তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ২

তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ২
আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

কবুল বলেই বিয়ের আসর ছেড়ে যে মেয়ের বর চলে যায় তাকে নিশ্চয়ই মানুষ ভালো চোখে দেখবে নাহ!আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতীক্রম হলো নাহ।যদিও বাবার ভয়ে আমাকে কখনোই কেউ কিছু বলতে পারে নাহ।কিন্তু তাও সরাসরি কিছু না বললেও ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমাকেও কিছু কথা না শুনিয়ে ছাড়ানি।

আমিই বোধহয় প্রথম মেয়ে যার শশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য একমাত্র শশুর মশাই ছাড়া আর কেউ নাই।নিজের এই অবস্থানের কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শশুর মশাই এর সাথে গাড়িতে উঠলাম।গাড়ির জানালা দিয়ে আরেকবার বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকালাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাবা ছোটো কাকু কাকিমা অধরা আর কাকুর বড় ছেলে আকাশ ভাইয়া সহ আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে।বাবার সামনে এতোক্ষণ চোখের পানি ধরে রাখলেও এখন আর ধরে রাখতে পারলাম নাহ।টপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি গাল বেয়ে ঝড়ে পরলো।আজ থেকে এই চেনা বাড়িটাই অচেনা হয়ে যাবে। মেয়েদের জীবন টা এমন কেনো যে বাড়িটাতে জন্ম নেয় সেই বাড়িটাকেই পর করে চলে যেতে হয়।

কিছুক্ষণ আগে আমার সেই চেনা বাড়ি ছাড়িয়ে নতুন গন্তব্যের দিকে গাড়িটা ছুটছে শুরু করেছে।এতোক্ষণে বোধহয় আমার চেনা শহর টাও ছাড়িয়ে গিয়েছে।গাড়ি যতো এগোচ্ছে ফারহান আংকেলের মুখে চিন্তার ভাজ ততোই দৃঢ় হচ্ছে।অনেকক্ষণ যাবতই খেয়াল করছি আংকেল আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন হয়তো কোনো সংকোচনের কারণে বলতে পারছেন নাহ।তাই আমিই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“আংকেল কিছু বলবেন?”
“আসলে মা কথা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি নাহ।”
“আংকেল আমি তো আপনার মেয়ের মতোই কোনো সংকোচ ছাড়াই যেকোনো কথা বলতে পারেন।”

“তোমার আর শুভ্রের বিয়েটা তো হঠাৎ করেই হলো। বাড়ির কাউকেই তো কিছু জানানোর সময় পাইনি তার থেকেও বড়ো কথা তোমরা দুজন দুজনকেও ঠিকভাবে চেনো নাহ।আর কিছু নাহ আমার সব থেকে ভয় শুভ্রকে নিয়ে।আসলে ছেলেটা আমার ছোটো থেকেই একটু বদমেজাজি এক রোগা টাইপের।মা তোমাকে একটু ওকে নিজের মতো গুছিয়ে নিতে হবে।আর বাকিসব আমি সামলে নিতে পারবো।তুমি শুধু আমাকে কথা দেও আমার ছেলেটার দায়িত্ব তুমি নিবে যাই হোয়ে যাক ওকে কখনো ছেড়ে যাবে নাহ।”

বাবার বয়সী একটা লোক যদি এমনভাবে হাত জোড় বলে তাহলে কি করে আমি না বলতে পারি।
“আচ্ছা আংকেল এই আপনাকে কথা দিচ্ছি যাই হয়ে যাক আপনার ছেলের হাত আমি কখনো ছাড়বো নাহ। আর উনাকে শুধরনোর দায়িত্বও আমার।”
” বাচালে মা বুকের উপর থেকে অনেক বড়ো ভারী পাথর টা একটু হলেও নামলো।আর তুমি এখনো আমায় আংকেল কেনো বলছো শোনো এখন থেকে বাবা বলে ডাকবে।”

আমি ছোট্ট করে “আচ্ছা” বলে সম্মতি জানাতেই উনি এক গাল হাসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।মানুষ টা সত্যিই অদ্ভুত এই একটুখানি সময়ের মধ্যেই আমায় কতোটা আপন করে নিলো।মানুষ টার মধ্যে আমি আমার বাবার প্রতিছবি দেখতে পাই।এই মানুষ টার মুখ চেয়ে হলেও আমাকে ওই বাড়িতে টিকে থাকতে হবে।হয়তো নতুন কোনো লড়াই অপেক্ষা করে রয়েছে সেখানে আমার জন্য।

ভাবতে ভাবতে যে কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়ালই ছিলো নাহ।শুভ্রের বাবার ডাকে চোখ খুললাম।একটা বিশাল বড়ো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা।বাবা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।আমি তাই দ্রুত বেড়িয়ে আসলাম গাড়ি থেকে।আমাকে নিয়ে বাবা বাড়ির সামনে এসে দরজায় বেল বাজাতেই একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়েছে।মেয়েটা প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে আমাকে দেখেই একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো,

” খালাম্মায়য়য়য়য়া দেইখা যান আমাগো খালু জানে কারে জানি বিয়া কইরা লইয়া আইছে।”
” এক চড় মারবো।বেয়াদব মেয়ে উল্টো পাল্টা কথা বন্ধ হয়ে যাবে।এই মেয়েটাকে দেখে তোর….”
বাবা তো প্রচন্ড রেগে গেছে মেয়েটার কথা শুনে।মেয়েটা মনে হয় এ বাড়িতেই কাজ করে।আমার খুব হাসি পাচ্ছে মেয়েটার কথা শুনে।বাবার ধমক খেয়ে মেয়েটা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।এরমধ্যেই এখানে একজন বয়স্ক মহিলা আর একটা কালো রংয়ের সালোয়ার কামিজ পড়ুয়া মেয়ে এসে পরেছে।ওরা হয়তো শুভ্রের মা আর বোন।ভদ্রমহিলা চোখের চশমা পরতে পরতেই বলে উঠলেন,

” রোকেয়া তোর আজেবাজে বলার অভ্যেস টা এখনো গেলো নাহ?”
“খালাম্মা আমি কিছুই কইতাম নাহ আমনেই খালুজানের পাশে চাইয়া দেহেন।”
এবার উনাদের নজরে আমি পরলাম।আমাকে দেখে সবাই বেশ অবাক হলো।কালো জামা পড়া সেই মেয়েটা একটু আমার কাছে এসে বাবাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা মেয়েটা কে?”
“আরে ও তোর ভাইয়ের বউ।”

“তারমানে এটা আমার ভাবীইইই!তাই তো ভাবি কাল হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি তোমার ওই গুনধর ছেলে বাড়ি ফিরলো কি করে।যাইহোক আমার ভাবী টা কিন্তু খুব সুইট।আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে আমারও ভাবী এসে পরেছে।”
পিছন থেকে গম্ভীর গলায় শাশুড়ী মা বলে উঠলেন,
” মিহি এদিকে আয়।আর এসবের মানে কি?তোমরা তো কাল তোমার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলে।তাহলে এসব কি?”
“তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি আগে মিহি ওকে তোর ঘরে নিয়ে যা তো ওর রেস্টের প্রয়োজন।অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে মেয়েটা।”

“ওকে বাবা” বলেই মিহি নামের মেয়েটা আমাকে ওর নিজের ঘরে নিয়ে গেলো।মিহির কাবাড থেকে হয়তো ওর নিজেরই একটা সালোয়ার কামিজ আমাকে দিয়েছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আর যাইহোক বিয়ের ভারী ভারী শাড়ি গহনা পরে তো আর থাকা যায় নাহ।আমার লাগেজ টা এখনো হয়তো গাড়িতেই।এতো ঝামেলার মধ্যে বাবা হয়তো ভুলো গেছেন ওইটার কথা।যাইহোক ফ্রেশ হয়ে মিহির দেওয়া সালোয়ার কামিজ গুলোই পরে নিলাম।

ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে কাউকেই রুমে দেখতে পেলাম নাহ।একটা অচেনা অজানা জায়গায় তাই এখানে প্রত্যেকটা পা ফেলতেও জড়তা সংকোচ কাজ করে।আমার আবার একটু জার্নি করলেই মাথা ব্যাথা আর শরীর ক্লাস হয়ে পরে প্রচুর ঘুম পায় তখন।এখনও খুব ইচ্ছে করছে একটু ঘুমাতে কিন্তু কে কি ভাববে সেটা ভেবেই ঘুমাতে পারছি নাহ এদিকে আমার চোখের পাতা মেলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে।

” ভাবী তোমার লাগেজ নিয়ে এসেছি দেখো।”
তাকিয়ে দেখি মিহি আমার লাগেজ টানতে টানতে রুমে চলে এসেছে।ওর দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিলাম।মিহি বোধহয় আমার অবস্থা টা বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে ঘুমাতে বললো।ব্যস আর লাগে কি আমার জন্য তো এইটুকুই যথেষ্ট ছিলো।কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি নাহ যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বোধহয় বিকেল।বেশ কয়েকজন লোকজনের কথা বার্তাতেই আমার ঘুম ভেঙ্গেছিলো।

তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ১

মিহির সাথে আরো কয়েকটা মেয়ে এসে আমাকে সাজিয়ে দিলো।আরো কি কি সব আচার আচরণ পালন করলো।সবটাই অচেনা কয়েকজন বয়স্ক মহিলারা করেছে।রাতে আমাকে নিয়ে মিহিসহ আরো কয়েকজন একটা রুমের সামনে নিয়ে গেলো।হয়তো এটা শুভ্রের ঘর। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে দরজা লক ছিলো।অনেক বার ডাকার পরও কেউ দরজা খোলাতে পারেনি। শেষে মিহি গিয়ে বাবাকে ডেকে আনে।
“শুভ্র কি হচ্ছে কি নতুন বউকে ঘরের বাইরে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেনো।এখুনি দরজা খোলো নাহয় কিন্তু ভালো হবে নাহ।”

বাবার কথায় ঠাস করে দরজা খুলে দিলে দিলো।হঠাৎ এভাবে দরজা খোলায় সবাই একটু ভড়কে গিয়েছে।সবাই যে শুভ্রকে বেশ ভয় পায় তা আমার এতোক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে।বাবা আমাকে ভেতরে ঢুকতে বলে চলে গেলেন।বাকিরাও এতোক্ষণে চলে গিয়েছে।আমি ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে ঘরে ঢুকতেই কেউ একজন আমাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে গলা চেপে ধরলো।তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র রক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
” এই মেয়ে তোমার খুব শখ নাহ এই শুভ্রের বউ হওয়ার তাই নাহ?”
” আমাকে প্লীজ ছাড়ুন আমি ব্যথা পাচ্ছি।”

আমার অনুনয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।গলায় খুব জোড়ে ধরাতে গলায় কাশি উঠে গিয়েছে।আমার দিকে পানির গ্লাস টা বাড়িয়ে দিয়েই কিছু নাহ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি শুধু পানি টুকু খেয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।আচ্ছা লোকটা আমার সাথে এমন করছে কেনো।যদি বিয়ে টা নাই করতে চেয়েছে তাহলে কেনো রাজী হলো?তখনই তো না করে দিতে পারতো।আচ্ছা লোকটার কি অন্য কোথাও কারো সাথে কিছু আছে?কিন্তু লোকটাকে দেখে তো মনে হয় মেয়ে জাতির প্রতিই লোকটার এলার্জি।মেয়েদের সহ্যই করতে পারে নাহ।

তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ৩