তোর নেশালো শহরে পর্ব ৬

তোর নেশালো শহরে পর্ব ৬
লেখিকা:ঈশিকা খানম

রাতে খোলামেলা পরিবেশে মৃদু শীতল বাতাস অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। আর সেই পরিবেশ যদি থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতে ভরপুর, গাছপালা আর ফুলে ভরা তাহলে তো কোনো কথাই বাকি থাকেনা। মাঝে মাঝে এই আবহাওয়া শরীরে আজব শিহরণ দিয়ে যাই। আবার রাতে সদ্য ফোটা ফুলে নিজে উষ্ণ স্পর্শে ছুয়ে দেওয়া কতোটা মনোমুগ্ধকর তা যারা অনুভব করেছে তারাই বর্ণনা করতে পারে। এক অদ্ভুত আনন্দ খেলে যায় মনের মধ্যে। সেই আনন্দই আজ উপভোগ করতে পারছি আমি। জীবনের প্রথম এত শান্ত আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করে বুঝতে পারছি মাঝে মাঝে জীবন আমাদের অনেক সুন্দর উপহার দেয় আমাদের।

খালামনিদের বাড়ির বাগানে এখন বসে আছি আমি। এখানের সৌন্দর্য যত শব্দেই বর্ণনা করি না কেন কম পড়বে। রাহিকেও নিয়ে আসতে মন চাইছিল আমার কিন্তু মেয়েটার শরীর ভালো না যা দেখালাম। তাই খুব জলদি ঘুমিয়ে পড়েছে। এরিক বলেছিল তাকে দেখে মেয়েটা নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বলি হারি মেয়েরে বাবা! এরিককে দেখে অজ্ঞান হওয়ার কি আছে। এরিক তো আর কোনো ভূত না। আমার আবার চিন্তা হচ্ছে অন্য বিষয়ে। আজ আমি বারে যাইনি কাজ করতে। একদিন যাইনি এতেই অনেক বকা দিবে আমায়। তারপর খালামনি যদি আমার এই কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তবে আমি কি করব? নাহ কিছু বুঝতে পারছিনা আমি কি করব। আমি বগানে হাটতেই থাকলাম। দূরে একজনের আবছায়া দেখতে পেলাম আমি। কে সে? ভূত নাকি? নাহ এই শহরে ভূত থাকবে কিভাবে? কিন্তু এই সময়ে এখানে কেই বা দাঁড়িয়ে আছে এভাবে? ব্যপারটা দেখতে হবে তো। আমি গিয়ে মানুষটার একদম পিছনে দাড়ালাম। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই সে আমায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতো রাতে এখানে কি করছ মিহি?
বারে ইনি আমায় চিনল কিভাবে? আর এতো এরোনের কন্ঠ। তাহলে এরোনই দাড়িয়ে আছে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। যাক তাহলে একটু নিশ্চিন্ত আমি। এরোনকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। মনে মনে এসব ভাবছি তখন আবার এরোন সেই অবস্থাতেই শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,
কি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি উত্তর দাও না কেন?
এরোনের এই শান্ত গলা আমাকে অনেক ভাবিয়ে তুলছে। দুইদিন হয়েছে তার সাথে আমার পরিচয়। তাও অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু তাকে বিশ্বাস করা যায় এটা বুঝেছি। সে তো এতো শান্ত গলায় কথা বলেনা।
এবার এরোন পিছনে ঘুরলো। আমি তার চোখ মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। এমন মনে হচ্ছে যেন জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমি কৌতুহলবশত প্রশ্ন করেই ফেললাম। আমি বললাম,

একি এরোন আপনার এই অবস্থা কেন?
-এতো রাতে এখানে কি করছ?
-এইতো একটু ঘুরছিলাম। বলেন আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
-এমনি। তুমি আমায় তুমি করে ডাকতে পারো। কারন আমি তোমার খালাতো ভাই হই।
-না আমি এভাবেই কম্ফোর্টেবল।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-হুম।
-রাহি কোথায়?
-ঘুমিয়ে পড়েছে।

-জানো আজ আম্মু অনেক খুশি হয়েছে তোমাকে পেয়ে আর রাহিকে পেয়ে। যখন খালামনির ওফাতের খবর পেয়েছিল তখন অনেক কষ্ট পেয়েছিল আম্মু। অনেক খুজেছে তোমাদের আব্বু আর আম্মু। আর আজ তোমাদের পেল।
-খালু কোথায়?
-ফ্রান্সে, ব্যবসার কাজে।
-ওহ, আপনার কি হয়েছে?
-তুমি বুঝবে না।
-কেন বুঝবে না?
-কারণ তোমার আমার মতো পরিস্থিতি হয়নি। আর আল্লাহ না করুক এমন যাতে তোমার সাথে এমনকি কারো সাথেই কখনো না হয়। ভালোবাসার মানুষ যখন ধোকা দেয় আর মিথ্যে কথা বলে তখন বুকটা ফেটে যায় মিহি।
আমি বুঝতে পারলাম তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষ তাকে ধোকা দিয়েছে। মনে মনে খুব কষ্ট লাগলো তার জন্যে। হায়রে দুনিয়া! প্রকৃত ভালোবাসার কদর এখন আর কেউ করেনা। আসলেই একেক মানুষ একেক দিক দিয়ে অসহায়। আমি এরোনকে বললাম,
শেয়ার করুন, একটু হালকা লাগবে।

-কাকে শেয়ার করব আমি? আর হালকা লেগেই বা কি হবে? আমার ভালোবাসাকে তো আমি ফিরে পাব না।
-যে আপনাকে ধোকা দিয়েছে সে অমানুষের পরিচয় দিয়েছে। আপনি কেন নিজে তাকে ভালোবাসে একজন হীন মানুষকে ভালোবাসে ভালোবাসার মতো পবিত্র একটা জিনিসকে অপমানে করবেন?
-এখানে ভালোবাসাকে অপমানের কি আছে?
-অবশ্যই আছে। যে ভালোবাসার যোগ্য না তাকে ভালোবাসা মানে ভালোবাসাকে অপমান করা। ভালোবাসার অপচয় করা। এতে নিজেও মানুষ নিজেকে ছোট করে।
-সত্যি?
-হুম।

-রিয়াকে তো ভালোবাসি আজ চার বছর ধরে। ও তো বলতো আমায় ভালোবাসে, তাহলে আজ কেন এমন করল?
-কি করেছে সে?
এরোন আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বলল। খুব রাগ হতে লাগলো রিয়ার প্রতি আমার। মানুষ চেয়ে এতো ভালোবাসার মতো মানুষকে পায় না। আর ও টাকা পেয়ে এমন একটা হীরা হারালো। ওর যায়গায় আমি থাকলে এরোনকে কখনোই হারাতে দিতাম না। অনেক ভালোবাসতাম এরোনকে। মানুষ এতো নিচু স্বভাবের হয় কিভাবে? আমি এরোনকে বললাম,
বন্ধু হবেন আমার?
-আমি কেন তোমার বন্ধু হতে যাব? (অবাক হয়ে)
-ইচ্ছে না হলে প্রয়োজন নাই। তবে আমি আপনায় বন্ধু হিসেবে একটা কথা বলি?
-কি কথা?

-আপনি রিয়ার জন্যে নিজে এভাবে থাকবেন না। ওকে দেখিয়ে দিন যে আপনিও পারেন নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে। রিয়াকে না পেলে আপনি মরে যাবেন না, বরং ওর মতো একটা কালনাগিনী আপনার জীবনে না থাকলে আপনি অনেক ভালো থাকবেন এটা ওকে বুঝান। দেখবেন আপনি নিজেও ভালো থাকবেন আর আপনার ওর থেকে প্রতিশোধ নেওয়াও হবে।
-অনেক ভালো পরামর্শ। এবার তুমি যেতে পারো, আমায় একটু একা থাকতে দাও। ( হাত জোড় করে দেখিয়ে বলল এরোন)
-হুহ ভালো মানুষের তো দামই নাই এখন।
-হু নাই তুমি যাও তো।
-যাচ্ছি, আপনার বাড়ি আপনার সব, আমি তো আশ্রিতা, খালামনি রেখেছে বলে সহ্য করছেন। তাই ভালো কিছু বললেও আপনার ভালো লাগবে না।
-এই তুমি যাবে?
এরোনকে আর কিছু বলার সূযোগ দিলাম না আমি। দৌড়ে চলে আসি আমি সেখানে থেকে। দরজা লাগিয়ে আমি বিছানায় চুপটি করে বসে রইলাম। একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালবেলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে এরিক। এটা এরিকের নিত্যদিনের অভ্যাস। সে কফি খেতে খেতে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করে। এরিকের বেলকনি থেকে বাহিরের রাস্তা দেখা যায়। সে প্রতিদিন ব্যস্ত মানুষদের দেখে, তাদের চলাচল দেখে। সে দেখে কেউ কারো জন্যে থেমে থাকেনা। কারো কারো সাথে কথা নেই, সবাই এগিয়ে চলে নিজের মতো। এটাই জীবন, যেটা কারো জন্যে থেমে থাকেনা। আর থেমে যাওয়ার যে ভয়টুকু প্রথমে থাকে সেটা হলো আবেগ। আবেগ আমাদের এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সে তার দৈনিক রুটিন অনুযায়ী আজও তাই করতে বসেছে। সকাল ৬টা ৩০ বাজে এখন।

তোর নেশালো শহরে পর্ব ৫

একটু পর আবার নাস্তার জন্যে নিচে ডাকবে। তারপর আবার ব্যাডমিন্টন প্র‍্যাক্টিস। ব্যস্ত জীবন পার করছে সবাই। হঠাৎ সে তার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে একটা গাড়ি প্রবেশ করতে দেখলো। মূহুর্তে তার ভ্রযুগল কুচকে গেল। সে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলো এই সময়ে তাদের বাড়িতে কে এসেছে তা দেখার জন্যে। গাড়ি এসে থামলো, গাড়ির দরজা খুলে দিল ড্রাইভার। পরমূহূর্তে যে বেরিয়ে আসলো তাকে দেখার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিলো না এরিক। মুখে যে কফিটুকু ছিল তা সে মুখ থেকে ছুড়ে বের করে ফেলল ঘটনার আকস্মিকতায়। আর সেই কফিটুকু গিয়ে পড়লো মালির উপর। মালি চেচিয়ে উঠল। এরিক ভয় পেয়ে গেল। এবার সে নির্ঘাত মায়ের কাছে বকা খাবে। কারণ এমন কাজ আজ প্রথম সে করেনি। মালি উপরে তাকিয়ে এরিককে দেখতে পেল। আর সে জোড়ে চেচিয়ে বলে উঠল,

এরিক বাবা আপনি আবার….
মালি এটা বলার সাথে সাথে সেই ব্যক্তি যে মাত্র গাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে উপরে তাকিয়ে এরিককে দেখতে পেল। তারপর সে বলে উঠল,
এরিক মাই জান!
ব্যস এরিক দিল দৌড় তার ঘরে।

তোর নেশালো শহরে পর্ব ৭