নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫০

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫০
ইফা আমহৃদ

দুপুরের খাবারের পর সবাই ধানখেতে বসে রোদ পোহাচ্ছে। কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে থাকার এক ঘণ্টা পার হয়েছে বলে তিয়াস খেতে বসেছে। স্বামীর একাকিত্বের সঙ্গী হতে সুমি খায় নি। নিজের হাতে খাবার সাজিয়ে দিল তিয়াসকে। কাঁচামরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে তিয়াস বলে, “যার বউ নেই, তার কেউ নেই। খাওয়ার সময় অনশন দিয়ে দিল। আপনি জানেন না, খাওয়ার সময় সালাম দিতেও নেই।”

“কিন্তু তুই তো কথা বলছিস। দুর্ভাগ্যবশত তুই তখন খেতে বসিস নি।” পা দোলাতে দোলাতে বলে অপূর্ব।
“খেতে বসিনি। কিন্তু খাওয়ার জন্য উত্তেজিত ছিলাম।”
“বেশি পকপক না-করে তাড়াতাড়ি খা। তোর ভাগ্য ভালো আমি মাঝরাতে ধানখেতে একা কাকতাড়ুয়া সেজে থাকতে বলিনি। গতরাতে নির্ঘুম কাটিয়েছিস। এই রাতে তোকে খুঁজেই পাওয়া যেত না।” অপূর্বর এমন জবাবে বাক্য হারাল তিয়াস। সৌজন্য হেসে সুমির হাতে খাবার খেতে লাগল। অন্যদিকে নির্ঘুম রাতের কথা শুনে ঘুমে জেঁকে ধরল আরুকে। এই সময়ে তার পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ঘাসের ওপর মেলে দিয়ে হাই তুলে বলে, “ঘুম পেয়েছে। বাড়িতে চলুন। ঘুমাব।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপূর্ব সরে পর্যাপ্ত জায়গা করে দিলে আরুকে। কোলে ইঙ্গিত করে বলে, “আমার কোলে মাথা দিয়ে শো। রোদে ঘুম ভালো হবে।”
আরু শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে তাকাল অপূর্বর দিকে। অপূর্বর হাতটা কপালের কাছে এনে জড়ানো গলায় বলে, “ঘুমের কারণে মাথা ব্যথা করছে। একটু চুলগুলো টেনে দিন না।”

অপূর্ব কি আরুর কথা ফেলতে পারে? যত্নের সাথে স্পর্শগুলো আদুরে হয়ে উঠল। আরু বিড়াল ছানার মতো লেপটে রইল অপূর্বর সাথে। রাতে ঘুম না হওয়াতে সবাই মাথা হোগলায় রেখে পা ঘাসের ওপর রেখে সটান হয়ে ঘুমিয়েছে। অপূর্ব একাই শুতে পারল না। এতে কোনো আফসোস নেই তার। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে নখ লাগল অপূর্বর হাতে। আরুর চোখাল নখে ছিলে গেল একটু। আরুর হাতটা এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে ইলিয়াস আলীকে বলে, “নখ কাটার কিছু আছে চাচা?”
“ব্লে/ড আছে। চলবে?”

“দিন।” অপূর্বর মত পেতেই ইলিয়াস আলী ব্লে/ড নিয়ে এলো। আঙুলের মাথা ধরে ম/রা নখগুলো ফেলে দিচ্ছে। ঘুমের মাঝে বিরক্ত করার কারণে ঘুম ভাঙল আরুর। পরক্ষণে প্রিয় নখগুলোর এই অবস্থা দেখে হাত টেনে নিতে নিতে বলে, “কী করছেন? নখ কা/ট/ছেন কেন? আপনি জানেন এগুলো আমার কত পছন্দের? স্কুলের ম্যাডামের নখ দেখে বড় রাখার চেষ্টা করছি।”

“কিন্তু তোর নখগুলো ভেঙে গেছে। আমার হাতের সাথে সামান্য লেগে কী অবস্থা হয়েছে দেখ।” হাতটা দেখিয়ে অপূর্ব বলে। চকিতে ভেংচি দিয়ে আরু উঠে বসে বলে, “আপনার মোটা মোটা প্যান্ট ধুতে গিয়েই ভেঙেছে। আমার জন্য এইটুকু সেক্রিফাইস করতে পারলেন না?”

অপূর্বর চোখের পলক পড়ল না। মেয়েটার জন্য না ঘুমিয়ে বসে ছিল যাতে আরুর ঘুমের কমতি না-হয়। আর সেই মেয়েটা বলছে সেক্রিফাইসের কথা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অপূর্ব অন্য দিকে তাকাল। চোখ পড়ল ধানখেতের দিকে। ইঁদুরে মাটি তুলেছে। অপূর্বর মনে পড়ল পুরনো দিনের কথা। আরুর সাহসিকতার কথা। খানিক ব্যঙ্গ করে বলে, “আমি তোর মতো এত সাহসী নই। মনে আছে, আমার জামার ভেতর থেকে কীভাবে ইঁদুরটাকে বের করে নিয়ে এসেছিলিস? বলতে গেলে তুই বাঘিনী আর আমি বিড়াল।”

নিজেকে এভাবে ভীতু করাতে অপূর্বর প্রেসটিস পাংচার হলেও আরু সন্তুষ্ট হলো। অতঃপর বলে, “আমার কোলে মাথা রাখুন। আপনিও তো আমাদের কারণে ঘুমাতে পারেননি।”
“আমি ঘুমাব না, তুই ঘুমা। রাতে ঘুমালে হুঁশ থাকবে না।”
“শুনলেন না চাচা কী বলল? রাতে নাচ দেখতে যাবো। আমি কখনো এমন নাচ দেখিনি।” আরুর আবদার ফেলল না অপূর্ব। আরুর কোলে মাথা রেখে ওড়নার সাহায্যে নিজেকে আবৃত করল। উদর আঁকড়ে ধরে শোনার প্রয়াস করল ছোট্ট পাখিকে। আরু অপূর্বর স্পর্শ হাসল কেবল।

গাছের পাতা হলদে হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। কিছু গাছে পাতা নেই বললেই চলে। বসন্তের ছোঁয়া পেতেই তাঁরা নতুন পাতা নিয়ে আসবে। আসবে মুকুল, হবে ফল। বিকেল গড়িয়ে আসতেই ঘুম ভাঙল তিস্তার। হাই তুলে নিভু নিভু দৃষ্টি আরুর পানে নিবদ্ধ করলে চোখ পড়ল শিউলি ফুলের তৈরি বিনি সুতার মালায়। অপলক চেয়ে বলে, “এটা কোথায় পেলি? আমরা ঘুমানোর পর তোরা ঘুরতে গিয়েছিলিস নাকি?”
“তুমি বোধ হয় খেয়াল করোনি। এটা তো নানি জানের সখীর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম।”
“দাদি জানের সখীকে কোথায় ফেলি তোরা?”

“আফিয়া তার নাম। এখানে আসার সময় পরিচয় হয়েছে। অপূর্ব ভাইয়ের ফোন দিয়ে দুজন সখীর কথা হয়েছে।”
“তোরা কতকিছু দেখলি। অথচ আমরা কিছু দেখতে পারলাম না।” শুকিয়ে যাওয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলে। আরু অপূর্বর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তিনি বলেছেন, ‘বিকালে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ দেখতে যাবে।’ আজ বোধ হয় যাওয়া হবেনা।”

“কী? ব্রিজ দেখতে নিয়ে যাবে?” উত্তেজিত হয়ে সবাইকে ঠ্যালে ঘুম থেকে তুলতে ব্যস্ত হলো তিস্তা। সুজন পাশ ফিরে শুতে তিস্তা জগ ভরতি পানি ফেলল দেহে। ভিজে জবুথবু হয়ে লাফিয়ে দাঁড়াল সুজন। বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
সুজনের চিৎকারে উঠে বসল অপূর্ব। লহমায় তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটার কারণে রক্তিম নয়ন জোড়া। চোখ ঢলতে ঢলতে বলে, “কী হয়েছে?”

