নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৮ || ইফা আমহৃদ

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৮
ইফা আমহৃদ

— “ঐ গন্ডরের বাচ্চা গন্ডার বললাম তো সরি। এবারও রাগ করে থাকবেন। আপনি জানেন, আমি একটবার হ্যালো বললে, সব ছেলেটা পাগল হয়ে যায়। দেখবেন”?
আয়াত তৃষ্ণার কথা এক কানে দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল। গা ছাড়ানো ভাব নিয়ে বাদামের লালচে খোসা গুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। সামান্য খোঁসা তৃষ্ণার মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ খুলে আয়াতের দিকে তাকাতেই মেজাজ বিগড়ে গেল তার।
— “আপনার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না”!
আর কিছু বলার আগেই আয়াত তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল..

— “প্রথমত গন্ডারের বাচ্চা অলওয়েজ গন্ডারই হয়, সিংহ নয়। আর দ্বিতীয়ত আমি সবসময় তোমার সাথে ছিলাম না। তাই তুমি হ্যালো বললে ছেলেরা পাগল হয়ে পাগলা গারদে যায় নাকি অন্য কোথায়, সেটা আমি কিভাবে জানবো।
তোমার ভয়েজ এতোটাই খারাপ যে, ছেলেদের হ্যালো বললেই পাগল হয়ে যায়। তুমি আবার তা গর্ব করে বলছ? হাউ ফানি”।
গভীরভাবে কিছুক্ষণ ভাবলো তৃষ্ণা। কথার মাঝে ফাঁক রাখলে যা হয় আরকি।” ওয়েট” বলে উঠে গেল তৃষ্ণা। আয়াতের সামনে ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে পড়লো। বাদাম খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল এক্সজেকলি কি করছে তৃষ্ণা।

মাথার ঘোমটা ফেলে পায়ের উপরে পা তুলে ভাব নিয়ে বসলো তৃষ্ণা। চোখের দৃষ্টি মোহনীয় করে সামান্য দূরত্বের ছেলেটার দিকে তাকালো।‌ ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দিল। চুলে কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে ছেলেটাকে চোখ টিপ মারলো। দুগালে হাত রেখে ইশারায় কথা বলছে।
তৃষ্ণার কান্ড দেখে পরপর ঢেকুর তুললো আয়াত। কিছুতেই কমছে না, যতোই তৃষ্ণার দিকে তাকাচ্ছে ততোই ঢেকুর বেড়েই চলেছে। বেঞ্চিতে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে দুই ঢোক খেয়ে সামনে তাকালো।
তৃষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে, দেখে মাথা গরম হয়ে গেল আয়াতের। বোতলটা দূরে ছুঁয়ে ফেলে এগিয়ে গেল তৃষ্ণার দিকে। শরীর থেকে ওরনাটা টান দিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

থেমে গেল তৃষ্ণা। ওরনাটা ধরার আগেই আয়াতের হাতে চলে গেল। দুহাতে শরীর ঢেকে মাথা নিচু করে নিল। আয়াতের চোখের তাকানোর মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছেনা। আয়াত পকেট থেকে ফোন বের করে বলল..
— “ওরনাটার সাথে তোমার নোংরা বিহেব যাচ্ছে না। তাই খুলে নিলাম। এবার যেটা করছিলে সেটা কান্টিনিউড করো। আমি ভিডিও করছি”।
তৃষ্ণাকে শান্ত দেখে আবার বলল..

— “বুঝতে পারছি, আমার সামনে সমস্যা হচ্ছে। ঠিক আছে তারচেয়ে বরং আমি চলে যাই আর তুমি কান্টিনিউড করো”।
শিস বাজাতে বাজাতে আয়াত চলে গেল। আয়াতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল তৃষ্ণা।পার্কের সবাই বাজে দৃষ্টিতে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। বড্ড অভিমান জন্মালো তার উপর। কিভাবে পারল এমন পরিস্থিতিতে ফেলে চলে যেতে।
মিনিট দুয়েক পর কেউ একজন ওরনা পেঁচিয়ে দিলো তৃষ্ণা শরীরে। দুহাতে ওরনার ফাঁক দিয়ে কোমড় জড়িয়ে গলায় গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। চমকে উঠলো তৃষ্ণা। সে ভালো করেই জানে আয়াত এসেছে। আয়াতের অস্তিত্ব উপলব্ধি করে তাকে চিনতে হয়না। উষ্ণ স্পর্শগুলো‌ জানান দেয় আয়াতের উপস্থিতি।

— “কি হলো, বাড়িতে যাবে না না-কি এভাবেই থাকবে”।(নিজের দিকে ফিরিয়ে আয়াত)
— “আসলে হাতি পড়ে গিয়েছিল তাই কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে। হাঁটতে পারবে না। কোলে নিতে হবে”।
বলেই হাতজোড় বাড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো তৃষ্ণা। আয়াতও হেসে তৃষ্ণাকে কোলে তুলে নিলো। এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যে দিকে।

