তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪১+৪২

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪১+৪২
শান্তনা আক্তার

রাতে নিজের আর আহসানের ব্যাগপত্র গুছাচ্ছে রিমি। যদিও পরশুদিন ওরা সাজেকের উদ্দেশ্যে বের হবে, তবুও রিমি এখন থেকেই জোগাড় শুরু করে দিয়েছে। রিমির অনেক দিনের শখ সাজেক ভ্রমণ। একদিকে সাজেক যাওয়া নিয়ে আনন্দ-উল্লাস, অন্যদিকে জিসান ও তিয়াসার মুখোমুখি সংঘর্ষের দৃশ্য চিন্তা করে ভয় পাচ্ছে। রিমির ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

সে মনে মনে ভেবে নিয়েছিল যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠান উপলক্ষে জিসান যদি এই বাড়িতে আসে, তাহলে তিয়াসাকে রিমি এই বাড়িতে আগেভাগে আসতে মানা করে দেবে। কারণ রিমি চায়না তিয়াসাকে দেখে জিসানের মনে তিয়াসার প্রতি জন্ম নেওয়া অনুভূতিগুলো নাড়া দিয়ে উঠুক। তবে যেটার ভয় সেটাই হতে চলেছে। আসল কথা যা হওয়ার তা হয়েই ছাড়বে। ঠেকানোর সাধ্যি কারো নেই সৃষ্টিকর্তা ছাড়া। রিমির মাথায় সহসা একটা বুদ্ধি ভর করলো। তিয়াসাকে নিষেধ করবে ওদের সাথে যাওয়ার জন্য। এই ভেবে ফোন দিল বাড়ির নাম্বারে। রিমির মা আম্বিয়া ধরেছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘হ্যালো কে?’
‘মা আমি বলছি, রিমি। কেমন আছো?’
‘এক কথা একদিনে আর কত জিজ্ঞেস করবি মা? আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’
‘আচ্ছা মা তিয়াসাকে একটু ফোনটা দাওতো। ও কি করছে?’
‘কি করবে আবার? তোদের সাথে ঘুরতে যাবে জানা মাত্র কি নেবে না নেবে সেই লিস্ট করতে বসেছিল সেই কখন থেকে। মনে হচ্ছে ব্যাগ গোছানোও শেষ।’
‘মানে! আমাদের সাথে যাবে! কোথায় যাবে?’

‘বলল তো সাজেক। তোরা দুইবোন কতবার বলেছিস নিয়ে যাওয়ার জন্য। বায়না করে আমার আর তোর বাবার মাথা খেয়ে ফেলতিস। এখন গিয়ে তোদের বোনেদের কলিজা ঠান্ডা হবে।’
‘আম্মু তুমি একটু থামবে! তিয়াসা কিভাবে জানতে পারলো সাজেকের ব্যাপারটা?’
‘জামাই বলেছে। কিন্তু তুই এত রেগে কথা বলছিস কেন? কিছু সমস্যা হয়েছে ওই বাড়িতে?’
‘না, তুমি তিয়াসার কাছে ফোন নিয়ে দাও। ওর সাথে কথা বলব আমি।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি। তুই লাইনে থাকিস।’

রিমির রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। আহসানকে সামনে পেলে যেন মাথা চিবিয়ে খেত এখন। লাইনের ওপাশে আম্বিয়া আছে বলে রাগটা দাঁতের উপর দিয়েই চালাতে হচ্ছে রিমিকে। রিমির ভাবনার মাঝেই তিয়াসার বাজখাঁই কন্ঠ কানে এলো।
‘ওই আপু! তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?’
রিমি গলা পরিষ্কার করে বলল,
‘হ্যাঁ বল।’
‘তুই বল কি বলবি আমায়? আই গেস, নিশ্চয়ই সাজেক যাওয়া নিয়ে?’
‘হুম তাই বলব।’ গম্ভীর কণ্ঠে।

‘আপু তুই জানিস না আমি কত খুশি। কত ইচ্ছে সেখানে যাওয়ার। তোর ওতো। অনেক মজা হবে বল? অল ক্রেডিট গোস টু ভাইয়া। আমার মুডটাই ভালো করে দিল আজ।’
তিয়াসার উৎসাহের পরিমাণ টের পেয়ে রিমির গলা শুকিয়ে গেল। দোটানায় পড়ে গেল যেন। ছোট বোনের খুশিটায় পানি ঢালতে ইচ্ছে হলো না ওর। সাহসে কুলাচ্ছে না রিমির। এইজন্য অন্য কোনো উপায় খুঁজছে। যাতে কৌশলে তিয়াসাকে মানানো যায়।
‘কিরে আপু? তুই কি সাইলেন্ট মোডে থাকবি নাকি?’

‘আসলে তিসু, আমি আর আহসান ছাড়াও সেখানে জিসান আর জান্নাতও যাচ্ছে। তুইতো জিসানকে সহ্য করতে পারিস না। তাই আমি চিন্তিত। ও যদি তোকে বিরক্ত করে?’
‘করবে না আপু।’ সোজাসাপ্টা বলে ওঠে তিয়াসা।
‘করবে না মানে? তুই এত কনফিডেন্সের সাথে কিভাবে বলতে পারলি?’
‘আসলে আজ আমি আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড টয়া,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,’ তিয়াসা আজকের সব ঘটনা খুলে বলল রিমিকে।

‘কি সাংঘাতিক! তেমন বেশি ক্ষতি হয়নি তো মেয়েটার?’
‘ব্যথা তো ভালো মতোই পেয়েছে। তবে কাটা ছেঁড়া হয়নি। রাস্তায় পড়ে যা একটু ছিলে গিয়েছে হাত পা। যাই হোক, জিসানের কাজে আমি তো পুরোই অবাক। এমন ভাব করলো যে আমাকে চেনেই না।’
‘খুব ভালো কথা। জান্নাত তাহলে জিসানের মন থেকে তোকে সরাতে পেরেছে। আমি খুব খুশি হলাম শুনে।’

‘হয়তো, আমি জানি না আপু। আমার জানার ইচ্ছেও নেই। তাহলে এখন কি আমি তোদের সাথে যেতে পারি?’
‘অবশ্যই। এখন আমার কোনো চিন্তা নেই। ভয় কেটে গেছে। তুই সব গুছিয়ে রাখিস। আমাকে ছাড়া কিছুই তো পারিস না। কিছু দরকার পড়লে আম্মুর সাহায্য নিস। তাও মাথা গরম করে থাকিস না। কিছু খুঁজে না পেলেই রুদ্রাণী রূপ ধারণ করে ফেলিস সাথে মুখ ফুলিয়েও থাকিস।’
‘আমি এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি আপু। অনেক গোছালো আর বোধবুদ্ধিও হয়েছে আমার।’
‘আচ্ছা মানলাম।’

‘গুড, তো ভার্সিটি কবে থেকে যাচ্ছিস তুই? পড়াশোনা কি বাদ দিয়ে দিবি আপু?’
‘আরে না। গ্রেজুয়েশনের আছেই তো আর কটা মাস। আমি বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করছি। এখন কিভাবে যাব ভার্সিটি? আমি স্যারের থেকে ছুটি নিয়েছি। তাছাড়া পরীক্ষার জন্য কয়েকমাস হাতে আছে। আমরা সাজেক থেকে আসার পরই আমি আবারও নিয়মিত ভার্সিটি যাব ইনশাআল্লাহ। পড়াশোনা না করলে চোখ থাকলেও অন্ধ হয়ে থাকতে হয়। যেভাবেই হোক গাফিলতি জিনিসটা এড়িয়ে চলবি সবসময়। বুঝলি?’

‘আমি জানি আপু। তুই আমাকে না বোঝালেও আমি জানি সেটা।’
‘জানলেই ভালো। আচ্ছা রাখি এখন। টাটা তিসু।’
তিয়াসা কিছু সময় চিন্তায় মজে গেল। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। কিছুক্ষণ পর চোখের পলক ফেলে বলল,

‘আসলেই কি জিসান আমাকে ভুলে গেছে! নাকি তার আমার করা অপমানটা গায়ে লেগেছে? তবে আমাকে দেখেও না দেখার অভিনয়টা ভালো লাগেনি আমার কাছে। কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে। জিসান কি সরাসরি আমাকে ইগনোর করলো? নাকি আমি ফিরিয়ে দিয়েছি বলে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ধুর, সে যাই করুক তাতে আমার কি? প্রফুল্ল মনটার বারোটা বেজে গেল যেন। আর ভাববো না এই টপিক নিয়ে। শুধু শুধু সময় নষ্ট। আমি জাস্ট গোনায় ধরি না ওই জিসানকে হুহ!’

‘তুমি আজই সব কিছু গুছিয়ে ফেলেছো?’
আহসানের প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে নিজ কাজেই মনযোগী হয় রিমি। আহসান রিমির থেকে প্রতুত্তর না পেয়ে রিমির কাজ বন্ধ করে এক হাত ধরে বসে রিমির। রিমি তার অক্ষিযুগল রাগে ডুবিয়ে বলে, ‘আজ করে রাখলে অসুবিধা তোমার?’

‘না তোমার ইচ্ছে। আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’
‘চুপচাপ বসে নিজের কাজ করো। আমি কি তোমার কাজে বাঁধা দেই?’
‘এত রাগ? আচ্ছা স্যরি। কাজ শেষ হলে একটু কথা বলবে আমার সাথে?’
‘কি বলবে বলো আমি শুনছি। আমার কাজ শেষ হবে না সহজে।’
‘আসলে আমাকে একটা জিনিস বেশ ভাবাচ্ছে জানো?’

‘কি জিনিস?’
‘আমি স্রুতির শর্তে রাজী কেন হলাম?’
‘এই প্রশ্ন?’
‘আমি আমার বউকে ছোঁবো না ছোঁবো সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। জান্নাত আর জিসানের বিষয় টা সম্পূর্ণ আলাদা। বুঝলাম না আমি কি ভেবে রাজী হলাম। আমার কাছে শর্তটা অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে। তুমি কি বলো?’

রিমি মৃদু হেসে বলল, ‘আজ বুঝলে? আমি তো প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে আমি স্রুতির থেকেও তোমার উপর বেশি রেগে গিয়েছিলাম সেদিন। খুব রাগ হচ্ছিলো তোমার উপর। এত বোকা কিভাবে হলে তুমি? তবে মনে হলো বোনের জন্য হয়তো কিছু না ভেবেই রাজী হয়ে গিয়েছিলে। এইজন্য রাগটাকে গুরুত্ব দেইনি।’

‘এটা ঠিক। আসলে জান্নাত যেই ভয়ংকর কাজটা করেছিল, আমি তো কয়দিন খুব ভয়েই ছিলাম। মনে করতে চাইনা সেসব। আমি চাই আমার বোন ভালো থাকুক। ওর ভালো থাকার মধ্যে কেউ আসলে আমি তাকে ছেড়ে কথা বলবো না। সে যেই হোক না কেন, আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করবো না। তবে আমি যেটা বলতে চাই তোমায় সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো।’
‘কি? বলো।’

আহসান আচমকাই রিমির হাত ধরে টেনে ওর কোলে বসিয়ে দিল। রিমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিমির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘কয়দিন এই অপ্রাসঙ্গিক শর্তটাকে ভুলে গেলে কি খুব ক্ষতি হবে? শুধু একটা সপ্তাহ মাত্র।’
রিমি চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘একদমই না। ভুল তুমি করেছো। সবকিছু বুঝে শুনে করতে হয়। না ভেবে ভুল করলে সাফার তো করবেই।’

‘এভাবে কেন বলছো? স্রুতি তো সেখানে থাকবে না। আমরা কিছু সময় নিজেদের মতো কাটাবো।’
‘ভেবে দেখা যাবে। তবে একটা কাজ করলে আমরা ৩ মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই জিতে যাব।’
‘সত্যি! কি সেটা?’

‘আমি আর তুমি মিলে জিসান আর জান্নাতকে কাছাকাছি নিয়ে যাব। দুজনের যুগলবন্দী পরিকল্পনায় যদি ওরা একে অপরের কাছাকাছি যায় তাহলে সব সমস্যা সলভ।’
‘চমৎকার, দুর্দান্ত আইডিয়া। তুমি এত বুদ্ধি কোথায় রাখো হুম?’
‘তোমাকে ধার দেব? না তুমি শুধু পেসেন্ট নিয়েই থাকো। আমার মতো গোয়েন্দা মাথার অধিকারী হতে হবে না।’

‘লাগবে না আমার। তুমি আমার পাশে থাকলেই হলো। আমি তোমাকে সবসময় আগলে রাখবো রিমি। আমরণ পর্যন্ত আমার থেকে আলাদা হতে দেব না। কিন্তু তুমি আমাকে কখনো ঠকাবে না। আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করবে।’

‘আমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখো শুধু। আমি তোমার ক্ষতি হয় এমন কিছুই করবো না। তোমার কেন, আমি কারোর ক্ষতি হয় এমন কিছু কখনোই করবো না। ভুলকে প্রশ্রয় দেব না। তোমার পরিবারের সবাই আমার নিজের লোকজন। তাদের জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো।’
‘শুধু আমি ছাড়া তাইনা?’ অভিমানী গলায় বলল আহসান।

রিমি রেগেমেগে আহসানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর জোর গলায় বলল, ‘তুমিও না? তুমি তো আমার শক্তি, মনোবল। তোমাকে আরও বেশি আগলে রাখবো। একেবারে আঁচলে বেঁধে। কাউকে দেব না তোমায়।’
‘তাই? আমার কিন্তু প্রমাণ চাই। দেখতে চাই তুমি আমাকে কিভাবে আঁচলে বেঁধে রাখো।’
‘সঠিক সময় আসুক। দেখতে পাবে।’

আহসান রিমি ও তিয়াসাকে নিয়ে পেছনের সিটে বসা। ড্রাইভার নিয়ে নিয়েছে। কারণ ঢাকা থেকে সাজেক যেতে প্রায় ৬-৭ ঘন্টা লেগে যাবে। এত লং জার্নি বলে আহসান গাড়ি চালাবে না। তিয়াসা জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ উত্তেজিত। রিমি আহসান ও তিয়াসার মাঝে বসা। কানে হেডফোন গুজে গান শুনতে ব্যস্ত রিমি। আহসানের কাছে নীরব পরিবেশটা একদম দমবন্ধের মতো ঠেকছে। তাই নীরবতা ভাঙতে বলল,

‘তোমরা কি যার যার মতো চুপচাপ থাকার জন্য সাজেক যাচ্ছো, নাকি ফান করার জন্য?’
রিমি চোখ বন্ধ করে গান শুনছে তাই আহসানের আওয়াজ ওর কানকে ছোঁয়নি। তবে তিয়াসা শুনেছে।
‘কেন ভাইয়া?’ প্রশ্ন করল তিয়াসা।
‘কেউ কিছু বলছো না। আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে। তোমার বোনতো কত লাফালাফি করছিল গাড়িতে চড়া অবধি, এখন দেখো ঘুমিয়ে নেতিয়ে পড়েছে।’

‘স্যরি ভাইয়া। আসলে আপু জার্নির সময় গান শুনতে ভালবাসে। তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারো।’
‘কি আর বলব? আচ্ছা তোমার মুড এখন কেমন তাই বলো।’
‘সত্যি বলতে গতকাল আমার মুড একদমই ভালো ছিলনা। তবে তুমি যখন ফোন দিয়ে সাজেক যাওয়ার কথা জানালে, তখন খুশিতে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা ছিল আমার। আবারও থ্যাংকস ভাইয়া।’
‘তুমি তো তোমার মুড সুইং এর কারণ বলতে চাওনা। তবে তুমি যে এখন বেশ খুশি, তা জেনে আমিও খুশি হলাম। আশা করছি আমাদের সাজেক ট্যুর বেশ আনন্দের সাথে কাটবে।’

‘সে আর বলতে! আমি তো ব্যাকুল হয়ে আছি নিজের চোখ দিয়ে সাজেকের অপরূপ সৌন্দর্য্যের ভিতর ঢুকে যাওয়ার জন্য।’
‘তোমাদের দুইবোনের এক্সাইটমেন্ট দেখে আমিও এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছি। আমরা সুস্থ ভাবে গিয়ে পৌঁছালে হয় এখন।’
‘ঠিক বলেছো ভাইয়া। আচ্ছা ভাইয়া আপু বলল জান্নাত আপু আর তার হাসবেন্ডও নাকি আমাদের সাথে যাচ্ছে!’

‘হ্যাঁ, আসলে আমরা চারজন মূলত হানিমুনের উদ্দেশ্য সেখানে যাচ্ছি।’
‘হানিমুনে যাচ্ছো যখন, আমাকে নেওয়ার কি দরকার ছিল?’
‘হানিমুনে শুধু কপোত-কপোতী যাবে, এটা কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে বলে আমার মনে হয়না। তাছাড়া তুমি তো আমার বোনের মতো। তোমার মুড ভালো করার জন্যই তোমাকে নিয়ে যাওয়া।’
‘তুমি আসলেই খুব ভালো। তো তোমার বোনেরা আমাদের সাথে এলো না কেন? তারা কি আলাদা যাচ্ছে?’

‘না আমরা একই রিসোর্টে রুম নিয়েছি। তবে ওরা সরাসরি সাজেক গিয়ে নামবে। শুধু শুধু আমাদের এখানে এসে সময় নষ্ট করার মানেই হয়না।’
‘তাও ঠিক। আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কোন রিসোর্ট বুক করেছো?’
‘রুন্ময় রিসোর্ট। ওই রিসোর্টের ম্যানেজার আমার এক কাজিন। তাই গাইডলাইন পাওয়া যাবে।বিচার-বিবেচনা করে সবকিছু দাদিয়াই ঠিক করেছে নিজ দায়িত্বে।’

‘রুন্ময় রিসোর্স জাস্ট ওয়াও! রিসোর্ট তো বড় কিছু নয়। বাহিরের দৃশ্য, দর্শনীয় স্থানই আসল। আপুর ফ্রেন্ডরা গিয়েছে সেখানে। আমার কিছু ফ্রেন্ডরাও গিয়েছে, তবে ঝাড়ভোজ রিসোর্টে বুকিং করেছিল তারা। এই রিসোর্টটাও ভালো। রুন্ময় আরও ভালো। তবে এক্সপেন্সিভ। ওইখান থেকে হেলিপ্যাড খুব কাছে। রুন্ময় রিসোর্ট ও ঝাড়ভোজ রিসোর্ট হেলিপ্যাডের দুই প্রান্ত জুড়ে আছে।’

‘শুনেছি তোমার আপুর থেকে। এখন গেলে বোঝা যাবে। তোমার বোন নাকি সব চেনে। আর আমি যাতে হারিয়ে না যাই, তাই সবসময় আমার সাথে সাথে থাকবে। বলোতো, আমি কি তোমাদের মতো বাচ্চা যে হারিয়ে যাব?’
তিয়াসা নাক ফুলিয়ে বলে,
‘আপু বাচ্চা হতে পারে, কিন্তু আমি না ওকে? তুমি আমাকে কেন বাচ্চার সাথে তুলনা করলে?’
‘আচ্ছা স্যরি। ভুল হয়েছে আমার।’

এরই মাঝে রিমি ওর মাথা আহসানের কাঁধে নিয়ে ঠেকালো। অর্থাৎ ভর দিল। ঠিক তখন তিয়াসা ফিক করে হেসে বলে,
‘তুমি আজ ফেঁসে গেলে ভাইয়া। এখন সাজেক গিয়েই ঘাড় নড়াতে পারবে। তার আগে আপুর ঘুম ভাঙলে ভালো। বাঁচার চান্স পাবে।’
আহসান আশ্চর্যান্বিত মুখে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন বলোতো?’

‘কারণ আপু সবসময় এমনই করে। যখন গ্রামে যাই, সারা পথ আমার কাঁধে মাথা রাখাবে। ঠেলে সরালেও একই কাজ। বিরক্ত লাগতো শুধু। শুধু প্রে করতাম তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর।’
‘কিন্ত আমার বিরক্ত লাগবে না একটুও। আমার বউ যদি আরামে ঘুমোতে পারে, তাহলে আমারই শান্তি।’ এই বলে রিমির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো আহসান।

সাজেক যাত্রা পথের আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিঁচু পাহাড়ি রাস্তার সাথে চারিদিকে সীমাহীন সবুজের সমারোহ মাখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইতিমধ্যে মন কেড়ে নিয়েছে রিমি ও তিয়াসার। রিসোর্টের প্রায় কাছাকাছি চলে আসায় আহসান রিমিকে আস্তে করে ডাক দিতেই রিমি জেগে যায়। আর চারিপাশের দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে ভাললাগার কিছু অনুভূতির জাগরণ করতে লাগে। তবে এসবের থেকেও আহসানের কাছে রিমির হাস্যজ্বল মুখটাই সর্ব সুন্দর মনে হচ্ছে। তাইতো আহসান বাহিরের সৌন্দর্যে সময় নষ্ট না করে প্রিয়তমার হাসিতেই চোখ দুটো আবদ্ধ করতে ব্যস্ত।

