দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৩ (২)
আফরোজা আশা
আমেনা কথা বলল না। চটপট হাতে সব পড়িয়ে বেলাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এলো। ড্রয়িংরুমে মিতালী রাগে গজগজ করছে। জহিরুলকে বলছে বিয়ে হতে দিবে না। বেলার ফুপি হিসেবে ও মানে না বিয়ে। জহিরুল নিরব। রহমান শাসালো বোনকে। কাজে দিল না। মিতালী রাগারাগি করছে। মাঝখানে সোফা দখল করে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছে ফাহাদ দেওয়ান। ওর পাশে নতুন বর ফয়সাল। আমেনা বেলাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই রহমান ওদের দিকে এগিয়ে এলো। বেলার হাত ধরে এনে ফাহাদের পাশে বসালো।
ফাহাদ একঝলক দেখলো বেলাকে। আর মাত্র কিছুক্ষন। তারপর এই মেয়েটা ওর অর্ধাঙ্গিনী হবে। যত্ন করে, আদরে ভরিয়ে রাখবে ওকে। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে আছে ফাহাদের।
এদিকে, আব্বুর কাজে অবাক হলো বেলা। বিক্ষিপ্ত মন, গেঞ্জাম পরিবেশ এ অতিষ্ট লাগছে ওর। রহমান সময় ব্যয় করলো না। কাজীকে কাজ শুরু করতে বলল। রহমানের কথা শুনে মাথায় বাজ পড়লো বেলার। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ কি বললে? আমার বিয়ে? কার সাথে? আব্বু, দিগন্ত ভাই এসেছে। ’
বেলার মুখে দিগন্তের নাম শুনে ধক করে উঠল ফাহাদের অন্তস্থল। ভেতরে কোথাও একটা অজানা শঙ্কা কাজ করতে শুরু করলো। অবুঝ না সে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বসে রইল।
রহমান স্থির চিত্তে বেলাকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ বসেন আম্মা। আব্বুর কথা শুনেন। আব্বু আপনার খারাপ চায় না। এখন শুধু আপনার মোহর হবে। পড়াশোনা শেষ হবে তারপর বাকিসব। ফাহাদ ভালো ছেলে। আপনি ভালো থাকবেন। ’
ফাহাদের নাম শুনে হাসফাস করে উঠল বেলা। ধক করে উঠল বেলার বুক,ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। দম বন্ধকর পরিস্থিতির চাপে পড়ে সহসা কেঁদে উঠলো ও। রহমানের কাছে এসে ওর হাত ধরে বলল,
‘ আব্বু, আমাকে বলোনি তো কিছু। আমার তো একজন ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। আমি অন্য কাউকে বিয়ে টিয়ে কিচ্ছু করব না। ’
রহমান চোখ ঘুরিয়ে আশপাশের ভর্তি,উৎসুক মানুষজনকে দেখল। বেলার মাথায় হাত রেখে কিছুটা কড়া গলায় বলল,
‘ আপনার এই ব্যবহার আমাকে ছোট করছে। আব্বুর কথা শুনেন। কাজী সাহেব অপেক্ষা করছে। আগের জায়গায় বসেন,আম্মা। ’
ক্ষিপ্ত হলো বেলা। রহমানের কথার বিরুদ্ধে চলে গেল মূহুর্তেই। রাগ-জেদ গভীরভাবে আকড়ে ধরলো ওকে। ঠিক-ভুল এর বিচার ভুলে বসলো। মাথা থেকে রহমানের হাত সরিয়ে দিয়ে উন্মাদের ন্যায় চেঁচিয়ে উঠল,
‘ দিগন্ত ভাইকে ভালো লাগে আমার। তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। ’
আর নিতে পারলো না ফাহাদ। ঝট করে বসা থেকে উঠে এসে বেলার হাত শক্ত করে ধরল। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ নাটক হচ্ছে। বিয়ের সময় নাটক করবি না। তাড়াতাড়ি বিয়ে শেষ কর। তারপর তোর দিগন্ত ভাইকে দেখছি আমি। ’