তিস্তার হাতে পানির জগ দেখে পরিস্থিতি আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না সুজনের। কাজের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে সুজন বলে, “ঘুমের মাঝে তিস্তা পানি ঢেলে দিয়েছে।”
“এখনো বুদ্ধি হলো না তোদের। মাথার ভেতরে টাসটাস করছে। মনে হচ্ছে, রগ ছিলে যাচ্ছে।”

তিস্তা নতজানু হয়ে আরুর দিকে চাইল। সবকিছুর সমাধান আজকাল আরুর ভেতরে লুকিয়ে থাকে। ও যেন জাদুর কাঠি। অপূর্বর মাথার চুলগুলো টেনে দিতেই আরুর কাঁধে মাথা ঠেকাল অপূর্ব। আরুর মনে হলো, মস্তিষ্কও যেন হৃৎপিণ্ডের ন্যায় স্পন্দন করছে। আরু জড়তা নিয়ে বলে, “চন্দন বাড়িয়ায় যাবেন না? ওঁরা সবাই ব্রীজ দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।”

ইলিয়াস আলী নারিকেল তেলের বোতল আগুনে গলিয়ে নিয়ে এসেছে। আরু করতলে নিয়ে অপূর্বর তালুতে ছোঁয়াল। অপূর্ব চোখ বন্ধ করে ইলিয়াস আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচা ওঁদের নিয়ে চন্দন বাড়িয়ার দিকে এগোন। আমার শরীর কাঁপছে। স্বাভাবিক হলে আসছি।”

“জি বাবা।” ইলিয়াস আলী বলার পূর্বেই যুবক-যুবতিরা ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেল রাস্তার দিকে। অপূর্বর যে চোখ দেখেছে, তাতে লহমায় ওদের ছাই করে দিতে প্রস্তুত। ইলিয়াস আলী এগিয়ে যেতেই অপূর্ব বলে, “তুই কেন গেলি না আরু? আমার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। হাত-পায়ে জোর পাচ্ছি না।”
“আপনাকে রেখে যাবো কীভাবে? যদি যেতে পারেন তাহলে যাবো। নাহলে ইলিয়াস চাচার তো আছেই, তিনি সবাইকে ঘুরিয়ে দেখাবে।”

“বড়ো ভাই হিসাবে ওঁদের সাথে থাকা আমার কর্তব্য। ভ্যান পেলে ভ্যানে যাবো।”
“এই বাড়িতে ইলিয়াস চাচার একটা সাইকেল আছে। আমি সাইকেল চালাতে পারি। প্রয়োজনে আমি সাইকেল চালিয়ে আপনাকে নিয়ে যাব।”
“চল তবে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪৯ শেষ অংশ 

উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। তাকায় আরুর দিকে। মেয়েটা এই অবস্থায় তাকে বয়ে নিয়ে যাবে চন্দন বাড়িয়ায়। এক্ষেত্রে আরুর ব্যায়াম হবে বলেই অপূর্ব রাজি হয়েছে, নতুবা এই অবস্থায় রাজি হতো না।
সাইকেলে করে অপূর্বকে বয়ে গন্তব্যে চলছে আরু। কুড়াচ্ছে সুখ। অপূর্ব পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে প্রেমময় কণ্ঠে বলে, “পদ্মাবতী গুণে গুণান্বিত, রূপে রূপসী। দেশ-দেশান্তরে কম ভ্রমণ করিনি। কিন্তু আমার পদ্মবতীর মতো রূপবতী ও গুণবতী নারীর সন্ধান আমি পাইনি।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫১