পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২০

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২০
মম সাহা

জোৎস্না ভরা রজনী। বকুলের ঘ্রাণে আচ্ছাদিত পরিবেশ। দূর হতে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝি পোকা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রাতের আঁধারকে হালকা করার চেষ্টা করছে। এ এক মধুময় রজনী। কিন্তু সবার জন্য সবকিছু মধুময় আদৌও হয়? যে মানুষের পুরো জীবন জুড়ে আঁধারে পরিপূর্ণ তার কাছে জোৎস্না রাত নেহাৎই বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। তার কাছে রাত মানেই কেবল বিষন্নতার হাহাকার,বিষাদের ছড়াছড়ি। এই জগৎ সংসারের সবটুকু রঙ তার কাছে ভীষণ ফিকে,অস্বচ্ছ। কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।
উঠোনের এক কোণায় বেতের মোড়া পেতে বসেছে দুই রমনী। তাদের মাঝে এক আকাশ নিশ্চুপতা। তারা হয়তো নিজেদের সময় দিচ্ছে। গুছিয়ে নিচ্ছে তাদের এলোমেলো বাক্য গুলো, সাথে কিছু অনুভূতি।
নিরবতা ঠেলে দর্শিনীই মুখ খুললো। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুক্ত আকাশে। কণ্ঠ তার কাঁপছে। তবুও সে কথা বলে উঠলো,
“আমি কী তোমাদের বোঝা হয়ে গিয়ে ছিলাম, বড় বৌদি? আমি আসার পর তুমি বিপ্রতীপকে কেন কল করেছিলে? ঘাড়ের বোঝা নামানোর জন্য?”

নিধির কণ্ঠস্বর কাঁপছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করলো সে। নিচু হয়ে গেলো তার মাথা। কথা বলবে বলবে করেও কণ্ঠনালীতে এক অদৃশ্য বাঁধা অনুভব করলো। মস্তিষ্ক হয়তো ধিক্কার জানাচ্ছে তার ছোট কাজের জন্য। কিন্তু আদৌও সে এত ছোট কাজ করেছে? সে তো কেবল ননদের ভালোর জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলো।
বড় বৌদিকে চুপ থাকতে দেখে দর্শিনীও নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“যদি মায়া আমাকে কল না দিতো তবে জানতামই না আমার বড় বৌদি আমার অগোচরে আমার স্বামীর কাছে নতজানু হয়েছে। কেনো করেছো এসব বৌদি? স্বামী ছাড়া কী বেঁচে থাকা যায় না?”
এবার নিধি কথা বললো। ভেঙে ফেললো দ্বিধার দেয়াল। তার তো নিজেকে ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। কারো ভালো করতে গেলে মাঝে মাঝে একটু নতজানু হওয়া তো অন্যায় না। সে দর্শিনীর দিকে এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কেমন যেন একটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“স্বামী ছাড়া তুই হয়তো বেঁচে থাকবি কিন্তু আদৌও সুখে থাকতে পারবি, প্রিয়? তোর প্রথম দিনের বিধ্বস্ত রূপ দেখে আমার সহ্য হচ্ছিলো না। তাই সবার অগোচরে বিপ্রতীপকে কল করেছিলাম যেন সে তোর সুখ কেড়ে না নেয়। একটাবার তোকে যেন আগলে নেয়।”
“তা সে মিনসে তোমার কথা রাখলো বৌভাই? অপাত্রে কেনো কিছু দান করা উচিৎ না আর ভুল মানুষের কাছে ভুল আর্জি পেশ করাও উচিৎ না। তুমি কী ভেবেছো,বিপ্রতীপ তোমার কথা শুনে আমাকে নিতে আসতো? কখনোই না। আর তার সাথে থেকে গেলেই আমি ভালো থাকতাম? যদি সত্যিই এমনটা হতো তাহলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। হাজারো কটুক্তি সহ্য করে নাহয় আরও কতগুলো যুগ তার সাথে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু না,যেই সুখের লোভে সেখানে থাকতাম সেই সুখই আমাকে কখনো ধরা দিতো না। বেঁচে তো এতদিনও ছিলাম বৌদিভাই কিন্তু মরার মতন বেঁচে থাকাকে কী সুখে থাকা বলে?”

নিধি চুপ করে থাকে। দর্শিনীর প্রত্যেকটা কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু নিধিরও যে কিছু করার ছিলো না। তখন দর্শিনীর অবস্থা তার কাছে সহ্য হচ্ছিলো না। তাই তো সে কল করেছিলো ঐ মানুষকে। কিন্তু সে ছেলে আগাগোড়া পুরোটাই অ-মা-নু-ষ।
নিধি দর্শিনীর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে। ব্যাথিত কণ্ঠে বলে,
“তাহলে একবার সুখের সন্ধানে যা না প্রিয়। খুঁজে নে নিজের সুখটা। চোখ মেলে দেখ না, কে তোর সুখের দায়িত্ব নিতে চায়। আরেকটা বার বিশ্বাসের পাহাড় গড়ে তোল না মন মন্দিরে।”
“সে আর সম্ভব না যে বৌদিভাই। ভালোবাসা কী বার বার হয়? সে মানুষ নতুনে মত্ত হতে পেরেছে তাই বলে আমিও পারবো তেমনটা না। আমার কাছে রঙিন বসন্ত একবারই ধরা দিয়েছিলো। বার বার বসন্ত জীবনে আসে না গো বৌদিভাই। তবে তার আর আমার মাঝে পার্থক্য কি রইলো?”
নিধি কিছু বললো না। ছোট্ট শ্বাস ফেলা ছাড়া তার আর কিছু বলারও রইলো না। মাঝে মাঝে কারো বিষন্নতা দেখলে নিজেকে ক্লান্ত লাগে। মনে হয় ইশ, তার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম! কিন্তু আফসোস,বাস্তবে তার জন্য কিছু করে উঠে হয় না আর। অতঃপর পৃথিবীতে নিজেকে ব্যর্থ ছাড়া আর কিছু ভাবা সম্ভব হয় না। নিধি এখন নিজেকে সেই ব্যর্থতার খাতাতেই দেখছে।

রাত আরেকটু গভীর হলো। দুই রমনীর মাঝে হাজার কথা থেকেও কিছু বলার মতন খুঁজে পেলো না। অতঃপর নিধি “তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস” বলে চলে গেলো। দর্শিনী রয়ে গেলো একা। এমন করেই সবাই যার যার মতন চলে যায় জীবন থেকে। একটা সময় পর মানুষকে একা-ই বেঁচে থাকতে হয়।
দর্শিনী মুচকি হাসলো। নিজের গালে নিজে হাত ছুঁয়েই আনমনে বলে উঠলো,
“একা বাঁচতে শিখো, প্রিয়।”
নিজের করা কাজের কথা ভেবে নিজেই আবার হেসে উঠলো। দিনে দিনে কী সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? তার তো পাগল হওয়ার কথা ছিলো না৷ তবে? জীবন কেনো তাকে এমন মোড়ে এনে দাঁড় করালো? ছয় সাত মাস আগেও জীবন টা অন্যরকম ছিলো। রাতটা তার এত বিদঘুটে ছিলো না। কিন্তু এক লহমায় যেন সব শেষ। একদম সবটা মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। আচ্ছা, এখন কী বিপ্রতীপ মায়াকে তার বুকের বা’পাশে নিয়ে ঘুমায়? এখনো কী চুমু না খেলে বিপ্রতীপের সকাল মিষ্টি হয় না? অফিস থেকে এসে ঘাম গুলো কার আঁচলে মুছে সে? মায়ার? না,না। সব ভাবনা গুলো এত যন্ত্রণাদায়ক কেনো? তার সংসারে আজ অন্য কারো বসবাস কেনো? নিয়তি তার বেলা এত নিষ্ঠুরতম কেনো? বিপ্রতীপের খাটের ডানপাশ আর বুকের বা’পাশ তো দর্শিনীর নামে ছিলো। তবে আজ কেনো সেথায় অন্য কারো রাজত্ব? কেনো দিশ শেষে মানুষ বদলে যায়? শুরু আর শেষে মানুষের অনুভূতির এত পার্থক্য কেনো হয়?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই দর্শিনীর। সে কেবল জানে,সে জীবন যুদ্ধে একজন পরাজিত সৈনিক। যে প্রতিনিয়ত মরে যাওয়ার প্রার্থনা নিয়ে বেঁচে আছে। অনেকদিন পর বিপ্রতীপের ভাবনা স্মৃতির পাতায় আঁকিবুঁকি করছে। মানুষটা কেমন আছে? বেশ সুখে আছে বোধহয়। বিপ্রতীপদের সুখের জন্য প্রিয়দর্শিনীরা নাহয় খারাপ থাকবে। তবুও বেইমানরা ভালো থাকুক।

শহুরে জীবন মানেই যান্ত্রিক জীবন। কর্ম ব্যস্ততা থেকে তাদের মুক্তি নেই। রোবটের মতন অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে চলতে হয় তাদের জীবনধারার স্রোতে গা ভাসিয়ে। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই বাহিরে বের হয় আর রাতে আলো ঝিমিয়ে এলে বাড়ি ফিরে। এ যেন মুসাফির। নিরন্তর হেঁটে চলাই যেন তার কাজ!
মায়া রান্নাঘর থেকে টিফিনবক্স হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। খাবার টেবিলে তখন টুংটাং শব্দ তুলে খেয়ে যাচ্ছে নিলয় কুমার, বিপ্রতীপ আর মোহনা। কারো সাথে মনে হয় কারো কোনো সম্পর্ক নেই। কেমন বিচ্ছন্নতা ঘেরা সম্পর্ক।
মায়া বিপ্রতীপের দিকে টিফিনবক্সটা এগিয়ে দিলো। ছোট্ট কণ্ঠে বললো,
“আপনার খাবার।”
বিপ্রতীপ বা’হাতে বক্সটা নিয়ে পাশেই রাখলো। অতঃপর আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলো। মোহনা আটার রুটিটার এক অংশ ছিঁড়ে দুধে ভিজাতে ভিজাতে মায়ার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“বিয়ে হলো এক মাসের বেশি হয়ে গেছে। আশাকরি খুব দ্রুতই কোনো সুসংবাদ আমাদের দিবে। তাই না?”
“অবশ্যই, সুসংবাদ তো আছেই। বলতে ভুলে গেছিলাম।”

মায়ার কথায় উপস্থিত তিনজনের খাবার থেমে গেলো। বিপ্রতীপ ভ্রু কুঁচকে তাকালো মায়ার পানে। মায়া ঠিক কোন সুসংবাদের কথা বুঝালো!
মোহনার মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। অবশেষে সে বংশধরের মুখ দেখে যেতে পারবে। মোহনা গদোগদো হেসে বললো,
“সুসংবাদ আছে অথচ তুমি আমাদের বলো নি?”
“আসলে বলার সুযোগ পাই নি। কিছুদিন আগে আমার রেজাল্ট দিলো না? আমি ভালো একটা কলেজে চান্স পেয়েছি। দারুণ না সংবাদ টা?”
মায়ার কথায় মোহনার মুখের হাসি উবে গেলো। মুখটা থমথমে করে শব্দ করে উঠে গেলো সেখান থেকে। নিলয় কুমারও প্লেটে রুটিটা রেখে উঠে গেলো। আজকাল তার যে কোনো কিছুতেই মন বসে না। সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হতে মন চায়।
মায়া মিটমিটিয়ে হাসে। মোহনাকে জব্দ করতে তার এত যে ভালো লাগে সেটা বলার বাহিরে। বিপ্রতীপ আগের ন্যায় খেতে খেতে বললো,
“তোমার সাথে বিয়ের পর এখনো আমি এক বিছানায় ঘুমাই নি। সুসংবাদ তো আসবে দূরের কথা। তাই না মায়া?”
মায়া হকচকিয়ে গেলো। বিপ্রতীপের ঠোঁটের কোণায় এখনো বিদ্রুপের হাসি বিদ্যমান। মায়া নিজের হাত কাচলাতে লাগলো। সে যেন ভাবতেই পারে নি বিপ্রতীপ তার চাল বুঝে যাবে।

সকাল হতেই নিধিদের বাড়িতে রান্নার ধুম। দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয়ও বসে আছে তাদের উঠানে। তৃণা আর দর্শিনীকে ক্যাম্পিং এর জন্য নিতে এসেছিলো কিন্তু সবাই সকালের নাস্তার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করায় বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো তাদের।
দর্শিনী মাত্র চুলাতে দুধ বসিয়ে ছিলো ধৃষ্টের জন্য। হঠাৎ করেই দুধের গন্ধ নাকে যেতেই তার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। হুড়মুড় করে ছুটে উঠোনের এক কোণায় বমিতে ভাসিয়ে দিলো। রীতিমতো ততক্ষণে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবাই যেন বিষ্মিত। দুধের ঘ্রাণে বমি করার মতন যুক্তি তাদের বোধগম্য হলো না। একবারেই যে বোধগম্য হলো না তেমনটা না। কিন্তু তারা নিজেদের ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলো না।

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১৯

দর্শিনী ততক্ষণে বমি করে ক্লান্ত প্রায়। তৃণা ছুটে জল এনে দর্শিনীর মুখ চোখ ধুয়ে দিলো। দর্শিনী ক্লান্ত শরীরে ভার ছেড়ে দিলো তৃণার উপর। ততক্ষণে বাড়ির সবার বিষ্ময় দৃষ্টি তার চোখে পড়লো। না,এবার বোধহয় আর সব লুকানো সম্ভব নয়। অতঃপর নিজের গলার ঘামটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে বাবার দিকে তাকিয়ে সে অবশ কন্ঠে বললো,
“বাবা,আমার ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২১