একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২২

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২২
সাদিয়া জাহান উম্মি

নিস্তব্ধ হাসপাতালের কেভিনে প্রাহির হাত ধরে বসে আছে অর্থ।গুলি বের করে দেওয়া হয়েছে প্রাহির হাত থেকে।অনেকটা রক্ত ঝরেছে প্রাহির শরীর থেকে।ঘুমের মেডিসিন ইঞ্জেক্ট করায় ঘুমোচ্ছে প্রাহি।জ্ঞান ফিরলেই রিলিজ দিয়ে দেওয়া হবে হাসপাতাল থেকে।তবে আজ রাতে জ্ঞান নাও ফিরতে পারে জানিয়েছেন ডাক্তার।অর্থ করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাহির দিকে।ভীতরটা জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে প্রাহির এমন ফ্যাকাশে মুখশ্রী দেখে। অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে।অর্থ গভীর কন্ঠে বলে,

‘ তোমার সব কষ্ট আমার হোক।তোমার সব যন্ত্রনা আমার হোক।তোমার বিষাদ তোমার দুঃখ আমার হোক।আর আমার সমস্ত সুখ যেন তোমার হয়।জলদি জেগে উঠো প্রাহি।এইভাবে তোমাকে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।আমার হৃদয়টা ঠিক কতোটা ব্যাকুল হয়ে আছে তোমার জন্যে তুমি কি বুঝতে পারছো না?’
প্রাহি নিশ্চুম।সেযে অর্থ’র কথা কিছুই শুনেনি।অর্থ’র হৃদয়টা যে ওর জন্যে ছটফট করে যাচ্ছে ক্রমাগত তাতো কিছুই জানলো না মেয়েটা।কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে সে।অর্থ আরো করুণ চাহনী নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো প্রাহির দিকে।এদিকে ক্রমাগত ভাইব্রেট করে শব্দ তুলে যাচ্ছে ওর ফোন।অবিরত বেজে চলেছে ওটা।শেষে না পেরে ক্লান্ত হাতে ফোনটা তুলে অর্থ।রায়হানা বেগম ফোন করেছেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ হ্যালো মা!’
রায়হানা ব্যাকুল কন্ঠে বলেন,
‘ বাবা তুই কোথায়?রাত একটা বাজতে চললো।তুই আর প্রাহি কোথায় আছিস?’
অর্থ’র ক্লান্ত কন্ঠে,
‘ মা টেন্সন করো না আমরা ঠিক আছি।আম্মুর কিছু চেক-আপ আছে।আজ নাও ফিরতে পারি।কারন বিদেশ থেকে ভালো একজন ডাক্তার এসেছেন তার মাধ্যমেই এখন থেকে আম্মুর চিকিৎসা হবে।’
মিথ্যে বললো অর্থ।কিন্তু মায়ের মন কি এতো সহজে মানে?
‘ আব্বা,এমন শোনাচ্ছে কেন তোর কন্ঠ?কি হয়েছে আব্বা তোর?বেয়ানের কি শরীর বেশি খারাপ তোর বাবা আর আমি কি আসবো?’
অর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘ মা,এতো অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয়নি।তিনি ঠিক আছেন।শুধু উনাকে কিছু চেক-আপ করানো হবে।তাই আমি আর প্রাহি আজ রাতটা এখানেই থাকবো মা।আর তুমি নিজের দিকে ধ্যান দিয়েছো?তোমার নিজেরই তো শরীর ভালো নেই।বুকের ব্যাথা নিয়ে তুমি এতো দূর জার্নি করবে কিভাবে মা?আর এতো রাত হয়েছে ঘুমাও নি কেন?বাবাও নিশ্চয়ই জেগে?’
‘ তোদের জন্যে চিন্তা হচ্ছিলো।সন্তানের চিন্তায় কি বাবা মা’র ঘুম আসে আব্বা।যাক, সাবধানে থাকিস।কাল জলদি ফিরিস।মনটা কেমন যেন করছে তোর আর প্রাহির জন্যে আব্বা।ভালো থাকিস।আর বেয়ানের সম্পর্কে ভালোমন্দ জানাস কেমন?রাখছি।আর হ্যা! খেয়েছিস?’

