নিভৃতে তেজস্বিনী গল্পের লিংক || নামিরা নূর নিদ্রা

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ১
নামিরা নূর নিদ্রা

“বিয়ের প্রথম রাতে কোথায় বরের সাথে থাকব, সেটা না করে সতীনের বাচ্চার জন্য ফিডার তৈরি করতে হচ্ছে।”
রান্নাঘরে থাকা নতুন বউয়ের রাগী চেহারা দেখে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে ওঠে সিরাতের। তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে সে বিছানার মাঝখানে বসে আছে। ঘর থেকে রান্নাঘর সরাসরি দেখা যায়। পাশেই অবাক চোখে দাঁড়িয়ে আছে মাহতাব। স্ত্রীর এমন রূপের সাথে সে মোটেই পরিচিত নয়।

“সিরাত সমস্যা কী তোমার? নিমু আমার স্ত্রী। ওকে দিয়ে তুমি এভাবে কাজ করাতে পারো না।”
“তাহলে আমি কে?”
“তুমিও আমার স্ত্রী।”
“ঘরে বউ, বাচ্চা রেখে আরেকজনকে বিয়ে করার কোনো মানে হয় মাহতাব?”
“তোমার সাথে পাঁচ বছর তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তোমার প্রতি আমার কোনো অনুভূতিই কাজ করে না। এতে দোষ কী আমার?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

“অনুভূতি কাজ করে না? অথচ প্রতি রাতে আমার কাছে ঠিকই আসতে পারো। অনুভূতি যদি না থেকে থাকে তাহলে আমার কোলে তোমার বাচ্চা এলো কীভাবে? কাছে আসার সময় অনুভূতি ঠিকই জন্মায়। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় অনুভূতি শেষ?”

কথাগুলো বলার সময় রাগে সিরাতের চোখের কোণে পানি জমা হয়। বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে সে এক নজরে তার সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে। এই মানুষটাকে তার কাছে বড্ড অচেনা লাগছে আজ।
মাহতাব সিরাতের পাশে এসে বসে শান্ত স্বরে বলে,

“আমি তোমার বা আমাদের সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু নিমুর প্রতিও আমার একটা দায়িত্ব আছে। ওকে বিয়ে করে এই বাসায় এনেছি আমি। এখন চাইলেই ওকে বাসা থেকে বের করে দিতে পারব না আমি।”
“ভালো তো। বের করতে হবে না। থাকুক এখানেই সে।”
“আমি তোমার মতো মেয়ের সাথে এক বাসায় কিছুতেই থাকতে পারব না।”
নিমুকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে সিরাত স্বাভাবিকভাবে বলে,

“তাহলে বেরিয়ে যাও। এই বাসা আমার, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাও আমার। তুমি কোথা থেকে আসলে হ্যা?”
“মাহতাব আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।”
“সে বিবাহিত জেনেও সম্পর্কে কেন জড়ালে তুমি? তুমি কেমন মেয়ে বলো তো? পরিবার থেকে কোনো সুশিক্ষা পাওনি তাই না?”

“খবরদার আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না তুমি। তুমি কেমন মেয়ে যে নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পারোনি?”
নিমুর চিৎকারে বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সিরাত। নিমুর হাত থেকে ফিডার নিয়ে বাচ্চাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,

“মাহতাবের কথা অনুযায়ী, আমি অনেক সহজসরল একজন। তো আমি কতটা সহজসরল সেটা তো ওকে দেখাতে হবে। ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না৷ তুমি আপাতত নিজের কথা ভাবো।”
সিরাতের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে নিমু মাহতাবকে প্রশ্ন করে,
“আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই রাতটা আমাদের জন্য বিশেষ একটা রাত। তুমি কি সারারাত তোমার প্রথম স্ত্রীর সাথেই থাকবে?”

মাহতাব লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সিরাতকে উদ্দেশ্যকে করে বলে,
“তুমি বাচ্চাকে নিয়ে অন্য ঘরে যাও৷ আগামীকাল নিমুর জন্য অন্য ঘরের ব্যবস্থা করব আমি।”
“রাত বাজে এখন এগারোটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট। এখন যদি আমি পুলিশকে কল করি সেটা কি ভালো দেখাবে মাহতাব?”

“সিরাত!”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি হয়তো জানো না বিয়ের আগে আমি কেমন ছিলাম। আমাকে বেশি ঘাটানোর চেষ্টা করো না। ফল ভালো হবে না। এখন বের হয়ে যাও ঘর থেকে।”

মাহতাব আর কোনো কথা না বলে নিমুর হাত ধরে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। অন্য ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সিরাত ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। তার পা যেন আর চলতে চাইছে না। বিছানার উপর বসে তিন বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটাকে বুকের মাঝে আগলে নেয় সে। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নোনাপানির স্রোত চোখ বেয়ে উপচে পড়ে। চোখ বন্ধ করে সে আনমনে ভাবে,

“বিয়ের আগে আমি এমন ছিলাম না মাহতাব। তোমার সাথে যখন আমার বিয়ে হলো তখন থেকে আমি ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তোমার যেন আমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে সেই চেষ্টা করে গিয়েছি প্রতিনিয়ত। লক্ষ্মী বউ হওয়ার চেষ্টা করেছি। তুমি সব সময় আমাকে বলতে, ভালোবাসো। আমাকে ছাড়া নাকি তুমি আর কাউকে নিয়ে ভাবতেই পারো না। অথচ সেই তুমিই আজ অন্য একজনকে বিয়ে করে সেই বাসায় এনে তুললে যেখানে তোমার প্রথম স্ত্রী আর সন্তান উপস্থিত।”