ফাহাদের শক্তির সাথে পারলো না বেলা। ওকে সোফায় এনে বসিয়ে দিল। ফাহাদের ব্যবহার চোখে লাগল রহমানের। ভ্রুঁ কুঁচকে অভিজ্ঞ চোখজোড়া নিরবে সেদিকে রাখলো। কিছু বলল না, আটকালো না। দেখল শুধু।
বেলার সাথে পারছে না কেউ। কারো ধমকানি,গালি, কথা কিছুই ওর কানে যাচ্ছে না। আমেনা আর মিতালী রহমানের এই সিদ্ধান্তে খুশি না। কিন্তু বেলার পাগলামো দেখে সবাই চুপ মেরে গেছে। দিগন্তের নাম নিয়ে প্রলাপ বকছে ও। বার বার দিগন্তের নাম জপছে। কেউ কিছু বলতে চাইলে তার উপর দ্বিগুণ ক্ষিপ্তভাবে চেঁচাচ্ছে।
ফাহাদ কাজীকে আবার শুরু করতে বলল। কাজী শুরু করলো। বেলার দিকে খাতা,কলম এগিয়ে দিলে, বেলা ফুঁসতে ফুঁসতে হাতে নিল। তারপর ক্ষিপ্তহাতে কলম ছুড়ে মারলো ফাহাদের দিকে। ভয়ংকর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেদী গলায় বলল,
‘ ছিঁড়ে দিবো সব। আপনি একটা গুন্ডা। মানুষ মারেন। খারাপ লোক। শয়তান লোক। আব্বুউউ! এই লোকটা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পার্কে মেরেছিল। মানুষকে কষ্ট দেয়। ’
নিজের জন্য বেলার চোখে এতো ঘৃণা দেখে থমকাল ফাহাদ। বুকের ভেতরে ব্যাথার উপস্থিতি টের পেল। তেজালো ভাব হুট করে শান্ত হয়ে এলো। ক্ষনিকের জন্য পেয়েও হারানোর ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো। হাতে ধরে রাখা কলমটা দেখলো, আরেকটু হলে ওর চোখে গেঁথে যেতো। ওর সামনে একটা ছোট মেয়ে দিগন্তের জন্য পাগলামী করছে। যেই মেয়েটাকে নিয়ে এতোদিন স্বপ্ন বুনেছিল ও, সে মেয়েকে দিগন্ত কেড়ে নিয়েছে।
পরিবেশ নিরব। সবাই তব্দা মেরে আছে। শান্ত পরিবেশে ফাহাদের আওয়াজ পাওয়া গেল। একটা শুকনো ঢোক চেপে বলল,
‘ দিগন্তও গুণ্ডা। আমার থেকেও বেশি খারাপ। ওকে ভালো লাগলো, আমাকে লাগলো না কেনো? ’
কথাটা মাটিতে পড়ারও সময় দিল না বেলা। লাল চোখমুখ নিয়ে একবাক্যে উত্তর দিয়ে দিল,
‘ কারণ আপনি আমার দিগন্ত ভাই না। ’
‘ আমার দিগন্ত ভাই ’ কথাটাতে বেলার জোর দেখে পিত্তি জ্বলে উঠল ফাহাদের। ভেতরের কোথায় যেন খামচে ধরলো। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ আমার থেকে দিগন্ত বেশি গুন্ডমি করে। বেশি খারাপ। ’
সহসা জবাব এলো বেলার কাছ থেকে ,
‘ দিগন্ত ভাই খারাপ না। ভালো,খুব ভালো। ’
ফাহাদ হুশ খুইয়েছে। ছোট বাচ্চার ন্যায় ব্যাকুল হয়ে বেলাকে বলল, ‘ দিগন্তের থেকে আমি বেশি সুন্দর। ’
একগুঁয়ে জবাব বেলার। অস্থিরতার সহিত বলল,‘ উফফ! কেমন বিরক্তিকর মানুষ। সহ্য হচ্ছে না। আমার দিগন্ত ভাই বেশি সুন্দর। খুব বেশি সুন্দর। শুনেছেন? ’
ফাহাদ মানতে নারাজ বেলার কথা। ক্ষণিকের জন্য নিজের হয়তো বেলার মতো অবুঝ হয়ে গেল। বলল,
‘ তুমি ছোট। ভালো মন্দের জ্ঞান নাই তোমার মাঝে। আমি ভালোবাসি তোমাকে। আমাকে বিয়ে করতেই হবে। ’
ফুঁসে উঠল বেলা। চোখ বন্ধ করে গলা ফাটিয়ে চেঁচালো,
