নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৭

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৭
ইফা আমহৃদ

“তবে আমার ভাইটা যে চলে গেল। আমি যদি আরেকটু সময় ওখানে দাঁড়াতাম তবে অয়নকে হারাতে হতো না।”
বলতে গিয়ে আরুর চোখে বর্ষণের সূচনা হলো। পাখিকে আগলে নিয়ে আরুর সেই বর্ষণ মুছে দিল অপূর্ব। জড়ানো গলায় বলল, “কাঁদিস না আরুপাখি। এটাই নিয়তি। তবে আমার তীব্র আফসোস, সে সময়ে তোর পাশে থাকতে পারলাম না। বৃক্ষের মতো তোকে ছায়া দিতে পারলাম না।”

“অয়নকে দাফন দিয়েছে? মায়ের অবস্থা এখন কেমন?” আরুর পালটা প্রশ্নে প্রথমে অপূর্বর প্রতুক্তি দেওয়ার স্পৃহা জন্মালেও পরবর্তীতে রুষ্ট হলো। দৃষ্টি সরিয়ে খোলা জানালার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে স্থির করে বলল, “তোর মা নেই। আমারও পরিবার নেই।”
অপূর্বর থমথমে কণ্ঠ আচমকা আবির্ভাব হয়েছিল বিধায় আরু খানিক ভড়কালো। ভীত অথচ কৌতূহলী গলায় বলল, “মানে? কী বলছেন আপনি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“যেটা শুনেছিস সেটাই। আমাদের সন্তান এখানে জন্ম নিয়েছে কেবল তোর মায়ের জন্য। এক সন্তান মা/রা গেলে বলে, সে নিঃসন্তান হতে চেয়েছিল। তাই আমি তাকে নিঃসন্তান করে এসেছি‌। আমার পরিবার তোর মাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাই পরিবার ছেড়ে চলে এসেছি। আমি আর ওই বাড়িতে ফিরব না তোদের নিয়ে।”
থমথমে গলায় কথাটা বলে ফের আরুর দিকে তাকাল অপূর্ব। নজরবন্দি হলো দেহের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছিটা লেগে আছে। চকিতে অপূর্ব স্পর্শ করল সেই ক্ষতগুলো। রক্ত উঠে গেলেও সেখানে রয়ে গেলে দাগ, কিঞ্চিৎ ফুলে উঠেছে জায়গাটা। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে অপূর্ব বলল, “এগুলো কীভাবে হয়েছে?”

সত্যিটা বলা মানে অপূর্বর রাগে ঘি ঢালা। সত্য আড়ালের প্রচেষ্টা করতে হাত বাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
“পাখিকে আমার কাছে দিন। খালা সেই মধু খাওয়াতে নিয়ে গেল, আর কোলে দিল না। পরিবার পরিকল্পনার কর্মীরা বলেছিল, জন্মের এক ঘণ্টার ভেতরে তার শাল দুধ খাওয়াতে হয়। কোলে দিন।”
“স্টপ আরু। আমি একজন ডাক্তার, আমাকে শেখাতে আসিস না, কখন কী করতে হবে! উত্তর না পেলে পাখিকে কোলে পাবিনা। তাড়াতাড়ি মুখ খোল।”

“অয়নকে আমিই দিঘি থেকে তুলে এনেছি। ডুব দিয়ে দিঘির মাঝে যখন খুঁজেছি, তখন বাঁশের কঞ্চির সাথে লেগে শরীর এভাবে আঁচড়ে গেছে।” নত গলায় বলে অপূর্বর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে নিল আরু। চট করে উঠে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো অপূর্ব। পেছন থেকে আরু ডেকে থামাতে পারল না অপূর্বকে।

মিনিট ত্রিশ পর অপূর্ব ফিরত এলো জুনিয়র গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইরফানকে নিয়ে। আরুকে পরীক্ষা করে ওকে জানাতেই অপূর্ব ব্যাকুল হলো আরুকে নিয়ে যেতে। পাখিকে ইরফানের কোলে দিয়ে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল। বিতৃষ্ণা ও ব্যথায় আরুর দেহ অবশ হয়ে আছে। অপূর্বর গলা জড়িয়ে ধরে আরু বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? এই অবস্থায় আমি যেতে পারব না।”

