তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব ৪২

তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব ৪২
ইরিন নাজ

দেখতে দেখতে আবরার আরশির বিয়ের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আবরারের সাথে বেশ ভালো আছে আরশি। আবরার তার অনেক যত্ন নেয়। তবে লোক টা এখন পুরো দ*মে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন বাড়ি থাকে না, রাতে ফিরেও টু*ক*টা*ক কাজ করে। এ নিয়ে আরশির অবশ্য কোনো অ*ভি*যো*গ নেই। লোক টা সুযোগ পেলেই তাকে ফোন করে, খোঁজ খবর নেয়। রাতেও ঘন্টা খানেক সময় দেয়। এই বা কম কি! আরশির মতে, কেউ যদি হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আপনার জন্য দুই তিন মিনিট সময় বের করে তাহলে সে অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসে, আপনার কথা চি*ন্তা করে। আপনার কথা সারাক্ষন তার মাথায় থাকে। তাই তো সুযোগ পেলেই আপনার খোঁজ খবর নেয়। আর এমনিতেও আবরারের কাছে তার মূল্য কতটুকু এটা আরশি বেশ জানে।

ছাদে বসে আছে আরশি। আজ তার মন টা ভীষণ খা*রা*প। বাবার কথা বড্ড মনে পড়ছে। আবরার রুমে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে আর তার ও ঘুম আসছে না তাই ছাদে চলে এসেছে সে। দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকালো আরশি। তবে আজ আকাশ অ*ন্ধ*কার। চন্দ্র, তারা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির পূর্বের শীতল হাওয়া এসে শরীরে বা*রি খাচ্ছে। হালকা শীত শীত লাগছে আরশির। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে হয়তো। কিন্তু মোটেও ন*ড়*তে ইচ্ছা হলো না তার। এই পরিবেশটাই ভালো লাগছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চোখ বন্ধ করে বাবার সাথে কা*টা*নো শৈশবের সুন্দর স্মৃতি গুলো মনে করতে লাগলো আরশি। কতো সুন্দরই না ছিলো দিনগুলো! তারপর কতো কিছু হয়ে গেলো তার জীবনে। কেউ গায়ে চাদর মু*ড়ে দেয়ায় চোখ খুললো আরশি। তাকিয়ে দেখলো আবরার তার পাশে কিছু টা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। সেই দূরত্ব ভালো লাগলো না আরশির। মুহূর্তেই আবরারের কাছে চে*পে আসলো সে। দূরত্ব ঘু*চি*য়ে নির্দ্বিধায় আবরারের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বু*জ*লো। হাসলো আবরার। শান্ত কণ্ঠে শুধালো,

— মন খা*রা*প?
আরশি চোখ বু*জে*ই জবাব দিলো,
— হু। আব্বুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে।
এতটুকু বলে থেমে গেলো আরশি। আবরার টু শব্দটাও করলো না। কিছু সময় নীরবতা পালনের পর আরশি পুনরায় বলে উঠলো,

— জানেন অনেক সুখের পরিবার ছিলো আমাদের। সুখ আর সুখ। অর্থ, ভালোবাসা কোনো কিছুর অভাব ছিলো না আমাদের। আব্বু, আম্মু আর আমি। আমাদের তিনজনের সুখী পরিবার। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি, আব্বুর প্রিন্সেস ছিলাম। আমার নামটাও নাকি আব্বু রেখেছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নাকি তার মনে হয়েছিল সে কোনো স্বচ্ছ আরশি তে চোখ রেখেছে।

তাই একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছে আরশি। আব্বু আমাকে কতোটা ভালোবাসতো তা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মা*র তো দূরের কথা, কোনোদিন উচু আওয়াজে কথা বলতো না আমার সাথে। যদি ক*ষ্ট পাই! আম্মু মাঝে মাঝে ব*ক*তো, তখন আব্বুই আমাকে বাঁচাতো। আব্বু আসলে কেঁ*দে কেঁ*দে আম্মুর নামে বি*চা*র দিতাম। তখন আমাকে খুশি করার জন্য মি*ছে মি*ছে আম্মু কে ব*ক*তো আব্বু। কোনো কিছু চাওয়ার আগেই হাজির করতো। কোনো কিছুর কমতি রাখতো না। আমার সকল আবদার পূর্ণ করতো। বাবা মায়ের এতো টা আদরের হওয়ায় অনেকটাই বাঁ*দ*র তৈরি হচ্ছিলাম। সারাদিন খেলাধুলা, দু*স্টু*মি করতাম। পড়াশোনা তেমন একটা করতাম না। তবে রেজাল্ট যে খা*রা*প ছিলো এমন না, মোটামোটি ভালোই ছিলো। এভাবেই স্বপ্নের মতো সুন্দর দিন কা*ট*ছিলো আমাদের।

কথাগুলো বলে ছ*ল*ছ*ল চোখে হাসলো আরশি। আবরার আরশির মুখের পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আজ যেনো আরশি নিজের ভিতরে জমিয়ে রাখা প্রতিটা কথা আবরার কে জানিয়ে দিতে চাচ্ছে। আরশি ফের বলে উঠলো,
— বাবা পেশায় মোটামোটি নামকরা সাংবাদিক ছিলেন। দাদাবাড়ি থেকেও ভালোই সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সেই সম্পত্তি বেঁচে আমাদের বাড়ি টা তৈরি করেছিলেন আর বাকি টা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতেই সুখের দিন কা*ট*ছি*লো আমাদের। তবে বেশি সুখ বুঝি কপালে স*য় না! হঠাৎ এক ঝ*ড় এসে আমাদের সুখের জীবন ল*ন্ড*ভ*ন্ড করে দিয়ে যায়। আমার গর্ভধারিণী মা আমাকে ঘৃ*ণা করতে শুরু করে। অবশ্য আমার দো*ষ ছিলো। আমার কারণেই হয়তো আমার আব্বু আর নেই…

শেষের কথা টা বলতে গলা কাঁ*পে আরশির। আবরার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরশির পানে। কোনো শান্তনা দেয় না। সে চায় আরশির থেকে সব টা শুনতে। কিছুক্ষন বিরতি নেয় আরশি। শান্ত হয়ে বলা শুরু করে,

— সেবার আমি এসএসসি দিয়েছি। রেজাল্ট ও দিলো। গোল্ডেন না পেলেও এ প্লাস পেয়েছিলাম। তাতেই আব্বু সে কি খুশি! আমাকে দাদির দেয়া লকেট উপহার দেয়। আব্বুর ইচ্ছা ছিলো বেস্ট কলেজে পড়াবে আমাকে। কিন্তু কলেজ টা আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে ছিলো। তখন ও আমি বাবা মায়ের হাত ধরে সব জায়গায় যেতাম। তারা আমাকে একা ছাড়তো না।

তাই বহু ভাবনা চি*ন্তা*র পর আমার যাতায়াতের সুবিধার কথা ভেবে নিজের জমানো টাকা ব্যয় করে অল্প দামের মধ্যে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা গাড়ি কেনে আব্বু। এ নিয়ে আম্মুর সে কি রা*গ! শুধু শুধু কেনো এতো টাকা ব্যয় করলো? সাধারণ একটা কলেজে পড়ালেই তো হয় আরও কতো কি… আব্বু শুধু হাসছিলো। শেষে আম্মু কে বলেছিলো,
“তুমি শুধু শুধু রা*গ করছো মিহি। আমি বেঁচে আছি তো। আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের কোনো ক*ষ্ট করতে দেবো না। তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে বলো! আর আমার মামুনি বেস্ট কলেজেই পড়বে। ও যখন ভালো কোনো পসিশন এ যাবে তখন এমন কতো টাকা আসবে!”

সেদিন আব্বুর কথাগুলো শুনে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম এবার থেকে অনেক ভালো করে পড়াশোনা করবো। আমাকে অনেক বড় পসিশন এ যেতে হবে। আব্বু আম্মুর খেয়াল রাখতে হবে। তাদের যে আমি ছাড়া কেউ নেই।
পরেরদিন ছুটির দিন ছিলো। আব্বু বাসায় ছিলো। কিন্তু সকাল থেকেই খেয়াল করেছিলাম আম্মু কিছু একটা নিয়ে চি*ন্তি*ত। কেমন যেনো অ*ন্য*ম*ন*স্ক হয়ে আছে। আম্মু কে জিজ্ঞাসা করার পরও আম্মু কিছু বললো না। নাস্তা করার পর আব্বু গাড়ি দেখানোর জন্য বাড়ির বাইরে নিয়ে আসলো। আর কথায় কথায় জানতে পারলাম আব্বু ড্রাইভিং জানে।

গাড়ি দেখে আর আব্বু ড্রাইভিং জানে এটা জানার পর আব্বুর কাছে বায়না ধরলাম যেনো আমাকে গাড়িতে করে আশেপাশের এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। আব্বুর প্রিন্সেস আবদার করেছে আর আব্বু তা পূরণ করবে না তা কি হয়? আব্বু এক কথাতেই রাজী হয়ে যায়। কিন্তু আম্মু কে আমার ইচ্ছার কথা জানানোর পর সে কেমন যেনো অ*স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ভ*য়া*র্ত কণ্ঠে বলে আজ যেনো আমরা কেউ বাইরে না যাই। তার মনে হচ্ছে কোনো ভ*য়া*নক বি*প*দ আসতে চলেছে। কেমন যেনো অ*স্থি*র অ*স্থি*র লাগছে।

আর সে নাকি রাতে কোনো একটা বা*জে স্বপ্ন ও দেখেছে। আসলে এই পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক মানুষ রয়েছে যারা বি*প*দ আসার পূর্বে কোনো না কোনো ভাবে বি*প*দ আসার ইঙ্গিত পেয়ে যায়। কেউ বুঝতে পারে আবার কেউ দুঃ*স্ব*প্ন, এমনিতেই ভ*য় হচ্ছে এসব ভেবে উ*ড়ি*য়ে দেয়। আমরাও সেদিন আম্মুর কথা গায়ে মা*খি নি। আম্মু দুঃ*স্ব*প্ন দেখার কারণে ভ*য় পাচ্ছে ভেবেছিলাম। আর আম্মুর এই কথা না শোনাটাই আমাদের জন্য কা*ল হয়ে দাঁড়ালো।

আব্বু আর আমি বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে। আম্মু অনেকবার নিষেধ করেছিলো। কিন্তু আমি মন খা*রা*প করবো তাই আব্বু আম্মু কে এটা ওটা বুঝিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আস্তে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিলো আব্বু। আমিও জানালা খুলে পরিবেশ টা উপভোগ করছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আব্বু খেয়াল করে একটা বিশাল বড় ট্রাক সর্বোচ্চ স্পিডে পিছন থেকে আমাদের গাড়ি বরাবর এগিয়ে আসছে।

আব্বু বুঝে যায় ভ*য়া*নক কিছু হতে চলেছে। সেও গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আব্বু গাড়ি যেদিক যেদিক সরিয়ে নিচ্ছিলো, ট্রাকটাও সেদিক সেদিক ই আসছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো ইচ্ছা করেই আমাদের গাড়িতে ধা*ক্কা দিতে চাচ্ছে। আব্বু যে গাড়ি থামাবে তারও উপায় নেই। কারণ গাড়ি থামানো মাত্র হয়তো ট্রাক টা গাড়ি কে ধা*ক্কা মা*র*বে। আব্বু বুঝে যায় বাঁচার কোনো উপায় নেই। ট্রাক যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গাড়ি কে ধা*ক্কা দিবে। আমি আ*ত*ঙ্কি*ত দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকাই। দেখি আব্বুর চোখে জল ট*ল*ম*ল করছে। আব্বু হুট করে আমাকে বলে,

“মামুনি নিজের আর তোমার আম্মুর খেয়াল রাখবে। তোমাকে অনেক স্ট্রং হতে হবে কিন্তু। আমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।”
এতটুকু বলে থামে আব্বু। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আমিও তখন কাঁ*দ*ছি আর আব্বুর কথার মানে বো*ঝা*র চেষ্টা করছি। ট্রাক আমাদের গাড়ির একেবারে কাছে চলে এসেছে তখন। আব্বু এগিয়ে এসে আমার সাইডের ডোর খুলে দেয়। আমি চ*ম*কে তাকাই সেদিকে। কি হতে যাচ্ছে তার কিছু টা আন্দাজ করে ফেলি। হা*উ*মা*উ করে কেঁ*দে বলে উঠি,

“এমন টা করো না আব্বু। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। প্লিজ এমন টা করো না।”
অ*শ্রু*শি*ক্ত চোখে হাসে আব্বু। এক হাতে ড্রাইভ করতে করতে শেষ বারের মতো বলে,
“আব্বু তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে মামুনি…”

বাস্ এটাই ছিলো আব্বুর শেষ কথা। মুহূর্তের মাঝে আমাকে ধা*ক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বাইরে ফে*লে দেয় আব্বু। গাড়ি রাস্তার সাইডে নিয়ে আমাকে ধা*ক্কা দিয়েছিলো আব্বু। যার ফলে অন্য কোনো গাড়ির নিচে পড়ার সুযোগ ছিলো না। কিন্তু চলন্ত গাড়ি থেকে ফে*লার কারণে ভীষণ আ*ঘা*ত পেয়েছিলাম। রাস্তার সাইডের ইটে বা*রি খেয়ে কপাল ফে*টে গ*ল*গ*ল করে র*ক্ত বের হচ্ছিলো।

তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব ৪১

জীবনে প্রথম বার এতো আ*ঘা*ত পেয়ে স*হ্য করতে পারি নি। চোখ ঝাঁ*প*সা হয়ে আসছিলো। ঝাঁ*প*সা চোখেই তাকিয়ে ছিলাম আব্বুর গাড়ির দিকে। আশায় ছিলাম আব্বুও গাড়ি থেকে লাফ দিবে। কিন্তু সেই সুযোগ টা হয়তো আব্বু আর পায় নি। চোখের সামনেই ট্রাক টা আব্বুর গাড়ি ধা*ক্কা দিয়ে উ*ল্টি*য়ে দেয়। তারপর… তারপর সব অ*ন্ধ*কার।

তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব ৪৩