নীলচে তারার আলো পর্ব ২৮

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৮
নবনী নীলা

” আমার হাত থেকে পড়েগেছে। সরি……”, আর বলার আগেই শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল ধরে বললো,” একদম চুপ। আর কাদবে না তুমি।”
হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো শুভ্রের দিকে। শুভ্র কি তার উপর রাগ করেনি? যে কিনা নিজের রুমে কারোর আসা পছন্দ করে না আর আজ তার প্রিয় জিনিস ভেঙে ফেলায় সে এতো স্বাভাবিক আছে কি করে? হিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই ঘরে মোহনা আসতেই হিয়া ফট করে শুভ্রের কাছ থেকে সরে এলো। শুভ্র হিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে নিতে বলল,” চোখের পানি মুছো।”

হিয়া চোখের পানি মুছতেই মোহনা হিয়ার পাশে এসে বসলো চিন্তিত স্বরে বললো,” ঠিক আছো?”
হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। শুভ্র উঠে পড়লো। যাক কান্না থামিয়েছে এই বাঁদরটা। তারপর শার্টের হাতা নীচে নামাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
মোহনা শুভ্রের দিয়ে ঈশারা করে কোনো শব্দ ছাড়া ঠোঁট নেড়ে জিজ্ঞেস করলো,” বেশী বকেছে?”
হিয়া মোহনার দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো। না উক্তটি শুনে সুমনা ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
এ কোন শুভ্র! ভাবতেই অবাক লাগছে। এই পিচ্চি মেয়েটাকে এতো ভালোবাসে তার ভাই। মোহনা ঝেড়ে কাসলো তারপর বললো,” আচ্ছা চলো। তোমাকে রুমে দিয়ে আসি।” চলে যাওয়ার কথা শুনে শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে একবার তাকালো তারপর বললো,” পাকনামি করে হাতের ব্যান্ডেজ খোলার একদম চেষ্টা করবে না।” রীতিমত যেনো হুকুম দিচ্ছে এমনভাবে বললো শুভ্র।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মোহনা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,” আরে, আমি আছি তো। বউয়ের জন্যে এতো চিন্তা করতে হবে না।” মোহনার এমন রসিকতায় হিয়া লজ্জা পেয়ে গেলেও শুভ্র তা কানেই নিলো না। নিজের কাজে সে ব্যাস্ত।
মোহনা যেতে যেতে হিয়ার কানে কানে বললো,” ওর প্রিয় জিনিসটা ভেঙে ফেলেছ যে সরি বলেছো?”
হিয়া মাথা নিচু করে আবারো হা সূচক মাথা নাড়ল। মোহনা ফিসফিসিয়ে বলল,” শুধু সরি বললে কি হবে? একটু জরিয়ে ধরে বলতে পারলে না।”

হিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” উনি তো আমাকে গায়ে পড়া ভাববেন।”
” ধুর, নিজের বউ একটু গায়ে পরা হলে বররা খুশিই হয়।”, বলেই মোহনা ঠোঁট চেপে হাসলো।
হিয়া নির্বুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন জানি গা শিউরে উঠছে কিন্তু শয়তান মন তো বলছে জড়িয়ে ধরা যায়। মোহনা হিয়াকে আরো অনেক কিছু বললো। সেসব শুনে হিয়ার মস্তিষ্ক যেনো উল্টা পাল্টা চলতে শুরু করলো। মোহনা দুষ্টু হাসি দিয়ে হিয়ার ঘর থেকে বের হলো। বের হয়ে শুভ্রের ঘরের সামনে এসে রহস্যময় হাসি দিতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
মোহনা একগাল হাসি দিয়ে বললো,” তুই তো দেখি একে বারে প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেছিস।”
শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। মোহনা আরো বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? হিয়াকে কি তোর রুমে শিফট করে দিবে?”