‘ বলছি না, আপনি দিগন্ত তালুকদার না। আমি আমার দিগন্ত ভাইকেই বিয়ে করবো। ’
এ পর্যায়ে বেলার পাশে এসে দাঁড়ালো রহমান। ফাহাদের ব্যবহার তাকে ভুল প্রমাণ করেছে। কিন্তু তিনি স্তব্ধ হয়ে গেছেন বেলার ব্যবহারে। কেমন করছে মেয়েটা! কাঁপছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে, মানুষজনকে দেখেও দেখছে না। বেলাকে দেখে নিজের ব্যর্থতা বুঝতে সময় লাগলো না তার। দিগন্তের মোহে পুরোপুরিভাবে আবিষ্ট বেলা। ঠিক-ভুল বিচার বোধ হওয়ার আগেই অনুভূতির বেড়াজালে আটকা পড়ছে ও। এতোদূর গড়াবে তার বিন্দু পরিমাণ ধারণাও ছিল না রহমানের। বেলা যেরকম করছে তাতে ওর ওপর জোরজবরদস্তি করলে, আবেগের তাড়নায় নিজের ক্ষতি করতেও দুবার ভাববে না ও।
রহমানের ছোট মেয়ে বাড়িতে চঞ্চল থাকলেও, বাইরের মানুষদের সামনে ভদ্র, শান্তশিষ্ট, সে মেয়ে এতো মানুষজনকে তোয়াক্কা করছে না। রহমানের মুখ থেকে কথা বের হলো না। জহিরুল,ফজলুল দেওয়ানসহ মহিলা সদস্যরা নানাভাবে চেষ্টা করলো কিন্তু বেলার সাথে কেউ পারলো না। সবশেষে বাণী বেলাকে বোঝাতে আসবে এমন সময় রহমান এতোক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে ভাঙ্গা গলায় বলে উঠল,
‘ মাফ করবেন জহিরুল ভাই। আমার মেয়ের এতোটা অবনতি হয়েছে তা আমার বোধগম্য ছিল না। আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আপনাদের অপদস্থ হতে হলো। ’
রহমানের কথা শোনার পর জহিরুল চুপ থাকলেও, ক্ষেপে উঠল ফাহাদের বাবা ফজলুল। কমিশনারের দাপট দেখিয়ে মান-হানির মামলার ভয় দেখালো। রহমানকে কথা শোনাল। নিশ্চুপ সে। ভুল করেছে। রাগে অন্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়েছিল হয়তো। এই মুহূর্তে, এই অবস্থার জন্য দায়ী রহমান। শান্তভাবে দেওয়ানদের সাথে কথা বললো।
রহমানের কথার মাঝে বড় বড় শ্বাস টেনে শান্ত হলো বেলা। চোখের পানি মুছলো। ভয়,ডর কিছুই নেই ওর মধ্যে এখন। মন-মস্তিষ্ক জুরে শুধু দিগন্তের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। হুট করে কেমন সাহসী হয়েছে ও। আব্বুর কাছে এসে, দেওয়ানদের শুনিয়ে বলে উঠল বেলা,
‘ বলছি না আমি দিগন্ত ভাইকে ভালোবাসি। এটা জানার পরও যে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে ওই লোক তো লোভী। ’
বলে রহমানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ আব্বু! লোভী মানুষের থেকে বেকার মানুষ বেশি ভালো না? ’
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রহমান জবাব দিল, ‘ হুম ’
চঞ্চলে স্বরে বলল বেলা,
‘ তুমি বলেছিলে না, দিগন্ত ভাই বেকার। আমার জন্য পারফেক্ট তাহলে। ’
একই গতিতে রহমানকে পুনরায় প্রশ্ন করল বেলা, ‘ দিগন্ত ভাইকে আমি ভালোবাসি, আমাকে দিগন্ত ভাই ভালোবাসে। পারফেক্ট না আব্বুউউ? ’
রহমান একগুঁয়ে, জেদী মেয়েকে দেখছে। ওর অভিজ্ঞ নজর বেলার মানসিকতা ধরতে সক্ষম। ব্যর্থতার শ্বাস টেনে জবাব দিল আগের ভঙ্গিতে,
‘ হুম ’
‘ আমি ব্যাথা পেলে দিগন্ত ভাইও ব্যাথা পায়। এই যে,এই লোকটা। কি যেন নাম! ’
ফাহাদের নাম মনে পড়ছে না বেলার। রহমানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফাহাদের দিকে তাক করলো। ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
‘ এ ভাই, কি নাম আপনার? ’
ভঙ্গুর হৃদয় নিয়েও বেলার তেজ দেখে হাসলো ফাহাদ। ধীরভাবে বলল, ‘ ফাহাদ দেওয়ান ’
পুনরায় রহমানের দিকে তাকালো বেলা। বলল,
‘ হ্যাঁ। এই, ফাহাদ দেওয়ানি। এর পঁচা লোকজন একদিন আমাকে মেরেছিল। হাতে লেগেছিল অনেক। তখন আমার ব্যাথায় দিগন্ত ভাইও খুব ব্যাথা পেয়েছিল। তাহলে ওই লোকটা আমার জন্য পারফেক্ট, না আব্বুউ? ’
মেয়ের অবুঝপনা অবস্থা দেখে রহমান বাকরুদ্ধ। দিগন্ত পুরো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে ওকে। অপরদিকে, রহমানের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে অস্থির হলো বেলা। আব্বুর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ বলো? ’
ছোট জবাব এলো রহমানের কাছ থেকে, ‘ হুম ’
‘ আমার রাগ,জেদ,কান্না সবকিছু শুধু দিগন্ত ভাইয়ের জন্য। সে কাঁদায় আবার সে-ই হাসায়। তাহলে সে আমার জন্য পারফেক্ট, তাই না আব্বু? ’
‘ হুম ’
দিগন্তকে ভালো প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বেলা। ওর বর্তমান ভাব-ভঙ্গিমা এমন, জোর-জবরদস্তি, রাগ-জেদ নিয়ে হলেও দিগন্ত সব থেকে ভালো সেটা ওকে প্রমাণ করতেই হবে।
উপস্থিত মানুষ হাসবে নাকি রাগ করবে খুঁজে পাচ্ছে না। বেলার একেকটা কথা তাদের দুই নৌকার ভাসাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ বৃষ্টির বিয়ের পরপরই চলে গিয়েছে। কিছু আত্মীয়-স্বজন, দিশা,মাইশা,বাণী,মিতালী সহ বাড়ির সবাই আর দেওয়ান বাড়ির কয়েকজন আছে এখানে।
বেলা আবারো বলল,
‘ দিগন্ত ভাইকে আমার ভালো লাগে, আমি একথা তোমাকে এতোদিনও বলিনি বলে, আমার উপর রাগ করেছে খুব। দেখলা না, সেদিন যে আমাদের বাড়ি এসে আমাকে মারলো তারপর থেকে তার সাথে কোনো কথা হয়নি আমার। আমার সাথে একটুও কথা বলেনি। লোকটার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না। আমি মনে হয় মরে যাবো কথা বলতে না পারলে। আব্বুউ! আমাকে একটু দিগন্ত ভাইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দিবে। নিশ্বাসটা আটকে আসছে। ’
রহমান কি বলবে! দিক-দিশেহারা সে এখন। খুব অহংকার করে দিগন্তকে বলেছিল বেলা ওকে পছন্দ করবে না। কিন্তু তার ছোট অবুঝ মেয়ে, না বুঝেও উন্মাদ হয়ে আছে দিগন্তের জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহমান বলল,
‘ আপনাকে আমি কোনোরকম হারাম সম্পর্কে থাকতে দিবো না। অনেক বড় হয়েছেন। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখেছেন। আসতে বলেন তাকে। সম্পর্ক হালাল হওয়ার পর কথা বলবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, স্বেচ্ছায় আপনি যে ছেলেকে বেছে নিলেন সে আপনার পছন্দ, আমার না। ভবিষ্যৎ এ আব্বুকে দোষারোপ করতে পারবেন না। ’