অনেক চেষ্টা করেও সিরাত নিজেকে সামলাতে পারে না। কোন মেয়েই বা সহ্য করে পারে এমন কিছু!
“পাঁচ বছরে একটা দিনও তুমি আমাকে বুঝতে দাওনি তোমার আরেকজনের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা জন্মেছে। গতকাল অবধিও তুমি আমার সাথে ছিলে। ভালোবেসে নিজের বুকের মাঝে আমাকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়েছিলে। এক মুহূর্তের মাঝে ভালোবাসা এভাবে কীভাবে বদলায়? আমার পাঁচ বছরের ভালোবাসা কেন এভাবে হেরে গেল মাহতাব? তোমাকে ভালোবাসার জন্য কোনো কমতি তো আমি রাখিনি!”

আনমনে কথাগুলো ভাবার সময় সিরাতের মনে পড়ে ঘণ্টা দুয়েক আগের কথা। যখন সদর দরজা খুলে মাহতাবের সাথে নিমুকে দেখেছিল সে।
কলিংবেলের আওয়াজে সদর দরজা খুলে দেয় সিরাত। হাসিমুখে দরজা খুলে মাহতাবের পাশে বিয়ের সাজে সজ্জিত এক নারীকে দেখে নিমিষেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। অবাক চোখে সে প্রশ্ন করে,

“এসব কী মাহতাব?”
মাহতাব নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আমি নিমুকে বিয়ে করেছি। আজ থেকে সে আমার সাথে এই বাসায় থাকবে।”
কথাটা শুনে দুই পা পিছিয়ে যায় সে। কাঁপা কণ্ঠস্বরে সামনে থাকা মানুষটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“কেন করলে এমন?”

“তোমার মতো এত সরল একজনকে আমার স্ত্রী হিসেবে আমার পাশে মানায় না সিরাত। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও তুমি একই রকম আছ। আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি তোমার উপর। তাই আমি নিমুকে বিয়ে করেছি। আমি ওকে ভালোবাসি। তোমার যদি নিমুর সাথে থাকতে সমস্যা হয় তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।”
মাহতাবের কথাগুলো যেন কাঁটার মতো বিঁধে যায় সিরাতের শরীরে। পাঁচ বছরের সংসারে নিজের সবটুকু দেওয়ার পরেও সে তার স্বামীর মন পায়নি ভেবেই অবাক হয় সে। আজ তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কান্নাগুলো সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলার মাঝে। তবুও সে জিজ্ঞেস করে,

“এই পাঁচ বছরে আমার প্রতি কি তোমার একটুও ভালোবাসা জন্মায়নি মাহতাব?”
মাহতাব খানিক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“হয়তো ভালোবাসি। কিন্তু আমি নিমুকে ছাড়তে পারব না।”
“ঘরে আমাদের তিন বছরের মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। সে ঘুম থেকে উঠে যখন জিজ্ঞেস করবে কে এই মেয়ে তখন কী জবাব দেবে তুমি তাকে?”

এই প্রশ্নের কোনো জবাব মাহতাব দিতে পারে না। আদৌও কি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে তার কাছে?
“কী হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
“আমি এত কিছু জানি না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সাথে আর কোনো কথা বলতে চাই না।”
কথাটা বলে মাহতাব নিমুকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলে সিরাত বেশ শক্ত কণ্ঠে বলে,

“দাঁড়াও মাহতাব। তোমরা তো এভাবে ভেতরে যেতে পারবে না।”
“মানে?”
“এই মুহূর্তে যদি আমি পুলিশকে কল করে জানাই যে আমার স্বামী আমার উপর অ*ত্যা*চার করে। এমনকি আমাকে বাসায় রেখে অন্য নারীদের সাথে সম্পর্কে রেখে দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়েছে। আর আজ সে অন্য একজনকে বিয়ে করে এনেছে। এরপর যদি বাসায় পুলিশ আসে সেটা কি ভালো হবে?”
“এসব কী বলছ তুমি? পাগল হয়ে গিয়েছ?”

“এমন কিছু হোক সেটা যদি তুমি না চাও তাহলে আমি যা বলব সেটাই করবে তুমি।”
এরমাঝে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে ঘরে ছুটে যায় সিরাত। মেয়েকে কোলে নিয়ে মাহতাবের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোমার নতুন বউকে বলো বাচ্চার জন্য ফিডার তৈরি করে আনতে।”
“অসম্ভব! আমি পারব না।”

নিমুর কথায় সিরাত সরু চোখে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কল করব পুলিশকে?”
“না থাক, আমি বলছি ওকে।”
মাহতাবের মুখে ভয়ের ছাপ দেখে মুচকি হাসে সিরাত।

“নিমু দয়া করে আর কথা বাড়িয়ো না। আমি সবকিছু সামলে নেব। আপাতত তুমি রান্নাঘরে গিয়ে বাচ্চার জন্য ফিডার তৈরি করে আনো।”
“মাহতাব?”

“ঝামেলা করো না নিমু৷ এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা না চাইলে যা বলছি সেটা করো।”
একরাশ রাগ নিয়ে নিমু ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ২