দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬(২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬(২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশানের কথায় ইউনুস সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
—তবে কি নিশীথের দোলনচাঁপার মতো তোর জীবনেও কোনো ফুল আছে নাকি, দাদুভাই?
—থাকাটা কি অস্বাভাবিক, দাদু? বয়স তো আর খুব একটা কম হলোনা!
নিশানের জ্ঞানী কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ। হাসতে হাসতেই বললেন,

—আলবত হয়েছে! তোরাই যদি বয়সের কথা বলিস তবে আমি কি বলবো? আমার তো তাহলে এক পা কবরে ঢ…
—দাদু! খবরদার এসব কথা বলবেনা। একদম ঘৃণা করি আমি এমন কথা!
—আচ্ছা বলবোনা যা। এখন বল মেয়েটা কে? দেশে আছে না তোর বিদেশে?
নিশান একবার বলতে যেয়েও থেমে গেলো। কি মনে করে মনে মনে খানিকটা ভাবলো। অতঃপর বললো,
—উম,, এখন না! একবারেই তোমাদের সবটা খুলে বলবো। আপাতত তুমি আমাকে একটা কথা বলো!
—আবার কি কথা? সব তো বলেই দিলাম এতক্ষণ!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইউনুস সাহেব ভ্রু কুচকান। এদিকে তার মন আনচান করছে নিশানের কথা শুনার জন্য। তবে নাতিকে তিনি জোর করলেন না, যখন কমফোর্টেবল হয়ে সবটা বলতে চাবে তখনই নাহয় শুনবেন। এছাড়াও নিশানের সাথে তিনি নিশীথের মতো ফ্রি নন যে ওর থেকে জোর করে সবকিছু শুনতে পারবেন। নিশান ওর বাবার সাথে বেশি ফ্রি, নিশীথ দাদার সাথে।
নিশান দাদাকে শুধালো,

—আচ্ছা দাদু, বাবা কি কখনো প্রেম করেছিলো?
ইউনুস সাহেব মাত্রই হেলান দিয়েছিলেন বিছানার সাথে। আচমকা নিশানের এহেন প্রশ্নে তিনি পিঠ ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না খাটে। সোজা হয়ে বসে বিস্মিত চোখে চাইলেন নাতির দিকে। আশ্চর্যচকিত কণ্ঠে বললেন,
—হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
নিশান মনোযোগ দিয়ে দাদার রিয়েকশন দেখলো। ওকে দেখে মনে হলো ও মনে মনে কিছু ভাবছে। তবে সেটা কি ভাবছে তা ইউনুস সাহেব আন্দাজ করতে পারলেন না! বরং নিশানকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারো শুধালেন,
—কিরে? কিছু জিজ্ঞেস করলাম তো! নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই চুপ করে আছিস।
নিশান মুখ খুলে। বলে,

—না, এমনিতেই ভাবছিলাম!
—এমনিতে তো এটা ভাবার কথা নয়, নিশান। এমন প্রশ্ন তো আর কেউ হুট করে ভাবেনা। এটুকু বুঝার সেন্স আমার আছে। চুল তো আর বাতাসে পাকেনি তাইনা! বল, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন এলো তোর মাথায়?
নিশান হেসে বলে,
—বুঝেছোই যখন তখন জবাবটাও দিয়ে দাও না, দাদু। তুমি এতকিছু বললে ঠিকি অথচ সিম্পল একটা প্রশ্ন করলাম সেটারই জবাব দিলেনা!
ইউনুস সাহেব গম্ভীর মুখে দেয়ালের দিক চাইলেন। চশমাটা ঠিক করে ছোট্ট করে জবাব দিলেন,

—হুম!
নিশানকে আবারো হাসতে দেখা গেলো। ইউনুস সাহেব সেদিকে চেয়ে বললেন,
—হাসছিস কেন?
—আমি সঠিক গেস করছিলাম এজন্যই হাসছি।
নিশান হাসির মাঝেই জবাব দিলো। ইউনুস সাহেব বললেন,
—যৌবনকালে প্রেম করাটা অস্বাভাবিক কিছুই না। আমিও করেছিলাম তোর দাদির সাথে, নিশীথও প্রেম করেই বিয়ে করলো আর তুই নিজেও তো প্রেম করছিস….
নিশান দাদুকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

—কিন্তু বাবা?
—বাবার কি?
ইউনুস সাহেব মুখ কুচকে শুধালেন। নিশান বেশ গম্ভীর গলায় বললো,
—তুমি দাদির সাথে প্রেম করেছো, নিশীথ দোলনচাঁপার সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু বাবা যার সাথে প্রেম করেছিলো সে তো আমাদের মা নয়, তাইনা?
নিশান প্রশ্ন করলেও ইউনুস সাহেব জবাব দিলেন না। উপরন্তু মুখে কলুপ এটে রইলেন। দাদুকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে নিশান আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতেই বললো,
—কি ব্যাপার, দাদু? তুমি এমন চুপ হয়ে গেলে যে? বাবা কার সাথে প্রেম করেছিলো বলবেনা?
নাতির প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে ইউনুস সাহেব বললেন,

—এবার একটু থামতো, নিশান। সেই তখন থেকে বাবার প্রেম বাবার প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিস। বাপের সম্পর্কে এসব প্রশ্ন কেউ করে? বেশি মর্ডান হতে হতে তোর লাজলজ্জা হারিয়ে ফেলেছিস দেখছি।
নিশান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার দাদার কথায় আর চুপ থাকতে পারলোনা। মুখখানা কাঠ করে ইউনুস সাহেবকে চমকে দিয়ে বললো,
—বাবা তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পারেনি বলেই মা-র সাথে সারাজীবন ঠান্ডা ব্যবহার করে এসেছে, তাইনা দাদু?

নাতির কথায় এবার ইউনুস সাহেব থমকে গেলেন। উঠে যেতে নিয়েও থেমে গেলেন। দাঁড়িয়ে গেলেন এক জায়গায়! নিশান ধীরেসুস্থে ধৈর্য নিয়ে দাদুর কাছে উত্তরের আশায় চেয়ে রইলো। ইউনুস সাহেব এখনো জবাব দিচ্ছেন না বিধায় আবারো শুধালো,
—কি হলো, দাদু? এখন কোনো কথা বলছোনা কেন? আমার প্রশ্নে কি কোনো ভুল ছিলো? অন্তত আজ আমার প্রশ্নের জবাব দাও!
নিশানের কথায় ইউনুস সাহেব নিচু গলায় বললেন,

—সব প্রশ্নের জবাব হয়না, নিশান।
—কেন হবেনা, দাদু? আমি শিওর বাবার সাথে কি হয়েছে তার সবটাই তুমি জানো। একমাত্র তুমিই আমার সকল প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে এজন্যই আমি এ সকাল সকাল কেউ উঠার আগে তোমার কাছে এসেছি। আর তুমিই কিনা আমায় জবাব দিতে অস্বীকার করছো?

—জবাবটা তোদের মোটেও ভালো লাগবেনা। অনেককিছু সম্পর্কে তোদের দৃষ্টিভংগি বদলে যাবে, হয়তোবা সম্পর্কের পরিবর্তন হবে। আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাইছিনা, নিশান। আমায় জোর করিস না আর!
নিশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ইউনুস সাহেবও ওর নিরবতা দেখে পুনরায় খাটে বসলেন। কিন্তু তাদের দুজনের একজনও জানলোনা, রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশীথ এতক্ষণ তাদের সব কথাই শুনছিলো! মূলত আজ এতদিন পর এ বাসায় আসায় পুরো রাত ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি নিশীথ। দোলাকে ঘুমিয়ে দেওয়ার জন্য নিজে ঘুমের ভান করলেও বাকি রাত বলা চলে সে অনেকটাই ছটফট করে কাটিয়েছে।

অজানা সব প্রশ্ন, দুশ্চিন্তা, কেমন যেন ঘোলাটে এক অশান্তিতে বুদ হয়ে ছিলো নিশীথের মন। তাই ঘড়ির কাটায় ছ’টা বাজতে দেখেই ও দাদুর রুমে আসছিলো গল্প করতে, কত্তদিন মন খুলে দাদুর সাথে আগেকার মতো গল্প করা হয়না ভেবে! কিন্তু দাদুর রুমে ঢোকার আগেই নিশানের সাথে দাদুর কথোপকথন কানে আসে ওর। বিশেষ করে বাবার প্রেম নিয়ে নিশান প্রশ্ন করতেই নিশীথ আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে দাদুর কথাগুলো নিশীথের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তুলে।

আর ঠিক সে সময় এসে দাদু এভাবে থেমে গেলে চলে? মোটেও না! নিশীথের জেদি মন আজ দমে যাবেনা। দাদুর থেকে শুনেই ছাড়বে বাবার অতীতের কথা। কে ছিলো আয়মান সাহেবের ভালোবাসার মানুষ? সত্যিই কি তিনি আয়মান সাহেবের সাথে ওদের এত দূরত্বের কারণ? নিশীথের মন ভাবনায় ব্যাকুল! ভাবনাদ্বয়কে স্বস্তি দিতে ও দরজা ঠেলে প্রবেশ করে রুমের ভেতর।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬

ওকে আচমকা এ সময় ঢুকতে দেখে প্রচন্ড অবাক হলেন ইউনুস সাহেব, কিছুটা অবাক হলো নিশান নিজেও! তবে ও মনে মনে খুশি হলো। এবার নিশীথ এসেছে, একা নিশান দাদুর কাছে থেকে যে কথা বের করে নিতে পারছিলোনা, এবার নিশীথ আসায় নির্ঘাত ওরা সক্ষম হবে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬ (৩)