“ইরফানের সাথে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। সঠিক যত্নের সাথে নিলে সমস্যা হবেনা। আমি ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করেছি। তুই শুধু ধৈর্যের বাঁধটা আরেকটু উঁচু কর।”
আরু রাজি হলো। ভ্যানগাড়িতে আরুকে তুলে, পাখিকে ঠান্ডা থেকে আঁকড়ে রাখল হৃদমাঝারে। ইরফানকে সাথে নিয়ে আহসান বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে শহরের রাস্তা ধরতেই আরু থতমত খেয়ে বলল, “একি, গাড়ি এদিকে কোথায় যাচ্ছে? এটা তো বাড়ির রাস্তা নয়।”

“আমরা বাড়িতে যাব না আরু। আমরা ইরফানের বাড়িতে যাচ্ছি। আজ রাতটা ওর বাড়িতে থেকে আগামীকাল নতুন বাড়ি খুঁজে শিফট হব।” অপূর্ব নিজ সিন্ধান্তে অনড় থেকে বলল। আরু দুঃখের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠল। মেনে নিতে পারছে না পরিবার ছাড়া বসবাস। ইরফান তার স্ত্রী মিতাকে নিয়ে হাসপাতালের পাশের এক গলিতে বসবাস করে। অপূর্ব ও আরুর থাকার কথাটা মিতাকে জানাতে সে সব ব্যবস্থা করেই রেখেছে। ভ্যানসহ সেখানে পৌঁছাতে নজর এলো মিতাকে। দাঁড়িয়ে ছিল অপূর্বদের ফেরার অপেক্ষায়।

আহসান পরিবার ও মৃধা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিস্থিতিতে। পারুল চাতালে বসে ভাবছে অপূর্বর কথাগুলো। ইমদাদুল হোসেন গামছা গলায় ঝুলিয়ে মোতাহার আহসানকে বলল, “পারুলকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যান ভাইজান। যদি পারেন, ওকে পা/গ/লা গা/র/দে ভর্তি করে দিয়েন। পুরোপুরি সুস্থ হলে আমি নিয়ে আসব। এখন আমি আরুকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। এক সন্তান হারিয়ে আমি শেষ হয়ে গেছি। আরেক সন্তানকে হারাতে পারব না। আমি আরুকে ফিরিয়ে আনতে গেলাম।”

বলে ইমদাদুর হোসেন থানার দিকে অগ্রসর হলে পারুল হিংস্র হয়ে এগিয়ে গেল ইমদাদুলের দিকে। শার্টের কলার টেনে উচ্ছৈঃস্বরে বলল, “আমাকে কী মনে করেন আপনি, আমি পা/গ/ল?”
“তুমি পাগল কি-না আমি জানি না। তবে তুমি এখন বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ।” বলতে বলতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পেয়ারা গাছের ডালের দিকে। দুইশো ভোল্টের হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঝুলন্ত তাবিজ খানা।

ইমদাদুল হোসেন আগেও একবার দেখেছিল সেই ঝুলন্ত তাবিজ। এগিয়ে গিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুলিতে
ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করল। তাবিজ ধরে টান দিতেই শুষ্ক গাছের ডালটা ভেঙে পড়ল মাটিতে। এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে বলল, “তাবিজটা তুমি এখানে ঝুলিয়েছ পারুল?”
“না।” পারুলের একরোখা জবাব।

“আমার সংসার ভাঙার পেছনে যে দায়ী তাকে এত সহজে আমি ছেড়ে দিব না।” তাবিজটা লুঙ্গিতে গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ইমদাদুল হোসেন। শাহিনুজ্জামান মোতাহার আহসানের গা ঘেঁষে বলল, “ভাইজান, এভাবে কতদিন চলবে? আহসান বাড়ির বড় নাতনি জেলে থাকবে কতদিন? আপনি পারুলকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে থানায় চলুন। আমাদের অপূর্ব, আরুর পাশে থাকা দরকার। ওদের বোঝানো উচিত।”

“হুঁ।” বলেই দাদাজান ডানলেন চম্পাকে। চম্পার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ালেন অনিতা। সাথে এলেন জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। শাহিনুজ্জামান আকারে ইঙ্গিতে স্ত্রীর মাধ্যমে রাগ দেখালেন সবাইকে, “দলবেঁধে চলে এসেছে। তোমাকে কেউ এখানে ডাকেনি, কাজে যাও। পারুলকে নিয়ে বাড়িতে যাও।”
গায়ে লাগতেই সবাই পা বাড়াল ফিরতি পথে‌। শাহিনুজ্জামান অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি থাকো ভাবি, বাকিরা যাক।”

