তোমার নেশায় আসক্ত পর্ব ৪০ || Suraiya Aayat || SA Alhaj

তোমার নেশায় আসক্ত পর্ব ৪০
Suraiya Aayat

বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আরূ, পা টা বারবার দোলাচ্ছে অস্থিরতায় ৷ আরিশকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও ভাল লাগছে না ওর, সেই কখন থেকে একা একা ঘরের মাঝখানে বসে আছে ৷ অস্থিরতায় ঘড়িটার দিকে তাকাতেও এখন বিরক্তি লাগছে তবুও তাকাচ্ছে ঘড়িটার দিকে না পেরে ৷ সময়টাও আজকে যেন ওর সামনে বিরাট প্রাচীর গড়ে তুলেছে হয়তো ওর অপেক্ষার দীর্ঘ পরীক্ষা নিচ্ছে….

ঘড়ির ছোট কাঁটাটা এখন দশের ঘরে আর বড় কাটাটা নয়ের ঘরে , অর্থাত 10.45 বাজে এখন ,এই মুহূর্তে আরুর ইচ্ছা করছে ঘড়ির কাঁটাটাকে নিজের ইচ্ছেমত চালাতে যাতে সময় টা ওর হিসাবেই চলে কিন্তু এই ঘড়িটাকৈ থামিয়ে দিতে পারলেও জীবনের বাস্তবতার ঘড়িটাকে তো আর পাল্টাতে পারবে না কোনভাবেই ৷ পারলে আরু এবার কেঁদেই ফেলে,
এমনিতেই সকালথেকে কিছু খাইনি আরিশ ,আর ওর ও মন টানছে না যে আরিশকে ছাড়া কিছু করতে এমনকি কিছু খেতেও , না জানি মানুষটা সারাদিন কিছু খেয়েছে কি ! আরিশ মুখে যতই বলুক অফিসে গিয়ে লাঞ্চ করে নেবে কিন্তু আরু বেশ ভালোই জানে যে একবার কাজের মধ্যে ঢুকে গেলে আরিশের কোন দিকে খেয়াল থাকে না ‌৷ আরু এখন নিজেকেই নিজে বকা দিচ্ছে এটা ভেবে যে ও নিজে যদি একটু নিজের প্রতি যত্নশীল হতো তাহলে হয়তো আজকে ওকে নিয়ে এতটা ধকল আরিশকে সহ্য করতে হতো না , এগুলো ভাবলেই বুক ফেটে কান্না আসে আরুর ৷ আজ ওর জন্যই মানুষটা এত কষ্ট করছে ৷
আপনা আপনিই চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে তা চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই তাড়াতাড়ি করে জামার হাতা দিয়ে মুছে নিল আরু , এভাবে আর চলবে না আরিশকে ফোন করতেই হবে এবার ৷
তাড়াতাড়ি করে আরিশের এর নাম্বারে ফোন করলো….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফোনটা কানে ধরে আছে আরু , বেশ কয়েকবার রিং হচ্ছে তবে ওপাশ থেকে রিসিভ করছে না আরিশ , শেষ মুহূর্তে একরাশ রাগ আর হতাশা নিয়ে ফোনটা যখনই কাটতে যাবে তখনই আরিশ ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠলো ,,,,,,
__” এইতো আমি আসছি আরূপাখি, আর পাঁচ মিনিট লাগবে ৷”
আরু আরিশের কথার কোন উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন ৷ আরিশ ওকে মিথ্যা কথা বলেনি,রাস্তায় গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে আরূ বুঝতে পেরেছে যে আরিশ বাড়িতে ফিরছে ৷ আরিশের ক্লান্তিমাখা কন্ঠ শুনে আরুর ভিতরে যেন ছারখার হয়ে গেল , আরিশের সঙ্গে কথা বলার অবস্থায় ছিল না ও , ফোনটা কেটেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আরু , প্রিয় মানুষের কষ্টে আজ ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে খুব , আজ ও বুঝতে পারছে তাহলে ওর সামান্য কিছু হলে আরিশ কতটা কষ্ট পায় ৷ তাহলে ভালোবাসা বুঝি এমনই হয় !

কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ শুনেই দৌড়ে ছুটে ব্যালকনিতে চলে গেল আরু , ডাক্তার ওকে বারণ করে দিয়েছে যাতে কোনরকম লাফালাফি বা দৌড়াদৌড়ি না করে তবুও এই মুহূর্তে যেন এই সমস্ত কিছুই উপেক্ষিত ওর কাছে, কোনো বারণ শুনবে না এখন ৷
আরিশকে এক পলক দেখে রুমের ভিতর চলে এলো৷
মনে মনে ভাবছে,,,,,,

__” কাঁদবেনা আর কারণ আমি কাঁদলে উনি আমার থেকে আরো বেশি কষ্ট পায়….”
আরূ রুমে বসে আছে তখনই চিরচেনা মানুষটা ওর কাছে এগিয়ে আসতেই বুকের হৃদস্পন্দন টা যেন বেড়ে গেল, কয়েক ঘণ্টা আগে দুজনের মধ্যে দেখা হলেও এখন যেন মনে হচ্ছে যে বহু যুগ পরে আবার ওরা দেখা পেয়েছে নিজেদের ৷
আরিশ দেখল আরু অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে, ধীরে ধীরে এগিয়ে আরুর পাশে গিয়ে বসলো,,,,,
__” তুমি এখনো জেগে আছো আরুপাখি? তোমাকে না আমি বললাম যে আমার ফিরতে লেট হবে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ৷
তাও তুমি জেগে আছো ?”

খানিকটা ধমকের সুরেই বললো আরিশ ৷
আরিশের কথা শুনে আরু আরিশের দিকে তাকালো গভীর দৃষ্টিতে,,,,,,
আরুর চোখের দিকে তাকাতেই আরিশের বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল, চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, ভয়ঙ্কর কষ্টে মানুষ যেমনটা জর্জরিত হয় তেমনিই রাঙা সেই চোখ দুটো….
আরিশ আর কিছু বলার সাহস পেলো না , বাকরুদ্ধ এই মুহূর্তে ৷ ও কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা , আর আসল কারণটাই ব কি?
আরোশী দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো,,,,,,

__” আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন ৷”
বলে উঠে চলে গেল ৷
আরিশ কিছুই বুঝতে পারছে না যে কি হয়েছে আরুর ৷ মনটা ওর বড্ড আনচান করছে , সারাদিন এত ধকল এরপর আবার এতকিছু হওয়াতৈ চিন্তাটা যেন আরও দ্বিগুন হয়ে গেল ৷
আরুশি নিচে গেছে দেখে আরিশ আর কোনরকম সময় নষ্ট না করে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল ৷
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের সমস্ত ক্লান্তি দূর করছে আরিশ আর মনে মনে ভাবছে,,,,
” তাহলে আরুপাখিকে কি কম সময় দিয়ে ফেলছি? ঠিকঠাকই সময় দিয়ে উঠে পড়তে পারছি না যখন এই মুহূর্তে ওর আমাকেই সব থেকে বেশি প্রয়োজন ৷”

সমস্ত কিছুই আজ এলোমেলো আরিশের কাছে আরুশির চোখ দুটো দেখে…..
আরু ঝটপট করে নিচে গিয়ে খাবারগুলো গরম করে নিল ৷ ফ্রিজ থেকে মাছ আর চিকেনটা বের করে গরম করে নিল তারপর গরম করে রাখা বাটিগুলো ট্রে তে বসিয়ে নিয়ে ঘরের দিকে রওনা দিল ৷ খাবারগুলো সামান্য বেশি করেই নিয়েছে কারন ও নিজেও কিছু খাইনি ৷ অনিকা খান অনেকবার জোর করা সত্বেও ওকে খাইয়ে উঠতে পারেনি , একটাই কথা আরিস না আসলে ও খাবেনা….

রুমের দিকে পা বাড়াতেই মনে পড়লে সিংগারার কথাটা যেটা মামনি সন্ধ্যাবেলা বানিয়েছিল ওর জন্য৷ সারাদিনে কিছু না খাওয়ার পর সিঙ্গারা খেলে এসিডিটি হয়ে যেতে পারে তা জেনেও আরোশী সিঙ্গারা টাও নিয়ে গেল কারণ মামনি অত্যান্ত যত্ন আর ভালোবেসে ওর জন্য বানিয়েছে, না খেলে তাকে অপমান করা হয় ৷ তারাও যেমন ওদের কথা ভাবে তাই আরুর ও কর্তব্য তাদের কথা ভাবা ৷
শাওয়ার শেষে আরিশ দেখল খাটের উপরে ট্রেতে করে অনেক খাবার সাজানো রয়েছে, আর আরুশি বোতল থেকে গ্লাসে জল ঢালছে…..

ভেজা চুল গুলোকে হাত দিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে তোয়ালেটা দিয়ে আর একবার সমস্ত শরীর টা মুছে নিয়ে সোফার ওপরে রাখা শার্ট টা পড়ে নিল….
ধীর পায়ে এগিয়ে আরুশিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আরিশ ৷
অদ্ভুত এক সুগন্ধ ভেসে আসছে আরিশের শরীর থেকে আর যাতে আরু ক্রমাগত পাগল হয়ে যাচ্ছে, মানুষটি সত্যিই ওকে পাগল করে দেয় ৷ এতটা কাছে না আসলেই কি নয় !
যদিও এটা আরিশের ভালোবাসা ৷ দিন শেষে নিজের প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু নিজের করে নিতে ভোলেনা আরিশ ৷ হাজার ব্যস্ততার মাঝেও যে আরুকে ভালোবাসার দায়িত্ব ওর ৷

আরুশি নিজে থেকে আর আরিশকে ছড়ালো না , দিনশেষে এটুকু ভালোবাসা ওর নিজের জন্যও খুব দরকার ৷
__” বিয়ে করবো আবার আরুপাখি, আবার গড়ে তুলব নতুন করে সংসার একরাশ ভালোবাসা দিয়ে ৷”
আরু কোন উত্তর দিল না আরিসের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আরিশ কে বিছানায় বসতে বলল,,,,
আরিশ বিছানায় বসতেই আরু বাটি থেকে একটু তরকারি নিয়ে ভাত মেখে আরিশের মুখের সামনে ধরল ৷
__”নিন হা করুন ৷”
__” তুমি খেয়েছ আরুপাখি?”
__” আমি খেলাম কি না খেলাম সেটা বড় কথা নয়, আমি আপনাকে এখন খেতে বলেছি তো আপনি খাবেন ৷”
আরিশ এবার রেগে গেল ,,,, ধমকের সুরে বলল :

__”তারমানে তুমি খাওনি তাইতো? এতটুকু বোঝেনা যে তুমি আর একা না তোমার সাথে আর একটা প্রান ও বেড়ে উঠছে তাই তুমি কিছু না খেলে তুমি যেমন কষ্ট পাবে সে ও সমানভাবে কষ্ট পাবে , এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি !”
আরুশি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয় ৷
আরিশ তাড়াতাড়ি করে আরুর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল ৷ওর নিজের চোখের কোনেও জল ৷ আজকে দুজনের মনের মাঝেই দীর্ঘ কালো মেঘ ৷
আরুশির কপালে ভালবাসার পরশ একে আরিশ জিজ্ঞাসা করল:
__” কি হয়েছে আরুপাখি কাঁদছো কেন তুমি? তুমি কি জানো না যে তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয় ৷”
আরু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল :

__” আপনি নিজের কখনো কোনো যত্ন নেন না , আপনি নিজেও তো দুপুরে লাঞ্চ করেননি আর আপনি আমাকে বকছেন ৷ সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে দিনশেষে আপনি নিজেই ভালো নেই সেটা কেন মানতে চান না আপনি ? কেন সবাইকে দেখান যে আপনি হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও ভালো আছেন যা আপনি নেই ৷ কি হবে এত কাজ করে ? দিনরাত এক করে সামান্য কিছু টাকার জন্য অফিসে পড়ে থাকার কি খুব দরকার ? আমাদের তো ভালোভাবেই দিনটা চলে যাচ্ছে তাই না ! আর আমার খুব কষ্ট হয় আপনাকে এত স্ট্রাগল করতে দেখে , আমার নিজের ও ভালো লাগেনা ৷”
আরিশ আরুশিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলতে লাগলো ,,,

__’ বুঝেছি আমার বউটা খুব কষ্ট পেয়েছে , আসলে তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয় , আমার সত্যিই কোন কষ্ট হয়না ৷”
আরুশি এবার রেগে গিয়ে বলল ,,,,,,
__” তাই বুঝি ! তাহলে আমিও ভালোবাসা থেকে কিছু অনুভব করলে তাও বুঝি আজকাল মিথ্যে হয়?”
আরিশ এখানেই থেমে গেল, বুঝতে পারছে যে আরুশির সাথে তর্ক করে লাভ নেই তাই আরুশিকে থামানোর জন্য আরশির ঠোঁটে আলতো করে স্পর্শ করে বলল :
__” লেট হবে না কখনো প্রমিস ৷”
__” এটুকুতেই নয়, এটাও বলেন যে ঠিকঠাক নিজের যত্ন নেবেন আর ঠিকঠাক টাইমে লাঞ্চ করবেন ৷”
__” আচ্ছা বাবা সব মেনে চলবো আমি , চলোতো এবার আমাকে খাইয়ে দাও , আমার খুব খিদে পেয়েছে আর পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে ৷”

আরু ফিক করে হেসে দিল আরিশের কথা শুনে, তারপরে আরিশকে সামনে বসিয়ে আরিশকে খাইয়ে দিল,আর তার সাথে নিজেও খেলো….
আরিসের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে আরূ, আর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেনো আজ এক জায়গায় হয়ে ওদের কাছে এসেছে ৷ প্রিয় মানুষটার সাথে একসঙ্গে সুখ অনুভব করা এক অদ্ভুত ভালো লাগা , এভাবে যেন দুজনে শত শত যুগ পার করে দিতে পারে….
আরিশ আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আরুকে বলছে,,,,,

তোমার নেশায় আসক্ত পর্ব ৩৯

__”আরুপাখি আমরা আবার বিয়ে করব ৷ কালকেই আব্বুকে বলবো বিয়ের ডেট ঠিক করার কথা ৷”
আরু চমকে আরিশের দিকে তাকাল,তাকিয়ে বলল :
_”না না তার কোন দরকার নেই এখন আবার নতুন করে কি সব বলছেন পাগল হয়ে গেছেন আপনি?”
আরুশিকে নিচে শুইয়ে দিয়ে আরূশির উপরে উঠে বলল:

__” কেন দরকার নেই হমম ? আলবাত দরকার আছে, তাছাড়া তোমার আমার বিয়েটা ঠিকঠাকভাবে হয়নি তাই আমি চাই আরো বড় করে ধুমধাম করে আমাদের বিয়েটা হোক , তারপরে আমাদের বেবি যখন আসবে তখন তাকেও তো বলতে হবে তাই না যে একবার তা আম্মুকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি আর একবার ভালোবেসে ৷”
আরোশী আরিশের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেল , লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেছে , কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না ৷
লজ্জায় আরুর গাল দুটো চকচক করছে, আরুশির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই আরিশকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে শক্ত করে ৷
ওদের ভালোবাসাটা কত অদ্ভুত তাইনা ! সারা জীবন যেন এভাবেই সুখে থাকে দুজনে ৷

তোমার নেশায় আসক্ত পর্ব ৪১