পূর্ণতা পর্ব ২১

পূর্ণতা পর্ব ২১
নন্দিনী নীলা

পূর্ণতা এই মুহূর্তে বসে আছে মায়ার ফ্লাটে। মিস্টার স্মরণ কে দেখে পূর্ণতা রেগেমেগে নিচে চলে গিয়েছিল। মায়াকে এখন কীভাবে খোঁজে পাবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। পরে বাধ্য হয়েই বাসায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনি কোথা থেকে ছুটে আসে মায়া। এসেই পূর্ণতা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,“ পূর্ণতা তুই এসেছিস আমার তো বিলিভ‌ই হচ্ছে না।

ওর কন্ঠে উৎকন্ঠা। পূর্ণতা কে দেখে ওর চোখেমুখে উপচে পড়ছে আনন্দ।
পূর্ণতা সব খুলে বলে। মায়া ওকে টেনে ফ্লাটে নিয়ে আসে। পূর্ণতা স্মরণ কে যে ফ্লাটে দেখেছিল সেই ফ্লাটে মায়ার সমেত আসতেই চমকে উঠে‌।
‘এই বাসায় তো ওই বেয়াদব লোকটা ছিল। মায়া ও এখানেই থাকে?’
ও যে জিজ্ঞেস করবে সেই সুযোগ ও পায় না। মায়া ওর কোন কথাই শুনছে না। ওকে টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে আসে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পূর্ণতা কে সোফায় বসিয়ে মায়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,“ তুই এখানে আসায় আমার যে কত আনন্দ হচ্ছে পূর্ণ আমি তোকে বুঝাতে পারব না। কল করিস নি কেন? সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য?”
পূর্ণতা মায়ার ধ্যানে নেই ও আছে ওর চিন্তায়। স্মরণ কোথায় সেটাই ও বাসায় ঢুকে উঁকিঝুঁকি মেরে খুঁজছে। পলক ফেলছে ড্রয়িংরুমের আনাচে কানাচে।

“ ওই কি হলো তোর কথা বলছিস না কেন?” মায়ার ধাক্কায় ওর সম্মতি ফিরে এলো।
“ ফোন কীভাবে দিতাম ছিনতাই হয়ে গেছে।” ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
মায়া চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। কন্ঠে বিষ্ময় প্রকাশ করে বলল,“ বলিস কি! কীভাবে?”
পূর্ণতা ঘটনা খুলে বলল‌। মায়া পূর্ণতার কথা শুনল স্তম্ভিত হয়ে। তারপর পূর্ণতাকে বলল,“ ফোন গেছে যাক তোর কোন ক্ষতি হয়নি তো? শুনেছি এদের কাছে অস্ত্র থাকে।”

“ না আমার কিছু হয়নি।”
“ ফোন গেছে আবার কেনা যাবে বাট তোর কিছু হলে কি হতো।”
মায়া পূর্ণতাকে রুমে দিয়ে এলো ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বলল। পূর্ণতা না থাকার অনেক বাহানা বানাতে লাগল। কিন্তু মায়া ওর কোন বাহানা কানে নিল না‌। মায়া ওকে ছাড়বে না ও জানে কিন্তু মায়ার সাথে স্মরণের কি সম্পর্ক সেটাই ও বুঝতে পারছে না। স্মরণের জন্য এখন এই বাসায় ও থাকতে ইচ্ছে করছে না। বিছানার বসে পূর্ণতা এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিল। কেন এখানে আসতে গেল? লোকটাকে দেখলেই কষিয়ে একটা থাপ্পর মারার জন্য হাত নিশপিশ করে।

আয়রার বদলে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় শুনতেই ওর রাগ মাথায় উঠে গেছিল। এতো দিন পর আবার সেই লোকের সান্নিধ্য আছে ভাবতেই রাগ লাগছে।
পূর্ণতা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মায়া এসে ওকে টেনে খেতে নিয়ে আসলো। মায়ার হাজব্যান্ড টেবিলে বসেছিল। পূর্ণতা সৌজন্য সাক্ষাৎ করল। স্মরণ কে আর দেখতে না পেয়ে ও কিছুটা নিশ্চিন্ত হচ্ছে মনে হয় চলে গেছে এই বাসায় ওর মতোই কোন দরকারে হয়তো এসেছিল। মায়া ওর প্লেট খাবার তুলে দিলো। পূর্ণতা নিশ্চিন্ত মনে এক লোকমা খাবার মুখে তোলার জন্য হাত উঁচু করে মুখটা হা করেছে সেই মুহূর্তে ভেতরে থেকে হাসিমুখে এগিয়ে এসে পূর্ণতা সামনাসামনি বসলো স্মরণ। বসেই মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,“ সরি ভাবি, লেট হয়ে গেল। বাড়ি থেকে আম্মু কল করেছিল। কাল বাসায় ফিরতে পারব না বলতেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে তাকে মানাতে লেট হলো।”

পূর্ণতা মুখের সামনে খাবার তুলে ধরেই বিস্মিত আঁখিযুগল মেলে তাকিয়ে আছে স্মরণের দিকে।
পূর্ণতা মুখটা হা করে তাকিয়ে আছে। না খাবার মুখে তুলতে পারছে আর না প্লেটে রাখতে পারছে। ও বিষ্ময় এ নড়তে ভুলে গেছে।
স্মরণ পূর্ণতার দিকে একটা গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,“ এই নতুন সদস্য কে ভাবি?”
মায়া হাসিমুখে বসে থাকা পূর্ণতা কে জড়িয়ে ধরে বলল,“ আমার কলিজার বান্ধবী। আমরা একসাথেই অনার্স কমপ্লিট করেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।”

স্মরণ বিস্মিত লুক দিল পূর্ণতার দিকে। চমকিত কন্ঠে বলল,“ ঢাকায় এতো ইউনিভার্সিটি থাকতে তোমার বান্ধবী রাজশাহী পড়তে গিয়েছিল কেন?”
মায়া কিছু বলতে যাবে পূর্ণতা ওর হাত শক্ত করে ধরে বলল,“ কেন সেখানে পড়তে যাওয়া বারণ নাকি?”
“বারণ না, আসলে আমি রাজশাহীর বাসিন্দা হয়েও ঢাকা ছিলাম। তুমি ঢাকার হয়ে রাজশাহীতে ছিলে‌। একজায়গায় থাকলে হয়তো আমাদের একবার দেখা হতো।”

পূর্ণতা দাঁত কিড়মিড় করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কেবলি মনে হয়েছিল শয়তানের দেখা আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে শয়তানের এন্টি শুরু হয়ে গেল। পূর্ণতা রক্তচক্ষু করে আড়চোখে তাকাল স্মরণের দিকে। লোকটা ওকে আগে থেকে চিনে কি অবলীলায় লুকিয়ে গেল। এমন ভান করছে যেন আজকেই প্রথম দেখা। স্মরণের জন্য খেতেও পারছে না। স্মরণ ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর খাচ্ছে। মায়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল,“ কিরে খাচ্ছিস না কেন?”

স্মরণ বলে উঠল,“ ভাবি আপনার বান্ধবী দেখছি ভারী লাজুক। খেতেই পারছে না।”
পূর্ণতা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্মরণের দিকে তারপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,“ খাচ্ছি তো‌।”
বলেই দুই লোকমা খেয়ে উঠে গেল। মায়া ডাকাডাকি করলে বলল আর খেতে পারব না।
মায়া আর জোর করল না‌।
পূর্ণতা উঠে যেতেই স্মরণ ও উঠে গেল। অতঃপর পূর্ণতার পিছু পিছু বেসিনের সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণতা হাত ধুয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,“ ড্রামা তো ভালো করতে পারেন।”

“ ড্রামা কোথায় করলাম?” আকাশ থেকে পড়ে বলল স্মরণ।
পূর্ণতা যাওয়ার পথ ধরতেই স্মরণ বলল,“ প্রথম দেখার সেই সিগ্ধ, কোমল চেহারার নারী আমার হৃদয়ে প্রেমের পরশ দিয়েছিল। যার সেই লাজুকতা চেহারা আমায় টেনে এনেছে সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকা। দ্বিতীয় দেখায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন এই রূপ ও যে আমাকে এতোটা মুগ্ধ করবে জানা ছিল না‌। তুমি সব রূপেই আমার কাছে অনন্যা পূর্ণতা।”

পূর্ণতা বিস্মিত চক্ষু মেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। স্মরণের প্রতিটা কথা ওর হৃদয়ে গহীনে লাগল যেন রাগে ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো।
স্মরণ ওর রাগে রক্তিমা হ‌ওয়া মুখশ্রীর দিকে চেয়ে বলল,“ শোন আগামীকাল আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যার জন্য সব ছেড়েছুড়ে ঢাকায় এসেছি তাকে ছাড়া আমি কীভাবে একা রাজশাহী ফিরে যাই বলো? তোমাকে না নিয়ে আমি আর রাজশাহী ফিরছি না।”

পূর্ণতা স্মরণের মুখের দিকে চেয়ে রাগে ক্ষোভে বলল,“ মেন্টাল।”
তারপর মেজাজ দেখিয়ে রাগে গজগজ করে রুমে এসে ঠাস করে দরজা আটকে ফেলল। স্মরণ ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে হাসছে।
দিদান শশীর বাবার সামনে বসে আছে। বয়স্কদের মতো তার মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে। দিদান শশীর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। শশীর বাবা দিদানকে আপাদমস্তক দেখে বলল,“ আর কত কাল আমার বাড়ি পড়ে থাকবে? একা বিয়ে করেছ, এখন আবার নিজের বাড়ি থেকেও বিতারিত। তোমাকে আমি কেন থাকতে দিয়েছি সেটাই বুঝতে পারছি না।”

দিদান মাথা নিচু করে বসে ছিল। চকিতে মাথা তুলে তাকাল তার দিকে। তিনি গুরুতর ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দিদান জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। শশী কে নিয়ে নিজের বন্ধুর বাড়ি দুইদিন কাটিয়ে ওরা এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। শশী আসতে চায় নি কারণ বাবা ওকে আগেই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু দিদান ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে।
শশী কে অবাক করে দিয়ে ওর বাবা ওদের বাসায় জায়গা দিয়েছে। শশী এখানে থাকতে চায় নি দিদানের জন্য থাকতে হচ্ছে বাসার কেউ ওর সাথে কথা বলে না।

দিদান আবার বিদেশে যাবার চেষ্টা করতে চেয়েছিল কিন্তু টাকা পয়সা একটাও হাতে নেই। এভাবে মা ওর সাথে কঠোর আচরণ করবে কল্পনা ও করেনি। দিদান এই বাসায় জোর করেই আছে হাতে পায়ে পড়ে আর দুই দিন পর পর শশীর বাবার এমন হুমকি ধামকি শুনতে হয়। প্রতিবার‌ই দিদান মাথা নিচু করে তার সামনে বসে থাকে।
আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শশীর বাবা সামনে থেকে উঠে যেতেই দিদানের সামনে এসে দাঁড়াল শশী তারপর বলল,“ বাবার সাথে কি কথা বলছিলে? আমি বুঝি না মেয়ে তার আমি সে আমার সাথে কথা না বলে তোমার সাথে কি কথা বলে?”

“ কি আর বলবে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছিল।” চাপা রাগী কন্ঠে বলল।
শশী বলল,“ তো কি আসা করছিলে তোমাকে জামাই আদর করে বছরের পর বছর বাসায় রাখবে? এতো কিছুর ও যে থাকা খাওয়ার রাখছে এটাই অনেক নয় কি?”
“ বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো করেছিল কে? আমি না তুমি দোষ সম্পূর্ণ আমাকে দিচ্ছ আজ তোমার জন্য এমন অপমানিত সারাক্ষণ হতে হচ্ছে। তোমাকে বিয়ে না করলে আমায় নিজের ঘর ছাড়া হতে হতো না।”

পূর্ণতা পর্ব ২০

শশী ঠাস করে দিদানের গালে থাপ্পড় মেরে বলল,“ আমার বাড়ি আছিস আমাকেই গলার জোর দেখাচ্ছিস অনেক হয়েছে আর না ভুল মানুষ একবার করে।”
রাগে দিদানের ফরসা মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে উঠল। দিদান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

পূর্ণতা পর্ব ২২