নীলচে তারার আলো পর্ব ৩১

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩১
নবনী নীলা

” তার মানে কি তুমি আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে চাইছো?”,একটা ভ্রু তুলে কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই হিয়া জড়সড় হয়ে বসলো। আজ ভূতের ভয়ে সিংহের গুহায় হানা দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার?
হিয়া একটা ঢোক গিলে দুবার পলক ফেলেই চোখ সরিয়ে নিলো। হিয়া এইবার কি করবে?
আজব মানুষ,নিজের বউ ভয় পাচ্ছে কোথায় সাহস দিবে তা না লোকটা প্রস্ন করছে তুমি কি আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে চাইছো? এবার উত্তরে সে কি বলবে? হুম চাইছি। যত্তসব! নিজে থেকে এসে বসে আছি তারপরও জিজ্ঞেস করা লাগবে তার।

কিছু করার নেই আজ রাতে সে একা নিজের ঘরে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তাই নিলজ্জের মতন হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।
শুভ্র ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামলো। তারপর মাথা নেড়ে বললো,” ওকে বাট একটা কন্ডিশন আছে।”
হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। কন্ডিশন মানে কি? নিজের বউকে নিজের ঘরে থাকতে দিবে এতেও কন্ডিশন! কেমন জামাই এইটা? এমন দিনও তাকে দেখতে হলো। লোকটা কি তাকে পছন্দ করে না ? একটুও না? এখণ তো তার সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো সবটাই তার ভুল ধারণা ছিল এতো দিন। হিয়া সেসব প্রকাশ না করেই বলল,” কি কন্ডিশন?”
” আমার রুমে যদি তোমার আজ রাত থাকতে হয়,,” কথাটা বলেই শুভ্র ঝুকে এসে হিয়ার দুপাশে হাত রেখে হিয়ার চোখের দিকে তাকালো। হিয়া মলিন চোখে তাকিয়ে আছে। কি কন্ডিশন দিবে কে জানে। শুভ্র সিরিয়াস হয়ে বললো,” সারা জীবনের জন্যে আমার ঘরে থাকতে হবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শুভ্রের কথার ইঙ্গিত হিয়া ধরতে পারলো না। এমন ডাবল মিনিং কথাবার্তা তার মাথার উপর দিয়ে যায়। হিয়া কি বলবে? উনার ঘরে সারাজীবন থাকা মানে কি ? নিঃশ্বাস নিতে শব্দ করা যাবে না, হাঁটার সময় নূপুরের আওয়াজ করা যাবে না, লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে হবে যার মানে পুরো জীবনটাই ধ্বংস। হিয়া ভেবে কোনো কুল পাচ্ছে না।
শুভ্র উঠে দাড়ালো। এই মেয়ে এখন ভাবতে বসেছে। সারারাত ভাবার সময় দিলেও সকালে উঠে সে আবার ভাবতে বসবে। তাকেই কিছু করতে হবে।

” তোমাকে ভাবার জন্যে আমি সারারাত দেই নি। পাঁচ সেকেন্ড সময় দিবো এরপর আমি লাইট বন্ধ করে ঘুমাবো। উত্তর যদি না হয় পাঁচ সেকেন্ডে পর নিজের রূমে ফেরত যাবে।”, কঠিন গলায় বললো শুভ্র।
” কি আজব!পাঁচ সেকেন্ড? মাত্র পাঁচ সেকেন্ডে সারা জীবনের সিদ্ধান্ত নিবো কি করে?”,বলেই লাফিয়ে উঠলো হিয়া।
” কেনো? ভরসা নেই আমার উপর।”,বলেই হিয়ার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্র জানে এই মুহূর্তটা একনিমিষেই ” কি?, মানে, কেনো”, এ জাতিয় কথা বলে হিয়া নষ্ট করে ফেলবে। এসব কথা হিয়ার মগজে ঢুকবে না।
শুভ্রের ধারণা সত্যি করে দিয়ে হিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,” মানে?” শুভ্র হালকা হেসে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” কিছু না। আমার ঘুম পাচ্ছে। তুমি কি করবে জলদি সিদ্ধান্ত নেও।”

কি সিদ্ধান্ত নিবে সে? আশ্চর্য..! হিয়া তাকিয়ে রইলো। শুভ্র লাইটা অফ করে দিলো। হিয়ার ভয়ে ঘাম ছুটছে, চিৎকার করতে গিয়েও চুপ করে গেলো। হিয়া অপেক্ষায় আছে শুভ্র কখন তার পাশে এসে বসবে। হিয়া ভয়ার্ত গলায় অন্ধকার রুমে বললো,” আপনি কোথায়?”
শুভ্র যে তার ঠিক পাশে শুয়ে আছে সেটা হিয়ার খেয়াল করেনি। অন্ধকারে বোঝাও মুশকিল। কিছুক্ষণ যেতেই যদিও সেটা সে অনুভব করেছে শুভ্র তার পাশেই আছে। কিন্তু তাও ভয় লাগছে। শুভ্র কি তার পাশে আছে? হিয়ার কয়েকবার ডাকার পরও শুভ্র উত্তর দিলো না। হিয়ার ভয় বাড়তেই আস্তে আস্তে হাত দিয়ে শুভ্রকে খুঁজতে লাগলো। হাত বাড়াতেই প্রথমে শুভ্রের মুখের উপর হাত রাখতেই শুভ্র চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। ভয়ের চোটে কি পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা? হিয়ার শুভ্রের হার্টবিট চেক করতে করতে আস্তে আস্তে গলা তারপর বুকের দিকে হাত নিতেই শুভ্র হাতটা ধরে ফেললো, হিয়া চেঁচিয়ে উঠলো।

শুভ্র টেবিল ল্যাম্প জেলে দিতেই দেখলো হিয়ার চোখ মুখের অবস্থা ভয়বহ। শুভ্র বিরক্তি নিয়ে তিক শব্দ করে বললো,” কি করতে চাইছো? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড?।”
” আ….. সরি, সরি আমি আসলে আপনার হার্ট বিট…….”, বলেই নিচের ঠোঁট কামড়ে থেমে গেলো।
” এই লাইটটা থাকুক। আমার ভয় লাগে। আমি কখনো অন্ধকারে ঘুমাই নি।”, বলেই আবারো ঠোঁট কামড়াতে লাগলো হিয়া।

শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের দিকে আঙ্গুল করে বললো,” হিয়া.. জাস্ট স্টপ ইট.., নাও ইউ আর ড্রাইভিং মি ক্রেজি।”
হিয়া হতভম্ব হয়ে তাকালো। শুভ্র এই প্রথম তাকে নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কি বললো এইটা? থামাতে বললো,কি থামাবে সে? শুভ্রকে পাগল করে দিচ্ছে মানে? হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো।
শুভ্র হিয়ার হতভম্ব চেহারা দেখে বললো,” বোঝনি তাই তো? তোমার বুঝতেও হবে না, ঘুমাও। কিন্তু তার আগে ঠোঁট কামড়ানো বন্ধ করো।”

হিয়া সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। লোকটার নজর তাহলে তার ঠোঁটের দিকে..? কি সাংঘাতিক!
শুভ্র বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে ল্যাম্পের আলো কমিয়ে শুয়ে পড়লো। হিয়া স্তব্দ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। তারপর অনেক সাহস করে হাত বাড়িয়ে শুভ্রর টি শার্টের এক প্রান্ত মুষ্টিবদ্ধ করতেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
শুভ্র ওপাশ ফিরতে যাবে,শার্টে টান অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকালো। তারপর বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলো হিয়ার ঘুমন্ত মুখটার দিকে। তার শার্টের প্রান্ত ভাগ হিয়ার মুষ্টিবদ্ধ দেখে হালকা হাসলো। তারপর যেভাবে ছিলো ঐভাবেই শুয়ে রইলো।

ভোর হতেই হিয়ার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলতেই প্রথমে শুভ্রের দিকে নজর গেলো। লোকটা ঘুমিয়ে থাকলে কতই না মায়া লাগে, অথচ চোখ মেললেই কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে।
হিয়া আস্তে করে শুভ্রের শার্টের প্রান্তভাগ ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো। ভাগ্যিস লোকটার আগে জেগে গেছে সে। এইবার কেটে পড়া যাবে।
হিয়া বেড়িয়ে এসে দেখে ইউভি প্রতিদিন যেই জায়গায় ঘুমায় সে সেইখানেই বসে আছে। ভালোয় ভালোয় আজ সবাই ফিরে এলেই সে বেচে যায়।

⭐ শুভ্র সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে, তোয়ালেটা গলায় ঝোলানো। চুল থেকে পানি টপ টপ করে পড়ছে। মাথার পানি নিতে নিতে ফোন বেজে উঠলো। শুভ্র তোয়ালেটা নামিয়ে রেখে কলটা রিসিভ করল। মা কল করেছে। কথা বলে সে যা বুঝলো সেটা হলো আজ তাকে নরসিংদী যেতে হবে। শুধু তাকে যেতে হলে একটা কথা ছিলো, হিয়াকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। শুভ্রের মা, কথার এক পর্যায়ে হিয়ার খোঁজ করলেন। শুভ্র বেড়িয়ে আসতেই দেখলো হিয়া কলেজের জন্যে রেডি হয়ে বেরুচ্ছে।
শুভ্র কোনো কথা না বলে ফোনটা হিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। হিয়া হতবুদ্ধির মতন তাকিয়ে রইলো। ফোনটা তাকে ধরিয়ে দিয়েছে কেনো? সে কি করবে? হিয়া ফোনের স্ক্রিনে মা লেখা দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে ফোনটা কানে ধরলো।

