তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩৩
নীল মণি
সবার অজান্তেই, ঝড়ের গতিতে সদর দরজার ভারী পাল্লাটা ধাক্কা খেয়ে খুলে গেল–
আলোর অভিমুখে দাঁড়িয়ে গেলেন একজন অপরূপ, দুর্দান্ত পুরুষ।
জেল দিয়ে সেট করা ব্যাকব্রাশ চুল, চোখে হালকা সাদা ফ্রেমের চশমা, উজ্জ্বল গায়ের রঙে তার উপস্থিতি যেন অদৃশ্য বাতাসকেও স্পর্শ করলো।আলোর অভিমুখে দাঁড়িয়ে গেলেন একজন অপরূপ, দুর্দান্ত পুরুষ।
পরনে সাদা ইন করা শার্ট আর কালো ট্রাউজার, কব্জিতে চকচকে দামী রিস্টওয়াচ–
কিন্তু যেটা সবার দৃষ্টি আটকে রাখলো, সেটা ছিল তার হাতে ধরা কাঠের চেলাকাঠ।
ঘরের সকল কোলাহল স্তব্ধ। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
সেই কোলাহলভরা ড্রয়িং রুমে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল শব্দ।
কোণের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইউভি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো–
“ভাইয়া।”
জায়নের এই হঠাৎ আগমনে যেন চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে মুহূর্তেই জমে গেল এক অজানা শীতলতা। কারো মুখে হাসি, কারো চোখে জল, আর কারো চোখেমুখে ফুটে উঠল বিস্ময়।
অয়নের চোখেমুখে সাদা শেরওয়ানির ঝলক তখন যেন এক নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।
জায়নের চোখে ছিল এমন এক তীব্র আগুন, যা যেন সামনে পেলেই সব পুড়িয়ে ছাই করে দেবে— সে আগুন কারও চোখে পড়লে, আর মুখে হাসি থাকে না।
জায়নের পেছনে দাঁড়ানো জেমস–
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সেই আধা বিদেশি তরুণ, সাদা চামড়া, নেভি ব্লু স্যুটে সাজানো, কিন্তু জায়নের উপস্থিতির পাশে সে যেন ছায়া
আলো আর ছায়ার মাঝে কোনো এক অমীমাংসিত গল্প হঠাৎ ফিরে এসেছে।
জেমস ও তার স্যার এর এই রূপ দেখে ভয়ে কাঁপছে, মুখে কোন শব্দ নেই কিন্তু ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে এইটা তার স্যার এর দেশের বাড়ি।
মেহজাবীন বেগমের চোখে জল, বুক কাঁপছে— এতদিন পর তাঁর ছেলে ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু যে রূপে এসেছে তা যেন তাঁর অচেনা।
পাশ থেকে রূহেনা বেগম আর সুরাইয়া বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে, বোবা কান্না চেপে রেখেছে ঠোঁটের কোণে।
জায়নের চোখ মায়ের চোখে পড়ল না– পড়লেও উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মেজো মায়ের সামনে।
কণ্ঠস্বর ছিল ভারী, অথচ ছুঁয়ে গেল সবাইকে— “মেজো মা, রোদ কোথায়?”
রূহেনা বেগম ভেজা কণ্ঠে জবাব দিলেন,
“ও… ও উপরে, নিজের রুমে বাবা।”
জায়ন কিছু না বলে ড্রয়িং রুমের মাঝখানে রাখা কাঁচের টেবিলের ওপর তার হাতের চেলাকাঠটা রেখে দাঁড়াল। সবাই গোল হয়ে বসা, কনের পক্ষ, পাত্র পক্ষ, আত্মীয়স্বজন– এক মুহূর্তে সবার দৃষ্টি তার দিকে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সাদা শেরওয়ানিতে বসে থাকা অয়নের দিকে, যার কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে।
তারপর গলা নামিয়ে, কিন্তু এমনভাবে বলল যেন প্রত্যেকটি শব্দে বিদ্যুৎ ঝরে পড়ছে–
“এই ঘরে আমি যতক্ষণ না বলছি, কেউ গায়েব হলে তার কপালে অশেষ দুঃখ আছে।
আর এই টেবিলের ওপর রাখা কাঠটা যদি কেউ সরায়, তাহলে তার হাতটা থাকবে কি না, আমি গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
মুহূর্তে জমে গেল চারপাশ। কেউ কথা বলছে না, কেউ চোখ তুলে তাকাচ্ছে না– কে জানে কোন দিকে সেই আগুন ছিটকে পড়ে।
প্রান্তিক সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, এবার তাঁর গম্ভীর কণ্ঠ গর্জে উঠল–“বিদেশে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? এটা কী ধরনের ব্যবহার? এই বাড়িতে গু*ন্ডা*মি চলবে না, বুঝলে?”
