নীলচে তারার আলো পর্ব ৩২

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩২
নবনী নীলা

অজানা এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাকে। কলেজ থেকে ফেরার সময় একবার সে এমন এক দৃশ্য দেখেছে। ঘটনা তার মনে গেথে গিয়েছিল। কিন্তু কখন শুভ্র এইভাবে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে কল্পনাও করেনি সে। শুভ্র ছোট ছোট এই কাজ গুলো তার মনে বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে। হিয়া নিজের অজান্তেই শুভ্র নামের এই চশমা পড়া, গম্ভীর, চুপচাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছে। যে ছেলে হিয়ার ছোট ছোট অনুভূতিগুলোর খুব খেয়াল রাখে তার আড়ালে।
শুভ্র শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করে উঠে দাড়িয়ে শার্টের হাতা ঠিক করে নিলো। শুভ্র তাকানোর আগেই হিয়া তার বিমোহিত দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। সামনের চুলগুলো অকারনেই কানের পিছে গুঁজে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” আমার আর কিছুক্ষণ লাগবে। চুলটা বেধেই চলে আসবো।”

শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হিয়াকে খোলা চুলেই অনেক মায়াবতী লাগছে। শুভ্র চাইলে হিয়াকে আটকাতে পারে কাছে এনে বলতেই পারে যে, আমার ভালো লাগে তোমার এই খোলা চুল। কিন্তু হিয়ার এই মায়াবতী রূপ দেখার একমাত্র অধিকার শুধু তারই আছে। অন্যকেউ তা দেখে বিমোহিত হোক, সে সেটা চায় না। নিজের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে সে হিংসুটে তো বটেই।
শুভ্র হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো তারপর বললো,” আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নীচে আসবে, নয়তো তোমাকে রেখেই আমি চলে যাবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হিয়া ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে তাকালো। লোকটা কি একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না? সবসময় খালি হুকুম দিয়ে বেড়ায়। হিয়া মুখ কালো করে নিজের রুমে এলো। চোখের নিচে হালকা একটু কাজল দিয়ে, চুলে একটা খোঁপা করেই বেড়িয়ে এলো সে। ইউভিকে দারোয়ানের কাছে রেখে যেতে হচ্ছে। বদমাইশ ডাক্তার তো আর সঙ্গে করে নিয়ে যাবে না। নিজেই এনে দিয়েছে অথচ এমন ভাব ইউভি যেনো তার চিরো শত্রু।

শুভ্রের সাথে গাড়ি করে কোথাও যেতে হিয়ার একদম ভালো লাগে না। সারা রাস্তা কোনো কথা নেই চুপ চাপ বসে থাকা। কতটা বিরক্তিকর! তাই প্রতিবারের মতন এবারো বসে বসে হিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। গাড়ি জ্যামে আটকা পড়তেই শুভ্র হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া ঘুমে তলিয়ে আছে। ঘাড় কাত হয়ে আছে। শুভ্র সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে এসে হিয়ার ঘাড় সোজা করে দিতে দেখলো হিয়া ঘুমের মাঝেও নিজের ঠোঁটটা কামড়ে আছে। শুভ্র নিজেকে সামলে সরে এসে নিজের সিটে বসে পড়লো। চশমাটা চোখ থেকে খুলে মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে নিয়ে মুখ দিয়ে তিক শব্দ করে চশমাটা আবার পড়ে নিলো। ধীরে ধীরে নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল যেনো সে হারিয়ে ফেলছে। আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে হিয়ার প্রতি।
শুভ্রের দাদাবাড়ি হিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে বিশেষ করে সরিষার মাঠগুলো। অর্ধেক রাস্তা এসে তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভেঙে ভালোই হয়েছে এতো সুন্দর দৃশ্যগুলো নাহলে মিস করতো।

শুভ্র বাড়িতে এসেই প্রথমে নিজের দাদীর ঘরে এলো। তার দাদী প্রায় অসুখের এমন বাহানা দিয়ে সবাইকে একসাথ করে। এইবারের ঘটনা কি সেটাই শুভ্রর জানতে হবে। সবাই এলে মাইনুর শিক্ষকের এই বাড়ি যেনো তখন হৈ হৈ করে উঠে। তার দাদা শিক্ষক হলেও সেকালে তার এমন দোতলা বাড়ি যেমন সবার নজর কাড়তো এখনো সবার নজর আকর্ষণ করে বাড়িটি।

শুভ্র তার দাদী আকলিমা আক্তারের ঘরে ঢুকলো। ছেলের বউগুলো তাকে ঘিরে বসে আছে। তাদেরও বয়স কম হয়নি। তাদের মধ্যে শুভ্রের মা আকলিমা আক্তারের মাথার কাছে বসে আছেন। শুভ্রকে দেখেই তিনি হাতের ঈশারায় ডাকলেন। দাদীর পাশে বসেই শুভ্র এই নাটকটা ধরে ফেললো। তার দাদির ঠোঁটে হাসি, শুভ্রকে দেখে সে হাসি আরো প্রশস্ত হলো। আকলিমা আক্তার ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন,” কি গো ডাক্তার সাহেব.., নতুন বউরে লগে আনো নাই?”
এখন যেনো ঘটনাটা আরো পরিষ্কার হলো তার কাছে। শুভ্র কিছু বলার আগেই তার তার ছোটো চাচার মেয়ে নিধি হিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,” এইযে আমাদের ডাক্তার সাহেবের বউ।”

হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কারণ রুমে উপস্থিত সব মহিলারা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের দাদী আস্তে করে উঠেতে চাইলেই শুভ্র তার হাত ধরে তাকে বসালেন। আকলিমা আক্তার উঠে বসে হাতের ঈশারায় হিয়াকে নিজের কাছে বসতে বললেন। হিয়া এগিয়ে গেলো। একবার শুভ্রের দিকে তাকাতেই দেখলো শুভ্রর দৃষ্টি তাকেই দেখছে। হিয়া একপাশে এসে বসলো। শুভ্রের দাদী অনেক কথা বললো তার সাথে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে অসুস্থ। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি শুভ্রকে বললেন,” ডাক্তার সাহেব, ঘরে ছোট ডাক্তার কবে আসবো?”

” যার যখন আসার সময় তখন সে ঠিক আসবে।”, বলেই শুভ্র উঠে দাড়ালো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার হিয়ার দিকে তাকালো দাদীর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চোখ গুলো রসগোল্লার মতন করে ফেলেছে সে।
শুভ্র এইখানে এসে যে কয়েকদিনের জন্য আটকে গেছে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে। তার বাবা আর চাচাদের দেখো। কারো মা অসুস্থ থাকলে এমন নিশ্চিন্তে আড্ডা দেয়, মানুষ? শুভ্র ধারণা প্রতিবছর এই নাটকের সূত্রপাত তার বাবার বুদ্ধিতেই হয় সঙ্গে তার দুই ভাই। নাহলে মায়ের অসুস্থতায় কেউ ক্যাপ সঙ্গে নিয়ে আসে? তিন ভাই ক্যাপ মাথায় উঠানে বসে আলাপ করছে। শুভ্রের চাচাতো ভাই বোন গুলো এখনো এসে পৌঁছায় নি। ছোট ছোট কয়েকটা এসেছে ঐগুলো এদিক সেদিক ছুটছে।

হিয়া প্রায় অনেক্ষন পর দাদীর ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিল তারপর বৈবাহিক জীবন নিয়ে এমন আলোচনা তাকে শুনতে হয়েছে যে লজ্জায় তার অবস্থা খারাপ। হিয়া খেয়াল করলো সবাই এইখানে শুভ্রকে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকে। ডাক্তার সাহেব ডাকটা তারা এক রাশ ভালোবাসা নিয়ে বলে। হিয়া বাড়ির নিচে পুরোটা খুঁজলো কিন্তু এই ডাক্তার সাহেবকে পেলো না। শুভ্র কি ঘুরতে বেরিয়েছে? গেটের বাহিরে আরো কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে মনে হলো।
হিয়া হাঁটতে হাঁটতে দোতলায় উঠলো। শুভ্র দোতলার লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। রিমি হুট করে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বুঝলো না সে। রিমিকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতেই রিমি হেসে উঠে বললো,” আহ্, কতো দিন পর তোকে দেখলাম। আমি একমাস হলো দেশে ফিরেছি অথচ তোর দেখা পাই নি।”

রিমি এইখানে কি করে এলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই চলে এসেছিস আমেরিকা থেকে?”
” এভাবে বলছিস কেনো আমি ফিরে আসায় তোর ভালোলাগে নি?”,
শুভ্র না সূচক মাথা নাড়ল। তারপর বললো,” তুই ফিরে এসেছিস তাতে আমার খুশি হওয়ার কি আছে বলতো? স্টুপিডের মতন প্রশ্ন।”
রিমি রেগে গিয়ে বললো,” তুই এত খারাপ কেনো বলতো? মুখের উপরে এভাবে বলে দিলি।” শুভ্র রিমির কাধেঁর উপর হাত রেখে বলল,” আমি তো এমনই।”
রিমি ফট করে হাতটা সরিয়ে মুখ কালো করে বললো,” তুই অনেক নিষ্ঠুর।”
শুভ্র রিমির মাথায় চুল টেনে বললো,” বেশি কথা বলিস। হটাৎ দেশে ফিরে এলি কেনো?”

