দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ১৩

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ১৩
অনন্যা অসমি

” কিরে সাফু এসব আমি কি দেখছি? তোর হঠাৎ এই অবস্থা কেন? কয়েকদিন ধরে ভার্সিটি আসছিস না, ফোনও করছিস না, মেসেজের কোন রেসপন্স নেই। আজ সকালে আন্টি আমাকে ফোন করে জানতে চাইল কি হয়েছে। তুই নাকি খাওয়া-দাওয়াও করছিস না ঠিকমতো, দরজা বন্ধ করে বসে থাকিস। কি হয়েছে তোর?” ব্যাগটা রেখে চেয়ার টেনে বসল তোহা৷ সাফাইত কোন উওর না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল৷ তোহা পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখল আগের থেকেও ঘরটা বেশি এলোমেলো৷ ভাবল গুছিয়ে রাখবে কিন্তু পরে আর তা করল না। সাফাইত বেরিয়ে এলে তার দিকে ভালো করে তাকাল, পর্যবেক্ষণ করল তাকে।

” চোখ মুখের এ কি অবস্থা করে রেখেছিস তুই? চুলগুলো একেবারে কাকের বাসা হয়ে গিয়েছে। সেইভ করিসনি কতদিন? পুরো একটা বনমানুষ লাগছে তোকে। তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গিয়েছিস। একেবারে পুরো দেবদাস লাইট।” যদিও তোহা শেষের কথাগুলো না-জেনে মজা করে বলেছিল কিন্তু সে তো আর জানেনা তার মজাই বাস্তবে ঘটেছে।
সাফাইত বিছানার চাদর ভাঁজ করতে করতে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

” ঠিকই বলেছিস। জীবনে একটাই প্রেম করেছিলাম আর তাতেই ব্যর্থ হলাম।”
তোহা তার কথার অর্থ বুঝতে পারল না।
” মানে? এই সাফাইত একদম মজা করবিনা, সত্যি করে বল কি হয়েছে?”
” বললাম তো তুই যা বলেছিস তাই। বিরহের কষ্টে দেবদাস হয়ে গিয়েছি।”
তোহা মূহুর্তেই উঠে দাঁড়াল। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করল,

” কি! কিসব বলছিস তুই? এই সাফু কোথায় যাচ্ছিস? খোলসা করে আমাকে বল।”
সাফাইত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ” বস, আমি চা নিয়ে আসছি। আমার খুব মাথা ধরেছে।”
তোহা বসল না, অস্থির হয়ে পুরো রুমে পায়চারি করতে লাগল।

সাফাইত একটা কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরেকটা নিয়ে আরাম করে বিছানায় বসল৷ তার এরকম নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে তোহা কিছুটা বিরক্ত হলো। চেয়ারটা টেনে তার মুখোমুখি বসে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
” কিরে বল কি হয়েছে তোর? তখন ওসব কি বললি? ইশরার সাথে কি তোর সত্যিই কোন ঝামেলা হয়েছে? ঝগড়া হয়েছে?”

সাফাইত কাপে চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ” আমাদের সম্পর্কের সমাপ্তি হয়ে গিয়েছে তোহা।”
” মানে!” বুক কেঁপে উঠল তার।
” মানে ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে আমাদের। এখন আমাদের দু’জনের পথ সম্পূর্ণ আলাদা।”
” তুই কি সব আবোলতাবোল বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়েছে তোর? কি বলছিস তুই নিজে জানিস?”

” এটাই সত্যি তোহা। আমাদের মাঝে সব সম্পর্ক শেষ।”
” কিন্তু কেন? হঠাৎ তোদের মাঝে কী এমন হলো? আমাকে পরিষ্কার করে বলল।”
” ও একটা…..” বলতে গিয়েও থেমে গেলে সাফাইত। ভাবল, ” না ইশরার কথাগুলো তোহাকে বলা যাবে না। তাহলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। তার থেকেও বড় কথা ইশরার সম্পর্কে তার একটা খারাপ ধারণা তৈরি হবে৷ যত যাইহোক আমি ইশরাকে কারো সামনে ছোট করতে পারব না।”

” কিরে চুপ করে গেলি কেন?”
” আমাদের মনে হয়েছে আমাদের মাঝে আর কোন ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই, কোন ফিলিংস নেই তাই আমরা ব্রেকাপ করে নিয়েছি।”
” তুই মিথ্যা বলছিস সাফাইত। আমি জানি তুই ইশরাকে কতটা ভালোবাসিস আর সেই তুই কিনা বলছিস তোর মাঝে আর কোন ফিলিংস নেই! আমাকে বাচ্চা ভেবেছিস তুই।”

” এটাই সত্যি তোহা। ভালোবাসা একটা আপেক্ষিক জিনিস। যেকোন সময় পরিবর্তন হতে পারে। আমারো হয়েছে।”
” তাহলে তুই কেন মনমরা হয়েছে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিস? যদি ভালোবাসা শেষই হয়ে থাকে তাহলে তোর এখন মজা করার কথা, ফুর্তি করার কথা কিন্তু তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তুই মজায় আছিস।”

এবার কিছু বলতে পারল না সাফাইত৷ চুপচাপ কাপটা নিয়ে আবারো বেরিয়ে গেল। তোহা বুঝতে পারল ইশরার সাথে সাফাইতের বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। আর সেটার কারণ সাফাইত থাকে পরিষ্কার করে বলবে না এটাও সে বুঝতে পেরে গিয়েছে। সমস্যার কারণ এবার তাকে শুধু একজনই বলতে পারে।
” ইশরা।”

বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর আজ অবশেষে ইশরার দেখা পেলো তোহা। সে পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও ইশরার কোনরূপ উওর না পেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
” তোমাকে কতবার ডেকেছি।”
ইশরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তোহা তার পথ আটকে দাঁড়াল।

” কি হয়েছে তোমাদের মাঝে? তোমারই বা কি হয়েছে? এমন ব্যবহার করছ কেন তুমি? আমাকে কেন এড়িয়ে যাচ্ছো? তোমাদের দু’জনের কি হয়েছে বলো তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা হঠাৎ তোমরা এতোবড় সিদ্ধান্ত কেন নিলে? সাফাইত তো আমাকে খুলে কিছু বলছেনা, অন্তত তুমি বলো।”

” ও…. এতোসব কিছু করে এখন বলছো কিছুই বুঝতে পারছো না। বাহ্ এতো ভালো অভিনয় করতে পারো তুমি। তোমার তো অভিনয়ে নাম দেওয়া দরকার।” বিদ্রুপ করে বলল সে।
” কিসব বলছ তুমি ইশরা! আমি অভিনয় করছি! দেখো এতো ঘুরিয়ে কথা বলে সরাসরি আমাকে বলো কি বোঝাতে চাইছ তুমি? কি হয়েছে তোমাদের মাঝে? কোনো হঠাৎ এতোটা দূরত্ব তৈরি হলো তোমাদের মাঝে?”

” ও প্লিজ আর অবুঝের অভিনয় করো না তোহা আপু, তোমার প্রতি নূন্যতম যে সম্মানটা আছে সেটাও না মুছে যায়। আমাদের মাঝে দূরত্বের একমাত্র কারণ শুধু এবং শুধু তুমি।”
তোহার মাথায় যেন বাজ পড়ল। অবাক কন্ঠে বলল,

” আমি! আমার কারণে তোমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে!”
” হ্যাঁ তুমি৷ তোমরা দু’জনেই বেইমান, স্বার্থপর। তোমরা দু’জন মিলে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছ। সবাই বলতো তোমাদের মাঝে কিছু আছে কিন্তু আমি বোকা বিশ্বাস করিনি। উল্টো বলেছি তোমরা অন্যদের মতোন না, তোমরা শুধুই বন্ধু। কিন্তু পরিশেষে কি হলো? সবার কথায় সত্যি হলো, তোমরা দু’জন মিলে আমার অনুভূতিকে গলা টিপে মেরে ফেলেছ।” বলতে বলতে ইশরার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

” ইশরা বিশ্বাস করো আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নেই।”
তোহার কথা শ্রবণ না করে ইশরা আবারো বলল,
” কেন করলে আমার সাথে এরকমটা বলো? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমাদের? আমি তো নিজে তোমাদের মাঝে আসিনি। বেশ তো একা ছিলাম আমি।

কেন সাফাইত আমার জীবনে এলো? সে যদি তোমাকেই পছন্দ করতো তাহলে কেন আমার জীবনে ক্ষাণিকের জন্য এসে আমার গোছানো জীবনটা এলোমেলো করে দিল? আমি তো ওর কাছে যাইনি। কেন তোমরা আমার সাথে এতোবড় জঘন্য খেলা খেললে? আচ্ছা তুমি তো একজন মেয়ে, তুমি কি করে এসব করলে? তোমরা যা ইচ্ছে করতে আমার কিছু যাই আসতো না।

কেন তোমাদের মাঝে আমাকে নিয়ে এলে, বলো? উওর দাও।” অনবরত তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার কান্না দেখে তোহার চোখেও জল জমে গিয়েছে৷ সে ইশরার কাঁধে হাত রেখে বলল,

” বোন বিশ্বাস করো সাফাইত শুধু তোমাকে ভালোবাসে। তার মনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভালোবাসার নারী নেই। আমাকে সে সর্বদায় একজন ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছে। প্লিজ তোমরা এভাবে ভুলবোঝাবুঝির জন্য দূরে সরে যেও না।”

ইশরা ঝটকা দিয়ে তার হাত সরিয়ে দিলো৷ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, ” চুপ একদম চুপ। আমাকে আর বোঝাতে হবে না। তোমাদের মধ্যে কিছু না থাকলে সাফাইত এভাবে তোমার জন্য চিন্তিত থাকত না, ফোন করলেই ছুটে যেত না। কথায় কথায় তোমার গুণগান গাইত না। এতোদিন চোখে ভালোবাসার মিথ্যা কাপড় পড়েছিলাম এখন তা খুলে গিয়েছে৷ আমি আর কোন কিছুতে মানবো না। সম্পর্ক শেষ মানে শেষ। এবার তোমরা দু’জন ভালো থাকো, পারলে বিয়েও করে ফেলো৷ ইশরা নামক কোন মানবী আর তোমাদের জীবনে আসবে না।”

সে চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল৷ চোখের জল মুছে শক্ত মুখ করে বলল, ” আর হ্যাঁ যদি নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকে তবে কোনদিন নিজের এই মুখটা আমাকে দেখাবে না। মিথ্যা বলব না, তোমার এই চেহারা দেখলে এখন আমার ঘৃণা লাগে। নারী নামে কলঙ্ক তুমি।”

দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল ইশরা। তোহা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুসময় পর তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
” যে সম্পর্ক ভাঙনের ভয়ে এতোগুলা দিন নিজের অনুভূতিতে লুকিয়ে রেখেছি, গোপনে নিজের মনের কথা আড়াল করে রেখেছি আজ সেই কারণেই তাদের সম্পর্ক ভাঙন ধরল! তাহলে আমার এই অনুভূতি লুকিয়ে রাখার ফল কি পেলাম?”

” তুই কেন ওর কাছে গিয়ে ব্যাখা করতে গেলি বল? আমি বলেছিলাম তোকে? কেন শুধু শুধু ওর কাছে গিয়ে এতোগুলা কথা শুনলি?” চিৎকার করে বলল সাফাইত।
” আস্তে কথা বল সাফাইত, মা বাড়িতেই আছে। তোকে কে বলেছে আমি ইশরার কাছে গিয়েছিলাম?”
” সেই আমাকে ফোন করে বলছে। সাথে আমাদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেও ছাড়েনি৷ তুই কষ্ট পাবি তাই আমি তোকে কিছুই জানাইনি। কেন তুই গেলি বল?”

” দেখ সাফু, ইশরার বুঝতে ভূল হয়েছে। তোর উচিত ওর সাথে বসে কথা বলে সব ঠিক করে নেওয়া।”
” না যার মন এতোটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসে ভরা তাকে এখন মানিয়ে নিলেও ভবিষ্যতে ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকবে। যে তার ভালোবাসার মানুষের উপর এতটুকু ভরসা করতে পারেনা তার সাথে আমি থাকতে পারব না৷ সে আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুলতেও দ্বিধা করেনি৷ তুই আর চেষ্টা করছিস না তোহা, এই সম্পর্ক আর কখনোই ঠিক হওয়ার নয়৷”

এককদম এগিয়ে সে পেছনে না থাকিয়ে বলল,
” পুনরায় চেষ্টা করলে নিজে যেছে অপমানিত হবি, সাথে আমাদের বন্ধুত্বেও ফাটল ধরবে।”
সাফাইত চলে যেতেই তোহা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল৷ চুলগুলো মুঠো করে ধরে বিরবির করে বলল,

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ১২

” আমার জন্যই এসব কিছু হচ্ছে৷ যে সম্পর্ক ঠিকিয়ে রাখার জন্য নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিলাম এখন সেটা প্রকাশ না করেও সম্পর্ক ঠিকিয়ে রাখতো পারিনি। সব আমার জন্য হচ্ছে, সব দোষ আমার।”
এভাবেই নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল তোহা। পরক্ষণে আবারো শুধাল,
” আমার কি উচিত এই সুযোগটা ব্যবহার করা?”

দূর হতে আমি তারে সাধিব শেষ পর্ব