তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৪

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৪
জেনিফা চৌধুরী

চোখের সামনে বেস্ট ফ্রেন্ড নামক মানুষটার লা°শ দেখার চাইতে ভ°য়ংকর দৃশ্য আর কিছু হতে পারেনা। রঙিন মানুষটার দেহ সাদা কাফনে প্যাঁচানো দেখতে বি°শ্রি লাগছে। বড্ড বাজে লাগছে! তানিশার লা°শের খাটিয়ার সামনে শক্ত কাঠের মূতির মতো দাঁড়িয়ে আছে বেলী।

চোখ থেকে পানি পড়ছে না। চোখের পানি গুলো শুকিয়ে গেছে। তানিশার চেহারাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মুখটা কালচে হয়ে গেছে। আগের থেকে বেশ শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। হাসি-খুশি মেয়েটা আজ নিস্তব্ধ। বেলী খুব ধীরে বসল তানিশার মাথার পাশে। তানিশার মাথায় হাত রাখার জন্য হাত বাড়াতেই, কেউ বেলীর হাতটা ধরে ফেলল। কঠিন স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মৃ’ত ব্যক্তিকে ছুঁতে হয় না। তুমি জানো না?”
বেলীর মুখটা অসহায়ত্বের ছোঁয়ায় ভরে উঠল। নীলাভ্রর চোখেও পানি টলমল করছে। বেলীর থেকে সে দূরে দাঁড়িয়ে। মেয়েদের ভেতরে ঢুকতে পারছে না। বেলীর এই অবস্থা সহ্য হচ্ছে না ওর। তবুও যেন আজ সবাই নিরুপায়। বেলী খুব করুণ স্বরে মিনতি করে বলল,

“আমাকে একবার একটু ছুঁতে দিবেন, প্লিজ। বিশ্বাস করুন, আমি একটুখানি ছুঁয়ে উঠে যাব। প্লিজ, আপনাদের পায়ে পড়ি। আমাকে আটকাবেন না।”
অনেকবার কাকুতি-মিনতি করার পর। সবাই যখন রাজি হলো। তখন বেলীর মুখে হাসি ফুটল। বেলী হালকা করে তানিশার মাথায় হাত রাখল। শরীরটা বিদ্যুৎ গতিতে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা দুমড়ে এলো। কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। শান্ত স্বরে বলে উঠল,

“এই, এই। দেখ, আমি এসেছি৷ তুই না সেদিন বললি, ‘আমাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে’। তাহলে এখন চোখ বুঝে আছিস কেন? চোখ খোল। প্লিজ, এভাবে ঘুমিয়ে থাকিস না। আমার কষ্ট হচ্ছে রে।”
বেলী আর কিছু বলতে পারল না। শব্দ বের হলো না। তবুও শরীরে শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,

“তুই এভাবে একা একা ঘুমিয়ে থাকতে পারিস না। তুই আমাকে একা ফেলে চলে যেতে পারিস না। তুই তো বলেছিলি, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবিনা। তবুও এখন এভাবে চুপ করে আছিস, কেন? আমি তোকে কোথাও যেতে দিব না। দিব না যেতে।”

বলেই তানিশাকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে সবাই মিলে বেলীকে টেনে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নেমে পড়ল। কিন্তু বেলীকে শক্ত করে তানিশাকে ধরে রেখেছে। তবুও সবার শক্তির সাথে পেরে উঠল না। নীলাভ্র দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না। দৌড়ে এলো এদিকে। সবাইকে সাইড কা°টিয়ে বেলীকে আকঁড়ে ধরল। বেলী একনাগাড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। নীলাভ্র অনেক চেষ্টা করে বেলীকে একটু ভীড় থেকে দূরে সরিয়ে আনলো। বেলীকে বুকে চে°পে ধরে বলতে লাগল,

“প্লিজ, তুই শান্ত হয়ে যা। এমন করিস না। মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। নিয়তি আমাদের মেনে নিতেই হবে। এভাবে পা°গলামি করিস না, বেলীপ্রিয়া। তোকে এই অবস্থায় আমি সহ্য করতে পারছি না।”
বেলী শান্ত হলো না। বলতে লাগল,

“আমি তানিশাকে কোথাও যেতে দিব না। ‘ও’ আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। প্লিজ নীলাভ্র ভাই ‘ওকে’ বলুন উঠে বসতে। এত ঘুমাতে হবে না। অনেক ঘুমিয়ে নিয়েছে। আ…।”
এবার নীলাভ্র বেলীর মুখ চে°পে ধরল। কঠিন স্বরে বলল,

“তুই এক্ষুনি আমার সাথে ঢাকা যাবি। আর থাকতে হবে না তোকে। যদি তুই তানিশাকে শেষবারের মতো দেখতে চাস। তাহলে এক ফোটাও চোখের পানি ফেলতে পারবি না। আর একবার পা°গলামি করলে আমি এক্ষুনি নিয়ে যাব তোকে। সেটা কি তুই চাস?”

বেলী সঙ্গে সঙ্গে দুই দিকে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘না’। অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“আমি কান্না করব না। একটুও কান্না করব না। এইযে চুপ হয়ে গেলাম। আর কথা বলব না। বলব না।”

বলে চুপ হয়ে গেলো। চোখের পানিগুলো মুছে নিলো। চারদিকের কান্নার আওয়াজে নীলাভ্রর বুক ফে°টে যাচ্ছে। তানিশার মায়ের গগন বিদারক কান্না দেখে নীলাভ্র কষ্ট হচ্ছে না। একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং রাগ হচ্ছে। মেয়েটাকে তারা নিজের হাতে মে°রে ফেলেছে। এখন এসেছে লোক দেখানো কান্না দেখাতে। কয়েকজন মহিলা মিলে তানিশার গোসলের ব্যবস্থা করতে লাগল। কয়েকজন মিলে নিয়ে লা°শের খাটিয়ে তুলে নিলো।

নিয়ে গেলো গোসলের জায়গায়। বেলী ছুটে গেলো সেদিকে। কয়েকজন মহিলা মিলে মুহূর্তেই গোসল শুরু করল। আর বেলী দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। বেলীর চোখের সামনে তানিশার শেষ গোসলটা সম্পূর্ণ হলো। গোসল শেষে পাঁচ খন্ড সাদা কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হলো তানিশার শরীর। পুনরায় লা°শের খাটটা এনে রাখা হলো উঠানের মাঝখানে।

বেলী একটা চেয়ারে বসে রইল সেখানে। কাঁদছে না এখন আর। শুধু এক নজরে তানিশার লা°শের দিকে চেয়ে আছে। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। মাগরিবের নামাজের পর জানাযা শেষ হলো। লা°শের খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হলো ক°বরস্থানে। শুরু হলো শেষ কার্য। সেখান থেকে বেশ দূরে নীলাভ্র আর বেলী দাঁড়িয়ে আছে।

বেলীর দৃষ্টি সেখানটায় স্থির। চোখের পলকে তানিশা নামক কোনো ব্যক্তি মাটির সাথে মিশে গেলো। ক°বর দেওয়া শেষ হতেই সবাই যে যার মতো চলে যেতে লাগল। বেলী সেই যে চুপ হলো। এখনো চুপ হয়েই আছে। ফিরে আসার সময় শুধু এক নজরে কিছুক্ষণ তানিশার ক°বরটার দিকে চেয়ে ছিলো। তখন শুধু চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছে।

বেলী বাসায় ফিরেছে অনেকক্ষণ। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে৷ ফোনটা অনেকক্ষণ যাবৎ বেজেই যাচ্ছে। ফোন স্কীনে চোখ যেতেই রাকিবের নামটা ভেসে উঠল। এবার বেলীর ধ্যান ভাঙল। সারাদিনেও রাকিবের খবর নেওয়া হয়নি। ছেলেটা কী অবস্থায়? ঠিক আছে তো? তাড়াতাড়ি করে ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই। ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। বেলী খুব শান্ত স্বরে বলে উঠল,

“রাকিব? তুই ঠিক আছিস?”
উত্তর আসল না৷ বেলীর এবার বড্ড ভয় হলো। চিন্তিত কণ্ঠে আবার বলল,
“রাকিব, কথা বল। ঠিক আছিস তুই?”
এবার রাকিব জোরে শব্দ করে কান্নায় ভে°ঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,

“আমি না নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, বেলী। আমার দম আটকে যাচ্ছে। তানিশাকে তো আমি বহু আফগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ তো সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম। এখন তো আমার বেঁচে থাকার কোনো মূল্যই রইল না।”
বেলী উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না। রাকিবের কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝা যাচ্ছে, ছেলেটা সারাদিন কেঁদেছে। গলা বয়ে গেছে। রাকিব আবারো ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলতে লাগল,

“ওরা আমার থেকে আমার তানিশাকে কেড়ে নিলো কেন? কেন কেড়ে নিলো?”
আবার খানিকটা চুপ থেকে তীব্র ক্ষোভ মিম্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,

“ওরা আমার তানিশাকে মে°রে ফেলেছে। গলা টি°পে হ°ত্যা করেছে। কোনো বাবা-মা এতটা নির্দয় হয় কি করে? তানিশা তো ওদের নিজের মেয়ে ছিলো। বল, বেলী? তবুও কেন ওরা মেয়েটাকে বাঁচতে দিলো না। বল না, বেলী।”

এবার বেলীও ডুঁকরে কেঁদে উঠল। দুই পাশ থেকে দুজন অসহায় মানুষ চোখের পানি ফেলছে। একজন নিজের বোনের মতো বেস্ট ফ্রেন্ডকে হারিয়ে কাঁদছে। আরেকজন নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে কাঁদছে।

হঠাৎ করে ফোনের আওয়াজে বেলীর ধ্যান ভাঙল। হকচকিয়ে উঠল বেলী। চারদিকে নজর দিতেই মনে পড়ল। এতক্ষণ অতীত নামক ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে ডুবে ছিলো ও। চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু মুছে নিয়ে এগিয়ে গেলো ফোনের দিকে।

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৩

ফোনটা হাতে তুলে নিতেই দেখল আননোন নাম্বার। কেন যেন রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। অনিচ্ছা স্বত্তেও কী মনে করে যেন রিসিভ করল। ফোনটা কানে ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই। ওপাশ থেকে বহু পরিচিত সেই কণ্ঠস্বরে কেউ বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া”

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৫