রিমি শুভ্রের ছোট চাচার বড় মেয়ে। আমেরিকায় এতো বছর থেকেছে বলে তার জামাকাপড় ও সেইরকম। হিয়া শুভ্র আর রিমির এমন জড়িয়ে ধরার দৃশ্য দেখে বড় রকমের একটা শক খেলো। রিমির এমন পোশাক দেখেও হিয়ার মাথা ঘুরছে। সিভলেস কোমড় পর্যন্ত একটা টপ আর নিচে জিন্স প্যান্ট সঙ্গে হাই হিল। কে এই মেয়ে? শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেছে কেনো। কিভাবে কাছে কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দেখো। হিয়ার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো।

হিয়া কিছু না ভেবে এগিয়ে এসে শুভ্রের পাশে দাঁড়ালো। রিমি আর শুভ্র দুজনেই হটাৎ হিয়ার এমন আগমনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। হিয়াকে দেখে রিমি হেসে তাকালো। হিয়া এসেই শুভ্রের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। শুভ্র সেটা খেয়াল করলো। রিমি হেসে প্রশ্ন করলো,” হাই, তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া অনিচ্ছাকৃত হাসি মাখা মুখ নিয়ে বললো,” আমি ওনার ওয়াইফ।” বলেই একটা ঢোক গিললো। রিমি কথাটা শুনে যতটা অবাক হয়েছে শুভ্র তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকালো। বাহ্ ভালোই বুদ্ধি হয়েছে এই পিচ্চির।

রিমি বেশ অবাক হয়ে বললো,” বাহ্ কনগ্রাচুলেশনস।” বলেই আবার শুভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই হিয়ার শাড়ির আচল শক্ত করে ধরলো। রাগে পুরো গা জ্বলছে। কথায় কথায় খালি জড়িয়ে ধরে। শুভ্রের থেকে সরে এবার হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,” আমি তো জানতামই না। ইস বড় কিছু মিস করে ফেললাম।”
হিয়া অনেক কষ্ট নিজেকে আটকে রেখেছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। শুভ্র হিয়ার চোখ মুখ দেখে অনেকটা আন্দাজ করে, মনে মনে হাসলো। রিমির ডাক পড়তেই রিমি পড়ে কথা হবে বলে চলে গেলো, হিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেলো।

শুভ্র রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে হিয়ার রাগে ফুলে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হিয়া শুভ্রের দিকে মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। আজ পর্যন্ত সে কোনোদিন শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো না, এর এই মেয়ে একবারে তার সামনে দুই দুবার জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার রীতিমত কাদতে ইচ্ছে করছে। কেনো জড়িয়ে ধরবে শুভ্রকে এই মেয়ে?
শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি হয়েছে কাদঁছো কেনো?”
শুভ্রের এমন রসিকতা শুনে হিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ভালো; ভালো, চালিয়ে যান।”

শুভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হিয়া রেগে চলে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার হাতটা ধরে নিজের কাছে আনতেই। হিয়া রেগে উঠে বললো,” ছাড়ুন, আমার হাত।”
” এতো রাগ করছো কেনো? আমার কথা আছে তোমার সাথে।”,বলেই শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো।
হিয়ার রাগে কিরমির করেছে তাও একটু শান্ত হয়ে বললো,” কি কথা?”
শুভ্র হিয়ার হাতটা ছেড়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো,” এটা একটু নিয়ে যাও।

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩১

হিয়া রাগে বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো। ইচ্ছে তো করছে কাপটা শুভ্রের মাথায় ভাঙ্গে। কি খারাপ…! মজা করছে তার সাথে। হিয়া কঠিন গলায় বলল,” পারবো না। কাপ মাথায় রেখে বসে থাকুন আপনি।” বলেই হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো হিয়া। শুভ্র হিংসুটে হিয়ার রাগান্বিত চেহারা দেখে হেসে ফেললো

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩৩