দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭ (২)
আফরোজা আশা
দিগন্তের ডাক কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই ঘুম ছুটে গেল বেলার।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। হুট করে লাফিয়ে উঠার ফলস্বরূপ নিজেকে ধাতস্থ করে সময় লাগল ওর৷ পাশ থেকে ভেসে এলো দিগন্তের কণ্ঠস্বর। কিছু একটা বলছে বেলাকে। কিন্তু সে কথা আদোতে বেলার কানে গেল কি? গেল না বোধহয়! থম মেরে বসে থেকে স্থির দৃষ্টে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষন। পলক পড়ল এক-দুবার। তারপর হুট করে ডাগর ডাগর নেত্রপল্লব ছাপিয়ে এলো। পানিতে টইটুম্বুর হলো চোখজোড়া।
বেলার আচানাক পরিবর্তনে চমকালো দিগন্ত। পা বাড়িয়ে দূরন্ত বেগে বেলার মুখোমুখি বসলো। উদ্বেগ মিশ্রিত গলায় শুধালো,
‘ ভয় পেয়েছিস? কাঁদছিস কেনো? ’
দিগন্তের প্রশ্ন শুনে বেলার ভেজা আঁখিজোড়া থেকে টুপটুপ করে দুফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। ধরা গলায় বলতে শুরু করল,
‘ দাদী বলেছিল স্বামী ঘরে এলে কি কি করতে হয়। আমি জেগে ছিলাম তো অনেকক্ষন। অপেক্ষা করছিলাম। আপনি আসতে এতো দেরী করলেন কেনো দিগন্ত ভাই? ’
বাকহারা হলো দিগন্ত। অবাক স্বরে বলল,
‘ কি বলেছে দাদী? ’
কান্নামিশ্রিত আটকা গলায় উত্তর করল বেলা,
‘ স..সালাম করতে বলেছিল। ক..কিন্তু আপনি তো অনেকক্ষন আগে এসেছেন। ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চোখ সরু করে ফেলল দিগন্ত। বেলার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল কিছুপল। ঘুম থেকে উঠার ফলে চোখগুলো হালকা ফুলে আছে বেলার। চাপা কান্নার দমকে নাকের ডগা ফুলে উঠেছে। বউরূপী সাজে শাড়ি পরিহিত বেলাকে ছোট লাগছে না দেখতে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারীর ছাপ ফুটে উঠেছে। বেলার উপর গভীর দৃষ্টি পড়াতে ভেতর শুকিয়ে এলো দিগন্তের। শুকনো ঢোক চেপে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। শ্বাস টেনে স্বাভাবিকভাবে বলল,
‘ কাঁদবি না বেলা। কাঁদলেই ভুল মাফ হয়ে যায়? ’
দুপাশে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো বেলা। দিগন্ত বাঁকা গলায় বলল,
‘ এদিকে আয়। ’
বেলা কয়েক পলক ঝাপটে চুপচাপ দিগন্তের কাছাকাছি এগিয়ে গেল। প্রশ্ন করলো না কোনো। দিগন্তও কথা বাড়ালো না। হাত বাড়িয়ে বেলার গলার, হাতের সবকিছু একে একে খুলে দিতে শুরু করল। কানের দুল খোলার সময় বাঁধলো বিপত্তি। ব্যাথায় লাল হয়ে গিয়েছে বেলার কান। হালকা একটু রক্তের দেখা মিলছে। তা দেখে রেগে গেল দিগন্ত। ধমকের সুরে বলল,
‘ তোকে হালকা দুল পাঠানো হয়েছে না। এটা কেনো পড়েছিস? ব্যাথা হয়েছে তবু খুলিসনি। ’
সরল জবাব বেলার, ‘ হালকা দুলগুলো অন্যান্য দিন পড়ব। বিয়ের দিন ওসব পড়ে নাকি? ’
বেলার কথা শুনে বাকরুদ্ধ দিগন্ত। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তেধীরে দুলগুলো খুললো। মাঝে বেশ কয়েকবার ব্যাথায় আর্তনাদ করেছে বেলা। সেগুলো গিয়ে বিঁধেছে দিগন্তের বুকে। খোলা শেষ হতে দুলগুলো মেঝেতে আছাড় মারল। বেলার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ ওগুলো যদি আর কোনোদিন কানে দেখেছি তোর খবর আছে। ওখান থেকে তুলে সাজিয়ে রাখবি কিন্তু আমার অবাধ্য হয়ে কানে পড়বি না। ’
মাথা নাড়িয়ে দিগন্তের কথায় সায় দিল বেলা। তারপর ঠোঁট উল্টে দুলগুলো দেখল। ভালো লেগেছিল ওর, কিন্তু কানে সইলো না।