জায়ন ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রুপ হাসি টেনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল–“গু*ন্ডা*মির জি টুকুও দেখাইনি বাবা। জাস্ট ওয়েট করো। দেখাতে বাকিটা বাকি আছে।”
এই বলে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরে।
মেহজাবীন বেগম চোখ মুছে, হঠাৎ সোফায় বসে পড়লেন–
“মেজো, ছোট… এ কি আমার ছেলে রে? ওর মুখ দিয়ে এ কী কথা বের হচ্ছে?বাবা, চাচা ,আত্মীয়স্বজন, অতিথিদের সম্মান বলে কিছুই কি নেই?”
বড় ছেলের এই অবস্থা দেখে চাচিদের ও একি অবস্থা।”
সান্ত্বনার সুরে আয়েশা বেগম বললেন–“ভাবি মন খারাপ করো না। হয়তো তোমরা ওর জন্য অপেক্ষা না করেই তিয়াশার বিয়ে দিচ্ছ– তাই হয়তো সে রাগ করেছে। মন খারাপ হওয়াটা তো স্বাভাবিক… যাই হোক, তিয়াশা তো ওর বোন হয়।”
“ইউভি ভাইয়া তুমি অনুর রে নিয়ে আর আমি জলপরী রে নিয়ে দেশ ছারি চলো নয়তো দেখছ তো ওই চেলাকাঠ খানা , ওই কাঠ এর বাড়ি আমাদের ও মিস যাবে না।ওর বারি পড়লে গল্প শেষ।
আকাশের কথায় ইউভি বিরক্তি হয়ে বলল
” এই তুই চুপ করবি এমনিতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে , অসুস্থ লাগছে তার উপর আবার এই সব বলছিস । একদম চুপ ”
তিয়াশা কনে সেজে বসে আছে। পরনে গা-চমকানো মেরুন বেনারসি, শরীরজুড়ে ভারী গয়না, ঠোঁটে গারো লিপস্টিক, মাথায় কাজ করা লাল চেলি ওড়না সব মিলিয়ে যেন এক স্বর্গসন্ধ্যা। কিন্তু তার ভেতরে বইছে এক নিঃশব্দ প্রলয়।
মনের গভীরে চলছে এক অবিরাম দ্বন্দ্ব–এই মুহূর্তের পরই সে হয়ে যাবে অন্য কারো সহধর্মিণী। অথচ তার হৃদয় যে এতদিন ধরে ভালোবেসে এক পুরুষেরই ঘর বুনেছে, সেই ঘর ভেঙে ফেলার ক্ষমতা তার নেই। তাতে সে ভেঙে যাবে, একেবারে চূর্ণ হয়ে যাবে।
কিন্তু এই দোতলার ঘরে বসে কেউ জানে না নিচে ঠিক কী ঝড় বইছে…
ঠিক তখনই হঠাৎ ধাঁই করে দরজা খুলে গেল। যেন কেউ লাথি মেরে খুলে দিয়েছে। সবার চোখ সেদিকে গেল।জায়ন কে দেখেই চমকে উঠলো সবাই,
আরোহী আর অনুর মুখে দেখা গেলো এক অন্য রকম হাসি।
তিয়াশা এখনো তার ভাবনার মাঝেই ডুবে আছে।এর মাঝেই
মারিয়া আনন্দে চিৎকার করে উঠলো —
” জায়ন ভাই….””
