নীলচে তারার আলো পর্ব ২৪

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৪
নবনী নীলা

হিয়া ছাদ থেকে নামছিলো। নামার সময় শাড়িতে পেঁচিয়ে পরে গিয়ে ভীষণভাবে পায়ে ব্যাথা পেলো। হাঁটতে গেলেই ব্যাথা হচ্ছে পায়ে। নিজের উপরেই এখন রাগ লাগছে। কোনোভাবে নিজের রুমে যেতে পারলেই হলো। কিন্তু হটাৎ নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করতেই দেখলো শুভ্র তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হিয়া চোখ বড় বড় করে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র রাগী গলায় বললো,” লাফালাফি একটু কম করতে পারো না।

হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্র কখন এলো। হিয়া বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যখন শুভ্র তাকে কোলে করে নিজের রূমে ঢুকলো। হিয়া চোখ পিট পিট করে শুভ্রের দিকে দুইবার তাকালো। তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,” আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।” বলতে বলতে শুভ্র হিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
হিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। এইটা কি স্বপ্ন? এই বনমানুষ তাকে নিজের ঘরে এনেছে তাও আবার নিজের বিছানায় এনে বসিয়েছে। হিয়া ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। পা টা কি ভেঙে গেলো নাকি? কয়েকবার আর্তনাদ করতেই শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পায়ে স্পর্শ করলো। হিয়া পা সরিয়ে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললো,” কি করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” স্টুপিডের মতোন কথা বলবে না। দেখি পা এইদিকে আনো।”
হিয়া রাগী গলায় বললো,” না।” শুভ্র বিরক্ত হয়ে নিজেই এগিয়ে এসে হিয়ার পা থেকে শাড়িটা হালকা উপরে তুলতেই হিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে শাড়ী নামিয়ে বললো,” আমি আপনাকে দেখাবো না। আপনি কোনো মহিলা ডাক্টারকে ডাকুন।”

শুভ্র ভীষন রেগে গিয়ে বললো,” শাট আপ। একটাও কথা যদি আর বলেছো।”
শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার পা মচকে গেছে কিনা দেখছে। হিয়া শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে ধরে নাক মুখ কুচকে আছে। পায়ে তার ভীষন সুড়সুড়ি কিন্তু এই লজ্জার কথা এই বনমানুষটাকে বলবেই বা কি করে? লোকটা কিছুই বুঝে না। হিয়া কিছুক্ষণ পর হটাৎ ব্যাথাটা আর অনুভব করছে না। শুধু পা নাড়াতেই রগে ব্যাথা হচ্ছে। হিয়া আস্তে করে শাড়ী দিয়ে নিজের পা ঢেকে ফেললো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো ,” চুপচাপ এইখানে বসে থাকো আমি আসছি।” বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।

হিয়া বসে আছে, শুভ্রের ঘরটা দেখছে। দেওয়াল গুলো একদম সাদা। শুধু একটা দেওয়াল ধূসর রঙের। আর পর্দাগুলো হালকা নীল রঙের। খুব গুছানো একটা ঘর। মেয়ে হয়েও তো সে নিজের ঘর এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে না। হটাৎ কেনো জানি তার এই ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে। ঘর সাজানো হিয়ার তেমন পছন্দ হয়নি কিছু ওয়ালম্যাট থাকলে ভালো হতো। কিন্তু তাও শুভ্রের সাথে থাকটে ইচ্ছে করছে। অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা থাকলে সে এই ঘরে থেকে দেখতো লোকটা সারাদিন এই ঘরে কি করে।

শুভ্র কিছুক্ষণ পর আইস কিউব নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তারপর হিয়ার পাশে বসে হিয়ার পা নিজের কোলে নিতেই হিয়া বেশ চমকালো। শুভ্র খুব যত্ন করে লাল হয়ে যাওয়া জায়গায় বরফ দিচ্ছে। ছোটো বেলা থেকে একটু পরে গেলেই হিয়ার ফর্সা গায়ে সেটা রক্তিম বর্ন ধারণ করতো। শুভ্র একবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে ব্যাথা কমেছে কিনা জানতে চাইলো। হিয়া বললো ব্যাথা কমেনি কিন্তু ব্যাথাটা অল্প আছে। মিথ্যে বলেছে কেনো সে জানে না। হয়তো শুভ্রের তার প্রতি এই যত্ন তার ভালোলাগছে।

