নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১৪ || ইফা আমহৃদ

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

রুমের এক কোণ থেকে অন্য কোণে পায়চারী করে চলেছে তৃষ্ণা। একটু আগে একপ্রকার জোর করেই তাহসান বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বোনের অবস্থা ভেবে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কপালের কোণে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে তার।
কালো শাড়িটা ফ্লোরের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাঁটার সময় পায়ের সাথে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। গভীর চিন্তা করে ঠাস করে বেডের উপর বসে পড়লো সে। পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুলের সাহায্য আঁকিবুঁকি করছে। পাশে চোখ যেতেই আয়াতের হাসৌজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো সামনে। আয়াত গভীর ভাবে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটু আয়াতের দিকে সেটে গেল তৃষ্ণা। আয়াতের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলো। শান্তিপূর্ণ শ্বাস নিয়ে উচ্ছাসের সুরে বলল..

— “আয়াত আমি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খুশি। তুমি জানো, আমার সাথে আপির সব অভিমান দূর হয়ে গেছে। আপির কোলে ছোট একটা পুচকু আসবে।আচ্ছা আমাদের পুচকু কবে আসবে”।
মাথা তুলে আয়াতের দিকে তাকিয়ে হাসলো তৃষ্ণা। যে হাসিতে লুকিয়ে আছে হাজারো চাওয়া। আয়াত তৃষ্ণার কোমড় জরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..
— “যেদিন তুমি নিজ থেকে চাইবে, আমাদের সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের মতো হোক সেদিন”।
— ‘আমি তো চাই আমাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হোক”।

আয়াতের বাহু ছেড়ে সরে গেল তৃষ্ণা। দুজনের মাঝে বেশ দূরত্ব নিয়ে। আয়াত হাসলো। তার পিয়াসু পাখিটা নিজ থেকে তাকে চাইছে। তৃষ্ণার দিকে একটু এগিয়ে গেল সে। তৃষ্ণার কোমড় জরিয়ে কাছ এনে শান্ত কন্ঠে বলল..
— “ভালোবাসি! খুব বেশি ভালোবাসি তোমায় তৃষ্ণা। আমিও চাই আমার জীবনটা রঙে রঙিন করে তুলতে”।
আয়াতের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গল তৃষ্ণার মুখ। নিজের লজ্জার্থ মুখটা ধীরে ধীরে আয়াতের বুকে গুজে নিল। তৃষ্ণার কাছে আয়াতই তার একমাত্র স্থান, সেখানে সে নির্দ্ধিয় সবকিছু করতে পারে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হুশ ফিরল তৃষ্ণার। এখনো সে আয়াতের নগ্ন বুকে মাথা রেখে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আধোও এটা আয়াত কি? আয়াত আসবে কিভাবে? নিশ্চয়ই আয়াতের ভুত!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মস্তিষ্ক সচল হতেই আয়াতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। তার ফলস্বরূপ তৃষ্ণা নিজেই নিচে পড়ে গেল।কোমড়ে হাত রেখে সামনে তাকালো।আয়াত ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে‌। পড়নে একটা টাওয়াল ছাড়া কিছু নেই। হয়তো তৃষ্ণার এমন বিহেবে মানে বোঝার চেষ্টা করছে।
ভুতুড়ে ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..
— “আপনি! কে আপনি? আমি সিউর আপনি আয়াতের ভুত! আপনি এখানে কেন এসেছেন”?
ভয়ে ভয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণা। শাড়ির সাথে আটকে থেমে গেল সে।
তৃষ্ণার এমন বিহেবে প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে আয়াত। দাঁতে দাঁত চেপে বলল..
— “বিদেশে পানির অভাব পড়েছে। তাই শাওয়ার নিতে এসেছি। নিয়েই আবার চলে যাবো”।
আয়াতের উত্তর গ্ৰহনযোগ্য হলো না তৃষ্ণার আছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘনঘন পলক ফেলে বলল..

— “আপনি মজা করছেন আমার সাথে তাই না? আপনি আমাকে জ্বালাতে এখানে এসেছে। ছিঃ কি নিম্ন আপনার ভাবনা। আমাকে জ্বালাতে এতোদিন জামা কাপড় পড়ে এসেছেন আর আজ একটা টাওয়াল। যদি এতোই দেখাতে চান, তাহলে ওটুকু রেখেছেন কেন”?
আয়াতের কপালে সরু রুদ্র ভাজ ফুটে উঠলো। উঠে ধীর পায়ে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গেল কয়েকপা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল..
— ”এতোই যখন দেখতে ইচ্ছে করে? নেকামো না করে আগেই বলতে পারতে। স্টুপিট”।
বলেই টাওয়ালে হাত রাখল। মুহুর্তের তৃষ্ণার চোখ বড় বড় হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। “ভাইয়া গো” বলে এক চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল আয়াত। তৃষ্ণার পার্স ব্যাগ খুঁজে চাবী বের করলো। কাবার্ড খুলে ট্রাউজার আর টি শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তৃষ্ণা। আধ ঘন্টা ধরে তৃষাকে জিজ্ঞাসা করছে, কি হয়েছে। সে মুখে স্যলোটেপ লাগিয়ে বসেছে। তৃষ্ণার চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে মনিকা, আরোহী, লেবু। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে ফোপাতে লাগল সে।
বিরক্তি নিয়ে অষ্টাদশ বার জিজ্ঞাসা করলো মনিকা।
— মা আমাদের রুমে ভুত!
একে অপরের দিকে তাকিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার দিকে তাকালো সবাই। আদোও ভুত বলে কিছু হয়না। কিন্তু তৃষ্ণাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে মিথ্যা কথা বলছে। মনিকার ভাবনার মাঝেই মুখ খুললো লেবু..
— “ভাবীজান আমি একশত পার্সেন্ট সিউর মরা মানষের আত্মা তোমার পিছ লাগছে। আম্মা আপনি তারাতাড়ি ভাবীরে ফকিরের কাছে লইয়া জান। নাইলে পরে ভাবীরে আত্মায় লইয়া যাইবো গা। আল্লাগো বাঁচাও”।
সাথে সাথে লেবুর পিঠে চপল মারলো আরোহী। হালকা ধমকে দিয়ে বলল..

— “তুই চুপ করবি লেবু। তোর ফকির তুই মাথায় নিয়ে রাখ”।
— “তুমি ফকির বাবার নামে ফেলা ফেলা কইরো না। একবার তিনি অভিশাপ দিলে অনেক বড় ক্ষতি হইয়া যাইবো”।
চোখ গরম করে তাকাতেই ভয়ে চুপসে গেল লেবু। তৃষ্ণার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল..
— “ভাবী আমি বুঝতে পারছি, একা একা ভাইয়ার রুমে থাকাতে তোমার ভয় করছে। ঠিক আছে আজ থেকে আমিও তোমার সাথে থাকবো কেমন”?
— “তুমি কি মনে করেছ? তুমি থাকলে তোমার ভাই আসতে পারবে না”।

চিন্তিত হয়ে পড়লো আরোহী। তার জানা মতে তার ভাই ইউ-কে। দেশে ফিরল কখন। না-কি তৃষ্ণার হ্যালো স্লুয়েশন। আরোহীর ভাবনার মাঝে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল তৃষ্ণা.
— “আমি হসপিটাল থেকে ফিরে যখন রুমে ছিলাম; তখন তোমার ভাইকে দেখতে পেলাম না। হঠাৎ কোথা থেকে বেডের উপর টাওয়াল পড়ে উদয় হলো। তারপর টাওয়াল খুলে..
আর কিছু বলার আগেই মুখ চেপে থেমে গেল তৃষ্ণা। ভ্রোমের মাঝে কি বলতে কি বলে ফেলেছিল সে। তখনই আশ পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো.
— “তারপর কি? টাওয়াল খুলে ধিতাং ধিতাং নাচছিলাম”!

সিঁড়ির রেলিং এ হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আয়াত। সকলকে চমকে দিতে এসে নিজেই চমকে গেছে আয়াত। ফাঁকা বাড়িতে কেউই ছিল না। দারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সবাই হসপিটালে গেছে। ভেবেছিলো, শাওয়াল শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হবে। কিন্তু সেখানেও বাঁধল বিপত্তি। তৃষ্ণা যাওয়ার আগে কাবার্ড লক করে চাবী সাথে নিয়ে গেছে। তাছাড়া ট্রলির ভেতরের জামা কাপড় গুলো অপরিষ্কার। তাই টাওয়ার পড়ে বসে ছিল। কোনো প্রশ্ন করার আগেই চুলগুলো মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো আয়াত। হাতের ভেজা টাওয়াল-টা তৃষ্ণার কাঁধে ঝুলিয়ে উপরে উঠে যেতে যেতে বলল..

— “কখন এসেছি সেই ব্যাখা করতে পারবো না। পেটে প্রচন্ড ক্ষধা লেগেছে। আগে খাবো, তারপর বাকি সব।
আরোহী খাবার-টা উপরে দিয়ে যাস তো”!
যেমন অদ্ভুত ভাবে আবির্ভাব ঘটেছিলো আয়াতের। তেমনি মিলিয়ে গেল সে। সবাই এক ধ্যানে উপরে তাকিয়ে আছে। আয়াতের উপস্থিতি পরিক্ষা করতে হাতের উপর চিপটি কাটল তৃষ্ণা। তার ধারণাই সত্যি আয়াত এসেছে।

দরজা দিয়ে সামান্য উঁকি দিল তৃষ্ণা। চারপাশে আয়াতকে নজরে এলো না তার। পা টিপে টিপে শব্দহীন রুমে প্রবেশ করে ফ্লোর থেকে অগোছালো শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
আয়াত মনে সুখে তৃপ্তি করে খাবার খাচ্ছে। তার পুরো ধ্যান ধারণা খাবারের মাঝে নিহিত। দূর থেকে সোফায় বসে আয়াতের খাওয়া মন দিয়ে দেখছে। আয়াতের সবকিছু মুখস্থ তার। অলরেডি পাঁচ লোকমা খাবার মুখে তুলেছে, এখনো আর সাত থেকে আট লোকমা খাবার মুখে তুলবে।
গভীর চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এগিয়ে গেল আয়াতের দিকে। আয়াত খাবার খাওয়ার মাঝে একবার তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পূর্ণরায় খাওয়াতে মনোযোগ দিল। হাত কচলাতে কচলাতে দ্বিদা নিয়ে বলল..– “আমিও রাতের খাবার খাইনি”!
তৃষ্ণার দিকে না তাকিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল..

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ১৩

— “যাও নিচে গিয়ে খেয়ে এসো”।
কিছুক্ষণ মৌন্যতার পর আবার বলল..
— “অনেক দিন পরে আপনি এসেছেন? আপনার সাথে খেতে ইচ্ছে করছে”?
— “ঠিক আছে যাও খাবার নিয়ে এসো। একসাথে খাই”।
মুহুর্তের মাঝে চরম মন খারাপ হয়ে গেল তৃষ্ণা। আগে তো তৃষ্ণার বলার আগেই আয়াত ম্যাজিক করে সব বুঝে নিত! কই এখন তো নেয় না। তাহলে আয়াতের কেয়ারিং গুলো দিনের পর দিন কি হারিয়ে ফেলবে তৃষ্ণা।

— “বলছিলাম কি? আমি আপনার প্লেট থেকে খাবো”।
আয়াত ঢেকে রাখা প্লেটটা তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল..
— “ঠিক আছে; প্লেট নাও। আমি খাবার দিচ্ছি”।
মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল তৃষ্ণার। আয়াতের শার্ট টেনে নিজের কাছে এনে গলা তুলে বলল..
— “বুঝতে পারছিস না; আমি কি বলতে চাইছি? তোর সাথে, তোর প্লেট থেকে, তোর হাতের খাবার খাবো”।

নেশাক্ত তোর শহর শেষ পর্ব