তিয়াশা জায়ন নাম টা শুনতেই যেন চমকে উঠলো — চোঁখ যেন বড় বড় হয়ে গেল। কৌতুহল নিয়ে তাড়াতাড়ি পেছনে তাকিয়ে দেখলো সেই মানুষটা —
তিয়াশার পৃথিবী থমকে গেলো , এই যে সেই মানুষ টা যার অপেক্ষায় দিন গুনতো, স্বপ্ন জমাতো। তার শখের পুরুষ যার উপস্থিতি করে তুলেছে মনের মধ্যে এক অজানা শিহরন । তার বাঘের বাচ্চার এই নতুন রুপে সে যেন ঝলসে যাচ্ছে, চোঁখের ওই সাদা ফ্রেমের চশমায় যেন একটু বেশিই ভালো লাগছে তাকে।
সে স্বপ্ন দেখছে না তো একটু নিজে নিজেই চিমটি কেটে নিল নিজেকে । না এ তো সত্যি এ তো সত্যি
কিন্তু ওই পুরুষের চোঁখে তো আগুন জ্বলছে, মনে হচ্ছে এখন ই জ্বালিয়ে দেবে সব কিছু। সে যাই হোক আর তাকে যেতে দেবে না তিয়াশা।
“আউট”
জায়ন এর তীব্র কণ্ঠস্বর এ কেঁপে উঠলো পুরো ঘরে।
আরোহী এই “আউট” আগেও শুনেছে, অনন্যার ও
বুঝতে বাকি নেই এই ” আউট” কাদের জন্য। তাই তাড়াতাড়ি মারিয়া আর নেহার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো আরোহী অনন্যা।
করিডোর দিয়ে যেতে যেতে নেহা বলে উঠলো —
” আরে তিয়াশা তো রুমেই ।”
” তোমার ভাবতে হবে না নেহা আপু”
এই বলে অনন্যা ওরা সবাই নিচে যেতে লাগলো।
মারিয়াও এদিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠছে কিছুই বুঝতে পারছে না ।
ঘর ফাঁকা।
এবার জায়নের সামনে দাঁড়িয়ে সেই রমণী—তার কিটি ক্যাট, তার শখের বউ, এখন আর ছোট নেই, পূর্ণ যুবতী
ঘর ফাঁকা।
এবার জায়নের সামনে দাঁড়িয়ে সেই রমণী ,তার কিটি ক্যাট, তার বাচ্চা বউ, এখন আর ছোট নেই, পূর্ণ যুবতী। রূপেএসেছে পরিপক্বতা চেহারায় যৌবনের দীপ্তি ।শরীর জুড়ে এক অভিজাত নারীর প্রকাশ পাচ্ছে। এই চেহারায় সৌন্দর্য যেন জায়ন কে দুর্বল করে দিচ্ছে । গয়না, বেনারসি, লিপস্টিকে মোড়া সে রূপ যেন দগ্ধ করে দিচ্ছে জায়নকেও।
কিন্তু এই সাজ তো তার জন্য নয়, এই সাজ তো অন্য পুরুষের জন্য।
চোখে হঠাৎ আবার আগুন জ্বলে উঠল।
সে এগিয়ে গেল, ধপ করে তিয়াশার মাথা থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে ফেলল।
তিয়াশার কোমরে হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল, এমনভাবে যেন বলছে–তুই আমার, শুধু আমার।
তিয়াশা কেঁপে উঠল। চেনা স্পর্শ, চেনা গন্ধ,বিদেশি পারফিউমে ভেজা জায়নের শরীর তিয়াশাকে মাতন করে তুলছে , কিন্তু জায়ন এর এই হঠাৎ করা পদক্ষেপে পরিচত থাকলেও এত দিন পরে এই পরিস্থিতি তাকে কপিয়ে তুলছে।কিন্তু আজকের এই স্পর্শে আছে দাবির আগুন।
হঠাৎ ই তিয়াশার চুলের খোপাটা ধরে টেনে ধরলো জায়ন , যার জন্য তিয়াশা একটু পেছনের দিকে ঝুঁকে গেল, খোপায় গাঁথা গোলাপ গুলো দুমড়ে মুচড়ে নিচে পড়ে গেল।এরকম হঠাৎ চুল টানায় ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো তিয়াশা। পেছনে ঝোকায় উন্মুক্ত ফর্সা গলাটা জায়ন এর চোঁখে এসে লাগলো ,কিন্তু জায়নের চোখে তখন অন্য আগুন। দাঁতে দাঁত চেপে, রাগে কাঁপা গলায় সে বলল–
“যেই সুযোগ পেয়েছিস অমনি প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে করতে চলেছিস? করাবো তোকে বিয়ে। বলেছিলাম না, দূরে যাচ্ছি মানে ছেড়ে যাচ্ছি না।”
এই বলেই জায়ন তার উন্মুক্ত গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিল সেই চেনা ঘ্রাণ, যা তাকে পাগল করে তোলে, যা একসময় তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এই কবছর তাকে জ্বালিয়েছে প্রতি রাতে।
তারপর গলায় বসিয়ে দিল এক কা”ম”ড়।
“আহ লাগছে তো” — তিয়াশা ব্যথায় চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু এই ব্যথার মাঝেও যেন লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এতদিনের বিরহ যেন ভেঙে গেল এই উত্তাপে।
“এখনো কিছুই লাগেনি… আরো লাগবে… ওয়েট এন্ড ওয়াচ।” — জায়নের ঠান্ডা, হিংস্র কণ্ঠস্বর বেজে উঠল।
জায়ন এর কথা কানে এসে লাগলো —
জায়ন গলা সরিয়ে আবারো তিয়াশার মুখে তাকিয়ে
তিয়াশার ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে দিলো হাতের বৃদ্ধাআঙুল দিয়ে । মুছে দিলো চোঁখ এর কাজল ।
” চল ”
জায়ন এর কথায় এবার যেন তিয়াশা কেপেই উঠলো , কাপা কন্ঠে বলল —
” কো কো থায় ?”
” আমাকে প্রশ্ন করার তোকে এখনো রাইট দেয়নি । সেটা হক নিতেই চল এখন ।”
তিয়াশা মনে মনে ভাবছে কি বলছে এই লোক —
” মা মানে ।”
তিয়াশার এরকম অনিচ্ছা দেখে জায়ন বিরক্তি হয়ে তুলে নিল কোলদাবা করে তুলে নিল নিজের বা কাঁধে যার ফলে তিয়াশার মাথা ঝুকে থাকলো নিচে। আলগা খোপা খুলে গেল এক ঝটকায় ।
জায়ন দাঁতে দাঁত পিষে আগুন চোখে তিয়াশার পা জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতে লাগলো —
তিয়াশা তার এই অবস্থান বুঝে এক অস্থির গলায় বলতে শুরু করলো —
” কি করছেন, নিচে নামান পরিবারের সবাই দেখলে খারাপ ভাববে, প্লিজ”
জায়ন গম্ভীর কণ্ঠে তিয়াশার কথায় পরোয়া না করে বলে উঠল —
” আই ডোন্ট কেয়ার এনি মোর, আর আমি চাই পরিবার আমাদের এই ভাবেই দেখুক।”
তিয়াশা যেন আবারো চমকে উঠল , ড্রইং রুমের সবাই জায়ন তিয়াশা কে এই ভাবে আনতে দেখে
বিস্ময় হয়ে চমকে উঠলো ,
প্রণয় সাহেব এর যেন এই দৃশ্য দেখে মাথা ঘোরার মত অবস্থা।
প্রান্তিক সাহেব ,মেহজাবীন বেগম , প্রণয় সাহেব রুহেনা বেগম , তাহসান সাহেব, সুরাইয়া বেগম,
রায়ান , আশরাফ খান , আয়েশা বেগম , রহমত সাহেব , সুনিতা বেগম , অয়ন ,নয়ন , মাসরুক সাহেব ওনার স্ত্রী নেহা, আরোহীর আব্বু আম্মু আর বাকি মেহমান রাও তাকিয়ে আছে তাদের দিকে
এক অবাক নজরে দেখে যাচ্ছে । কি দেখছে তারা এইসব ?
বিয়েবাড়ির রঙিন আয়োজনে যেন হঠাৎ করে একটা ধোঁয়ার সাদা পর্দা নেমে এসেছে।
কাজী সাহেব পর্যন্ত নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছেন, কাগজ হাতে কাঁপছেন তিনি।
কিন্তু…
ইউভি, আকাশ, অনন্যা, আর আরোহীর চোখে লুকিয়ে রাখা এক অদ্ভুত তৃপ্তির ঝিলিক।
তাদের চোখ বলছে—”অবশেষে।”
গর্জে উঠলেন প্রান্তিক সাহেব —
“এ কি নাটক চলছে এই বাড়িতে? সহ্যের একটা সীমা থাকে। ছোট বোনের সঙ্গে একই ব্যবহার।”
জায়ন কোন জবাব দিল না সিঁড়ি থেকে ইউভি দের পাশে দার করিয়ে দিল । আর ইউভি কে ধীম
গলায় বললো —
” আর কিছুক্ষন সামলে রাখিস তোর বোন কে । ”
তারপর সে তিয়াশার চোখে তাকিয়ে বলল–
“এক পাও এদিক ওদিক হলেই… তোর পা আর থাকবে না। বুঝেছিস?”