পৌঁছে গেল রুন্ময় রিসোর্ট। তখন একেবারে সন্ধ্যা প্রায়। আযান পড়বে পড়বে। আহসানদের স্বাগতম জানালো রুন্ময় রিসোর্টের ম্যানেজার রেজওয়ান। রেজওয়ান রঞ্জিতের খালাতো ভাইয়ের ছেলে। সেই বুবাধে আহসান রেজওয়ানের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছে। ম্যানেজার হিসেবে না। তার কিছুক্ষণ পরই জিসান আর জান্নাতের গাড়ি চলে আসে।

তারপর সকলে একেবারে ফ্রেশ হয়েই একত্রিত হয়। প্রথমত জিসান আর জান্নাত তিয়াসা যে এখানে এসেছে তা জানে না। দ্বিতীয়ত রেজওয়ানের সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাবে সেটাও ভাবতে পারেনি। তবে এটা জান্নাতের কাছে সারপ্রাইজিং। কারণ জিসান আগে থেকেই জানতো এটা। তবে জান্নাত জানতো না।রেজওয়ান আর জিসানের গলায় গলায় ভাব সবসময় ছোট থেকে। দুজন সমবয়সী।

তিয়াসাকে চোখের সামনে দেখে জিসান যতটা না অবাক হয়েছে, তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে জান্নাত। সাথে খারাপও লাগছে ওর। কারণটা আসলেই খুবই ন্যাচরাল। কোনো স্ত্রী যদি তার হাসবেন্ডের প্রেমিকাকে সামনে দেখে তাও আবার হাসবেন্ডের উপস্থিতিতে, তাহলে সেই স্ত্রীর খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক নয় কি? অনুরূপভাবে এটাকে হিংসা বা জেলাসিংও বলা যায়।

এমনিতেই জিসান দুদিন ধরে পাল্টে গিয়েছে। আগের মতো হয়ে গিয়েছে। দুদিন আগে জান্নাতকে খুব কেয়ার করতো। কিন্তু গতকাল থেকে সেই আগের মতোই খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। জান্নাত খাবার নিয়ে বসে ছিল জিসান খাইয়ে দেবে বলে। কিন্তু জিসান খাইয়ে দেয়নি। জিসান বলেছিল, ‘এখন তুই সুস্থ হয়ে গিয়েছিস। তাই আর ন্যাকামো করতে পারলাম না।’

এই কথাটায় জান্নাতের মন আবার ভেঙে গেল। এমনকি জিসান সাজেক আসতেও চায়নি। খুব খিটখিটে মেজাজ প্রকাশ করেছে সাজেক আসার কথা শুনে। তবে আসতে তো হলোই। আফটার অল, মুনতাহার সিদ্ধান্ত বলে কথা। যা না মানা কেলেংকারী ব্যাপারের অন্তর্ভুক্ত। তাই আসতে বাধ্য হলো জিসান। তবে তিয়াসাকে দেখে জিসানের সত্যি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে।

ভালবাসার মানুষকে সামনে পেয়েও সে তার সাথে কথা বলতে পারবে না, এই কারণটার জন্যই জিসান ভেতরে ভেতরে খুব ডিপ্রেসড। শুধুমাত্র জিসানকে তিয়াসার বলা অসভ্য মায়ের সন্তান কথাটার জন্য আজ জিসান তিয়াসাকে ইগনোর করতে বাধ্য হচ্ছে। সেটাও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে। জিসান তার মাকে সম্মান করে বলে আজ এই বাধ্য পরিবর্তনের শিকার। তবে ভেতরে ভেতরে তিয়াসার জন্য তার মনে অগাধ ভালবাসা পোষা। যতই হোক প্রথম ভালবাসা বলে কথা।

সাজেক ভ্যালিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। তবে রিসোর্টগুলোতে সোলার প্যানেল রয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটর চালু থাকে। সেক্ষেত্রে রাতে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করা বিপদজনক। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা। বিদুৎ না থাকায় চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এইজন্য রিসোর্টের ছাদে সকলের আড্ডার জন্য ক্যান্ডেল লাইট আয়োজন করা হয়েছে। এটা শুধু আহসানদের জন্যই। রেজওয়ান নিজ দায়িত্বে সব আয়োজন করেছে। বসেছে ভাই বোনেদের মেলা। তিয়াসা আর রিমিই শুধু চুপচাপ। রিমি যদিও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। যেহেতু সে আহসানের ওয়াইফ, সেহেতু সে আড্ডার নতুন আকর্ষণ। তবে তিয়াসা একেবারেই বোবা হয়ে আছে। এক পর্যায়ে রেজওয়ান আহসানকে জিজ্ঞেস করে বসে,

‘কিরে আহসান, তোর বেয়ান সাহেবা কোথায়?’
রিমি আর তিয়াসা যেন থতমত খেয়ে গেল শুনে। ওরা দুজন ছাড়া বাকিরা নরমালই আছে।
আহসান বলল, ‘ভাই তুই থাম। এখানকার প্লেস নিয়ে কথা বল। ওসব অন্যদিন হবে।’
‘কেন? ওনাকে থামতে বলছো কেন তুমি? রেজওয়ান তুমি বলো,আমি শুনছি।’
বেশ রেগেমেগেই বলল রিমি।
‘আসলে ভাবি আমি স্রুতি আপুর কথা বলছিলাম। ওই তো আহসানের বেয়ান। আমরা তো তাই বলতাম আগে।’

রিমির শরীরে বিদ্যুৎ গতিতে রাগ পরিবহন হচ্ছে স্রুতির কথা শুনে। রিমি রাগটা আপাতত গিলে খেয়ে বলল, ‘বেয়ান কেন সে আহসানের?’
‘আমরা ছোটবেলায় বর-বউ খেলতাম। তখন আহসান হতো ছেলের বাবা আর স্রুতি সাজতো মেয়ের মা। তো সেই থেকে ওরা বেয়াই-বেয়ান।’

‘ওহ! আর বর-বউ কি জান্নাত আর জিসান হতো নাকি?’ জিজ্ঞেস করে রিমি।
‘না, ওরা দুজন মারামারি করে এক করে ফেলত। ওদের বর-বউ দিলে আমাদের খেলাই মাটি হয়ে যেত। আমি আর জান্নাত বর-বউ সাজতাম।’
‘তাহলে জিসান?’

‘ও ঘটক।’ বলা মাত্র সবাই হো হো করে হেসে দিল৷ শুধুমাত্র জিসান ছাড়া। রেজওয়ান আরও বলল, ‘মানে জিসান ছিল দর্শক। জান্নাত আর আমার জুটি খুব ভালো ছিল। আমরা সকলেই খুব দুর্দান্ত অভিনয় করতাম। জান্নাতকে ছোট্ট একটা বউ লাগতো। কাকির লাল একটা ওড়না মাথায় দিয়ে বউ হতো জান্নাত। আমার তো এখনও জান্নাতের সেই ছোট্ট বউ সাজা মুখটার কথা মনে আছে। তোর মনে আছে কি জান্নাত?’

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৩৯+৪০

জান্নাত ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আছে আবার নেই। ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছে। পুরোপুরি না।’
‘তুইতো এখনও বউ তবে আমার না, হলি কার? জিসানের । মানে কিভাবে সম্ভব এটা? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। ওহি আর নকুল কিভাবে মেলে? দুজন তো দুজনের জন্মশত্রু ছিল একসময়ে।’

আচমকাই জিসান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কাউকে কিছু না বলেই চলে যায় সেখান থেকে। তা দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই অবাক। ভাবছে জিসানের হঠাৎ কি হলো। রেজওয়ান বলল, ‘এর আবার কি হলো?
রিমি উত্তর দিল, ‘তুমিই তো দিলে আমার দেবরটাকে জেলাসি বানিয়ে। অন্যের বউ নিয়ে টানাটানি করা খুব বাজে স্বভাব বুঝলে?’

রিমি কথাটা মজার ছলে বলেছে বলে কেউ কিছু মনে করলো না।
জিসান রিসোর্টের রুমে এসে বিছানার চাদর এলোমেলো করে ফেলেছে। বেশ অস্থির সে। এমন সময় জান্নাতের প্রবেশ ঘটে।

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪৩+৪৪