একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২১

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২১
সাদিয়া জাহান উম্মি

‘ জ্বি এখানে কি করতে এসেছেন?’ প্রশ্ন করে উঠলো একজন গার্ড।এমন প্রশ্নে ইলফা ঘাবড়ে গেলো তাও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে,
‘ আমি এখানের রোগিকে চেক-আপ করতে এসেছি।
গার্ডটি ভ্রু-কুচকে বলে,

‘ কিন্তু আপনি তো এখানের নার্স না?এখানের জন্যে আমাদের স্যার নিজ তাগিদে নার্স আর ডাক্তার নির্ধারন করে গেছেন একমাত্র তারাই এখানে আসতে পারবে।’
ইলফা বুকটা ধুপপুক করছে।ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে এসেছে।ঘাবড়ানো কন্ঠ অনেকটা স্বাভাবিক রেখে বলার চেষ্টা করে,
‘ এখানের একজন নার্স অসুস্থ সে সিকলিভ নিয়েছে।তাই তার বদলে আমাকে দেওয়া হয়েছে। সো লেট মি গো প্লিজ।আমার আরো অনেক কাজ আছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গার্ডটি সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই ইলফা ঢুকতে দিলো।ভীতরে ঢুকতে পেরে বিশ্বজয়ী হাসি দিলো ইলফা।সে নার্স-এর ছদ্মবেশে এসেছে প্রাহির মা’কে এখান থেকে কিডন্যাপ করার জন্যে।ইলফা চিন্তিত হয়ে পরলো।মনে মনে বলে,
‘ এখানে এসে তো পরলাম কিন্তু আমি এই মহিলাকে নিয়ে বের হবো কিভাবে এই রুম থেকে।’
মনে মনে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেলো।আস্তে করে প্রাহির মা’র কাছে গিয়ে উনার শরীর থেকে চিকিৎসারত সব খুলে ফেলে।বহু কষ্টে স্ট্রেকচারে উঠিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলো।অতঃপর দরজায় টোকা দিতেই গার্ডটি দরজা খুলে দিলো। প্রাহির মা’কে এই অবস্থায় দেখে গার্ডটি রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,

‘ হচ্ছে কি এসব? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনাকে?এই অনুমতি কে দিয়েছে আপনাকে।’
এইভাবে ধমকানোর কারনে ইলফার রাগ মাথা চরা দিয়ে উঠছে।তবুও নিজের রাগ দমন করে বলে,
‘ উনার সিটিস্ক্যান করানো হবে তাই স্যার উনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
‘ আচ্ছা তাই না-কি ইলফা?’ হঠাৎ অর্থ’র শান্ত আর গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে আত্মা কেঁপে উঠলো ইলফার।অর্থ চোখের মাধ্যমে কিছু ইশারা করতেই স্ট্রেকচার থাকা মহিলাটি উঠে বসলো।আকস্মিক এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে যায় ইলফা।দ্রুত সরে যায় সেখান থেকে।তুতলিয়ে বলে,

‘ সে-কি ইনি উঠে বসছেন কিভাবে?উনি তো কোমায় আছেন তাহলে উনি নড়চড় করছেন কিভাবে?’
অর্থ শান্ত কন্ঠ বলে,
‘ কারন ইনি আম্মু নন।ইনি আমার আন্ডারে কাজ করা একজন মহিলা গার্ড।’
এরমাঝেই অর্থ’র পাশে এসে দাঁড়ায় প্রাহি।প্রাহি এসে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পর পর চারটা থাপ্পর মারে।রাগে চিৎকার করে বলে,
‘ তোর সাহস হলো কিভাবে আমার আম্মুকে কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করার। তোকে তো জানে মেরে দিবো আমি।’
থাপ্পর খেয়ে ছিটকে স্ট্রেকচারের উপরে গিয়ে পরে ইলফা।স্ট্রেকচার সরে গিয়ে ও ধপ করে ফ্লোরে পরে যায়।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে।ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বলে,

‘ তোমরা কিভাবে জানলে এতো কিছু?তোমাদের তো জানার কথা নাহ?’
হঠাৎ আরাফের কন্ঠস্বর,
‘ তুই হয়তো ভুলে গেছিস আমিও তোদের বাড়িতে ছিলাম।আমি ২৪ ঘন্টা তোর উপর নজর রেখেছি।তুই কি কি প্লানিং করেছিস তা আমিই অর্থকে সব ইনফোরমেশন দিয়েছি। তোর মতো শয়তানকে আমার বোন বলতেও ঘৃনা হচ্ছে।ছিঃ! এতোটা জঘন্য তুই।শেষে কিনা এতো নিচে নামলি?’
‘ চুপ থাকো।বোন বলতে বলেছে কে হ্যা?আমি কারো বোন না।আর আজ তো এইসব শেষ হবেই।হয় অর্থ আমার হবে নয়তো কারো নয়।’ কথাগুলো শেষ করে লুকানো পিস্তলটা বের করে উঠে দাঁড়ালো ইলফা।সবার দিকে পিস্তল তাক করে বলে,

‘ এই মেয়েকে মারলেও তুমি আমার হবে না।এর থেকে ভালো আমি তোমাকেই মেরে দেই।তুমি আমার হবে না তো কারো হবে নাহ!’
পাগলের মতো হাসতে লাগলো কথাগুলো বলে ইলফা।তারপর হাসি থামিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে গুলি চালিয়ে দিতেই।প্রাহি দৌড়ে গিয়ে অর্থকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় কিন্তু নিজে বাঁচতে পারে নাহ।গুলিটা একেবারে প্রাহির ডানহাতের বাহুতে গিয়ে আঘাত করে।জোড়ে আর্তনাদ করে উঠে প্রাহি।অর্থ ‘ প্রাহিইইইইইইইইই!’ বলে চিৎকার করে উঠে প্রাহিকে তাড়াতাড়ি নিজের বাহুতে জড়িয়ে বেয়। এদিকে ইলফা হতভম্ভ রাগের মাথায় ও আজ জীবনের প্রথম কারো জান নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

রাগে ওর হুঁশ ছিলো না।ও তো শুধু ভয় দেখিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্লান করেছিলো।আর পিস্তলটা জয় ওকে দিয়েছিলো বলেছিলো এটা নকল যদি ও ধরা পরে যায় তাহলে এই নকল পিস্তল দেখিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে ও যেন পালাতে পারে।কিন্তু জয় যে এতোবড় একটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে ওর সাথে ও ভাবতেও পারিনি এটা তো সত্যিকারের পিস্তল।ইলফার হাত জোড়া থরথর করে কেঁপে উঠে।হাত থেকে পরে যায় পিস্তলটি।এই সুযোগে মেয়ে গার্ডটি ইলফার ঘারের পিছনে আঘাত করে দেয়।যার ফলে ইলফা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।কিন্তু যা হওয়ার তাতো হয়েই গিয়েছে। প্রাহিকে নিজের বাহুতে নিয়ে চিৎকার করছে অর্থ,

‘ এটা কি করলে তুমি?কেন আমাকে সরিয়ে সামন্ব আসলে প্রাহি?এ কি করে বসলে? ডাক্তার! ডাক্তার জলদি আসুন।আমার প্রাহির চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।ওর কিছু হলে আমি সব ধ্বংস করে দিবো।’
প্রাহি জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।ব্যাথায় পুরো শরীরটা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে।এতো যন্ত্রনা হচ্ছে।প্রাহি ভাঙ্গা গলায় বলে,
‘ আ..আমার কি..ছু হয়নি।জাস্ট এক..একটু লেগেছে।আমি ঠি..ঠিক আছি।’

প্রাহির চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে।অর্থ প্রাহিকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে আর চিৎকার করছে।ডাক্তার আসতেই তিনি প্রাহিকে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলেন। হাত থেকে গুলি বাহির করতে হবে জলদি।অর্থ ধপ করে চেয়ারে বসে পরেছে।এদিকে আরাফ গার্ডদের ইলফাকে নিয়ে যেতে বলে অর্থ’র কাছে আসে।আরাফের আজ নিজেকে অপরাধী লাগছে।ওর মাধ্যমেই তো এই মেয়েটা অর্থ’র সাথে পরিচিত হয়েছিলো আজ যদি ওর আর অর্থ’র মাঝে বন্ধুত্ব না হতো তাহলে আজ এই পরিনতি হতো না।আরাফ অর্থ’র পাশে বসলো।মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় বলে,

‘ আমাকে ক্ষমা করে দে বন্ধু।আজ আমার কারনেই তোর সাথে এমনটা হয়েছে।না আমার সাথে তোর পরিচয় হতো না আমরা বন্ধু হতাম।আর না ইলফা তোকে চিনতো।আমি এইসব কিছুর জন্যে দায়ি।আমাকে ক্ষমা কর বন্ধু।’
অর্থ রাগি চোখে তাকালো।সারা মুখশ্রী রাগের কারনে লালাভ আভায় ছেয়ে গেছে।অর্থ চোঁয়াল শক্ত করে বলে,
‘ আর একবার নিজেকে অপরাধী বললে থাপড়ে তোর গাল লাল করে দিবো।আজ তোর কারনেই আম্মুকে আমরা বাচাঁতে সক্ষম হয়েছি।তুই আমার জীবনে ঠিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি বলে বুঝাতে পারবো না।আমি নিজের মনের বহিঃপ্রকাশ ঠিকঠাক করতে পারি না।কিন্তু তোকে ছাড়া আমার একদম চলে না। বুঝেছিস?তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ড আমার ভাই।তাই আর কখনো যেন এইসব কথা মুখে না আসে তোর।ওয়ার্নিং না আদেশ দিলাম!’
আরাফ অর্থকে জড়িয়ে ধরে।ধরা কন্ঠে বলে,

‘ দোস্ত।তুই চিন্তা করিস না একদম।প্রাহি ঠিক হয়ে যাবে। ওর কিছু হবে না।’
কিন্তু বন্ধুর কথায় কি মন মানে?ওর বুকে ঠিক কতোটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রাহিকে এই অবস্থায় দেখে তা ও কাউকে দেখাতে পারছে না।মেয়েটার আঘাতে যেন ওর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।এইযে অর্থ’র নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে দমটা বুঝি এই এক্ষুনি বেড়িয়ে আসবে।বুকের ভীতরটা জ্বলে পুরে যাচ্ছে।কেন এমন হয়?কেন মেয়েটার বিন্দুমাত্র কষ্ট ও সহ্য করতে পারেনা।কেন এতো বুকে ব্যাথা করে? কেন মেয়েটার চোখের পানি ওর হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয় বাজেভাবে?তবে কি ও ভালোবাসে প্রাহিকে?ভালোবাসা কি তবে এটাকেই বলে?ভালোবাসা হচ্ছে পাগলামি। স্বাভাবিক বুদ্ধি হারিয়ে পাগল হয়ে যাওয়ার নামই ভালোবাসা।

ভালোবাসা হচ্ছে অস্বাভাবিক উদারতা। নিজের সবকিছু অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে গরীব হয়ে থাকতে ইচ্ছে করার নামই ভালোবাসা।
ভালোবাসা হচ্ছে বিসর্জন। অন্যের খুশির জন্য নিজের ইচ্ছা, পছন্দকে বিসর্জন দেয়ার নাম ভালোবাসা।
ভালোবাসা হচ্ছে অপেক্ষা। সবসময় কারো পথ চেয়ে অপেক্ষা করার নাম ভালোবাসা।
ভালোবাসা হচ্ছে কারো কষ্ট নিজেকে পাগল পাগল মনে হওয়া।তার বিষাধটুকু নিজের মাঝে সুষে নেওয়ার আপ্রান চেষ্টা।
ভালোবাসা হচ্ছে ধৈর্য।
ভালোবাসা হচ্ছে বিশ্বাস।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি বোনাস পর্ব 

আসলে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা অনেক বিশাল। এটাকে কখনোই লিখে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না। এটা একটা অনুভূতি। যা হৃদয়ের অনেক গভীরে অনুভূত হয়। অনুভব করার মাধ্যমেই একে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারা।
আর অর্থ তা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে।অর্থ বুঝেছে ও ভালোবাসে প্রাহিকে। অসম্ভব ভালোবাসে মেয়েটাকে ও।তার কোন সীমা নেই।সীমাহিন ভালোবাসা যাকে বলে।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২২