বিছানা ছেড়ে নিচে দাঁড়ালো দিগন্ত। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বেলার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ চল। ’
কয়েক পলক ঝাপটে চঞ্চল গলায় বেলা জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায়? ’
ঘাড় ঘুরিয়ে বেলার দিকে তাকালো দিগন্ত। শান্ত গলায় বলল,
‘ ওযু করে আয়। ’
এ সময়ে ওযু করার কারণ বুঝল না বেলা। অবুঝভাবে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ কেনো? ’
রাগল না দিগন্ত। পূর্বের ন্যায় শান্ত স্বরে আবারো জবাব দিল,
‘ নফল নামাজ পড়বি আমার সাথে। ’
দিগন্তের কথা শুনে কৌতুহল বাড়ল বেলার। বিছানা ছেড়ে শাড়ি টেনেটুনে দিগন্তের সামনে এসে দাঁড়ালো। কণ্ঠে অবাকতার রেশ এনে প্রশ্ন করল,
‘ তাহলে কি হয়? দাদী তো একথা বলেনি। ’
দিগন্ত নিরব রইল। উত্তর দিল না। হেঁটে বেলার পেছনে গেল শাড়ির সাথে পিন দিয়ে লাগানো ওড়নাটা মেঝেতে ঝুলছে। আলতো হাতে পিনটা খুলে দিল। ওড়ানা গুছিয়ে বিছানায় রেখে হাত দিয়ে ইশারা করল ওয়াশরুমে যেতে। বেলা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর দিগন্তের কথামতো নিঃশব্দে ওযু করতে গেল। পানির ফোঁটায় ভিজে গেল ওর কপাল, হাত, ঠোঁট। দীপ্ত হয়ে উঠল ওর স্নিগ্ধ মুখ। অতঃপর ওযু শেষ করে শাড়ির অনেকাংশ ভিজিয়ে ঘরে ফিরল।
দিগন্ত একপলক দেখল ওকে। তারপর নিজেও ওযু করে ফিরে এলো। ঘরের একপাশে সাদা জায়নামাজ বিছিয়ে প্রথমে দাঁড়াল দিগন্ত। পাশে একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল বেলা।
দিগন্ত গম্ভীর স্বরে আওড়ালো,
‘ আমার সাথে আমার মতো করে পড়বি। ‘
‘ আমি নামাজ পড়তে জানি। ’
‘ কথা বাড়াবি না বেলা। ’
‘ আচ্ছা। ‘
বেলার বাধ্যতায় কিঞ্চিৎ হাসল দিগন্ত। অতঃপর, জোর গলায় তাকবির বলল। চোখ নামিয়ে সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত শুরু করল। ওর সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ ছড়িয়ে পড়ল রুমজুড়ে। দিগন্তের গলার আওয়াজ কানে ঠেকতেই মুগ্ধ হলো বেলা। চোখ বুজে শুনলো পুরুষালি কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ, কাঁপা কণ্ঠে অনুসরণ করল দিগন্তকে। রুকু, সিজদাহ সব ধাপেই দিগন্ত ধীর ও সাবধান। আস্তেধীরে নামাজ পড়ছে কারণ ওর পাশে দাঁড়ানো বেলা ওর অঙ্গভঙ্গিও অনুসরণ করছে। অন্যদিকে, শাড়ির কারণে উঠবস করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বেলাকে। পায়ে আটকে যাচ্ছে, মাথা থেকে আঁচল নেমে আসতে চাইছে। সেভাবেই নামাজ শেষ করলো।
জায়নামাজ দুটো উঠিয়ে কাবার্ড থেকে একটা কাগজ বের করল দিগন্ত। বেলার কাছে এসে সেটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল। কাগজের লেখা পড়ে চোখ বড় বড় হলো বেলা। বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ দিগন্ত ভাই, এতো টাকার চেক আমাকে দিলেন কেন? ’
নববধূর মুখের ভাই ডাকটা তিতার ন্যায় ঠেকল দিগন্তের কাছে। রাশভারি গলায় জবাব দিল,
‘ তোর মোহরানার টাকা। আমার হাতে এটুকুই ছিল। ‘
বেলার সরল প্রশ্ন, ‘ আমি এতো টাকা কি করব? ’
‘ এটা তোর। যা ইচ্ছা কর। নিজের প্রয়োজনে খরচ করবি। আমি কোনোদিনও এর সম্পর্কে জানতে চাইব না। ’
বেলার একবার চেকটা দেখছে তো আরেকবার দিগন্তের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। শেষমেষ বলল,
‘ কোথায় রাখব এখন? আপনার কাছেই রেখে দেন। ’
দিগন্তের পাল্টা জবাব,
‘ এতো বড় ঘর। যেখানে ইচ্ছা রাখ। রাখে তাড়াতাড়ি আয়। আমার ঘুম লেগেছে৷ ’
বেলা চোখ ঘুরিয়ে খুঁজল কোথায় রাখবে। আপাতত বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিগন্তের পাশে এসে দাঁড়ালো।
দিগন্ত ওকে দেখে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর তড়িৎবেগে পাশে দাঁড়ানো বেলার হাতে টান লাগাল। দিগন্তের আচানাক আক্রমণে নিজেকে সামলাতে পারলো না বেলা। দিগন্তের গা ঘেঁষে ওর পাশের ছোট একটু জায়গায় পড়ে গেল। সময় ব্যয় করল না দিগন্ত। নিজের সাথে বেলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। এতোদিনের একাকিত্ব ঘুচলো ওর। ফাঁকা পড়ে থাকা বক্ষে বেলার মাথা চেপে ধরে প্রশান্তি চোখ বুজল।
অপরদিকে দম আটকে এলো বেলার। পুরুষালি শরীরের অপরিচিত গভীর স্পর্শে শরীরে শিহরন জন্মালো। কেঁপে কেঁপে উঠল কয়েকবার। একে তো ছোট জায়গা। দিগন্ত একটু সরেও যাচ্ছে না। তারপর আবার লোকটা শক্তভাবে জাপটে ধরেছে ওকে।
মুখ দিয়ে কথাও বের হলো না বেলার। গলার কাছে এসে দানা বাঁধল সব। মিনিট পাঁচেক গড়ালো দিগন্তের নড়চড়ের নাম নাম নেই। এদিকে বেলার অবস্থা বেগতিক। দম টানাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আস্তেধীরে শরীর ছেড়ে দিতে শুরু করল।
দিগন্ত টের পেল। ঝট করে বেলাকে ছেড়ে দিল। তারপর আবার মিনিটের ব্যবধানে ওকে ঘুরিয়ে নিজের শক্তোপোক্ত দেহের নিচে ফেলল। খসখসে হাত দুটো চেপে ধরলো ওর দুই বাহু। একের অপর এক অনাকাঙ্খিত স্পর্শে বুক হাপড়ে উঠল বেলার। দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ এ..রকম করছেন ক..কেনো। আমার ক..কেমন যেন লাগছে। ‘
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল দিগন্ত। বেলার মুখের দিকে হালকা ঝুঁকে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ কেমন লাগছে? ‘
উত্তর খুঁজে পেল না বেলা। কেমন যেন মিশ্রিত একটা অনুভূতির মাঝে আটকা পড়েছে ও। ভালো লাগছে আবার কান্না আসছে। শ্বাস টানতে কষ্ট পাচ্ছে আবার দিগন্তকে ভয় লাগছে না। শুষ্ক অধরজোড়া ভিজিয়ে বেলা বলল,
‘ জ..জানি না। একটু দূরে সরে যান। আমি শ..শ্বাস নিতে পারছি না। ’
বেলার কথা শুনে ত্যাড়ামি একধাপ বাড়লো দিগন্তের। দূরে সরার বদলে আরো কাছাকাছি এলো। ওর গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ল বেলার চোখমুখে। ব্যস, এবার নাজেহাল হলো বেলা। চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল।
বেলার অবস্থা দেখে শান্তি পেল দিগন্ত। প্রগাঢ় নজরে বেলার চোখমুখ অবলোকন করল৷ ঠান্ডা ওষ্ঠজোড়া ওর কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তুই আর তোর বাপ খুব জ্বালিয়েছিস৷ এখন আমার একটু জ্বালা সহ্য করতে পারবি না? তুই মেয়ে বিরাট অসভ্য৷ ছোট হলে কি হবে; দিগন্ত তালুকদারকে নাচিয়ে ছেড়েছিস৷ এখন একটু সয়ে নে। তোকে না জ্বালালে আমার বুকের আগুন নিভবে না। ’
কথাটুকু বলে বেলাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না দিগন্ত। কান থেকে ওর গলার দিকে নেমে এসে গলদেশে মুখ ডুবালো।
আঁতকে উঠল বেলা,
‘ কি করছেন? ‘
বেলার প্রশ্ন শুনলো দিগন্ত। মাথা না উঠিয়ে ধমকের সুরে বলল,
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭
’ চুপ কর বেয়াদব। ’
পরপরই আবার নিজের কাজে মগ্ন হলো। এদিকে, দিগন্তের টুকরো টুকরো ছোঁয়ায় শরীর অবশ হয়ে এলো বেলার। আবেশে চোখে বুজে নিয়েছে। হৃদস্পনদনের গতি অস্বাভাবিক। নিশ্বাস ভারী হয়েছে।