নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১২ || ইফা আমহৃদ

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১২
ইফা আমহৃদ

আয়াত তৃষ্ণা ভার্সিটির সামনে রাস্তার উপর পড়ে আছে। আশে পাশে সবাই কটু চোখে দুজনার দিকে তাকাচ্ছে। ধুলি কণা ঝেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। হুট করে আয়াতের বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। রাস্তার মাঝে এমন পরিস্থিতিতে পরাতে বিরক্তকর হয়ে উঠেছিল তৃষ্ণা। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল.

— “হ্যালো মি. চোখের মাথা খেয়েছেন না-কি। আমার মতো একটা মেয়েকে আপনার চোখে পড়লো না”।
তৃষ্ণার দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আয়াত। প্রথমবার কোনো মেয়েকে এতোটা মোহনীয় লেগেছে তার কাছে। চোখ মুখে বিরক্তিকর ভাবটা যেন সৌন্দর্য কয়েকশত বাড়িয়ে তুলেছে। হঠাৎ কেউ তৃষ্ণা বলে ডাক দেওয়াতে ততক্ষণাৎ খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিলো। তার ফলস্বরূপ বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে।

তৃষ্ণার কথা মোটেও পছন্দ হয়নি আয়াতের। মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল..
— “আসলে বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি”।
” যখন পারে-ই না। তাহলে চালাতে যায় কেন? অসহ্য” আয়াতের এমন উত্তর পছন্দ হলো না তৃষ্ণার! মাটি থেকে বই খাতা গুলো সাবধানে তুলে নিল। ভালোভাবে ঝেড়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে গেল।
সদর দরজা দিয়ে ভেতরে যেতেই হুশ ফিরল আয়াতের। নিজেকে হাজারটা কথা শুনিয়ে মাটি থেকে বু-ফে তুলে নিলো। প্রচন্ড জোরে দৌড়ে তৃষ্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তৃষ্ণা পাশ কেটে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে এসে দাঁড়ালো আয়াত। যাতে চরম রেগে গেল তৃষ্ণা। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল.

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “কি সমস্যা কি আপনার হ্যা। বুঝলাম বাইকের কন্ট্রোল হারিয়েছে বলে, আমাকে এক্সিডেন্ট করতে বসেছিলেন। তো এখন কি.”
আয়াত যেন স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কেন ভার্সিটিতে এসেছে, সেই ভাবনা ভুলে চারপাশে তৃষ্ণা নামক মেয়েটিকে আবিষ্কার করছে। নিজের অজান্তেই হাতটা এগিয়ে তৃষ্ণার দিকে বাড়িয়ে দিল। তৃষ্ণা যেন অবাকের শেষ সিমানায় পৌঁছে গেল। তুরি বাজিয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল..
— “আর ইউ ক্রেজি। ইউ হ্যাভ ওন আইডিয়া, ওয়াট আর ইউ ডুয়িং। একটা মেয়েকে দেখলেন আর ফুল দিয়ে দিলেন। সেইম.”
ইগোতে লাগলো আয়াতের। হাত থেকে ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। পকেট থেকে চেক বই বের করলো। হাঁটুর উপর রেখে সিগনেচার করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিলো। অন্যদিকে মুখ করে বলল..

— “এই নিল আপনার দাম”।
চমকে উঠলো তৃষ্ণা। অজান্তেই হাতটা আয়াতের গালে চলে গেল। আঙুল তুলে বলল
— “আপনাকে ভালো মনে করেছিলাম। সাহস হয় কিভাবে আমার দাম দেওয়ার”।
তৃষ্ণার প্রতি যতটুকু রাগ হয়েছিল মুহুর্তের মিলিয়ে গেল। নিজেই নিজের কাজে হতবাক। মাথা নিচু করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মৃদু হেসে বলল.
— “মিস তৃষ্ণা। আপনি আমাকে ভুল ভাবছে? আমি আপনার দাম দেইনি। আমি রক্তের দাম দিয়েছি”।
— “কিসের রক্ত”
লম্বা শ্বাস নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল..

— “আমি আয়াত। মনে করে দেখুন, কিছুদিন পূর্বে একজন মেয়েকে আপনি ব্লাড ডোনেট করেছিলেন। আমি তার ভাই”।
ঘনঘন পলক ফেলে অপরাধী কন্ঠে বলল..
— “সরি। আমি অন্যকিছু মনে করেছিলাম। তাছাড়া আমার টাকা পয়সা কম নেই। আপনাদের ভাই বোনের অফুরন্ত ভালোবাসা দেখে এইটুকু আমার উপহার ছিলো। আজ আমি দিয়েছি, কাল হয়তো আপনি দিবেন। তখন কি টাকা নিতেন। যদি টাকা দিয়েই সব পাওয়া যেত, তাহলে রক্ত কেন পেলেন না।
আমার ক্লাস আছে। আজ আসছি”।

আয়াতের উত্তরে অপেক্ষা না করে চলে গেল তৃষ্ণা। চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে রইল। শুধু তার মহত্ত্ব কিংবা সৌন্দর্যের প্রেমেই আয়াত পড়ে নি। তৃষ্ণার মধুর ব্যবহারই তাকে প্রধান আকৃষ্ট করেছিল।
সময় যতোই অতিবাহিত হচ্ছিল তৃষ্ণার প্রতি আয়াত দূর্বলতা ততই বেড়ে চলেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে তৃষ্ণাকে ভার্সিটিতে দেখতে যাওয়া, অসংখ্য ছবিতে গ্যালারী ভর্তি করা রাখা। প্রতিটি দিন তৃষ্ণাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসতো তার। সময় পেলেই তৃষ্ণার দেখা পেতে ছুটত সে।
একদিন আয়াত সাহস সঞ্চয় করে তৃষ্ণাকে প্রপোজ করেছিল। ততক্ষনে সবটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছিল। তৃষ্ণা তখন রিজভী নামক নেশায় নেশাক্ত হয়ে পড়েছিল। তৃষ্ণা সুন্দর ভাবে বুঝিয়েছিল তাকে। তারপর প্রতিটি মুহূর্তে তৃষ্ণাকে ভোলার অদম্য চেষ্টা করেছে আয়াত। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তৃষ্ণা শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থাকলেও মানসিক ভাবে উপস্থিত থাকত।

প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। ছোট ছোট দুটো খরগোশ কিনে নাম রেখেছিল আয়াত, তৃষ্ণা।‌ অর্থাৎ তৃষ্ণার্থ আয়াত। কে জানতো, তৃষ্ণা ফিরে আসবে। মানসিক ভাবে নয় শারীরিক ভাবে। তাকে ছোঁয়া যাবে, কথা বলা, ব্যক্তিগত ভাবে শুধু তার।
হঠাৎ মায়ের মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে ভেঙ্গে পড়েছিলো আয়াত। অস্থিরতায় একবারও মেয়ের মুখ দেখেনি সে। বাসর ঘরে যখন তৃষ্ণাকে বউ বেসে দেখেছিল। জীবনটা তখন হঠাৎ করেই রঙিন প্রজাপতি মতো রঙিন হয়ে গেল।
এখনো মনের মাঝে তৃষ্ণাকে পাওয়ার হাজারো আকুতি। হঠাৎ হঠাৎ তৃষ্ণার যত্নগুলো যতোটা সুখের হয়, আঘাত গুলো তারচেয়ে বেশি যন্ত্রনাদায়ক হয়।

বর্তমানে__
— “স্যার, ইউ ক্যান হেয়ার। কিপ ইউর ফোন। আওয়ার প্লেন উইল ল্যান্ড এট দা এয়ারপোট সর্টলি। ফাস্টেন দা বেল্ট স্যার।” ( ফোনটা হাতে নিয়ে আয়াতকে ডাকতে ডাকতে বিমানকর্মী)
আধো আধো চোখ খুলে তাকালো আয়াত। তখনও এয়ার-হোস্টেজ ফোন এগিয়ে দিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানা নেই। হয়তো নিষুপ্তি উগ্ৰে হাত ফসকে ফোন পড়ে গেছে। মলিন হেসে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা নিয়ে নিল আয়াত। চারপাশের লোকজন তখন সিট বেল্ট লাগিয়ে নিয়েছে। সময় অবিলম্ব না করে নিজেও সিটি বেল্ট লাগিয়ে নিল।

