পূর্ণতা পর্ব ১২

পূর্ণতা পর্ব ১২
নন্দিনী নীলা

যথারীতি পরদিন প্রভাত পূর্ণতাকে পড়াতে আসলো। পূর্ণতা আজকেও নতুন জামা পরে সেজেগুজে আছে‌।
প্রভাত পূর্ণতা কে দেখেই বলল,,”তুমি যে এতো সাজতে পছন্দ করো আগে তো মনে হয়নি।”
পূর্ণতা লাজুক কণ্ঠে বলল,,”আমাকে সাজগোজ অবস্থায় দেখে আপনার ভালো লাগছে না। আমাকে কেমন দেখা যাচ্ছে?”

জিজ্ঞেস করল পূর্ণতা প্রভাত ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলল,,”খারাপ না।”
পূর্ণতা নিজের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা গম্ভীর করে বলল,,”এটা কেমন উত্তর হলো? কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করছি একটু তো প্রশংসা করতে পারেন।”
“আমি তোমাকে পড়াতে এসেছি তোমার রুপের প্রশংসা করতে নয়!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দাঁত কিড়মিড় করে পূর্ণতা চেয়ার টেনে বসল। প্রভাত ওর রাগী চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,,”সেজেগুজে তোমাকে যতটা না সুন্দর লাগছিল। অভিমানী রাগী চেহারায় তোমাকে তার থেকেও ভয়ংকর সুন্দরী লাগছে।”
পূর্ণতা স্তব্ধ নয়নে তাকাল প্রভাতের দিকে অনিমেষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা কিছু বলতে যাবে প্রভাত আঙুল উঁচু করে কথা বলতে মানা করে।

প্রভাত ফের বলে,,”আমি অতটাও বোকা নই যে এই পিচ্চি চঞ্চল মেয়েটার মনে ভাষা বুঝতে পারব না। তোমার মনে কি চলছে আর কেন এমন সেজেগুজে থাকো সবটাই আমি বুঝতে পারি। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে পড়াতে আসি তাহলে তোমাকে এই নিজেকে পরিপাটি করে আমার সামনে উপস্থাপন করার টা বন্ধ করতে হবে। তুমি যদি এসব করো আমি আগামীকাল থেকে আর পড়াতে আসবো না আজকে প্রথম আজকেই শেষ।”

পূর্ণতার চোখ ছলছল করে উঠলো জীবনে প্রথম ওর মনে প্রেমের দোলা লেগেছে। প্রথম কারো প্রেমে দেওয়ানো হয়েছে। কারো জন্য নিজেকে সাজাচ্ছিল আর সেই মানুষটা ওর অনুভূতি বুঝতে পেরেও এভাবে ওকে কাঁদাচ্ছে? আসবে না বলছে সে আসবে না কথাটা শুনে ওর বুকের ভেতরটা কতটা অস্থির হয়ে উঠেছে সে কি বুঝতে পারছে?
চোখের পলক পড়তেই পূর্ণতার বাম চোখের কোনা বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

প্রভাত পিছু ঘুরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে ফের বলল,,” তুমি যদি এভাবে সেজেগুজে আমার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করো এটা খুব বাজে দেখা যায় তোমার মা কি মনে করবে ভাবো? সে ভাববে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক চলছে। আন্টি বিশ্বাস করে আমাকে তোমাদের বাসায় জায়গা দিয়েছিল। এখন তার মেয়ের সাথে যদি আমি এমন কিছু করি তাহলে ব্যাপারটা কতটা খারাপ হয় তুমি ভাবো। তোমার বয়স অল্প নরম মন। যে বয়সটা তুমি পার করছ এই বয়সটাই সবাই ভুল করে তুমি এই ভুলের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলো না।”

পূর্ণতা ডুকরে কাঁদছে‌। প্রভাত ওর কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” কান্না থামাও। তোমার আম্মু যদি এসব দেখে আমি কিন্তু খুবই লজ্জায় পড়ে যাব। তুমি কি চাও আমি লজ্জা পাই বা অপমানিত হই।”
পূর্ণতা কান্না থামিয়ে দিল কিন্তু ওর ফুপাঁনো কমছে না। প্রভাত ওকে পড়াতে পারছে না এই অবস্থায়। পূর্ণতা থম মেরে বসে আছে একবারের জন্য ও ওর দিকে তাকাচ্ছো না। মাথা নিচু করে বসে আছে আর ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। প্রভাত ওর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,,”আমি কি চলে যাবো?”

চলে যাবো শুনতে পূর্ণতা লাল চোখ দুটো উঁচু করে তাকালো প্রভাতের দিকে।
প্রভাত বলল,,” মুখের কি অবস্থা করেছ। কেউ এতো কান্না করে পিচ্চি মেয়ে এখনই এসবের কী বোঝো?”
পূর্ণতা বলল,,”কাঁদিয়ে এখন বলছেন এতো কেউ কান্না করে! এভাবে আমাকে কাঁদালেন?”
“আমরা তো ফ্রেন্ড হতে পারি কেন আমাদের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড হতে হবে বলতো?”

“না আমরা ফ্রেন্ড হতে পারি না। আমরা শুধু টিচার আর স্টুডেন্ট হতে পারি। আমি আজকে পড়তে পারব না আগামী কাল থেকে পড়ব। আপনি আজকে চলে যান আমার নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগবে কিন্তু আমি নিজেকে সামলে নেব। ছোট হলো আমি অতটাও আবেগে জর্জরিত নয় নিজেকে সামলাতে পারি।”
প্রভাত পূর্ণতার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা ও তাকিয়ে আছে। প্রভাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে তারপর একটা দূর্বল হাসি দিয়ে চলে গেল।

পূর্ণতা প্রভাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগল।
তারপর থেকে প্রতিদিনই প্রভাত পূর্ণতা কে পড়াতে আসে। পূর্ণতা আর কখনো সেজেগুজে প্রভাতের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেনি। প্রভাতের কথা পূর্ণতা রেখেছে। আর কোন দিন পূর্ণতা প্রভাতকে ভালোবাসে বা ওর জন্য ওর মনে কোন অনুভূতি আছে সেইসব প্রকাশ করেনি। ওদের মধ্যে একটা টিচার স্টুডেন্ট এর সম্পর্ক বজায় রয়েছে। প্রভাত পড়তে আসে আর পূর্ণতা যন্ত্রের মতো পড়ে তারপর প্রভাত চলে যায়। একটা জিনিস খেয়াল করেছে প্রভাত পূর্ণতা আর আগের মতো ওকে ডিস্টার্ব করে না। শুধু পড়া নিয়ে ওর সাথে কথা বলে।

প্রভাত এসে জিজ্ঞেস করে কেমন আছো পূর্ণতা, পূর্ণতা শুধু ভালো আছি বলেই থেমে যায় ওকে জিজ্ঞেস করে না।
দেখতে দেখতে পূর্ণতার টেস্ট পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিল। এর মধ্যে ওর আব্বু আসবে শোনায় গেল। পরীক্ষার মধ্যে আর প্রভাত ওকে পড়াতে আসবে না শুধু ম্যাথ পরীক্ষার দিন পড়াতে আসবে। দুই দিন পর থেকে যেহেতু পরীক্ষা তাই আজকে প্রভাতের পড়ানো শেষ আবার পরীক্ষার পর থেকে পড়াবে।

পড়ানো শেষ প্রভাব চলে যাবে তখন পূর্ণতা বলে উঠল,,”একটা কথার উত্তর দিবেন?”
প্রভাত চমকে উঠল অনেকদিন পর ওর সাথে পূর্ণতা কথা বলছে।
প্রভাত বলল,,”হ্যাঁ বলো না।”
“আপনি আমার ভালোবাসাকে রিজেক্ট করেছেন আমি আপনার মতো ভালো স্টুডেন্ট নয় বলে তাই না?”
“আমি যে খুব ভালো স্টুডেন্ট তোমাকে কে বলল?”

“ভালো স্টুডেন্ট না হলে কি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে পারতেন? আমার আম্মু কি বলে জানেন আমি তো বেশি ভালো করে লেখাপড়া করি না এজন্য আম্মু বলেছে আমি ইন্টার পাশ করলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে‌।”
” সবার মধ্যে মেধা আছে। কেউ মেধা খরচ করে আর কেউ খরচ করে না। তুমি যদি পরিশ্রম করো অবশ্যই ভালো ফলাফল পাবে। হয়তোবা তুমি আমার থেকেও ভালো কিছু করতে পারলে।”

পূর্ণতা অনেকদিন পর আবার ফের আকুতি ভরা কন্ঠে বলে উঠল,,”আমিও যদি ভালো স্টুডেন্ট হয়। আপনার মতো পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস হ‌ই। তাহলে কি আপনি আমায় ভালবাসবেন?”
প্রভাত বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে পূর্ণতার দিকে।
“কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আপনি যদি আজকেও আমাকে ফিরিয়ে দেন আমি করে সত্যি বলছি আমি একটা পরীক্ষাও পাশ করার মতো দেব না।”

পূর্ণতার কথা শুনে প্রভাত চমকে উঠল,,”এসব কি বলছো পূর্ণতা?”
“আম্মু আব্বু সবাই যেমন আমাকে পূর্ণ বলে ডাকে আপনি ও আমাকে পূর্ণ বলুন না। ভালবেসে ছোট্ট করে পূর্ণ বলে ডাকবেন ইশ কি মধুর ডাক। দেখুন না আমাদের নামের কত মিল প দিয়ে প্রভাত প দিয়ে পূর্ণতা। আমি শুধু প্রভাতের পূর্ণ হতে চাই।”

প্রভাত রুম থেকে বের হতে গেলে পূর্ণতা ওর রাস্তা আটকে বলল,,”আমার কথার উত্তর দিয়ে যান আমি কিন্তু সত্যি টেস্টে ফেইল করব।”
প্রভাত দ্বিতীয়বারের মতো পূর্ণতা কে রিজেক্ট করে চলে গেল।

পরদিন পূর্ণতার বাবা আসলো। পূর্ণতার বাবা শাহিন আলম মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। পূর্ণতা নিজের বাবাকে মোটামুটি জমের মতো ভয় পায়। শাহিন আলম মেয়েকে স্কুল নিয়ে আসে পরীক্ষার জন্য। প্রতিদিন নিয়ে আসে নিয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে মেয়ের কাছে বেশি থাকতে পারে না একটা মাত্র মেয়ে সে মেয়েকে অনেক বেশি ভালোবাসে কিন্তু সে মানুষটা একটু রাগী প্রকৃতি। এজন্য মেয়েটা ওকে ভয় পায় সে জানে কিন্তু সে অন্য সব বাবার মতো অতটা নরম হয়ে মেয়ের সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু বাড়িতে আসলে যতটুকু সময় পারে মেয়ের সাথেই কাটানোর চেষ্টা করে।

তৃতীয় পরীক্ষাটাই ছিল পূর্ণতার ম্যাথ পরীক্ষা সেদিন প্রভাত ওকে পড়াতে আসলো না। এদিকে পূর্ণতা যথারীতি পরীক্ষা শেষ করল। পরীক্ষার পরে ওকে নিয়ে ওর বাবা মা নানা বাড়ি চলে এলো। নানা বাড়ি থেকে দাদা বাড়ি ঘোরাঘুরি করে বাসায় আসার পর আরও এক সপ্তাহ থাকলো শাহিন আলম তারপর তিনিও চলে গেল তার কাজে। পূর্ণতার স্কুল বন্ধ ছিল না টেস্ট পরীক্ষার পর থেকে কোচিং শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা যেহেতু এতোদিন পর এসেছে একটু ঘুরাঘুরি হয়েছে এজন্য কোচিং করেনি। আসার পর ওর কোচিং করার কোন রকম ইচ্ছা নেই। ওদিকে ফেইল করবে নিশ্চিতভাবে।

পূর্ণতার পরীক্ষার রেজাল্ট দিল ও ফেইল করেছে কিন্তু কিভাবে যেন তিনটা সাবজেক্টে পাশ করে গেছে ও তো খুবই বাজে লিখেছিল পাশ করল কিভাবে। স্টুডেন্টরা ফেইল করে অবাক হয় আর ও পাশ করে অবাক হয়েছে।
আর রেজাল্টের পর ও আশা করে আছে যেকোন দিন প্রভাতের আগমন ঘটবে ওদের বাসায়। এদিকেও ফেইল করেছে ওর মাকে ও বলতে পারছে না।

পূর্ণতা পর্ব ১১

গার্জেন নিয়ে না গেলে ওকে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না বলেছে। বিকেলের মায়ের কানে খবরটা চলে এলো। রোজিনা বেগম শাহিন আলম কেও বলে দিল। তারপর পূর্ণতা কে বকাঝকা করল সাথে চর থাপ্পড় দিল। পূর্ণতার ফর্সা গালে থাপ্পড় এর নীল দাগ পরে গেল।

পূর্ণতা পর্ব ১৩