এদিকে, রহমানের আদেশ পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো উল্লাসে চিল্লালো বেলা। হাস্যরত মুখে দৌড়ে মিতালীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘ ফুপি, কোথায় আছে এখন দিগন্ত ভাই? বাড়িতে নাই, আমি শুনেছি। দিশা আপু বলেছিল। ’
মিতালী তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এতোদিন দিগন্তের পাগলামোর সাক্ষী সে। আজ বেলার পাগলামি দেখে মাথা ঘুরছে ওর। ধ্যানে থেকেই জবাব দিল,
‘ ক্লাবে। ’
ব্যস,বেলা আর কারো দিকে তাকালো না। লাফিয়ে দরজার দিকে ছুটল। পেছন থেকে রাসেল খেঁকিয়ে উঠল,
‘ একা কোথায় যাচ্ছিস, বেলায়ায়া? ’
বেলার কানেও গেল না সে কথা। একদম বাইরে চলে গিয়েছিল । আবার ধুপধাপ করে দৌড়ে এলো রহমানের কাছে। হাত পেতে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলল,
‘ ভাড়া নাই তো আব্বু। দেও। ’
রহমান বিনা বাক্য ব্যয়ে পকেট হাতড়িয়ে দুইটা একশো টাকার নোট দিল বেলার হাতে। বিস্তর হেসে আবার দৌড় ধরলো বেলা।
ফাহাদ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল বেলার পাগলামিগুলো দেখলো। এই ছোট মেয়ের মন-মস্তিষ্ক জুড়ে দিগন্ত। সেখানে নিজের জায়গা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা বোকামি। ভেতরে জ্বলছে ওর। চিনচিন ব্যাথা করছে। কিন্তু জোর করলো না,থামানোর ইচ্ছে করলো না, নাই-বা পেল নিজের ক্ষমতা-দাপট দেখিয়ে বেলাকে আটকে রাখার মনোবল।
ক্লাবের মেঝেতে বসে রায়হানসহ দলের দুটো ছেলে মিলে লুডু খেলছে দিগন্ত। হাতের ধোঁয়া ওঠা গরম চা। পরনের শার্ট এলোমেলো, চুল উস্ক-খুষ্ক অবস্থায় অযত্নে ছড়িয়ে আছে। চোখে ঘুমভাব কিন্তু ঘুম ধরা দেয় না। লাল হয়ে আছে।
রায়হান হাজার বলার পরেও এ ঘর থেকে বের করতে পারেনি ওকে। বেলার বিয়ে শুনেও দিগন্তের এতো শান্ত-স্বাভাবিক আচরণ রায়হানের নিকট অস্বাভাবিক ঠেকছে।
যেখানে তান্ডব করার কথা, সেখানে বসে বসে চা খাচ্ছে আর লুডু খেলছে দিগন্ত। দিগন্তের রিল্যাক্স মুড দেখে প্রেশার ফল করছে রায়হানের।
এর মাঝে রতন হুড়মুড়িয়ে এসে ঘরে ঘুকলো। দিগন্তের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ভাই রহমান পাটোয়ারীর ছোট মাইয়া আসছে। ভিতরে আসার জন্য হাউকাউ করতেছে। ’
রতনের কথা শুনে তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়ালো রায়হান। বড় বড় পা ফেলে বাইরের দিকে গেল। দিগন্ত কিছুক্ষন নিরুত্তর থেকে চা টা শেষ করলো। মাথা ভার হয়ে আছে ওর। হাত চালিয়ে এলোমেলো চুলগুলো পেছনে ঠেলতে ঠেলতে ঘরে থাকা সব ছেলেদের বাইরে যেতে বলল। দিগন্তের কথায় রতনসহ একে একে সবাই চলে গেল। নড়চড় হলো না দিগন্তের। সেভাবে বসে থেকেই সিগারেট ধরালো।
কিছুক্ষন পর ধুপধাপ পা ফেলে ঘরে হাজির হলো একজন। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল দিগন্ত। সিগারেট মুখের কাছে আনবে এমন সময় সামনের ব্যক্তি ছুটে এসে ওর বুকে দুহাত দিয়ে ধাক্কা মারলো। জোরে ধাক্কার দরুন অনেকটা পিছিয়ে গেল দিগন্ত। সামলানোর জন্য একহাতের ভর মেঝেতে ঠেকিয়ে দিল। অতঃপর রাশভারি গলায় বলল,
‘ কি চাই? ’
কোনো কথা বলল না বেলা। জোরে জোরে শ্বাস টেনে আবারো হাত উঠালো দিগন্তকে ধাক্কা মারার জন্য। বুকের কাছে আনতেই ওর হাত চেপে ধরলো দিগন্ত। হাত ছাড়ানোর জন্য জোর লাগিয়ে কিছুক্ষন মোচড়ামুচড়ি করলো বেলা। দিগন্তের দাবাং মার্কা পুরুষালি শক্তির সাথে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো। পরক্ষণেই দিগন্তের হাত কামড়ে ধরলো। সমস্ত রাগ উগ্রে দিতে চাইলো সেখানে। দাঁতে দাঁত পিষে ব্যাথা হজম করলো দিগন্ত। থামালো না বেলা। কিছু সময় পেরিয়ে গেল। ছাড়ার নাম নেই বেলার। আর না পেরে ধমকের স্বরে বলে উঠল দিগন্ত,
‘ বিয়ে দিছে না তোর বাপ। স্বামীর সাথে নাটক কর। আমার সাথে কি? ’
সময় নিয়ে নিরবে কাঁদলো বেলা। চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে ওর। অভিযোগী স্বরে বলল,
‘ করি নি বিয়ে। আমার ক..কষ্ট হয়েছে অনেক। আপনি আটকাতে আসলেন না কেনো? রাইমার বিয়ে আটকেছিল ওর বয়ফ্রেন্ড। আপনি এখানে বসে থাকলেন কেন? ’
ভ্রুঁ কোঁচকালো দিগন্ত। ত্যাড়াভাবে প্রশ্ন করলো,
‘ আমি তোর বয়ফ্রেন্ড লাগি? ’
নাক ফুলিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলো বেলা,
‘ কি লাগেন তাহলে? ’
মুখ থেকে চুউউ শব্দ বের হলো দিগন্তের। কণ্ঠে বিরক্তির রেশ এনে বলল,
‘ একে তো মুখের উপর কথা বলে আবার বেঢক প্রশ্ন করে, বেয়াদব। কেনো এসেছিস এখানে? ’
নাক টেনে সরল স্বীকারোক্তি বেলার কাছ থেকে,
‘ আপনার বউ হতে। ’
একসাথে কুঁচকে রাখা ভ্রুঁ জোড়া শিথীল হলো দিগন্তের। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষন বেলার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে করতে স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ বউ শব্দে আমার এলার্জি আছে। মিসেস দিগন্ত তালুকদার সাউন্ডস গুড। ’
দিগন্তের কথা শুনে কিছু মিলানোর চেষ্টা করলো বেলা। পরক্ষনে ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ হ্যাঁ। ওটাই, একি তো। ’
বেলার কাহিনী দেখে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির এলো দিগন্তের। আবার বেলার আগোচরেই সেটা মিলিয়ে গেল।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দিগন্তের নজর আটকালো বেলার হাতের দিকে। একটা করে সোনার চিকন চুড়ি আর তার সাথে একজোড়া হলুদ রঙের কাঁচের চুড়ি দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো দিগন্তের। ফোঁস করে উঠে বলল,
‘ এই চুড়ি খোল। ’
কয়েক পলক ঝাপটে বেলা বলল, ‘ কেনো? সুন্দর না? ’
‘ তোর নীল রঙ পছন্দ। হলুদ নিয়ে ক্যাড়ম্যাড় করবি না একদম। বিচ্ছিরি রঙ৷ ভালো লাগে না আমার৷ ’
বোকার মতো আবার প্রশ্ন করলো বেলা,
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৩
‘ ভালো লাগে না? ’
‘ না ’
ব্যস, বেলা চটজলদি হাত থেকে চুড়ি খুলে ফেলে দিতে দিতে বলে উঠল,
‘ তাহলে আমারো ভালো লাগে না। ’