকনি হতে। যাওয়ার পূর্বে ইয়াদ কে উদ্দেশ্যে করে বলল,
— আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কিছুই নেই। আপনি বরং সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমা চান। শুধু আমার একটু সময়ের প্রায়। বর্ষণ এবং আপনি যে একই ব্যক্তি বিষয়টা যে আমার মস্তিষ্কে মানতে নারাজ!

রাফুকে হসপিটাল হতে কারাগারে বন্ধি করা হয়েছে সপ্তাহ খানিক পূর্বে। এ কয়েক দিন মেহেকে যতটুকু সম্ভব সময় দিয়েছে বাড়ির প্রত্যেক ব্যক্তি। সমুদ্র একটি বারের জন্যে ও মেহের কে দৃষ্টির অগোচর করে নি। এর মধ্যে শোয়াইব খান মেহের কে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু সমুদ্র মেহেরের পরিস্থিতির সমন্ধে শোয়াইব খানকে জানায়নি। মেহেরের বাবা মায়ের নিমন্ত্রণ থাকলেও তাদের দেখা মিলে নি আর।
এর মধ্যে জারা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। পূর্বের ন্যায় হাসি খুশি প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠছে। কিন্তু এক সপ্তাহ যাবত ইয়াদের বাসায় নেই। টেনিং হওয়ার সুবাদে তাকে রাজশাহী যেতে হয়েছে। ইয়াদের অনুপস্থিতে বেশ কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার জারা। কয়েক দিন যাবত ইয়াদের দেখার চক্ষু তৃষ্ণান পাগল প্রায় সে। যতবার তার হৃদয়ে ইয়াদের ছবি ভেসে উঠে ঠিক ততো বার প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যায় তার অন্তরালে!

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই পাঁচ। গোধূলি বেলার কিঞ্চিৎ আবির্ভাব ঘটেছে চারপাশে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহের। সমুদ্রের আচার ব্যবহারে মুগ্ধ তার হৃদয় গহীন! লোকটা তাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু কখনোই তা প্রকাশ করে না। সমুদ্রের ভালোবাসা যেন একরাশ রহস্যময়, মেহেরের নিকট! ইদানিং সমুদ্র মেহেরকে পড়ানোর সময় টুকু ভর্ৎসনা সহিত কথা বলে। সাফাত স্যার কে এখন বিদায় দিয়ে দিয়েছে সমুদ্র। বর্তমানে মেহেরের সে নিজ দায়িত্বে পড়ায়। সমুদ্র মেহেরকে এক রহস্যের খোলাসা থেকে বের করে নিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। নব্য সূচনায় পা রেখেছে মেহের। সে যেন নতুন করে কৈশোর কালে পা রেখেছে। পূর্বের ন্যায় হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল, প্রাণবন্ত, চট্পটে বালিকায় রূপ নিয়েছে। সমুদ্রের সামনে চুপচাপ থাকলেও তার অনুপস্থিতিতে বাচ্চাদের ন্যায় নানান আচরণে লিপ্ত হয় মেহের। জারা কে রাঁধতে সাহায্য পর্যন্ত তার কর্ম সীমাবদ্ধ। তার এস এস সি পরীক্ষা সান্নিকটে! তাই পড়াশোনাতে সারাদিন অতিবাহিত করতে হয় তাকে।

অফিসে গিয়েছে সমুদ্র। সেই সুযোগে সাজগুজে লিপ্ত হয়েছে মেহের। আয়নাতে নিজ প্রতিবিম্ব দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে সে। ডোর বন্ধ করে দিয়েছে যেন সমুদ্র আসলে দ্রুত সাজ পরিস্কার করে ফেলতে পারে। কারন নির্ঘাত এই সাজ দেখলে সমুদ্র তাকে লজ্জা দেবে! মেহেরের হাতের চুরির ঝনঝন শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে চার দেয়ালে। মেহের তার হাত যুগল নাড়াচ্ছে বারংবার। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি যেন বেশ শোভা পেয়েছে তার আচরণে! তার অতিশয় দীর্ঘ কেশ গুলো পায়ে সঙ্গে বারি খাচ্ছে বারংবার। উন্মুক্ত কেশে সহিত হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে মেহেরের।

মেহের অন্যমনস্ক হয়ে আয়নাতে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছে, আর নিজ অঙ্গ ভঙ্গি লক্ষ্য করে অট্টহাসিটে ফেটে পড়ছে। মুহূর্তেই দরজা চাপানোর মৃদু শব্দ মেহেরের কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই তার মুখশ্রীতে একরাশ আঁধারের আগমন ঘটেছে। তৎক্ষণাৎ তার হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগ নিয়েছে। একরাশ দ্বিধা, সংকোচের আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে! কে এসেছে বিষয়টি মেহেরের নিকট পরিস্কার। তড়িঘড়ি ওয়াশরুমে যাবার উদ্দেশ্যে পা যুগল চলমান করতেই গম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠস্বর কর্ণপাত হলে মেহেরের পা জোড়া আপনা আপনি স্থির হয়ে উঠলো। লজ্জায় মাথা নিচু করে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কথায় প্রেক্ষিতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ল সে।
— ওয়েট পুচকি!

দীর্ঘ কেশের রহস্যে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে মেহের। সমুদ্র ধীর গতিতে মেহেরের খানিকটা নিকটবর্তী এলো। মেহেরের সম্মুখে উপস্থিত হতেই, তার ভ্রূ যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো! মেহের শাড়ি পড়েছে! শাড়ি পড়ছে বললে ভুল হবে সে ওড়ানা দ্বারা নিজেকে পেঁচিয়ে রেখেছে। সমুদ্র বিষ্ময়ের সহিত মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল! আকস্মিক বিষ্ময়ের দরুন গম্ভীর কন্ঠে নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
— হয়াট ননসেন্স!
সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে ওড়ানার আঁচল দিয়ে মাথা আবৃত করা প্রয়াসে মত্ত হলো মেহের।
সমুদ্র অবাকের সহিত ফির বলে উঠলো,
— কি পড়েছে এটা?
মেহের সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে আনমনে বলে উঠলো,
— শাড়ি।
— What! Are you serious?

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৫৯

মেহের বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় ইতোমধ্যে তার গাল যুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠেছে। অযথাই কাঁপছে সে। সমুদ্রের পুনরায় বিরক্তির সহিত বলল,
— তোমার কী শাড়ির অভাব পড়ছে? আমি কী তোমাকে,,,
বাক্যটার সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে, সমুদ্রের অবাধ্য আঁখি যুগল বেসামাল হয়ে উঠলো। আকস্মিক গভীর নয়নে মেহেরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে!

তুমি নামক অনুভূতি শেষ পর্ব