তিয়াশা নিঃশব্দে কাঁপছে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস নেই।
অন্যদিকে আরোহী আর অনন্যা মুচকি হেসে একে অপরের দিকে তাকাল।
তাদের চোখে যেন জ্বলে উঠল তৃপ্তির এক শিখা।
এরপর জায়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল প্রান্তিক সাহেবের দিকে।
তার মুখে থমথমে একটা তীব্রতা, শব্দে গলিত আগুন।
“ও যদি আমার ছোট বোন হয়, তাহলে আজ থেকে আপনি মাকে ‘বোন’ বলে ডাকবেন।”
প্রান্তিক সাহেব চমকে উঠলেন–
“কী বলছিস এসব? তোর মাথা ঠিক আছে?”
জায়ন ঠোঁট উল্টে একটা বিদ্রুপ হাসি দিয়ে বলল–
“বলছি না, এবার করে দেখাবো।”
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না প্রণয় সাহেব।
তীব্র কণ্ঠে বললেন–
“এইটা কী হচ্ছে জায়ন? কি বলছিস! এই অভদ্রতা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে!”
জায়ন এবার তাকালো হবু শ্বশুরের দিকে–
“হবু শ্বশুর মশাই, এখন সবার মাঝে অভদ্রতা আমি করতে পারবো না… আপনার সম্মান আছে, আপনার কথা রাখতে পারছি না বলে দুঃখিত।”
প্রণয় সাহেব রেগে ফুসে উঠলেন, আর তাহসান সাহেব চিৎকার করেই ফেললেন–
“জায়ন, বাড়াবাড়ি করছো। অনেক হয়েছে!”
“বাড়াবাড়ি এখনো শুরু করিনি, চাচ্চু। এখন করবো। ভালো করে বসুন।”
–জবাব দিল জায়ন, গলার সুরে যেন হিমশীতল বিদ্যুৎ।
ঠিক তখনই রূহেনা বেগম ভেজা চোখে এগিয়ে এসে বললেন–
“জায়ন বাবা, এভাবে বলছিস কেন এসব?”
প্রান্তিক সাহেব ভেবে চলেছেন এ কি তার ছেলে যে তার পরিবারের জন্য মান সম্মানের জন্য সবার আগে দাঁড়িয়ে থাকতো সেই কিনা আজ পরিবারের মান সম্মান নিয়ে খেলা করছে।
জায়ন পেছন ফিরে তাঁর মেজো মায়ের হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল–
“মেজো আম্মু, তোমায় আগেই বলে ছিলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি।
তুমি রাখতে পারোনি, তাহলে আমি সেটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবো। আর আজ সেই সময় এসে গেছে।”
রূহেনা বেগম নিঃশব্দে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, কোনো শব্দ বের হলো না তাঁর মুখ থেকে।
মেহজাবীন বেগম, দাঁড়িয়ে দেখছেন তাঁর ছেলে এক অচেনা রূপে রূপান্তরিত হয়েছে।
তাঁর মনে পড়ছে ছোট্ট সেই ছেলে, যার হাত ধরে একদিন স্কুলে নিয়ে যেতেন—আজ সে দাঁড়িয়ে আছে আগুনের প্রতিচ্ছবি হয়ে।
হঠাৎই জায়ন এগিয়ে গেল অয়ন এর সামনে।
চোখে চোখ রেখে তার সামনে থাকা চেয়ারটা এক টানে টেনে নিলো।
চুপচাপ বসে পড়ে হাতে তুলে নিল চেলাকাঠটা।
পেছনে না তাকিয়েই গলা উঁচু করে বলল–
“এইখানে উপস্থিত যদি কোনো বাপের বেটা আমার কাজে বাধা দিতে আসে, তার হাতের অবস্থাও থাকবে না, সম্মানের তো প্রশ্নই আসে না।মাথা ঠিক নেই এই পাগলা কুত্তার থেকে নিজেদের দূরে রাখবে।”
রহমত সাহেব ও সুনিতা বেগমের কলিজা কেঁপে উঠলো এই কথা শুনে । সঙ্গে পরিবারের সবাই যেন হতাশ হয়ে পরলো। অয়নের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে।
“বিয়ে করতে এসেছিস? কাকে বিয়ে করতে এসেছিস?”
