তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ শেষ পর্ব প্রথম অংশ

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ শেষ পর্ব প্রথম অংশ
জেনিফা চৌধুরী

আজ নীলাভ্র বেলীর হলুদ ছোঁয়া। চারদিক ঝলমল করছে কৃত্রিম লাইটের আলোয়। বক্সে উচ্চস্বরে গান বাজছে। গানের তালে তালে সমানে নেচে যাচ্ছে, মেরিনা, ইশু, রাকিব। নীলাভ্র আর বেলী পাশাপাশি বসে উপভোগ করছে সেসব দৃশ্য। নীলাভ্র আর বেলী দেশে ফিরে এসেছে_আজ ১৫দিন। এখন নীলাভ্র সুস্থ আছে। বেলীপ্রিয়াকে কাছে পাওয়ার তীব্র নে’শাটাকে আর দমিয়ে রাখতে পারছিল না। তাই বড়োসড়ো অনুষ্ঠান না করে, ছোটো খাটো করে সব নিয়ম মেনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীলাভ্রর গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবী। হাতে ঘড়ি, মুখে লেগে আছে হালকা হলুদ। দেখতে ছেলেটাকে মিষ্টি লাগছে খুব! বেলী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। চোখ জোড়া যেন আজ নিঁখুত কারোর সৌন্দর্যে আটকে যাচ্ছে বারংবার। বেলী আনমনে বলে উঠল,

“মাশ-আল্লাহ! নজর না লাগুক কারোর।”
নীলাভ্রর কর্ণপাতে কথাটা যেতেই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভেসে আসল,
“বহুকাল আগে থেকে-ই এক কাল-না’গিনীর নজর লেগে আমি কালো হয়ে গেছি৷ এখন আর অন্য মেয়ে তো দূরের কথা, কোনো ভূত-পেত্নীও আমার দিকে নজর দিবে না।”
নীলাভ্রর কথাটা শুনে ভ্রু যুগল আপনা-আপনি কুঁচকে আসল বেলীর। কাল-নাগি’নী! এই কাল-নাগি’নীটা কে? বেলী একবার নিজের গায়ের রঙ দেখল। কই সে-তো কালো না। তাহলে, কাল-নাগি’নী বলল কেন? একটা শব্দ নিয়ে বেলী আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে, প্রশ্ন করে বসল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি আমাকে কালনা’গিনী কেন বললেন?”
নীলাভ্র অন্যদিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসল। কিন্তু বেলী সেটা লক্ষ্য করল না। পরক্ষণেই হাসি মুখটাকে গম্ভীর করে বলল,
“মাঝে মাঝে যেভাবে সা°পের মতো ফোস করে উঠিস, সেটা দেখে যে কেউ তোকে কালনা°গিনী ভেবে বসবে। আমার আর কী দোষ বল?”
নীলাভ্রর এমন কথায় বেজায় রাগ হলো বেলীর। নাক ফুলিয়ে, চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে, কপাল কুঁচকে ফেলল। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,

“আর একবার উল্টা পাল্টা কথা বললে, দেইখেন কী করি?”
“কি করবি? চুমু দিবি? দিতে পারিস। আই ডোন্ট মাইন্ড।”
বলেই বেলীর দিকে চেয়ে চোখ টিপ মা°রল নীলাভ্র। তা দেখে বেলী সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করল। চারদিকে নজর দিল একবার। কেউ শুনে ফেলল কি-না? নীলাভ্রর মুখ দিয়ে এমন কথা বেলী কখনো আশা করে নাই। এমন বেশরম মার্কা হঠাৎ কিভাবে বলল? বেলীকে চুপ থাকতে দেখে নীলাভ্র আবার বলে উঠল,

“চুপ করে আছিস কেন? লজ্জা পাচ্ছিস? আরে লজ্জা পেয়ে কী লাভ? আমি তো তোরেই। তাই লজ্জা না পেয়ে তাড়াতাড়ি চুমু দিয়ে ফেল। আচ্ছা! কোথায় চুমু দিবি? গালে না-কি ঠোঁটে? না-কি অন্য কোথায়? আ…।”
আর কিছু বলার আগেই বেলী নীলাভ্রর মুখ চে°পে ধরল। বেচারীর কান দিয়ে ধোয়া উঠছে বোধহয়? হঠাৎ করে নীলাভ্রর এহেতুক রুপটা দেখে বিস্ময়ে চোখের পাতা পড়ছে না৷ বেলী এবার ফিসফিস করে বলে উঠল,

“চুপ। একদম চুপ। নির্লজ্জের মতো কী বলে যাচ্ছেন? কেউ শুনলে কি ভাববে?”
নীলাভ্র বেলীর হাতটা মুখের থেকে সরিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
“আমার বউকে আমি যা খুশি তাই বলব, তাতে কার দাদার কি?”
বেলী এবার জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কপালে হাত রেখে বলে উঠল,
“এই ছেলেকে বুঝানো আর কলা গাছকে বুঝানো, একই হলো।”
নীলাভ্র সে কথায় পাত্তা দিল না। পাত্তাহীন ভাবে আগের ন্যায় বলল,