‘ হ্যা মা খেয়েছি।তুমিও খেয়ে নেও।আমি জানি তুমি এখনো খাওনি।’
রায়হানা হাসলেন ছেলের কথায়,
‘ আচ্ছা আব্বা খাবো।রাখি এখন!’
‘ আল্লাহ্ হাফেজ।’
রায়হানা ফোন রাখতেই অর্থ আবারও একই ভঙিতে বসে রইলো প্রাহির হাত ধরে।এর মাঝে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে আরাফ।হাতে খাবারের প্যাকেট।অর্থ’র কাছে গিয়ে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ কতোক্ষন না খেয়ে থাকবি?কিছু খেয়ে নেহ অর্থ।এইভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।তুই অসুস্থ হলে
প্রাহির সেবা করবে কে হ্যা?’

অর্থ শান্ত চোখে তাকালো।আরাফ দেখলো ওই চোখে ঠিক কতোটা কাতরতা,অস্থিরতা,কষ্ট লুকানো রয়েছে নিজের প্রিয় মানুষটিকে এই অবস্থায় দেখে। আরাফের নিজেরও এমন লাগে হিয়ার কিছু হলে।আরাফ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘ অল্প কিছু খেয়ে নেহ।জোড় করবো না।শুধু বলবো প্রাহির জন্যে হলেও তোকে খেতে হবে।মেয়েটাকে তো তোকেই এখন থেকে দেখাশোনা করতে হবে।’

আরাফ বেরিয়ে গেলো।তবে পুরোপুরি গেলো না।দরজা হালকা ফাকা করে উঁকি দিতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।অর্থ খাচ্ছে।যাক তার কথা তাহলে কাজে দিয়েছে।আরাফ গিয়ে চেয়ারে হেলাম দিয়ে চোখ বুঝলো।সারাদিনে ওর শরীরেও কম ধকল যায়নি।সেই রাজশাহী থেকে জার্ণি করে এখানে আসা,ঢাকা শহরের জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা।তার উপর কিসব ঘটে গেলো।মন মানুষিকতা একদম ভালো নেই ওর।কয়েকদিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি ইলফার উপর নজর রাখার কারনে।এখন আর শরীরটা চলছে না।চোখে ঘুম নেমে আসছে।চোখ বুঝতেই হিয়ার মায়াবি মুখটা ভেসে উঠলো।মুখে হাসি ফুটে উঠতেই পরক্ষনে তা আবার নিভে গেলো।কাজের কারনে মেয়েটাকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারছে না।আজ দু’দিন যাবত ফোন করে না আরাফ।মূলত সময় পায়নি একটুও।অভিমান জমেছে ওর প্রেয়সীর মনে।সমস্যা নেই কাল তো যাচ্ছেই ওর প্রেয়সীর কাছে কাল সব অভিমান নিজের ভালোবাসা দিয়ে ভেঙ্গে দিবে।

রাত চারটা বেজে ছত্রিশ মিনিটে জ্ঞান ফিরে আসে প্রাহি।আধো আধোভাবে নিজের নয়ন জোড়া খুলে ঝাপসা দৃষ্টিতে চারপাশ তাকায়।মুহূর্তেই নজরে আসে অর্থ’র ঘুমন্ত ক্লান্ত মুখশ্রী।লোকটা কিভাবে ঘুমাচ্ছে।ঘুমন্ত অবস্থাতেও কাউকে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে কিভাবে?এইযে প্রাহি মাঝে মাঝে কতোরাত ঘুমায় না।লোকটার ঘুমন্ত চেহারা যেদিন চোখে পরবে সেদিন আর ঘুমাতে পারেনা ও।নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে অর্থ’র দিকে।প্রাহি বহু কষ্টে একটু উঠে বসার চেষ্টা করতে হাতে ব্যাথা পায় ও।হালকা আর্তনাদ করতেই ধরফরিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে অর্থ।প্রাহি ব্যাথাতুর চাহনী,আর মুখশ্রী লক্ষ্য করতেই অস্থির হয়ে উঠে অর্থ,

‘ কি হয়েছে প্রাহি?কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?আর কখন জাগলে তুমি?আমাকে ডাক দিবে না?এইভাবে উঠতে গেলে কেন?পেলে তো ব্যাথা?আমি কি ডাক্তার ডাকবো?বেশি ব্যাথা করছে?’
প্রাহি অর্থ’র মুখে হাত দিয়ে দিলো।থেমে গেলো অর্থ’র ক্রমাগত আওড়ানো বুলিগুলো।প্রাহি দূর্বল কন্ঠে বলে,
‘ হুসসসস! এতো অস্থির হওয়ার কিছু হয়নি।আমি ঠিক আছি বুঝেছেন?’

অর্থ করুনভাবে তাকালো।মুখ হতে প্রাহির হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের দুহাতের মুঠোয় তা ভরে নিলো।বললো,
‘ এইভাবে আমাকে এতোটা কষ্টের মাঝে না রাখলেও পারতে।কেন এইভাবে নিজের জীবন ঝুকিতে দিয়েছিলে আমার জন্যে।তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে কি কর‍তাম প্রাহি?উপরওয়ালা আমাদের উপর রহম করায় অল্পতেই বেঁচে গিয়েছো।তবুও জানো ঠিক কতোটা বাজেভাবে গুলিটা গেঁথেছে তোমার হাতে?কতোটা ব্লিডিং হয়েছে।আজ আরাফ না থাকলে আমি যে কি কর‍তাম আমি নিজেও জানি না।ব্লাড পাওয়া যাচ্ছিলো না তোমার।আরাফ এটা শুনতেই দ্রুত বলে ওর রক্ত আর তোমার রক্ত সেম।তাই যেন যতো রক্ত লাগে ওর থেকে নিতে।এই ছেলেটাকে আমি কিভাবে যে ধন্যবাদ দিবো বলে বুঝাতে পারবো না।আর কখনো এমন করবে না প্রাহি।নিজের প্রান দিয়ে আমাকে বাঁচাতে আসবে না।আমি তাহলে তোমাকে কখনই ক্ষমা করবো না।’

অর্থ’র মুখ হতে নিশ্রিত প্রতিটা বাক্য ঠিক কতোটা ব্যাকুলতায় ভরপুর তা খুব করে বুঝতে পারছে প্রাহি।লোকটা যে ওর জন্যে ঠিক এতোটা পাগলামি করবে কখনো ভাবতেও পারিনি ও।প্রশান্তিতে মন ভরে উঠে প্রাহির।লোকটাকে ও ভালোবাসে।তাকে বাচাঁতে একবার কেন?হাজার বার প্রাহি নিজের জীবন দিতে রাজি।প্রাহি মনেপ্রানে চায় শুধু সে ভালো থাকুক।অর্থ’র ব্যাকুল কন্ঠ,
‘ খুদা পায়নি?কিছু খাবে?’
প্রাহি মাথা নাড়ালো তার আসলেই অনেক খিদে পেয়েছে।সেই সন্ধ্যায় হালকা কিছু নাস্তা করেছিলো ও।ডিনারও করেনি।অর্থ দ্রুত পায়ে উঠে দাড়ালো।প্রাহির দুগালে হাত রেখে বলে,
‘ সুয়ে থাকো।আমি খাবার নিয়ে আসছি কেমন?কোন সমস্যা হলে বামহাতটা দিয়ে একটু কষ্ট করে আমাকে ফোন দিও কেমন?’

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২১

প্রাহি ঘার কাত করে সম্মতি দিতেই অর্থ চলে গেলো দ্রুত পায়ে।তারপর কিছুক্ষন বাদেই সে খাবার নিয়ে হাজির।এতো দ্রুত কিভাবে গেলো লোকটা?প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অর্থ’র দিক।অর্থ খাবার গুলো সাজিয়ে।প্রাহি উঠে বসিয়ে দিলো ভালোভাবে।তারপর নিজ হাতে প্রাহিকে খাইয়ে দিতে লাগলো আর প্রাহি খাচ্ছে আর মনভরে দেখতে লাগলো ওর স্বামির পাগলামিগুলো।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৩