জায়গাটা নির্জন হলো। সন্তান হারা মাকে তৈরি হতে ঘরে নিয়ে গেল। অনিতা পরিষ্কার তার মত জানাল, “ওটা আমার ছেলের বাপের বাড়ি আবার পারুলেরও বাপের বাড়ি। দুজনের সমান অধিকার। ননদ হিসাবে আমার মতো যত্ন কেউ করে না। ‘ওর জন্য যদি আমার ছেলে বাড়ি ছাড়ে’ তাহলে দেখবে, ভাবির অত্যাচার কেমন হয়। পারুল তার সন্তানকে জলে ফেলে দিতে পারলেও আমি পারব না।”

অনিতা দ্বিতীয় মুহুর্তের আগমনের অপেক্ষায় রইল না। ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে গেল আহসান বাড়ির দিকে। পুরুষেরাও অগ্রসর হলো থানার দিকে। মহিলাদের জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা করেছে। আসার সময় পায়ে হেঁটে এলেও, যাওয়ার সময় ভ্যানে বসে চলে গেল থানার দিকে।

গাছ গাছালির জন্য থানার সেই জমিটা ঘন হয়ে আছে সবুজ রঙে। শুকনো পাতা গাছ থেকে খসে পড়ছে টিনের ওপর। অনেক পাতায় রাস্তাঘাট দেখাই যাচ্ছেনা টর্চের আলোতে। মোতাহার আহসান থানার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পূর্বেই দারোগা সহ কনস্টেবল চলে গেছে, রয়েছে দুইজন হাবিলদার। কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেল, ইমদাদুল হোসেন মাথায় হাত দিয়ে সরু বেঞ্চিতে বসে আছে। মোতাহার আহসান তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “এখানে বসে আছো কেন? ভেতরে চলো।”

“ভেতরে গিয়ে কী করব? অপূর্ব আরু কেউ নেই। অপূর্ব এসে আরুকে জোর করে কোথায় নিয়ে গেছে। ঠিকানা দিয়ে যায়নি।” ইমদাদুল হোসেন হতাশ হয়ে বললেন। বিনিময়ে মোতাহার আহসান দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলে একই কথা বলল। অপূর্বর নাম্বারে ডায়াল করল, বন্ধ বলছে একটি মেয়ে। কখনো বাংলায়, কখনো ইংলিশে। দাদাজান বিরক্তির সাথে বললেন, “সংযোগ কেন দিবে না? দিতেই হবে। আমাদের ফোনে টাকা আছে। আমরা সুন্দরনগরের চেয়ারম্যান।”

“শাহিন, তুই একটা ফোন কিনে দিস বাবাকে। তাহলে ফোন সম্পর্কে তার ধারণা জন্মাবে। কেউ যদি ফোন বন্ধ করে রাখে, তাহলে কীভাবে সংযোগ দিবে?” মোতাহার আহসান ইঙ্গিতে তার পিতাকে বলেন।পরপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ইমদাদ বাড়িতে চলো, সেখানে গিয়ে কথা হবে।”
“আমি আমার বাড়িতে যাব, ভাইজান। পারুলকে দেখে রাখবেন। অপূর্ব ও আরুর কোনো খবর পেলে আমাকে জানাবেন।” দেহের ধুলাবালি ঝেড়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন ইমদাদুল হোসেন। অতঃপর সেই ভ্যানে করেই বাড়ির দিকে চলে গেল আহসান পরিবার।

স্বামী, দেবর ও শ্বশুরকে দেখে আশা আলো জ্বলে উঠেছে অনিতার মনে। কাছাকাছি যেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “পাখিকে দেখেছ? কেমন হয়েছে দেখতে, আমাদের মতো নাকি পারুলদের মতো দেখতে?”
“আমরা যাওয়ার আগেই অপূর্ব আরুকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।” শাহিনুজ্জামান বলতেই মোতাহার আহসান নিজের ঘরে চলে গেলেন। আশার প্রদীপ দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। অনিতা নিজের ঘরে গিয়ে দেখল, তার প্রাণনাথ জানালা খুলে অন্ধকার দেখছে। অনিতা কোমরে হাত দিয়ে কঠোর গলায় বলল, “তোমার কাছে আমার কথা কোনো মূল্য নেই, তাই তো? নিজের ছেলের প্রতি তোমার একটুও ভালোবাসা নেই?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৬

“আমাকে কি করব, বলো তুমি? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি! আর এই বোঝা বইতে পারছিনা।” অশ্রুসিক্ত নয়নে নরম গলায় বলল, “ছেলের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে সেরা অপরাধী মনে হয়না। পারুলের দিকে তাকালে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। এই যাতনা সহ্য করতে না পেরে কবে জানি আমি বাড়ি থেকে চলে যাই। মিলিয়ে যাই ঘোর অন্ধকারে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৮