তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৭

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৭
জেনিফা চৌধুরী

এক বছর পর ভালোবাসার মানুষটাকে হসপিটালের বেডে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পাবে। বেলী কল্পনাও করতে পারেনি। চোখ থেকে নোনা জল গুলো অবাধ্য হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চারদিকটা ঘুরছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীলাভ্রর চেহারাপানে তাকাতেই বেলীর যেন শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। এ কী এক নির্মম দৃশ্য! সহ্য করার মতো না। কেন এমন হলো? কী দোষ ছিলো ছেলেটার? নার্সটা বেলীকে মূতির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে বসল,

“আপনি কি উনাকে চিনেন? মনে হচ্ছে আপনি উনার পরিচিত।”
বেলীর কানে প্রশ্নটা যেতেই বেলী হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠল। বেলীকে এমন করে কাঁদতে দেখে নার্সটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মেয়েটার জন্য মায়া হলো তার। কাঁধে ভরসার হাত রাখল। শান্ত স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কান্না করো না। কান্না করে কিছু ঠিক হবে না। কে হয় ইনি তোমার?”
বেলী কান্নার জন্য কথা বলতে পারল না। তবুও কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো,
“ইনি আমার স্বামী। আমার ভালোবাসা। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। কিন্তু সেই তাকেই আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

বলেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠল। নার্সের দিকে তাকিয়ে কান্নারত স্বরেই জিজ্ঞেস করল,
“আমি একটু উনার পাশে গিয়ে বসি। প্লিজ, না করবেন না। একটু বসেই উঠে আসব। আপনার কাছে হাত জোর করছি। প্লিজ, না করবেন না। প্লিজ।”

বেলী কিছুতেই নিজের কান্না থামাতে পারছে না। মুখটা চোখের পানিতে একাকার অবস্থা। নার্সটা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারল না। নার্সের অবয় বানী পেতেই বেলীর মুখশ্রীতে হাসি ফুটল। হুড়মুড়িয়ে নীলাভ্রর মাথার পাশে গিয়ে বসল। তবে খুবই সাবধানে। নীলাভ্রর মুখের দিকে তাকাতেই কান্নাগুলো যেন ভেতর থেকে আগের চেয়েও দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। বেলী সাথে সাথে দুই হাত দিয়ে মুখটা চে°পে ধরল।

যেন কান্নার শব্দে নীলাভ্রর কোনো সমস্যা না হয়। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিলো। কাঁপা-কাঁপি হাতটা রাখল নীলাভ্রর মাথায়। সাথে সাথে পুরো শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। চোখের থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল নীলাভ্রর কপালে। নীলাভ্রর চোখ একটু হালকা কেঁপে উঠল। বেলী নীলাভ্রর মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,

“কেন এভাবে দূরে সরে আসছিলেন, নীলাভ্র? যদি আমার থেকে দূরে না আসতেন। তাহলে আপনার এই অবস্থা হতো না। কেন এত লুকোচুরি করলেন? কেন নিজেকে এই অবস্থায় এনে ফেললেন? কেন আজ চিকিৎসার অভাবে মৃ°ত্যুর মুখে পড়লেন? এইসব কেনোর উত্তর দিতেই হবে আপনাকে। তার জন্য আগে আপনাকে সুস্থ হতে হবে। আপনি সুস্থ হবেন। আপনাকে যে সুস্থ হতেই হবে আমার জন্য। আপনার মায়ের জন্য। আপনার মা’কে বলতে হবে যে আমি আপনাকে কেড়ে নেইনি।”

আর কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। কান্নাগুলো শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসল। সাথে সাথে আবার চোখের পানি গুলো মুছে নিলো। সেই নরম, মোলায়েম স্বরে আবার বলতে লাগল,
“আপনি কী জানেন? আমি এই এক বছর আপনাকে শহরের অলিতে-গলিতে খুঁজেছি। প্রতিদিন খুঁজেছি। কখনো বা রাতের অন্ধকারে আবার কখনো দিনের আলোতে। সব জায়গায় খুঁজেছি। অথচ একবার ও কোনো হসপিটালে খোঁজ নেইনি। কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল। আপনি সুস্থ আছেন। কিন্তু কে জানতো আমার বিশ্বাস ভুল ছিলো।”

এবার বেলী শব্দ করেই কান্না করে উঠল। জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। নার্সটা থামাচ্ছেনা। কাঁদুক মেয়েটা। কাঁদলে যদি একটু মনটা হালকা হয়। নিজের ভেতরে জমানো অভিমান, অভিযোগ, কষ্ট এই একবছর বয়ে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ ক্লান্ত। বড্ড ক্লান্ত! বেলীর কান্নার শব্দে আশেপাশের কয়েকজন এসে দরজায় ভীড় জমালো। দুইজন নার্স হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকল। অপরিচিত একটা মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,

“কে এই মেয়ে? এভাবে কাঁদছে। আর তুমি এলাউ করছো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছো। কিছু বলছো না কেন?”
নার্সটা সবটা বুঝিয়ে বলতেই সবাই শান্ত হয়ে গেলো। বেলীকে সবাই মিলে শান্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। এর মধ্যেই একজন ডাক্তার রুমে ঢুকল। ধমকের স্বরে বলল,

“এটা হসপিটাল। এখানে একজন ক্রিটিকাল রুগী রয়েছে। আপনারা সবাই মিলে এখানে হট্টগোল শুরু করেছেন কেন? আপনাদের কি মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই।”
বেলী এবার শান্ত হয়ে গেলো। আর নার্সগুলো ভয়ে বেলীর থেকে দূরে সরে দাঁড়াল। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করল। তার আগেই বেলী বলে উঠল,

“উনাদের কোনো দোষ নেই। দয়া করে, উনাদের বকবেন না।”
ডাক্তার এতক্ষণ পর একটা মেয়েকে খেয়াল করল। এই মেয়েটাকে তো কখনো এই ছেলেটার আশেপাশে দেখেনি। তাহলে কে এই মেয়ে? বেলী ডাক্তারের চেহারা দেখে সবটা বুঝতে পারল। মুখটাকে ওড়না দিয়ে ভালোভাবে মুছে নিলো। ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দয়া করে আমাকে যদি একটু সময় দিতেন।”
ডাক্তার অগত্যা বেলীকে কেবিনে ডাকল। বেলী একবার অসহায় চোখে নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের পেছন পেছন ছুটল…

“দেখুন, আপনার স্বামীর কন্ডিশন ভালো না। ইমিডিয়েটলি তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে। এটাই একমাত্র ও শেষ উপায়।”
বেলীর বুকটা কেঁপে উঠল। তবুও মুখে বলে উঠল,
” ডাক্তার, আমি কিডনি দিব। দরকার পড়লে আপনি দুটো কিডনি নিয়ে যান। তবুও আমার নীলাভ্রকে সুস্থ করে দিন। আপনার কাছে হাত জোর করছি।”

বেলী হাত জোর করেই কেঁদে দিলো। ডাক্তার শান্ত, শীতল স্বরেই বলে উঠল,
“দেখুন, কিডনি দিবেন বললেই হয়ে যায়না। ব্লাড গ্রুপ আর কিডনি না মিললে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব না। আপনারা সময় নষ্ট না করে তাকে ইন্ডিয়া বা অন্য কোনো দেশে নিয়ে যান। যতদিন যাবে তার অবস্থা তত খারাপ হবে। কিন্তু হ্যাঁ এটা কিন্তু প্রচুর টাকার ব্যাপার। এবার আপনারা যা ভালো মনে করেন।”

বলেই ডাক্তার চলে গেলো। আর বেলী ‘থ’ হয়ে বসে রইল। নিজেকে পা°গল পা°গল লাগছে। এই অল্প সময়ে কি করবে? কোথায় যাবে? কোথার থেকে কিডনির ব্যবস্থা হবে? কিছু ভেবে পাচ্ছে না। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। এখন অব্দি কাউকে জানানো হয়নি। বেলী ঠান্ডা মাথায় সবার আগে রাকিবকে ফোন করল। সময় নিয়ে সবটা রাকিবকে বুঝিয়ে বলল। রাকিবের উপর দায়িত্ব বাসার সবাইকে বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসার…

কিছু সময় পর বেলী নীলাভ্রর কেবিনের সামনে আসল। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শক্ত করেছে। ধীর পায়ে ঢুকল কেবিনে। নার্সটা বেলীকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“উনার কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরবে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন যেন, বেশি উত্তেজিত হয়ে না পড়ে।”

বেলী প্রতিউত্তরে শুধু মাথা নাড়াল। নার্সটা চলে যেতেই বেলী একটা চেয়ার টেনে বসল নীলাভ্রর পাশে। নীলাভ্রর হাতটা আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। হাতে গভীর ভাবে একটা চুমু খেলো। নিরবে চোখ থেকে অশ্রুফোটা গড়িয়ে পড়ল। বেলী চুপচাপ এক নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীলাভ্রর মুখ পানে। একটা বছর। অনেকটা সময়। অনেক কিছু বদলে গেছে এই এক বছরে। সব থেকে বেশি বদলে গেছে এই হসপিটালে বেডে থাকা মানুষটা।

আগের মতো চঞ্চলতা নেই। মানুষটা তো এত শান্ত না। তবুও কেন আজ এভাবে শান্ত হয়ে আছে। সে কি বুঝছে না। তার বেলীপ্রিয়া তাকে এভাবে সহ্য করতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে যে। সব কিছু বি°ষাক্ত লাগছে। হঠাৎ করেই নীলাভ্রর হাতটা নড়ে উঠল। তা বেলীর চোখে পড়তেই বেলী ধড়ফড়িয়ে উঠল। হার্টবিট বেড়ে গেলো।

উত্তেজনায় হাত কাঁপতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নীলাভ্র চোখ খুলল। বেলী যেন জড় বস্তুর মতো হয়ে গেলো। নড়াচড়ার শক্তি পেলো না। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। নীলাভ্র চোখ, মুখ খিচে তাকাচ্ছে বার বার। হয়ত কষ্ট হচ্ছে। চোখ দুটো টেনে খুলতে গিয়েও পারছে না। আবার কুঁচকে নিচ্ছে। বেলী একটু সাহস নিয়ে মুখ খুলল। করুণ স্বরে ডেকে উঠল,

“নীলাভ্র ভাই”
নীলাভ্র যেন কানে ভুল শুনল। এই কণ্ঠটা ওর চেনা। কিন্তু এই কণ্ঠের মানুষটা এখানে আসবে কোথার থেকে? ভুল শুনছে বোধহয়। নীলাভ্র কিছু একটা বলে উঠল হয়ত! অক্সিজেন মাস্কটা থাকায় বেলী ঠিক শুনতে পেলো না। তবুও নীলাভ্রর একটু কাছে কান নিতেই শুনতে পেলো। নীলাভ্র বলছে,

“তুই এখনো আমার স্বপ্নে কেন আসিস, বেলীপ্রিয়া? তুই তো এখন অন্য কারোর।”
কথাগুলো খুব কষ্টে নীলাভ্র উচ্চারণ করল। বেলী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে উঠল। বলল,
“আমি আপনার স্বপ্নে আসিনি, নীলাভ্র ভাই। দেখুন আমি সত্যি এসেছি। একবার তাকান। দেখুন, আপনার বেলীপ্রিয়া এসেছে। আপবার বেলীপ্রিয়া অন্য কারোর হয়ে যায়নি। আপনারেই আছে। আর আপনারেই থাকবে। প্লিজ, একবার দেখুন না।”

নীলাভ্রর সব অসুস্থতা হঠাৎ এই গায়েব হয়ে গেলো।বিস্ময়ে যেন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ পাশ ফিরে তাকাতেই বেলীকে দেখে চমকে উঠল। চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। চোখে অশ্র টলমল করে উঠল। হাতটা বেগতিক হারে কাঁপতে লাগল। তা দেখে বেলী আরো জোরে নীলাভ্রর হাতটা আকঁড়ে ধরল। দুজন দুজনের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ এক বছর পর দুজন মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফিরে পেয়েছে। এত জটিলতা শেষে এই দুটো প্রাণ কি এক হতে পারবে? না-কি হেরে যাবে নিয়তির কাছে?

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৬

[এই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা এই রোগের চিকিৎসা বিষয়ে আমার ধারণা নেই। দয়া করে ভুল হলে ক্ষমা করবেন। পারলে একটু দেখিয়ে দিবেন]

তুমি নামক প্রশান্তি সিজন ২ পর্ব ৮