” দিদি তোর কাজ নেই?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।
” ভালোর জন্য বলছি তো ভালো লাগছে না?”, ভ্রু কুঁচকে বললো মোহনা।
” প্লীজ আমার তোর জন্যে ভাবতে হবে না। আই ক্যান ডিল উইথ ম্যাই প্রবলেম। যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা তোর।”,
মোহনা হেসে উঠে বললো,” হেহে, আর তুই কি করছিস? মনে আছে আমি একটা টিয়া পুষতাম। তোর তো সেইসব একদম পছন্দ ছিলো না। সেদিন তো তুই সুযোগ বুঝে পাখিটা ছেড়ে দিয়েছিস। আর এখন তো বাড়িতে কুকুরছানাও নিয়ে এসেছ।” বলেই ইউভির দিকে তাকালো।

ইউভি যে এতক্ষণ ধরে শুভ্রের ঘরে পায়চারি করছিলো শুভ্র সেটা ঠিক খেয়াল করেনি, অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো। ইউভির জন্যে এত কিছুর মুখোমুখি হতে হবে কে জানতো। শুভ্র আর কিছু বললো না। টিয়া পাখিটা বড়ই বিরক্তিকর ছিলো সারাদিন কথা বলতো। তাই সে ছেড়ে দিয়েছিলো আর তার খোঁটা এখন শুনতে হচ্ছে।
শুভ্রের চুপ করে থাকায় বেশ মজা পেলো মোহনা তারপর যেতে বললো,” সেদিন এমন করেছিলি বলেই আজ শুনতে হচ্ছে।”

শুভ্র একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। এরা সবাই জোট বেধে তার পিছু লেগেছে।
রাতে হিয়া ডান হাতে ইউভির বিছানা করে দিলো। ইউভির মনে হয় ঘুম পায় নি। খালি লাফাচ্ছে এদিক সেদিক।
মোহনার কথা গুলো এখনো হিয়ার মাথায় ঘুরছে। হাতের ব্যান্ডেজটার উপরে রক্ত ভেসে উঠছে। বদলাতে পারলে ভালো হতো। হিয়া আর ভাবলো না, ঘুম পাচ্ছে অনেক। হিয়া সবে ঘুমাতে যাবে এই সময়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে। হিয়া মাথা নুইয়ে রাখলো, এতো রাতে শুভ্র তার ঘরে কেনো?
শুভ্র হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই হিয়া পিছাতে লাগলো। শুভ্র শান্ত গলায় বললো,” খাটে বসো।”

হিয়া চোখ তুলে একটু তাকাতেই দেখলো শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হিয়া চুপচাপ বসে পড়লো বিছানায়। শুভ্র শান্ত ভঙ্গিতে হিয়ার সামনে বসে মুষ্টিবদ্ধ হিয়ার হাতটা সামনে আনলো তারপর ব্যান্ডেজটা খুলতে খুলতে বললো,” ব্যাথা করছে ?”
হিয়া অন্যমনস্ক হয়ে মোহনার কথাগুলো ভাবছিল। শুভ্রের কথাগুলো শুনতে পেলো না। শুভ্র উত্তর না পেয়ে আবার হিয়ার দিকে তাকালো তারপর শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে, হিয়ার হুস ফিরল। হিয়া একটা ঢোক গিলতেই শুভ্র ভ্রু কুচকে বললো,” কি ভাবছো এতো? ব্যাথা করছে কিনা জিজ্ঞেস করেছি।”

হিয়া ঘন ঘন দুবার না সূচক মাথা নাড়ল। শুভ্র ব্যান্ডেজ টা বদলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। হিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের সামনের চুলগুলো কপালে এসে বিধেছে। চোখে চশমাতে চোখ আবদ্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর লালচে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছে সে। মুগ্ধতা নিয়ে হিয়া তাকিয়ে আছে।
শুভ্র ব্যান্ডেজ শেষে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়ার পলকহীন দৃষ্টি চোখে পড়লো তার। শুভ্র চোখে হাসতেই, হিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। লজ্জায় লাল বর্ন ধারণ করেছে সমস্ত চেহারা।
শুভ্র নীচের ঠোঁট কামড়ে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। থাক এমনিতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেছে পরে আবার কিছু বললে নীল হয়ে যাবে। শুভ্র উঠে দাড়ালো,চলে যেতেই হিয়া কিছু একটা বলবে বলে সেও উঠে দাড়ালো। শুভ্র সেটা খেয়াল করে পিছিয়ে এসে হিয়ার সামনে দাড়ালো। তারপর একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো,” কিছু বলবে?”

হিয়া ঘন ঘন মাথা নেরে বললো,” হুম্ ”
শুভ্র পকেটে হাত ভরে বললো,” আচ্ছা, বলো।”
হিয়া অনেক সময় চুপ করে রইলো, তারপর শুভ্রকে অবাক করে দিয়ে শুভ্রের বুকে মাথা রেখে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেই চোখ বন্ধ করে বললো,” সরি।”
শুভ্র যতটাই অবাক হয়েছে ততটাই খুশি হয়েছে। হিয়া আর তার সম্পর্কটা হয়তো ঠিক হচ্ছে। শুভ্র কখনোই জোর করে কাছে পেতে চায় নি হিয়াকে। কারণ সে নিজে থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তাই তাকে মেনে নেওয়ার সময়ও দিয়েছে হিয়াকে। শুভ্র পকেট থেকে হাত বের করে হিয়ার মাথায় রাখার আগেই হিয়া ফট করে কি যেনো ভেবে সরে এসে দাঁড়ালো।
সে কি করলো এটা? কেনো করলো? ভেবেই ইচ্ছে করছে গর্ত খুঁড়ে মাটিয়ে লুকিয়ে পরে। লজ্জায় শুভ্রের চেহারার দিকে আর তাকালো না হিয়া। তার জন্যেই হয়তো শুভ্রের ঠোঁটের কোনায় হাসিটা তার দেখা হলো না।

শুভ্র যাওয়ার সময় হিয়ার সামনের চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। বাঁদরটা লজ্জায় একদম টমেটো হয়ে গেছে। শুভ্র চলে যেতেই হিয়া লাইট অফ করে চাঁদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো। লজ্জায় নিজের মুখ নিজেরও দেখতে ইচ্ছে করছে না। যত্তসব উল্টা পাল্টা চিন্তা তার মাথায় কেনো আসে। এই লোকটা কি ভাবলো তাকে?
? দিবা সারাদিন একা একা থাকে। কোথাও একা একা গিয়েও কোনো লাভ নেই কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তাই আজ ধরে বেধে হিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক জায়গা ঘুরেছে তারা। হটাৎ করে দিবা ইভানকে দেখতে পেলো। সঙ্গে আরেকটি ছেলে মিলে কোথায় যেনো যাচ্ছে।

হিয়া ভেলপুরি খাচ্ছিল দিবা হিয়াকে টেনে নিয়ে এলো। হিয়া মুখের খাবার শেষ করে বললো,” এমন করেছিস কেনো?”
” বদমাইশটাকে দেখেছি। আয় দেখি তো কোথায় যাচ্ছে।”,বলেই আরো জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো দিবা। বাদ্য হয়ে হিয়াকেও হাঁটতে হচ্ছে। হিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করছে না। কারণ দিবার কানে আর কোনো কথা যাবে না, সে তার ইভানকে দেখতেই ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর পর দিবা গাছের পিছনে গিয়ে লুকাচ্ছে। হিয়াকেও লুকাতে হচ্ছে। কি যন্ত্রণা!
ইভান আর তার সাথের ছেলেটা একটা গেম কোডের মতন জায়গায় ঢুকলো। দিবাও হিয়াকে টেনে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। ভিতরে যদি অসভ্য ছেলেপুলে থাকে তখন? এই প্রশ্নের উত্তরে দিবা বললো আরে এইটা অনেক উন্নত একটা জায়গা মেয়েরাও আসা যাওয়া করে। আর বখাটে ছেলেদের এইখানে ঢুকতে দেয় না। ফ্রেন্ডরা মিলে আড্ডা দেওয়ার জন্যে আসে সবাই। ভয় পাওয়ার কারণ নেই।

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৭

কলেজ ড্রেসে এইখানে ঢুকতে কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে হিয়ার। সবাই তাকিয়ে আছে। গোল গোল করে কেউ গল্প করছে আবার কেউ কেউ খেলছে। এর মাঝেই হটাৎ কেনো জানি মনে হলো হিয়া শুভ্রকে দেখেছে মাত্র। দেখেই আত্তা কেপে উঠলো। হিয়া ফট করে একটা ফুড মেনু মুখের সামনে ধরে দিবাকে টেনে নিজের কাছে এনে বললো,” বাম দিকের শেষের টেবিলে দেখতো ডাক্টারটা বসে আছে নাকি?”
দিবা চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর খুঁজতে লাগলো, হিয়ার কথাটা সত্যি। শুভ্র ভাইয়ার সঙ্গে অন্তিক আর রুবাইয়া আপুও আছে। কি ভয়াবহ অবস্থা! দেখে নিলেই তো সমস্যা। লুকাবে কি করে? কলেজ ড্রেস দেখলেই তো চিনে যাবে?

নীলচে তারার আলো পর্ব ২৯