ওপাশ থেকে সাহারা খাতুন বললেন,” তুমি কি কলেজের জন্যে রেডি হয়েছো?”
উত্তরে হিয়া কিছু বলার আগেই সাহারা খাতুন বলেন,” আজ কলেজে যেতে হবে না তোমার। শুভ্রের সাথে এইখানে আসবে। শুনো, মেরুন রঙের যেই শাড়িটা তোমাকে দিয়েছি ঐটা পরেই আসবে। বুঝতে পেরেছো কি বললাম?”
হিয়া পর পর দুইবার জ্বি বললো উত্তরে। শাশুড়ির সাথে কথা বলতে গেলে কেনো জানি তার বুক কাপে। সাহারা খাতুন তারপর শুভ্রকে ফোনটা দেওয়ার কথা বলতেই হিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা এনে শুভ্রের সামনে ধরলো। হিয়ার মাথায় এখন একটাই চিন্তা শাশুড়ি তাকে শাড়ী পড়তে বলেছে কিন্তু সে তো পারে না শাড়ি পড়তে। তাহলে এবার উপায়? ভয়ের চোটে তো ঠিকই জ্বি জ্বি বলে ফেলেছে। এই ভাবনায় হিয়া অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

শুভ্র ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” দাড়িয়ে আছো কেনো এইভাবে? যাও রেডি হও।”
হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে এতো গুলা কথা শুনিয়ে দেয়। যাও রেডি হও বললেই হলো? নিজের কি ? নিজে তো ঠিক শার্ট, প্যান্ট আর হাতে একটা ঘড়ি পড়লেই হলো। কিন্তু তাকে তো শাড়ী পড়তে হবে। ইয়া লম্বা একটা শাড়ী, ভেবেই ঘাম ছুটছে তার। এইসব ভাবতে ভাবতে মুখ বাঁকিয়ে শুভ্রের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হিয়া।
ইউটিউবে এই পর্যন্ত কয়েকটা ভিডিও দেখা শেষ। টাইটেল লেখা শাড়ী পড়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে অথচ ভিতরে এত এত কঠিন সব নিয়ম। প্রায় দুই ঘণ্টা নিয়ে শাড়িটা পড়লো হিয়া। কিন্তু কুচিগুলো নিচের দিকে এলোমেলো হয়ে আছে। ধুর সে আর পারবে না যা হয়েছে, হয়েছে।

শুভ্র এই নিয়ে তিনবার হিয়ার দরজার টোকা দিলো।দরজা আটকে কি এমন সাজছে। মেজাজ ভালোই খারাপ হয়ে আছে তার। শুভ্র চতুর্থ বারের মতন দরজার নক করে বললো,” হিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি বের হও আদারওয়াইজ লকের চাবি কিন্তু আমার কাছে আছে।”
বলতে বলতে হিয়া দরজা খুললো। শুভ্রের এমন হুমকি শুনে সে দৌড়ে এসেছে। শুভ্র মুগ্ধতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। খোলা চুল আর মেরুন রঙের শাড়িটায় এই পিচ্চি মেয়েটাকেও মিষ্টি বউয়ের মতন লাগছে। কিন্তু কুচির দিকে তাকাতেই শুভ্রের ভ্রু কুঁচকে গেলো। এমন এলোমেলো অবস্থা কেনো? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” দুঘন্টা লাগিয়ে তুমি এই করেছো?”

” শুনুন, যা করেছি এটাই অনেক। শাড়ী পড়াটা কত কঠিন আপনি জানেন? আপনি পারবেন শাড়ী পড়তে?”, বিক্ষোভ নিয়ে বললো হিয়া।
” পড়তে না পারলেও, পড়াতে পারতাম। যাই হোক। দেখি এই দিকে আসো।”, কথাটা বলতেই হিয়া দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” না না, ছি! আমি আপনার কাছে শাড়ি পড়বো না।” বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে হিয়া।
মেয়েটা এত বেশি বুঝে কেনো? যেটা বোঝার প্রয়োজন সেটা বুঝবে না বাকি সবকিছু বেশি বেশি বুঝে বসে থাকবে। শুভ্র কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,”এইদিকে আসো। কুইক।”

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩০

হিয়া ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” আমি কিন্তু যা বলার বলে দিয়েছি..” এতটুকু বলতেই শুভ্র হিয়ার হাত ধরে টেনে হিয়াকে নিজের সামনে দাড় করাতেই হিয়া আড় চোখে তাকালো। শুভ্র শার্টের হাতা একটু উপরে তুলে হিয়ার পায়ের কাছে এক হাঁটু ভাজ করে বসতেই হিয়া অবাক চোখে তাকালো। শুভ্র হিয়ার শাড়ির কুচিগুলো গুছিয়ে দিচ্ছে।
অজানা এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাকে। কলেজ থেকে ফেরার সময় একবার সে এমন এক দৃশ্য দেখেছে। ঘটনা তার মনে গেথে গিয়েছিল। কিন্তু কখন শুভ্র এইভাবে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে কল্পনাও করেনি সে। শুভ্র ছোট ছোট এই কাজগুলো তার মনে বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে।

নীলচে তারার আলো পর্ব ৩২