শুভ্র আবারো জিজ্ঞেস করলো,” একটুও ব্যাথা কমেনি?” শুভ্রের ধারণা অনুযায়ী ব্যাথাটা কমে যাওয়ার কথা।
হিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। তারপর ব্যাথাতুর মুখভঙ্গি করলো। শুভ্র কয়েকবার পলক ফেলতেই রবীউল সাহেব আর সাহারা খাতুন ঘরে ঢুকলেন। দুজনেই হিয়াকে শুভ্রের ঘরে দেখে চমকালেন। হিয়ার তাদের চেহারার সে চমক দেখতে পাচ্ছে।

সাহারা খাতুন অবাক ভঙ্গিতে বললেন,” ওর পায়ে কি হয়েছে?”
শুভ্র বরফের বাটিটা একপাশে রাখতে রাখতে বললো,” সিড়িতে পড়ে গেছে।”
রবিউল সাহেবের সেইদিকে কোনো চিন্তা নেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,” হিয়া এইঘরে কি করে এলো?” এই প্রশ্নে হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইস নিজের রুমে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো।
শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” আমি এনেছি। কেনো তোমার কোনো সমস্যা?”
শুভ্রের এমন প্রশ্নে রবীউল সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,” সামনে ওর বিয়ে আর তুমি ওকে কেনো তোমার ঘরে এনেছো? এই রহিমা, রহিমা।” বিয়ের প্রসঙ্গটা শুধু শুভ্রকে রাগাতে বলেছেন তিনি। ঈশারায় হিয়াকে বুঝ দিলেন। খালা রীতিমত ছুটে আসতেই রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে ধরে নিজের রুমে দিয়ে আয়।” আর কিছু বলার আগেই শুভ্র কঠিন গলায় বললো,” হিয়া কোথাও যাবে না।”

শুভ্রের মুখে নিজের নাম শুনে হিয়া ভীষন অবাক হলো। কিন্তু ছেলের এমন উক্তিতে রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে তোমার ঘরে রাখার অনুমতি আমি কখনোই দিবো না।”
শুভ্র একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,” তোমার কাছে অনুমতি চেয়েছে কে?”
সাহারা খাতুন কঠিন গলায় তার স্বামীকে বললেন,” বুড়ো হয়েছো। কিন্তু বুদ্ধি জ্ঞান সব কি দিন দিন হারাচ্ছো? চুপ চাপ নিজের ঘরে এসো। হিয়া এখন থেকে এই ঘরেই থাকবে।” বলেই রবীউল সাহেবকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলেন। তারপর বেড়িয়ে এসে আরো বললেন,”এই বিয়ের চ্যাপ্টার বাদ। এই নিয়ে যদি আর কোনো বাড়াবাড়ি তুমি করেছো। আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তুমি আর তোমার বোন থেকো।” সাহারা খাতুনের এমন রূপ রবীউল সাহেব এর আগে দেখেনি।

হিয়া শেষের কথাটা শুনেই লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পড়লো। লাফাতে গিয়ে পায়ে একটু ব্যাথা অনুভব হলো। অ্যহায় শাশুড়িটা বলে কি? হিয়া শুভ্রের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার সামনে আসতেই শুভ্র দরজা লাগিয়ে দিয়ে কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো।
হিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আমার পা ঠিক আছে। আমি হেঁটে হেঁটে নিজের রুমে যেতে পারবো। আমার প্রতি এতো সহমর্মিতা দেখানোর জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।” শেষের কথাটা শুনে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো তারপর বললো,” চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসো। একদম দরজা খোলার চেষ্টা করবে না।”

” মানে? কি আশ্চর্য। আমাকে যেতে দিন।”,বলেই এগিয়ে এসে দরজা খোলার চেষ্টা করলো। শুভ্র এক হাত পকেটে ভরে অন্যহাতে দরজার লক ধরে আছে। হিয়া নিজের সর্ব শক্তি দিয়েও পারছে না। এতক্ষণ এই ঘরে থাকার ইচ্ছে হলেই শাশুড়ির শেষ বাক্যটি কানে আসতেই সে ইচ্ছে কর্পুরের মতন উড়ে গেছে।
শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ে ব্যাথা নিয়েও কিভাবে দরজা খোলার জন্য এই মেয়ে লাফাচ্ছে। শুভ্র তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” তুমি নিজে গিয়ে বিছানায় বসবে নাকি আমায় নিয়ে যেতে হবে। তোমার পায়ের ব্যাথা কি উড়ে গেছে?”