জায়নের এই হুমকি মার্কা কথায় অয়নের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
“Answer me.”
জায়নের চোখে জ্বলছে আগুন, কিন্তু অয়ন কিছু বললেই হয়ত আরও খারাপ হবে।
অয়ন আমতা আমতা করে বলল— “তি…”
“সাইই ই ই”আর বলতে পারলো না, তার আগেই চেলাকাঠের বাড়ি এসে পড়ল পায়ে।
সবার শরীর যেন কেঁপে উঠল, আর কাজী সাহেবের হাতে থাকা কলম ছিটকে পড়ল মেঝেতে…
সবাই চিৎকার করে উঠলো– “জায়ন!”
কিন্তু জায়নের কানে কিছুই ঢুকছে না সে পাগলের মতো পিটিয়ে যাচ্ছে।
চোখের জলে ভাসছেন সুনিতা বেগম ও মেহজাবীন বেগম।
রহমত সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন– “জায়ন বাবা, প্লিজ ছেড়ে দে ওকে! মারিস না ছেলেটাকে।”
কে শোনে কার কথা।
“কু”**র বাচ্চা, বিয়ে তোকে করাবো? তিন বছর আগে ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম—তোর বুকের পাটায় কত জোর! তুই আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিস?”
অনবরত চলেই যাচ্ছে সেই বারি,—
” বারণ করেছিলাম না ওর আসে পাশে আসতে। কু”**র
বাচ্চা তোকে তো আজ আমি ……..
আমি ওর পাশে কোন ছেলের ছায়া সহ্য করতে পারি না,
আর তুই আমার বাসায় বিয়ে করতে এসেছিস।
বুকের পাটা তে এত জোর তোর। আজ আর থাকবে না।”
এই বলেই আরও কয়েকটা বাড়ি মেরে দিলো।
রক্তা”ক্ত হয়ে পড়ে রইল অয়ন।
ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে নয়ন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ছুটে গেল ভাইয়ের কাছে– “জায়ন ভাই, প্লিজ আর মেরো না, প্লিজ।”
অমনি জায়ন রক্তভেজা চোখ নিয়ে কোমরের পেছন থেকে ব”ন্দু”ক বের করে ট্রিগার ছোঁয়ালো নয়নের কপালে— “আউট। নইলে এখানেই পুতে দেব।”
সবাই কেঁপে উঠছে জায়নের এমন পাগলামি দেখে। এই ছেলের কাছে এত ভয়ানক অস্ত্র এল কোথা থেকে!
সুনিতা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলছেন– “জায়ন, ছেড়ে দে, প্লিজ। আমরা চলে যাচ্ছি, আর কখনো তোর সামনে আসব না। তোর হাতে-পায়ে পড়ছি।”
মেহজাবীন বেগমও চিৎকার করছেন– “জায়ন, আর মারিস না। ছেড়ে দে, মরে যাবে ছেলেটা!”
ভয়ে তিয়াশার চোখে জল, ইউভির শার্ট আঁকড়ে ধরে বলছে– “ভাইয়া, প্লিজ। ওনাকে থামাও।”
ইউভি নিজেই কাঁপছে ভাইয়ের এই রূপ দেখে। আকাশেরও ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ।
ইউভি জবাব দিল – “কে বলেছিল বিয়ে করতে আসতে? আমি পারবো না ভাইয়ার সামনে যেতে।
তিয়াশা এবার আকাশ কে বলল– “আকাশ ভাইয়া, তুমি যাও না?”
“মাফ কর বইন, আমার জল পরীর সঙ্গে সমুদ্র সৈকত করা বাকি।”
আকাশের কথা শুনে ওই দিকে তাকিয়ে আরোহী বলে উঠল— “মানুষ বাঁচে না মানুষের জ্বালায়, উনি মরে উনার সমুদ্র সৈকতের ঠেলায়।”
ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে অয়ন।
প্রান্তিক সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না–
প্রান্তিক সাহেব এগিয়ে এসে বললেন–“ছেড়ে দে জায়ন, আর পাগলামি করিস না।”
জায়ন জবাব দিল– “বাবা, সরে যাও।”
“ওরা এখন ই চলে যাবে, ছেড়ে দে এবার ।”
এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে ওকে নিয়ে বের হও মামু।
জায়ন এর কথা শুনেই তারাতারি রহমত সাহেব ও নয়ন এসে অয়ন কে উঠিয়ে নিয়ে যেতে লা হলো, সঙ্গে ছুটলো সুনিতা বেগম —
যেতে যেতে ওনাদের কানে এক তীব্র আওয়াজ ভেসে আসলো —
” এবার আধমরা করে পাঠাচ্ছি নেক্সট টাইম আমার বউ এর আসে পাশে দেখলে ফুল মার্ডার করে পাঠাবো মামু তোমার ছেলে কে , আমার বউ এর আসে পাশে ও কেন অন্য কারো নজর আসলেও চোঁখ তুলে নিব ।”
অয়নকে মারতে মারতে জায়ন এর নিজের শরীরের
হোয়াইট শার্টটা নোনা জলে ভিজে উঠেছে। কপালের ঘামটা হাত দিয়ে মুছে ফেলল। এবার তাকালো কাজী সাহেবের দিকে।
ব*ন্দু*কটা ঠেকালো কাজী সাহেবের মাথায়–
” ওই কাজী, বিয়ে পড়াবি আমার।”
কাজী সাহেবের গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠলো ,
মনে মনে ভাবছে কোন কুত্তায় কামরাইছিল যে এই বাড়ি বিয়ে পড়াইতে আয়সি।
প্রান্তিক সাহেব ছেলের এই পাগলামি আর সহ্য করতে পারছে না গর্জে উঠলেন–
“ওনার মাথা থেকে ওটা সরা ,কিসের বিয়ে কোন বিয়ে হবে না। আমি অনুমতি দেব না তিয়াশা আম্মুকে এরকম পাগলের হাতে আমি তুলে দিতে পারব না।”
বাবার কথায় কান না দিয়ে কাজীর মাথা থেকে বন্দুকটা সরিয়ে বলল —
” হুরর তুই ওই কুত্তার বাচ্চার বিয়ে পড়াতে এসেছিস । তোর কাছে বিয়ে পড়বনা ।সরে যা আমার সামনে থেকে।”
জায়ন এর আর কিছু বলা লাগলো না দৌড় দিলো নিজের টোপলা নিয়ে ।
জায়ন এবার নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল —
” আপনার অনুমতি কি চেয়েছি বাবা , আপনি কি আমার মা কে বিয়ে করার সময় আমার অনুমতি নিয়েছিলেন যে আমার নিতে হবে ।”
প্রান্তিক সাহেবের ছেলের কথায় যেন মাথায় বাজ পরলো । কি বলে এই ছেলে ?কি ছেলে জন্ম দিয়েছে? এত অধঃপতন কেন?
মেহজাবীন বেগম বলে উঠলেন —
” পাগলামো করিস না বাবা এসব ঠিক না।”
জায়ন তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল–
” নিজেই তো সারাদিন ফোন করে বলতে, বিয়ে কর বিয়ে কর এখন করতে চাইছি মানা করছ কেন? নিজেরা দেবে না তুলে নিয়ে যাব?”
এদিকে জেমস এর ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে উঠেছে তার স্যারের এই রুপ দেখে। যত দেখছে ততই ঘাবড়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে —
” এই মায়াবী রুপসীর জন্য স্যার কোন মেয়ের দিকে তাকাতেন না । নিজের বাসায় এরকম রুপসী থাকতে কেউ অন্য দিকে তাকায়। আরে এ আমি কি বললাম সরি গড সরি উনি আমার সিস্টার এর মত নইলে স্যার যদি শোনে আমি ওনার would be wife কে রুপসী বলেছি , আমার গর্দান থাকবে না।”
এর মধ্যেই প্রণয় সাহেব চিৎকার করে উঠলেন–
“আমি আমার মেয়ে তোমার হাতে কিছুতেই দেবো না, নিজের বয়স দেখেছো । লজ্জা করে না নিজের থেকে ১২ বছরের ছোট মেয়ে কে বিয়ে করতে চাইছো।”
জায়ন একটু কপাল কুচকে বলল —
” আমি কি আপনার কাছে আপনার মেয়ে হবু শ্বশুর আব্বা । আর লজ্জা করবে কেন আমি কি এখানে আমার বাসর সারছি যে লজ্জা করবে ।”
প্রান্তিক সাহেব চিৎকার করে উঠলেন নিজের ছেলের এই অধঃপতন দেখে —
” জায়ন।”
তাহসান সাহেব এর এবার আর এই কথাবার্তা সহ্য করতে পারলেন না —
” জায়ন এত বাড়াবাড়ি ঠিক না, তিয়াশা তোর থেকে অনেক ছোট বোঝার চেষ্টা কর নিজের বয়স টা তো দেখ।”
” চাচু ভালোবেসেছি , আর আমি আমার বয়স দেখেছি
আমার বউ এর আমাকে সামলাতে সমস্যা হলে বউ কে বড় করে নেবো।”
ইউভি আকাশ কে বললো —
” দেখ আকাশ দেখ আগে তো আমার সামনে লাগামহীন কথা বার্তা বলতো এখন নিজের হবু শশুরকেও ছাড়ছে না।”
আকাশ একটু হেসেই ধিম গলায় বলল —
” তোমার শ্বশুরও পাশে দাঁড়ানো ট্রাই করতে পারো।”
আকাশের কথা শুনে ইউভি চোখ রাঙিয়ে পড়লো।
” লাস্ট টাইম জিজ্ঞাসা করছি বিয়ে দেবে কি দেবে না? ”
জায়নের কথায় প্রান্তিক সাহেব সোজাসুজি জবাব দিলেন “না”।
জায়ন আর কোন কথা বাড়ালো না , তিয়াশার দিকে এগিয়ে আসলো–
তিয়াশা ভয়ে নিজের ভাইয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল —
“চল, এবার তোর পালা ।”
জায়ন তিয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল ।
তিয়াসা এখন রীতিমত ভয় পাচ্ছে জায়ানকে দেখে, ওনার কাছে বন্দুক যদি রেগে উঠে মেরে দেয় ।
“ইউভি, আমার গাড়ির চাবি আর বাইকের চাবিটা নিয়ে আয় ”
জায়ন এর কথায় ইউভি নিজের রুমে যেতে লাগল ,
কিন্তু তিয়াশা ইউভির টিশার্ট টা টেনে বলল —
” ভাইয়া যেও না , ওনাকে ভয় করছে আমার ।”
ইউভি ও কিছু বলতে পাড়ছে না কিছু বলতে গেলেই
আবার যা তা শুনতে হবে ।
তিয়াশার কান্ড দেখে জায়ন তিয়াশাকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে যেতে লাগলো।
পিছন থেকে ভেসে আসলো এক কণ্ঠস্বর–
” তিয়াশা আম্মুকে এক্ষুনি নিচে নামাও, যদি আর পা বাড়িয়েছো তো এই বাসায় আর তোমার কোনদিনও জায়গা হবে না।”
প্রান্তিক সাহেবের কথায় জায়ন যেতে যেতে বলল
” জায়গা আমার লাগবে না, আমার যা জায়গা আছে আমার নাতি নাতনি কে বসিয়ে খাওয়াতে পারব। আপনার জায়গায় আপনি থাকেন কখনো আসবো না।”
জায়ন একবার ইউভির দিকে তাকিয়ে বলল —
” এখন দেখলি কেন এত জলদি বাসা খুঁজতে বলেছিলাম ।”
ইউভি অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে।
মেহেজাবিন বেগম চিৎকার করে বলতে লাগলো
” যাস না বাবা ।”
জায়ন এর কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো —
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৩২
” সরি মা আমার হবু বউ আমার ফাস্ট পিরিয়োরিটি। তোমার জন্য আমার বাবা আছে । তোমার স্বামী আমায় মানছেন না আমিও আমার বউ কে ছাড়ছি না ।
চলে গেল জায়ন তিয়াশা কে নিয়ে পেছন পেছন গেল জেমস ।
চাবি নিয়ে এসে পেছন ছুটল ইউভি আর আকাশ।
রূহেনা বেগম স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো , সে কথা দিয়ে ছিল জায়ন কে । তাই কথার মর্যাদা রাখলো।