নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৩ || ইফা আমহৃদ

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৩
ইফা আমহৃদ

বিয়ের প্রথম সকালেই সময় নিয়ে শাওয়ার নিচ্ছে তৃষ্ণা। কালকে রাতে তেমন কিছুই হলো না ,অথচ..! যদি কিছু হতো, তাহলে হয়তো আজ ওয়াশরুম থেকে বের হতো না।
লেটুস পাতা আর গাজর নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো আয়াত । ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নিল । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ অর্থাৎ এখনো ওয়াশরুমের ভেতরে । দৃষ্টি সরিয়ে বেডের উপর দিল। খরগোশ টা তৃষ্ণার আঁচল জুড়ে ঘুমিয়ে আছে । বড্ড হিংসা হচ্ছে আয়াতের । যার বিয়ে করা বউ সে এখনো ছুঁয়েও দেখলো না আর খরগোশটা বিনা বাঁধায় শাড়িটা নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ।
লেটুসপাতা আর গাজর গুলো একহাতে নিয়ে, অন্যহাতে খরগোশ টাকে তুলে বেলকেনিতে নিয়ে গেল।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তৃষ্ণা ।ভেজা চুলে তোয়ালে না পেঁচিয়ে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। চারদিকে আয়াতের উপস্থিতি অনুভব না করে বেলকেনিতে পা বাড়ালো । বেলকেনির মনোরম দৃশ্য দেখে ওষ্ঠ যুগল একে অপরের থেকে সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে । বেড রুমের থেকে শতগুণ সুন্দর তার এই ছোট বেলকেনিটা।গ্ৰিলহীনতা বেলকেনির সৌন্দর্য কয়েকশত গুন বাড়িয়ে তুলেছে । একপাশে তাকের উপর কৃত্রিম গাছ-পালা দিয়ে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা । কৃত্রিমের মাঝে কিছু কিছু সত্যিকারের গাছ রয়েছে । মাটি রাঙা মাঝখানে লম্বা হাতলযুক্ত ঝুড়ি। যেখানে ছোট ছোট তিনটে খরগোশ থাকে । উপরে গাঢ় সবুজ রঙের পাতলা কাপড় । তার পাশেই ওয়াটার ফলস রাখা । ফলসের মধ্যে ছোট ছোট লাল, হলুদ রঙের মাছ ও পাথর রয়েছে। উপরে অনেক শেওলা জমে আছে। বাংলায় যাকে বলে জলপ্রপাত কিংবা পানি চক্র।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাকের নিচে গাঢ় সবুজ নকশি পর্দা দিয়ে ঢাকা। বেলকেনির পুরোটা জুড়ে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক গাছ । মাঝে ফুঁলের গাছগুলো লক্ষ্য করে যাচ্ছে। যেখানে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে । অন্যপাশে একটা ঝুলন্ত দোলনা । দোলনার আশেপাশে অর্ধগলা ক্যান্ডলগুলো নিভে আছে । বেলকেনির দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্য আর্ট করা ।পায়ের নিচে মাটি রাঙা ফ্লোর। তৃষ্ণা একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে মেঝে স্পর্শ করলো। কিন্তু না ,, এটা মাটি না ইট সিমেন্টের তৈরি ফ্লোর । চোখের দৃষ্টি বাইরে যেতেই আরো চমকে উঠল তৃষ্ণা । সামান্য কিছু দূরত্বে পাখিরা উড়ছে আর কিচিরমিচির ডাকছে । এই বেলকেনিটা তৃষ্ণার কাছে শুধু বেলকেনি নয় ,, একটা জঙ্গল।
ভাবনার মাঝেই একটা লেটুসপাতা তুলে তৃষ্ণার হাতের মুঠোয় বন্দী করে দিল । চোখের সামনে তুরি বাজিয়ে বললো..

— “এভাবে হাঁ না করে থেকে ওদের খাইয়ে দাও” ।
কাঁপা কাঁপা হাতে তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশের দিকে এগিয়ে দিলো । খরগোশটা এগিয়ে দাঁত দিয়ে কুটকুট শব্দ করে গাজর খাচ্ছে । তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বলল..
— “এগুলো সব কি আপনি পোষেন” ??
আয়াত তৃষ্ণার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুহাত গ্ৰিলে রাখল । রেলিং এ সর্বশক্তি ভর করে তৃষ্ণার দিকে ফিরে বসলো। চোখজোড়া বন্ধ করে ধরা গলায় বলল..

— “জানো তৃষ্ণা ,, মানুষ মানুষকে ছেড়ে গেলেও অবুঝ পশুপাখি কখনো ছেড়ে যায় না। যখন আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে রিজেক্ট করেছিল ,, আমি পাগল গিয়েছিলাম। তবে সে আমাকে ঠকায় নি ।সে অন্য একজনকে ভালোবাসে , আমাকে ভালোভাবেই সেটা বুজিয়েছে । নিঃস্ব লাগছিল নিজেকে । তাকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি ।যদি আমার ভাগ্যে সে থাকে তাহলে আমি ঠিক তাকে পাবো । তখন প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছি ।মন ভালো রাখতে এই প্রিয় বেলকেনিটাকে নিজের পছন্দমত সাজিয়েছে ।
এই খরগোশ দুটির মাঝে আমি,, আমাকে আর সেই প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে পাই । আর পাখিরা রাতে এখানে থাকে । সারাদিন এদের দেখা পাওয়া যায় না ।
পূর্ণিমার রাতে এই বেলকেনিটাকে আমার কাছে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয় “।

তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশকে খাইয়ে, ছানাটাকে সাবধানে দুহাতে তুলে নিলো । আলতোভাবে খরগোশের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিল । অঙ্গরুহ তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল…
–” জানেন আমারও এক জোড়া খরগোশ ছিল । ভাইয়া এনে দিয়েছিল” ।
— “এখন নেই” । (বুকে হাত গুজে আয়াত)
মলিন হাসলো তৃষ্ণা । রিজভী খরগোশটাকে কি করছে জানা নেই তার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল..
— “তাও এক বিশাল কাহিনী । অন্য একদিন বললো”।
— “ভাবী কোথায় তুমি? প্রতিবেশী আন্টিরা তোমাকে দেখতে এসেছে” ।(রুমে প্রবেশ করে দু’জনকে খুঁজে না পেয়ে আরোহী)
আরোহীর কথায় ধ্যান ভাঙলো তৃষ্ণা- আয়াতের । হাতের বাজে বন্দী রাখা খরগোশের ছানাটাকে আয়াতের হাতে দিয়ে আরোহীর ডাকে সাড়া দিল ।

— “আরোহী আমরা এখানে । দাঁড়াও আসছি”!
গোটানো শাড়ির কুচিগুলো ধরে আরোহীর সামনে এগিয়ে গেল । তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে খরগোশের মাথায় দিকে গভীর ভাবে তাকালো আয়াত। খরগোশটাকে হিংসে হচ্ছে প্রচুর । নিজের বিয়ে করা বউকে এখনো ছুঁতে পারলো না এদিকে তৃষ্ণা আয়াতকে ছেড়ে খরগোশকে চুমু খেয়েছে ।দুহাতে খরগোশটাকে উপরে তুলে নিলো । তৃষ্ণার ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়া জায়গাটায় গভীর ভাবে নিজের ঠোঁট ছুয়ালো । পারলে যেন স্থানগুলো খেয়ে ফেলতো ।

আড়চোখে বেলকেনিতের দিকে তাকিয়ে ভাইয়ের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিল । দুজনে একসাথে বেলকেনিতে দেখে তৃপ্তিকর শ্বাস ছাড়লো । কিছু একটা ভেবে বলল…
— “ভাবী। নিচে আমাদের প্রতিবেশী আন্টিরা এসেছে তোমাকে দেখতে ।হুট করে বিয়েতে আসতে পারেনি তো তাই”।
তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল তৃষ্ণা । প্রতিবেশী আন্টিদের সাথে তেমন কোনো পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাদের । কেমন স্বভাবের তাও তার অজানা । ঠোঁট কামড়ে ফোস ফাস করে মলিন কন্ঠে বলল…

— “তুমি যাও আরোহী। আমি আসছি”!!
রহস্যময়ী হাসি দিয়ে দ্রুত রুম প্রস্থান করলো সে । যেন বেরিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে। পুরোটা সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ।
বোধশক্তি হারিয়ে আরোহীর পেছনে পেছনে বেরুতে নিল তৃষ্ণা । বের হওয়ার আগেই থামিয়ে দিলো আয়াত । বাহুতে হাত রেখে টেনে বেডে বসিয়ে দিল । কাঁধে ঝুলন্ত তোয়ালে টা দিয়ে মাথার চুল গুলো স্বযত্নে মুছিয়ে দিল । কাবার্ডে গুছিয়ে রাখা হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিল । তৃষ্ণার পাশে বসে প্রতিটা চুলগুলো সূক্ষ্মভাবে ড্রায়ার করে করে দিল ।
গা গুলিয়ে উঠলো তৃষ্ণার । কখনো কোনো ছেলের সংস্পর্শে যায়নি সে । ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরো দৃঢ় বান্ধনে আবদ্ধ করে নিল আয়াত । চুলের বাজে হাত রেখে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল..

— “খরগোশের ব্যবহার করা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে সুন্দর ভাবে চুল গুলো শুকিয়ে দিচ্ছি । যদি আরেকবার মোছড়া – মুচড়ি করো, তাহলে খরগোশের মতো হাতে নিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিবো ।মাইন্ড ইট” !
দমে গেল তৃষ্ণা । চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো শ্রাবণপথের পেছনে গুঁজে দিয়ে শান্তভাবে বসে রইল সে ।
পূর্ণরায় হেয়ার ড্রায়ার কাবার্ডে গুছিয়ে রাখল । প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় একপা দিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো । মোহনীয় চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ঘোরলাগা কন্ঠে বলল…

— “বাইরে যাও আর যেখানে যাও। যাওয়ার আগে শাড়িটা পাল্টে যাও ।
তোমাকে এই অবস্থায় শুধু আমি দেখবো ।অন্যকেউ যাতে না দেখে”।
দরজা বন্ধ করার শব্দে হুঁশ ফিরল তৃষ্ণার । আয়াতের কথাগুলো মাথায় আসতেই নিজের দিকে তাকালো । লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে। ইতিমধ্যে গালের খানিকটা অংশ রক্তিম আকার ধারণ করেছে । চুলের পানিতে পেছনের অংশ ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ।

— “মা ! ঘোমটা সরিয়ে একটু চুলগুলো দেখাও তো”?
বিরক্তির উপর চরম বিরক্তি হলো তৃষ্ণা । প্রতিবেশীদের এর জন্য তার ভালো লাগে না ।এই নিয়ে আঠারো না উনিশ বার বলেছে, ” মা একটু হেঁটে দেখাও? , হাতের রেখা দেখাও? , এতো চিকন কেন”? এটা ওটা বলতে বলতে তৃষ্ণার মধ্যে এমনিতেই বিরক্তিকর ভাব চলে এসেছে ।
মাথার ঘোমটা ফেলে খোঁপা করা শুষ্ক চুলগুলো ছেড়ে দিল । কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তৃষ্ণাকে দেখে থামলেন তারা । তৃষ্ণার এমন বিরক্তিকর ভাবটা প্রকট হলো আয়াতের মা মনিকার কাছে । চায়ের ট্রে টা টি টেবিলের উপর রেখে তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ২

— “তুমি এবার যাও! গিয়ে দেখ আয়াতকে কি প্রয়োজন হয়” ।
মনিকার মুখে রহস্যময়ী হাসি দেখে চাপা হাসলো তৃষ্ণা। সবাইকে সালাম দিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো । দু-সিড়ি অতিক্রম করে থেমে গেল সে । নিচের দিকে তাকাতেই কপালের কোণে তিনটি উদ্বিগ্ন ভাজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। উপর থেকে শাড়ির কুচিগুলো খুলে এসেছে । তট জলদি বাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে নিলে , কুঁচিগোছা ছুটে পায়ের কাছে পড়ে গেল । চোখ মুখে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে । সবাই তার দিকে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে । কয়েকজনে ইতিমধ্যে বলেও ফেলেছে ..

— “মনি! এ-কেমন বউ এনেছিস ।শাড়িটাও ঠিকভাবে পড়তে পারে না”।
— “আমি হলে এমন মেয়েকে ছেলের বউ তো করতামই না । যদি হয়ে যেত পিটিসে সোজা করে দিতাম । বাবা মা আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করেছে ।
যে মেয়ে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা। সে মেয়ে তোর ছেলেকে কি করে সামলাবে ।দেখিস হিতে বিপরীত হয়ে না যায় ।এখনো সময় আছে বউকে শাসনে জব্দ করে নে ..

ঠাস ঠাস শব্দে করে নিচে এলো আয়াত । প্রতিবেশী আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখজোড়া ছলছল করছে । এই বুঝি আটকে রাখা অশ্রু গুলো কান্না রুপে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁটু কাছের ট্রাউজার টা সামান্য গুটিয়ে নিল । হাঁটু ভাঁজ করে তৃষ্ণার কাছে বসে পড়লো। পায়ের কাছ থেকে অগোছালো কুচিগুলো গুছিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার হাতে ধরিয়ে দিলো।

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৪