তোর মায়ায় আবদ্ধ গল্পের লিংক || আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ১
আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

“যেই মহিলা সন্তান জন্মের সাথে সাথেই স্বামী সন্তানকে ফেলে হাটুর বয়সী এক ছেলের সাথে রাতের অন্ধাকারে পালিয়ে যেতে পারে সেই মহিলার মেয়ে হয়ে চরিত্রের এইটুকু নতুনা দেখাবি তা তো জানাই ছিলো।”
ভরা বিয়ের আসরে অভ্রের মুখে এমন কথা শুনে ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে উঠলো।এই মানুষ টাই নাকি আমার চার বছরের ভালোবাসা ছিলো।যার সাথে কিছুক্ষণ পর তিন কবুল পড়ে সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাওয়ার কথা।

পুরো বিয়ে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি এখন শুধুই আমাদের তিনটে মানুষের উপর সীমাবদ্ধ।অভ্র আমি আর যার সাথে পেচিয়ে আমার চরিত্রে কলঙ্কের দাগ লাগানো হচ্ছে।আমার বাবার বন্ধু আর তাঁর ছেলে শুভ্র বাবার আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আমার বিয়েতে অতিথি হিসেবে আসছে।আমি আজকের আগে চিনতামও নাহ লোকটাকে।অথচ সেই লোকটাকে পেচিয়ে আমার চরিত্রে এতো বড়ো কলঙ্কের দাগ লাগানো হচ্ছে। তাও আবার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য।কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে অভ্র জাস্ট একটা সূত্র ধরে বিয়ে টা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছে।বিয়ে বাড়িতে তো এমন কম বেশি ভুল হতেই পারে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বর যাত্রী আসার পর আমার কাজিনরা এসে বললো আমাকে নাকি অভ্র ডাকছে।আমি যে যেতে না চাইলে ওরা আমাকে জোর করেই পাঠায় অভ্র নাকি জরুরি কি বলার জন্য ডেকেছে।তাই একরকম বাধ্য হয়েই আমায় বেরতে হয়েছে।যেই রুমটাতে অভ্রকে রেস্ট নেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিলো সেই রুমটাতে আমি ডুকতেই আমার কাজিন গুলো দুষ্টুমি করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।ওদের বারবার দরজা খোলার কথা বলার পরও ওরা দরজা নাহ খুলেই হাসতে হাসতে পালিয়ে যায় ওখান থেকে।কিন্তু রুমে অভ্র তো দূর কাউকে দেখতে পেলাম নাহ।হয়তো ওরা মজা করেই আমাকে এ-ই রুমে এনে আটকিয়েছে ভাবলেও একটু পর ওয়াশরুম থেকে একজন অচেনা লোককে শার্টের ভেজা হাতা মুছতে মুছতে বেরতে দেখে ভড়কে গেলাম।

লোকটার শার্টের হাতায় হয়তো কিছু ময়লা লেগেছিলো সেটাই ওয়াশ করার জন্যই ওয়াশরুমে ঢুকে ছিলো।লোকটা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।হয়তো আমাকে এখানে আশা করেনি।বলতে গেলে আমরা দুজনেই দুজনকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেছি।কেউ কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে দরজা টা হাট করে খুলে গেলো।অভ্রই দরজা টা খুলেছে কিছু না বলে হঠাৎই আমার কাছে এসে আমাকে একটা চড় বসিয়ে দিলো।আর হাত ধরে টানতে টানতে টানতে করিডরের বড় রুমটাতে এনে সবার সামনে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ওই কথা গুলো বললো।

চার বছরের সম্পর্কে এইটুকু বিশ্বাসও নেই?সামান্য একটা কারণে এতবড় অপবাদ দিবে।আমার মাকে পর্যন্ত টেনে আনলো।হ্যাঁ আমার জন্মের পর সেই রাত থেকেই আমার মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি হারিয়ে গিয়েছে। সবাই মনে করে আমার মায়ের সাথে নাকি নাকি এই পাড়ারই এক ছেলের সম্পর্ক ছিলো সেই ছেলের সাথেই পালিয়ে গিয়েছে।কারণ আমার মা নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন পর ওই ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।কিন্তু আমার বাবা তা বিশ্বাস করে নাহ।আমার বাবার বিশ্বাস মায়ের সাথে সেদিন অন্য কিছু হয়েছে যার জন্য মাকে এভাবে হারিয়ে যেতে হয়েছে।আমার বাবা মা বিয়েটাও প্রেমের বিয়ে ছিলো।খুব ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিলো তাদের মধ্যে। মায়ের সম্পর্কে একটা কথাও সহ্য করতে পারে নাহ বাবা।তাই তো অভ্রের কথায় বাবা চুপ করে থাকতে পারলো নাহ।