হাসি আনন্দের মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। ধীরে ধীরে তৃষ্ণার মনে অজান্তেই আয়াত জায়গা করে নিয়েছে। প্রায়ই আগের সেই কেয়ারিং আয়াতকে মিস করে তৃষ্ণা। কারণ আয়াত আর আগে মতো নেই। তৃষ্ণার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। সে চায়না তার কেয়ারিং এ তৃষ্ণা অস্বস্তিতে পড়ুক। প্রথমে তৃষ্ণার অতীত সম্পর্কে কিছু না জানলেও পরবর্তী তার মায়ের কাছ থেকে সবটা জেনেছে। তাই তৃষ্ণাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরে কাজের চাপে নিজের যত্ন নিতে পারে না। ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে অফিসে যাচ্ছে আর মাঝরাত করে বাড়ি ফিরছে। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় গাড়িতে অবস্থান করা সময় টুকু আর রাতে ঘুমন্ত তৃষ্ণার মুখটা মন ভরে দেখে আয়াত।
রাতের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে আবার মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাত নয়টার কাটা অতিক্রম করার আগেই জনশূন্য হয়ে পড়েছে শহর। রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলও অনেকটা কমে গেছে।

বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে আয়াত। ব্যাগটা সোফায় রেখে সুট খুলে রাখল। বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টির দিনে ঘুম ভালো হয় বিদায় সন্ধ্যা রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভেজা শরীর নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালে পেছন থেকে ঢেকে উঠল মনিকা..
— “আয়াত খাবারটা নিয়ে যা। নিচে আর আসতে হবেনা। দুজনে একসাথে খেয়ে নিস”।
পেছনে ঘুরে খাবার হাতে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো আয়াত..
— “মা! তৃষ্ণা খায়নি”।
— “জানি না মেয়েটার কি হয়েছে। সকালে সামান্য খেয়ে ভার্সিটিতে গেছে। দুপুরে আর খায়নি”।

বাক্য উচ্চারণ না করে খাবার নিয়ে উপরে চলে এলো আয়াত। অন্ধকারে গ্ৰাস করে আছে আয়াতের রুমটা। জানালা দরজা খোলা বিধায় বৃষ্টির পানিতে রুমের অনেকটা অংশ ভিজে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানিতে সবকিছু দিনের মতো আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। যেই ঝলকানিতে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা আয়াত দেখতে পারছে। যেই মুখের দিকে তাকিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না আয়াত।
খাবারটা টেবিলের উপর রেখে দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। ভেজা জামা কাপড়সহ ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে শান্তভাবে বলে গেল..

— “তৃষ্ণা খাবারটা খেয়ে আবার ঘুমাও। নাহলে অসুস্থ হয়ে যাবে”।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। আগের ভঙ্গিতেই তৃষ্ণা শুয়ে আছে। আলো জ্বালাতেই গোপনীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নজরে এলো আয়াতের। মেয়েটার এমন বিহেবের কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলো না সে।
এগিয়ে গিয়ে তৃষ্ণার পায়ের কাছে বসে পড়লো। বাঙ্কেটের ভেতর থেকে পা বের করে কোলের উপর রাখলো। ধীরে ধীরে টিপে দিতে লাগল।
অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে ফিরে তাকালো তৃষ্ণা। মাথার ঘোমটা টেনে করতলের উপর ভর করে ধীরে ধীরে উঠে বসলো তৃষ্ণা। সময় নষ্ট না করে তৃষ্ণার পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। অতঃপর খাবার মেখে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিলো।
খেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু আয়াতের হাতে খাওয়ার সুযোগটা ছাড়তে চাইছে না। বড় করে হা করলো। আয়াত খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে বলল..

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৭

— “তৃষ্ণা আমি হয়তো জানি না এইসব দিনগুলো কেমন হয়। কিন্তু এইটুকু তো জানি, এই সময়ে স্বাভাবিক দিনের তুলনায় খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর হতে হবে। পাশাপাশি নিজের যত্ন নিতে হবে। কিন্তু তুমি দিন দিন কেমন আলসে হয়ে যাচ্ছ”।
তৃষ্ণা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়াতের কোলে উঠে বসলো। শক্ত করে আয়াতের গলা বেষ্টিত করে কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু শব্দে বলল..
— “আমি আলসে হয়ে গেছি তাতে কি? আমার আয়াত তো আছে, আমার জন্য! সে নাহয় তার পিয়াসু পাখির যত্ন নেবে”।
প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল আয়াতের মুখে। প্রথমবার আয়াতকে নিজের বলে দাবি করছে তৃষ্ণা। নিজেকে আয়াতের পিয়াসু পাখি বলে সম্বোধন করছে।
বাম হাত থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে তৃষ্ণার গালে হাত রাখলো। কিছু একটা ভেবে কপালের এপিঠ ওপিঠ ছুঁয়ে দিল। না জ্বর আসে নি।

ল্যাপটপের মৃদু আলোয় আয়াতের ক্লান্তিময় মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারছে তৃষ্ণা। কতো গুলো এই মুখটার বদলে ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থেকেছে তার হিসেব নেই। কিছুক্ষণের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মুখ খুললো তৃষ্ণা।
— “শুনছেন”?
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আয়াত। পূর্ণরায় ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বলল –“হয়”
— “বলছিলাম, আপনাকে আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে। প্রতিদিনই তো রাত জেগে কাজ করেন আজ ঘুমিয়ে পড়ুন”।
আয়াত কিছুক্ষণ ভেবে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল..
— “ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়বো। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে”।

নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ৯