নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৫ || ইফা আমহৃদ

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

চোখ জোড়া অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে এলো তিশার। নিজের কাজগুলোকে মনে পড়তেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। তিনমাসে বাড়ির কারো সাথে কথা হয়নি তার। বড় ভাই ফোন দিয়েছিল, কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করতে গিয়েও করলো না। নিজেও ফোন করেনি । আজ বড্ড ইচ্ছে করছে তার ছোট বোনের সাথে কথা বলতে,, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল দুজনকে দুজনার থেকে বহুদূরে সরিয়ে দিয়েছে। রিজভীর সাথে কাটানো সেই গভীর রাতের কথা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। যে রাতের পর নিজেকে রিজভীর থেকে আলাদা করে নিয়েছিল। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী রইলো না। তার আগেই নিজের গর্ভে ফুটফুটে একটা ছোট বাচ্চার হদিস পেল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কিছু মাসের জন্য অন্য কোথাও থাকার অবিরাম চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার আগেই সবটা ফাঁস হয়ে গেল।
রুম পরিস্কার করতে এসে শান্তির হাতে রিপোর্ট খানা পৌঁছে গেল। তিনমাস চলছিল তখন। বোনের অসহায় মুখ দেখে সেদিন নিজেকে শেষ করে দেওয়া তীব্র ইচ্ছা বিরাজ করছিল তিশার মনে। নিজের অস্তিত্বের কথা ভেবে সেই বেমানান ইচ্ছেটাকে সমাপ্তি করলো।
ছয় মাসের পেটের উপর হাত বুলিয়ে ,, দীর্ঘ শ্বাস নিল সে। রিজভীর সাথে তার সম্পর্কটা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। হয়তো সেও এখনো অর্ধাঙ্গিনী রুপে তিশাকে গ্ৰহন করতে পারেনি। শুধু দায়িত্ববোধের খাতিরে বিয়েটা করছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ ভেবেই নিয়েছে , তৃষ্ণার সাথে তাকে কথা বলতেই হবে। পেটের উপর হাত রেখে টেবিলের উপর থাকা ফোনটার দিকে হালকা ঝুঁকলো। ফোনটা হাতের বাজে আসতেই তৃষ্ণার নাম্বারে ডায়াল করলো। শ্রদ্ধেয় ভাই আর তৃষ্ণা নাম্বার সবসময় উপরেই থাকে। কারণ সে দিনে আনুমানিক দশবার ডায়াল করার বৃথা চেষ্টা করে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তৃষ্ণার নাম্বারে রিং হওয়ার আগেই কেটে দিল। ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে এক প্রকার ছুঁড়ে ফেললো বেডের উপর । দুহাত মাথায় গুঁজে ঢুকরে কেঁদে উঠলো।
আজ ছোট বোনের সাথে কথা বলার মতো সাহসে কুলাচ্ছে না তার।

কারো পদধ্বনিতে হুস ফিরলো তার। কেউ একজন ক্রমাগত তার দিকে এগিয়ে আসছে । চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই মনটা বিষাদে ভরে গেল। পূর্ণরায় মাথা নিচু করে নিল। রিজভীর মা এসেছে। বিয়ের তিনমাস পূর্ণ হয়েছে বটে কিন্তু তার হেল্থ কেয়ার ছাড়া কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না।
তিনি এগিয়ে গিয়ে ট্রে ভর্তি খাবারগুলো বেডের উপর মৃদু শব্দে রাখলেন। বসলেন না তিনি । নিজের হাতটা তিশার পেটের উপর রেখে কাঠ কাঠ গলায় বললেন..
— “খাবারগুলো শেষ করে ট্রে টা এখানেই রেখে দিবে ।আমি প্রয়োজন বোধে এসে নিয়ে যাবো।
আর হ্যা, কিছু দরকার পড়লে জানাবে”।
নত মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সায় দিলো তিশা। তিশার উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহনিয়ে রুম প্রস্থান করলেন তিনি। হয়তো এক জনের জায়গায় অন্য- একজনকে মেনে নিতে পারছেন না।
তিনি যেতেই মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে নিল । ফোনের স্ক্রিনে দুই বোনের দুষ্টু- মিষ্টি কয়েকটা ছবি দেখে নিল । আচ্ছা আজও কি তৃষ্ণার মুখটা হাসৌজ্জ্বলই আছে , না-কি বোনের দেওয়া দুঃখে হারিয়ে গেছে।

বেলকেনির গ্ৰিলে ভর করে মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণা। আজ তার মনটা অন্যদিনের মতো ক্লান্তিত্ব নয় বরং অস্বাভাবিক । এই বাড়িতে আসার পর থেকে তার ভেতরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। যেটা শুধুমাত্র আয়াতকে ঘিরে।
আজ প্রথমদিন আয়াত অফিসে গেছে। আয়াতের অনুপস্থিতে নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছে তার কাছে। আয়াত যতক্ষন পাশে ছিলো,, সারাক্ষন এটা- ওটা বলে জ্বলিয়েছে। আজ নেই তাই হয়তো তাকে খুব মিস করছে।
নিজের অজান্তেই, বেলী ফুলের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিল। বামকর্নের পেছনে চুলের বাজে গুঁজে দিল। নিজেকে কেমন লাগছে দেখতে বড্ড ইচ্ছে জাগলো। উল্টো ঘুরে দুকদম ফেলতেই মস্তিষ্কের ভেতরে এক চিরচেনা মুখ ভেসে উঠলো। চট করে পেছনে ফিরতেই ঠোঁটের কোণে অজানা হাসি ফুটে উঠল।

তার ভাই- ভাবী এসেছে। এক ছুটে বেলকেনি , রুম পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো। বারবার সদর দরজার দিকে উঁকি দিচ্ছে। মিনিটের আগেই সে ড্রয়িং রুমে আসতে পারলে তার ভাই -ভাবী কেন পারলো না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তাহসান রমিজ প্রবেশ করতেই, ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো সে।
বোনকে কাঁদতে দেখে নিজের চোখেও অশ্রু ধরা দিল তাহসানের। নিজেকে সামলে বোনের মুখটা তুললো।
আলতো হাতে বোনের চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিলো। ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন..
— “তুই কাঁদবি তাই আমরা এতো দিন আসি নি। দেরীতে এলাম তাও কাঁদছিস। যদি আবার কাঁদিস তাহলে আমরা আর আসবো না”।
ভরা চোখের অশ্রুটুকু পড়তে না দিয়ে মুছে নিল। দীর্ঘ নাক টেনে অশ্রুসিক্ত হাসলো সে। মুখ গোমড়া করে বলল..
— “এসেছিল দেরী করে , আবার বলছিস আসবি না। পঁচা তুই”।

প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় পর বাড়িতে ফিরলো আয়াত। চুলগুলো এলোমেলো , গলার টাই ছাড়াতে ব্যস্ত। আসেপাশে ভালোভাবে না তাকিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল..
— “মা! একগ্লাস পানি দাও।আরু এসিটা ছেড়ে দে”!
মনিকা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বললেন…
— “সারাদিন মা ,,মা করিস কেন? এখন থেকে বউ বউ করবি। বিয়ে দিলাম যাতে আমি একটু শান্তি পাই । কিন্তু তুই সেই শান্তিটুকুও দিবি না”।
বউয়ের কথা কানে পৌঁছাতেই চোখ মেলে তাকালো আয়াত। তার সামনে তাহসানের পাশে বসে আছে তৃষ্ণা। সারাদিনের কাজের চাপে তৃষ্ণার কথা ভুলে গিয়েছিলো। তাহসানের সাথে কুশল বিনিময় করে পূর্ণরায় নিজের জায়গায় বসে পড়লো।
— “তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম । যখন শুনলাম ,, বিয়ের প্রথম রাতের আমার বোনের পা কেটে গেছে।”
তাহসানের কথায় হাসলো সবাই। আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল আয়াত।

মাঝরাতে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল তৃষ্ণার। মাথার নিচ থেকে বালিশ তুলে কান ঢেকে নিল সে। তবুও বালিশ অতিক্রম করে কানের ভেতরে পৌঁছে যাচ্ছে শব্দগুলো। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলতেই চেঁচামেচির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে নিল। কুঁচকে আসা নয়নজোড়া সামনের দিকে যেতেই আয়াতের ঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠলো। আয়াত কাত হয়ে তার দিকে ফিরে ঘুমিয়ে আছে । চাপ দাঁড়িগুলো মুখের আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলেছে ,, সেই অগোছালো দাড়িগুলোর ফাঁকে লুকিয়ে আছে ছোট একটা লালচে তিল। হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁটজোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে। চুলগুলো কপালের কাছে কার্ল করা।
মনে মনে বলে উঠলো..

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৪

— “কোথায় জানো শুনেছিলাম ,, ছেলেদের অগোছালো অবস্থা দেখলে মুরগী চোরের মতো লাগে আর মেয়েদের মায়াবী। কিন্তু আজ আপনাকে মুরগী চোর নয় , মায়াবী খরগোশ চোর লাগছে। আমার খরগোশ চোর”!
নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো তৃষ্ণা। অতঃপর খিলখিল করে হেসে উঠলো।

তৃষ্ণার হাসির শব্দের ব্যঘাত ঘটলো আয়াতের নিদ্রায়। চোখ কুঁচকে আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।আয়াতের চোখ কুঁচকে আসা থেকে মুখ চেপে হাসি আটকে নিল সে। আচম্বিতে আয়াতের কপালের কোণে কাঁটা দাগটা প্রকট হতেই স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। এই দাগটা সাথে সে পূর্ব পরিচিত। শুধু দাগ নয় , নাক, চোখ , মুখ , ঠোঁট সবকিছু তাঁর পরিচিত। কোনো একদিন এই চোখের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ছিল সে। সেই মানুষটি কী আদোও আয়াত ছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে বসতে নিলে একটা বলিষ্ঠ হাত নিজের কোমরে অনুভব করল। দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দিকে দিতেই চমকে উঠলো সে। ব্লাউজের গলাটা বড় থাকায় এক কাঁধে গড়িয়ে পড়ছে।

শাড়ির আঁচলটা খুলে অন্যপাশে পড়ে আছে। সাথে সাথে লজ্জায় চোখ জোড়া বেষ্টিত করে নিল। অতি সাবধানে আয়াতের হাতটা নিজের কোমর থেকে ছাড়িয়ে নিল। হাতের করতলের উপর ভর দিয়ে উঠে বসলো । খুলে আসা শাড়িটা শরীরে পেঁচিয়ে বেলকেনির চলে গেল। নিভিয়ে রাখা মোমবাতি গুলো লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। মুহুর্তের গুটিগুটি অন্ধকারে ঘেরা বেলকেনিটা হলদে-টে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো ।
দৃষ্টি বেলকেনি থেকে ল্যাম্প পোস্টের দিকে ঘুরিয়ে পুরোনো সেই দিন গুলো কথা ভাবতে লাগলো। যখন আয়াতের সাথে প্রথমবার তার দেখা হয়েছিলো।
ফ্র্যাশব্যাক__
ভাইয়ের সাথে দেখা করতে হসপিটালে গিয়েছিল তৃষ্ণা।

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৬