_____তুমি এমনই আমার এক অসুখ
আমি চাইনা সেড়ে উঠতে
যত ভালোলাগা তোমাকে ঘিরে
তুমি মিশে আছো, যেন আমাতেই ?
বেলকেনিতে বসে খরগোশের ছানাটাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে তৃষ্ণা। যেন তার ছোট একটা পুচটি। স্যাম্পু শেষ করে পানি ঢেলে পরিস্কার করে নিল সে। কাবার্ড থেকে হেয়ার ড্রায়ার বের করে খরগোশের অঙ্গরুহ শুকিয়ে নিল। ললিপপের খোসা ছাড়িয়ে খরগোশের মুখে পুড়ে দিল। ঝুড়িতে রেখে রুমে প্রবেশ করলো।
আয়াতের অনুপস্থিততে দিনগুলো অতিবাহিত করতে অবুঝ প্রানীদের সাথে কাটিয়েছে। আয়াত সত্যি বলেছিল, মানুষ ধোঁকা দিলেও, তারা দেয় না।

বিগত মাসগুলোতে আয়াতকে প্রচন্ড মিস করেছে সে। আয়াতের অনুপস্থিতিতে অনুভূতি গুলো ডাইরির পাতায় বন্ধ করে রেখেছে। হয়তো মুহূর্তগুলো ব্যাখা দিতে পারে নি, কিন্তু আয়াতকে ঘিরে স্বপ্ন গুলোর রুপ দান করতে পেরেছে। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে আয়াতকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে।
বড় করে বাঁধাই করা ছবিটার দিকে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা। দুহাতে ছবিটায় হাত বুলিয়ে আয়াতে বুকে মাথা রেখে তৃপ্তিকর নিঃশ্বাস ছাড়ল। নয়নজোড়া অম্বুতে পূর্ণ হয়ে গেল তার। কতোদিন আয়াতকে দেখা হয় না তার। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে গভীর রাতে ২-৩ মিনিট আয়াতের সাথে করা হয় তার। অনুরাগী কন্ঠে বলল..

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১১

— “আয়াত। এই আয়াত। কেন আমার কাছে আসো না তুমি। তোমাকে কতোটা মিস করি ভাবতে পারবে না। আমিও যে তৃষ্ণার্থ আয়াতে পাগল হয়ে গেছি। তোর শহর এতো নেশাক্ত কেন? প্রচন্ড “”নেশাক্ত তোর শহর””।
রিংটোনের আওয়াজে ছলছল চোখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো তৃষ্ণার। আয়াত ফোন করছে ভেবে দ্রুত ফোনের কাছে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা। স্কিনে চোখ যেতেই রুদ্ধ হলো তৃষ্ণা। সিম কার্ডের অফিস থেকে ফোন এসেছে। ইচ্ছে করছে, কয়েকটা বাজে কথা শুনিয়ে দিতে। দিনের ভেতরে দুই থেকে তিনবার ফোন না দিলে এদের চলে না। এরা কি বোঝে না, তৃষ্ণার কষ্টটা না-কি তাকে জ্বালাতে এমন করে। ফোনটা রিসিভ করে মিনিট খানেক নিজের রাগ ঝেড়ে নিল তৃষ্ণা ?। দুজন পাগল দুদিকে বকবকানি করছে। তৃষ্ণা রাগ ঝেড়ে ফোন কেটে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। অতঃপর আয়াতের নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার আয়াত রিসিভ করুক, তাহলে আয়াতের একদিন, তৃষ্ণার যে-কদিন লাগে। কিন্তু তৃষ্ণাকে নিরাশ করে আয়াত ফোন রিসিভ করলো। একরাশ অভিমানে মন ভেঙ্গে গেল তৃষ্ণার।

কাবার্ড খুলে মেরুন রঙের আয়াতের শার্ট বের করে নিল। পাশের তাকে চোখ পড়তেই একটা প্যাকেট নজরে এলো। এতো গুলো দিন ভালোভাবে খেয়াল করা হয়নি। কৌতূহল নিয়ে প্যাকেট-টা বের করে খুলে দেখলো সে। কালো রঙের সিল্কের শাড়ি। যে কারো মন কেড়ে নিতে পারবে। প্যাকেটের ভেতরে ছোট একটা রিসিট চোখে পড়লো তৃষ্ণার। বছর আগে শাড়িটা কেনা হয়েছে। বুকের মাঝে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার। তাহলে কি সেদিনের পর আয়াত অন্য একজনের..
আর ভাবতে পারছে না তৃষ্ণা। মুখ ভেংচি কেটে শাড়িটা খুলে পড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল। যার হয় হোক, এখন আয়াতের সব জিনিসের উপর একমাত্র তৃষ্ণার অধিকার।

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১৩