” আমি এই ঘরে থাকবো না।”, রেগে বললো হিয়া।
শুভ্র দরজার লক থেকে হাত সরিয়ে শার্টের হাতা ভাজ করে বললো,” আমাকে বলছো কেনো? সাহস থাকে তো আমার মাকে গিয়ে বলো।”
শুভ্র লক থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে, চোখ পড়তেই হিয়া দরজা খুলে পালাবে তার আগেই শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে নিলো। হিয়া পরাজয় মেনে নিলো কারণ তার পায়ে এবার সত্যিই ব্যাথা হচ্ছে। শুভ্র হিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,” এবার তো তুলে এনেছি এইখান থেকে নামবে তো পরের বার বেধে রাখবো।”
” আপনি তো আমাকে আপনার রুমে এলেই গেট আউট গেট আউট করতেন এখন আবার আপনি আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেনো?”, বিস্ময় নিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র উত্তরে কিছু বললো না। হিয়া গভির চিন্তায় পড়ে গেলো। শুভ্র কি তাহলে নিজে থেকে চাইছে সে তার কাছে থাকুক। এই বনমানুষটা এমন কিছু চাইতে পারে বলে তো মনে হচ্ছে না। একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। হিয়ার এইবার রবীউল সাহেবের ঈশারা আন্দাজ করতে পারছে।
হিয়া একটু সাহস জুগিয়ে বললো,” দেখুন কিছুদিন পর আমার বিয়ে আপনি এইভাবে আমাকে আপনার ঘরে রাখতে পারেন না। আর এমনিতেও আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না।”
হিয়ার এমন উক্তিতে শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” বিয়ে… তোমার? ভেরি গুড। স্টে ইন ইউর ড্রীমস।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” মানে। কি বলতে চান আপনি?”
শুভ্র পকেটে হাত ভরে শান্ত দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” হু ইজ স্ট্যান্ডিং ইন ফ্রন্ট অফ ইউ?”
হিয়া দুইবার পলক ফেললো এইটা আবার কেমন প্রশ্ন? এই লোকটা কি নিজের নাম ভুলে গেছে? হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” শুভ্রনীল আহমেদ।” অনেকটা খাপ ছাড়া ভাবেই বললো হিয়া।
” নো। অ্যাম ইউর হাসব্যান্ড।”, গম্ভীর গলায় বললো শুভ্র। চোখে মুখেই শুভ্রের কথাটার গাম্ভীর্য টের পাচ্ছে হিয়া।
হিয়া এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো। শীতল শিহরণ বয়ে গেলো হিয়ার মাঝে। হিয়া জড়ানো গলায় বললো,” আচ্ছা, আমার তো মনেই ছিলো না। অবশ্য মনে থাকার মতো কিছু আপনি করেছেন বলে মনে হয় না।” হিয়া নিজে নিজেই বির বির করছিল।

শুভ্র সবটা শুনে পকেট থেকে হাত বের করে হিয়ার দুপাশে রেখে ঝুকে আসতেই হিয়া হকচকিয়ে উঠে বললো,” কি করছেন আপনি?”
শুভ্র শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। যে দৃষ্টি হিয়াকে অনায়াসে কাবু করে ফেলে। ছটটফট হিয়া তখন শান্ত হয়ে সেই দৃষ্টিতে হারিয়ে গেলো। হিয়ার আঁচলে মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো নিজের হাতের ভাজে আটকে পরক্ষণেই হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। তারপর গভীরভাবে কিস করলো। শুভ্রের হটাৎ এমন আচরনে হিয়া পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। প্রতি মুহুর্তে হৃদ কম্পন যেনো কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।শুভ্রকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো উপায়ও তার কাছে নেই।

কিছুক্ষণ পর শুভ্র সরে আসতেই হিয়া মাথা নিচু করে জোরে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। লজ্জায় গাল দুটোয় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
শুভ্র এক হাত দিয়ে হিয়ার চিবুক ছুঁয়ে মুখটা উপরে তুলেতেই হিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।” কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো।

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৩

কোনো ছেলের চোখ যে এতোটা সুন্দর হতে পারে এইটা আমার ধারণার বাহিরে ছিলো। সবে মাত্র ভিড় ঠেলে বেড়িয়েছি। কালো রঙের হুডি, কালো মাস্ক আর চোখ দুটো কালো ফ্রেমের চশমায় বদ্ধ সঙ্গে ধূসর রঙের ট্রাউজার পরা লম্বা ছেলেটি পকেটে হাত ভরে দাড়িয়ে আছে।
শুধু মাত্র চোখ দেখে বিমোহিত হয়ে আম্মুর থেকে টাকা নিয়ে বাচ্চাদের মত মাফিন কেক কিনতে গিয়েছিলাম দোকানটায়। তখন এক শান্ত শীতল কণ্ঠ কানে ভেসে এসেছিল,” তুমি কি বেরিয়েছ?”…………….[ নবনীর রোড ক্রাশ।?]{ সমাপ্ত }

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৫