“এখন বল কোথায় চুমু দিবি?”
বেলী এবার দুই কানে হাত রেখে জোরেই বলে উঠল,
“আল্লাহ রে ভাই! চুপ থাকেন একটু। মানুষ শুনলে নির্ঘাত আমাদের নির্লজ্জ বলবে।”
“আমি আগের থেকেই নির্লজ্জ।”

নীলাভ্রর কথা শুনে, বেলী এবার নিজেই চুপ হয়ে গেল। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, রাগে। নীলাভ্র মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে হাসতে লাগল। আর বেলী রাগে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। কিছুক্ষণ রাগান্বিত মুখটা গোমড়া করে রাখল। তারপর নিজে নিজেই হেসে উঠল। প্রশান্তির চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার। সবাই কত খুশি আজ। সবার মুখে হাসি। বহুদিন পর এই বাড়িটায় প্রাণ ফিরে এসেছে। যখন কষ্টের পর সুখ আসে তখন আগের সব দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা, বেদনা সব ভুলিয়ে দেয়। বেলী হঠাৎ করেই নীলাভ্রর বাহু ধরে, কাঁধে মাথা রাখল। শান্ত স্বরে বলে উঠল,

“আজ সবাই কত খুশি, তাইনা?”
নীলাভ্র ও শান্ত স্বরে, আস্তে করে জবাব দিল,
“মানুষের যতটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট উপরওয়ালা কখনো দেয় না। এবার থেকে সবটা ভালো হবে, ইন’শা’আল্লাহ। ”

বেলী উত্তর দিলো না। শুধু চোখ বন্ধ করে রইল। এই একটা মানুষ পাশে থাকলে সব কষ্ট নিমিশেই ভুলে যায় মেয়েটা। এই যে এই একটা বছর এত কষ্ট, এত অপমান, অবহেলা সহ্য করল। তবুও মেয়েটা উপরওয়ালাকে একফোঁটাও অভিযোগ করেনি। “ধৈর্যের ফল নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়।”

রাত ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হতেই, বেলী রুমে আসল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পড়নে লাল রঙের থ্রি-পিস। চুল গুলো দিয়ে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। এখন আর এই লম্বা চুলগুলো মোছার মতো শক্তি নেই গায়ে। অনেক ক্লান্ত লাগছে। কাল আবার ভোরে উঠতে হবে। ঘুমে চোখের পাতা গুলো নিভে আসছে। চুলে একবার তোয়ালে প্যাঁচিয়েও রেখে দিল ড্রেসিং টেবিলের উপর। ইশু আর মেরিনার খবর নেই। কোথায় আছে, কে জানে? বিছানার দিকে পা বাড়াতেই, দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হলো। বেলী দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগল,

“কত রাত হয়ে গেছে৷ আর এখনো তোদের হৈ-হল্লা শেষ হলো না। ঘুম আসবি কখন? পরে আবার কাল সকালে তোদের টেনে উঠাতে হবে। পারিস ও বটে তোরা। এ…।”
এইটুকু বলে দরজাটা খুলেই, বেলী থেমে গেল। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে দেখে থমকে গেল। কপাল কুঁচকে সাথে সাথে বলে ফেলল,

“আপনি! আপনি এখানে!”
নীলাভ্র কিছু বলল না। শুধু বেলীর হাত ধরে বলে উঠল,
“চল।”
“কোথায় যাব?” বেলী অবাক স্বরে প্রশ্ন করতেই, নীলাভ্র বলল,
“প্রশ্ন করবি না।”
“আরে, বলবেন তো কোথায় যাব? তাও আবার এত রাতে!”
“ম°রতে যাব।”

“ধুর কি সব বলছেন? ভালো করে বলুন কোথায় যাব?”
এবার নীলাভ্র বিরক্ত হলো। বেলীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বলল,
“আর একটা প্রশ্ন করবি, তো থা°প্পড় খাবি।”
বলেই বেচারির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল…,
“কিন্ত…?”

নীলাভ্রর রাগী স্বরে জবাব দিল,
“কোনো কিন্তু না। যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে যাবি। নো কুয়েশ্চন। মনে রাখবি, আমি তোর বর, বয়ফ্রেন্ড না যে, ইটিশ পিটিশ করতে নিয়ে যাব।”
এবার বেলী সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা আজকে বড্ড লাগামহীন হয়ে গেছে। আজ সব প্রশ্নের উল্টাপাল্টা উত্তর দেওয়াটাই তার কাজ।

নীলাভ্রদের বাড়ির পেছনের সাইডে একটা গোলাপ ফুলের বাগান আছে। বেলীর খুব পছন্দের এই জায়গাটা। কিন্তু সচারাচর এখানে কেউ আসার নাম নিলেও, নীলাভ্র রেগে আগুন হয়ে যায়। আজ নীলাভ্র নিজ ইচ্ছায় বেলীকে সেখানে নিয়ে এসেছে। বেলীকে বাগানের সামনে এনে ছাড়তেই, বেলী চোখ বিস্ময়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গোলাপ বাগানের চারপাশটা বিভিন্ন লাল, নীল, হলুদ, সবুজ লাইটের আলোয় ঝিকমিক করছে৷ নীলাভ্র বেলীর হাতটা আলতো করে ধরল। বেলী অবাক চাহনীতে দিতেই, বলল,

“চল।”
বলেই হাঁটা শুরু করল। সরু আইল দিয়ে বাগানের মাঝ খানটায় এসে দাঁড়াল। আজকে বেলীর সারপ্রাইজ পাওয়ার দিন নাকি? এখানটায় তো গাছে ভরপুর ছিল। আজ ফাঁকা কেন? শুধু ফাঁকা না, ফাঁকা জায়গায়টা গোলাপ ফুল দিয়েই, লাভ বানানো। লাভের চারপাশটায় ছোট ছোট প্রদীপের শিখা জ্বলজ্বল করছে। মাঝে সুন্দর করে লেখা,
“উইল ইউ ম্যারি মি, বেলীপ্রিয়া?”

মাটিও ফাঁকা নেই। সম্পূর্ণ মাটিতে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। পাশে একটা টেবিল আর দুইটা চেয়ার রাখা। সেগুলো সুন্দর করে লাল বেলুন দিয়ে সাজানো। টেবিলের উপর ছোটো বড়ো কয়েকটা মোমবাতি। বেলী বিস্মিত নয়নে চারদিকটা একবার ঘুরে দেখল। চারপাশে লাল গোলাপ ফুটে আছে। আর মাঝে দুজন প্রেমিক যুগল দাঁড়ান৷ দৃশ্যটা এত সুন্দর যে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। এই দৃশ্যের বর্ণনা নিজ চোখে না দেখা অব্দি কেউ করতে পারবে না। বেলী যখন অবাক নয়নে সবটা দেখতে ব্যস্ত তখনি, শুনতে পেলো,

“বেলীপ্রিয়া, তোমার বাকি জীবনের পথচলার সঙ্গি হতে চাই। তোমার মন খারাপে জোকার হয়ে হাসাতে চাই। তোমার সুখের দিনে সঙ্গি না করো, অন্তত দুঃখের দিনে তোমার পাশে একটু ঠাঁই দিও। আমি তোমাকে চাই আমার স্বার্থে। তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমার মানসিক শান্তির জন্য তোমাকে চাই। মেঘলা দুপুরে এক কাপ চায়ের তোমার ঠোঁটের উঞ্চ চুমুক যে, আমার বড্ড প্রয়োজন। তুমি কি আমার নিস্তব্দ রাতের একলা পথের সঙ্গি হবে? তুমি কি হবে আমার রিকশায় একসাথে হাত ধরার সঙ্গি? তুমি কি আমার ধরনীর বুকে বেঁচে থাকার কারণ হবে? হবে কি আমার হৃদ মাঝারের সঙ্গি? হবে কি আমার মানসিক শান্তি? যার নাম হবে #তুমি_নামক_প্রশান্তি।”

বেলীর সামনে এক হাঁটু ভেঙে বসে আছে নীলাভ্র। হাতে গোলাপ ফুলের বড়ো একটা তোড়া। বেলীর চোখে অশ্রুকণা টলমল করছে৷ উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যা’। বহু কষ্টে মুখ ফুটে বলল,
“আমি আপনার সব হতে চাই নীলাভ্র। শুধু আপনার বক্ষস্থলে আমাকে একটু ঠাঁই দিয়েন, আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।”

বলেই নীলাভ্রর হাত থেকে গোলাপটা নিয়েই হাম’লে পড়ল নীলাভ্রর বুকে। নীলাভ্র টাল সামলাতে না পারল না। দুজনেই সুয়ে পড়ল। নীলাভ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ করে আছে, বেলী। আর নীলাভ্র চোখ বন্ধ করে বেলীকে আকঁড়ে ধরে আছে। বহু মাস, বহু বছর, বহু প্রতিক্ষা শেষে আজ দুজন একসাথে। মিনমিনিয়ে নীলাভ্র বলে উঠল

“ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া।”
“আমিও…।”
“আমিও কি?”
“ভালোবাসি!”
“কাকে?”
“আপনাকে।”
“আমাকে কি?”

এবার বেলী বিরক্ত হলো। নীলাভ্রর বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি। শুনতে পেয়েছেন? ভালোবাসি আপনাকে। ”
এবার নীলাভ্র হাসল। জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া, আই লাভ ইউ।”

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ১১+১২

নিস্তব্দ রাতে, খোলা আকাশের নিচে, কোলাহল থেকে দূরে এই উচ্চস্বরটা চারদিকে প্রতিধ্বনি হতে শুরু করল। মুহূর্ত এখানে থমকে যাক। নয়ত এই ছোটো জীবনে এমন প্রশান্তিময় মুহূর্ত বার বার আসুক…

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ শেষ পর্ব শেষ অংশ