” অভ্র তোমার সাহস হলো কি করে আলমুনের মাকে নিয়ে এরকম বলার আর ওকেই বা এভাবে এখানে ছুঁড়ে ফেলার সাহস পেলে কি করে?”
অভ্রের মুখে মুহূর্তেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।বাবার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো,
” সেটা নিজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন।মা ভেগেছে মেয়ে জন্মের পর আর মেয়ে বিয়ের আগেই অন্য ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি শুরু করে দিয়েছে।জানি নাহ আর কয়জনের সাথে এমন করেছে।”

” অভ্র!! তুমি না জেনেই আমার স্ত্রী আমার মেয়ের নামে এতো গুলো মানুষের সামনে যা নয় তাই বলছো!তোমার মতো নোংরা মস্তিষ্কের একটা ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে যাচ্ছিলাম ভাবতেই তো ঘৃণা লাগছে।”
” ও হ্যালো আংকেল আমিও নাহ আপনার এই ফুলের মতো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য বসে নেই।এইরকম চরিত্রহীন মেয়েকে জীবনে কেউ বিয়ে করতে চায় নাকি! যেই মেয়ে বিয়ের আসরে আসার আগে অন্য ছেলের সাথে (শুভ্রের দিকে তাকিয়ে)এক ঘরে থাকতে পারে সেই মেয়ে আমার বাড়ির কাজের মেয়ে হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না।”
“এই ছেলে তুমি এখুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও……”

এইটুকু বলেই বুকে দুই হাত চেপে ধরে সোফার উপর পরে যাচ্ছিলো ছোটো চাচ্চু পাশে ছিলো বিধায় সাথে সাথেই ধরে ফেলছে।অভ্রের সাথে বর যাত্রী হিসেবে যারা এসেছিলো এতোক্ষণে অভ্রের সাথে সবাই চলে গেছে।বাবার অবস্থা এখন তেমন ভালো নাহ ডাক্তার ডেকে আনা হইছে। বাবাকে চেক করে বলেছে মিনি হার্ট অ্যাটাক হইছে।তবে অবস্থা বেশি ভালো কড়া কথা যেনো বাবাকে না বলা হয় তাহলে মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে বিয়ে বাড়ির জমজমাট হইচইয়ে ভরপুর ছিলো সেখানেই এখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।কারো মুখে কোনো কথা নেই।নীরবতা ভেঙ্গে শুভ্রের বাবা ফারহান রহমান বলে উঠলেন,

“আচ্ছা মা আলমুন এবার বলো তো আসলে কি হয়েছে?ওই ছেলেটা এমন কেনো করলো?আমি জানি মা তুমি নির্দোষ কি হয়েছে নির্ভয়ে সবটা খুলে বলো আমাদের।”
আমি কি বলবো আমি তো নিজেই পুরো ঘটনাটা তেমন ভাবে বুঝে ওঠতে পারিনি এখনো।আমার অস্বস্তি দেখে আমার কাজিনদের মধ্যে ছোটো চাচ্চুর মেয়ে অধরা বলে সবটা।ওর ভাষ্যমতে, অভ্র আর আমাকে দেখা করানোর জন্য ওরা একটা প্লান করেছিলো।প্রথমে অভ্রের কাছে গিয়ে বলে আমি অভ্রকে ডাকছি অভ্রকে ওরা ওই রেস্ট রুম টায় যেতে বলে তারপর ওরা আমার কাছে আসে। ওদের ধারণা ছিলো অভ্র এতোক্ষণে ওই রুমে এসে পরছে কারণ বেশ কিছুক্ষণ আগেই ওরা অভ্রকে আসতে বলেছিলো।সেই অনুযায়ী ওরা আমাকে ওই রুমে ঢুকিয়ে দিয়েই দরজা বন্ধ করে চলে যায়।কিন্তু ভুলবস অভ্রের জায়গায় শুভ্র সেই রুমের ওয়াশ রুমে ছিলো। অভ্র কোনো কারণে পরে আসে।আর আমাকে আর আলোক কে এক ঘরে একসাথে দেখেই ভুল বোঝে।

সবটা শুনে সবাই আবারো নিশ্চুপ। কি বা বলার আছে বিয়ে বাড়িতে এমন ধরনের অনেক মজা সচরাচর হয়েই থাকে।তবে এবারও শুভ্রের বাবা ফারহান রহমান নিরবতা ভেঙ্গে হঠাৎই বলে উঠলেন তাঁর ছেলের জন্যই যখন এতো বড়ো ভুলবোঝাবুঝি টা হয়েছে তাই সেটা তাঁর ছেলেকে দিয়ে শুধরে নিতে চান।মানে তাঁর ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চান।বাবা কথাটা শুনেই ছলছল চোখে বলে উঠলেন,

” সত্যি বলছিস?”
ফারহান রহমান পুনরায় সম্মতি জানাতেই বাবা একপ্রকার কেঁদেই ওঠলেন।কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে শুভ্রের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” তোকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমার জানা নেই।”
” আরে ধন্যবাদ কিসের বিপদের দিনে বন্ধু হয়ে যদি বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে না পারি তাহলে কিসের বন্ধু আর তোর মেয়েকে আমার এমনিতেই খুব পছন্দ এমন একটা লক্ষী মন্ত বউই তো আমার ছেলের জন্য দরকার।”
এতোক্ষণ শুভ্র এখানে উপস্থিত ছিলো নাহ ফোনে একটা কল এসেছিলো তাই একটু দূরে গিয়ে ফোনে কথা বলছিলো যার জন্য মাঝখানের কোনো কথাই জানে না কথা বলা শেষ করে যখন এখানে আসতে তখন নিজের বাবার শেষ কথা গুলো শুনতে পায়।আর শুনেই রেগে বলে উঠলেন,

” হোয়াইট? ড্যাড এসব কি বলছো?আমার বউ মানে?”
শুভ্ররের সাথে একটু আলাদা কথা বলবেন বলে আংকেল একটু দূরে গিয়ে কি কি জেনো বললেন জানি নাহ একটু পরেই আংকেল এসে বাবাকে বললো তাঁর ছেলেও নাকি রাজী এখন শুধু আমি রাজী হলেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে।ছোটো কাকু আর কাকিমা আমার কাছে এসে আমাকে বুঝাতে লাগলো। বাবা এই বিয়েটাতে খুব খুশী আর বাবার অবস্থাও তেমন ভালো নাহ।

আমি আমার মাকে কখনো দেখিনি কিন্তু তাই বলে মায়ের অভাবও তেমন একটা বুঝতে দেয়নি কখনো বাবা ।নিজের সর্বস্ব দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছে সব সময়।আমি আমার বাবার খুশীটাকে কেঁড়ে নিতে চাই নাহ।আমি চাই নাহ আমার জন্য বাবার কিছু একটা হয়ে যাক। আর কার জন্য অপেক্ষা করবো যে কিনা চারবছরের সম্পর্ক সামান্য এক ঠুনকো কারণে এভাবে ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো তার জন্য? অভ্রের কথা গুলো বারবার কানে বাজছে।
অভ্রের প্রতি অভিমান আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও সম্মতি দিয়ে দেই।আমার সম্মতি পেতেই বিয়ের কাজ শুরু হয়ে যায়।যেই আসরে অভ্রের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সেই আসরেই আমি এখন অন্য কারো জন্য কবুল বলেছি।

আমার কবুল বলার পর শুভ্রকে কবুল বলতে বলা হলে শুভ্র কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে এক নিশ্বাস তিনবার কবুল শব্দ টা উচ্চারণ করেই বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে হনহনিয়ে বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যায়।অভ্রের বাবা কয়েকবার পিছন থেকেও ডেকেও ছেলেকে আটকাতে না পেরে হতাশ হলেন।এই বিয়েতে তবে কি শুভ্র রাজী ছিলো নাহ?শুধুমাত্র বাবার কথায় বিয়েটা করেছেন।কি হচ্ছে আমার সাথে এসব?আমি তো জানিও নাহ লোকটা কেমন কোন অন্ধকার জীবনে পা দিয়ে ফেললাম না জেনে?

তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ২