পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৯

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৯
লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া

সারাদিন উনি বাসায় ফিরলেন না। রাতের দিকে বাসায় ফিরলেন। তখন আমি বিছানায় বসে বসে পড়ছিলাম। উনি নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করলেন। উনি আমাকে কিছু বললেন না। উনি এপ্রোনটা সোফার ওপর রাখলেন। ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে ঘড়িটা খুলে রাখলেন। সোফায় বসে পায়ের মোজাগুলো খুললেন। আমি নিরবে উনার প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু উনাকে কিছু বললাম না। উনি কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।
মিনিট পাঁচেক পড়েই উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। উনি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই উনার ফোনটা বেঁজে ওঠলো। উনি টাওয়ালটা গলায় ঝুলিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে ফোনে কথা বলছেন।

আমি আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে নিঃশব্দে উনার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ফোনে কথা বলা শেষ করে পিছনে ঘুরতেই চমকে ওঠলেন। উনি হাতের ফোনটা পকেটে পুরে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলেন, কী?
এই প্রশ্নটা তো আমার করা উচিত। এসবের মানে কী? এখন রিসেপশন আপনার মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে?
আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমাদের বিয়ের কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। ঘরোয়া ভাবে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। এই রিসেপশন পার্টির মাধ্যমে আমি সবাইকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানাব। সবাই জানবে আমি আর তুমি হাজবেন্ড ওয়াইফ।
এটা হয় না।
কেনো হয় না?
কলেজের সবাই জানে আমি অবিবাহিত।
এখন জানবে তুমি বিবাহিত।
সবাই ভাববে আমি মিথ্যাবাদী।
ভাববে না। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত কারণে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবার আড়ালে রেখেছি। কেনো রেখেছি এটা নিশ্চয়ই কেউ জানতে চাইবে না। এটা সম্পূর্ণই আমাদের পার্সোনাল মেটার।
কিন্তু …..
হুসসস। আর কোনো কথা নয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হুট করেই বেলকনি দিয়ে দমকা হাওয়া আসতে লাগলো। বাইরে প্রচণ্ড বাতাস বইছে। ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ। উনি দ্রুত গেলেন বেলকনির দরজা লাগানোর জন্য। উনি বেলকনির দরজাটা লাগিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই কারেন্ট চলে গেলো। রুম জুড়ে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসে জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। উনি উনার ফোন বের করে ফ্ল্যাশ অন করলেন। উনি জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন। আজকে দুপুরেই জেনারেটর নষ্ট হয়ে গেছে।
উনি জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। বাতাসের বেগ কমে গেছে। বৃষ্ট পড়া শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ঘড়ির কাটা ১২ টার ঘরে পা দিতেই উনি ফোনের ফ্ল্যাশ অফ করে দিলেন। প্রায় সাথে সাথেই ঠাস ঠুস বেলুন ফাটানোর শব্দ কানে এলো। হুট করে বেলুন ফাটানোর শব্দে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সাথে কিছু কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসলো।

হ্যাপি বার্থডে। হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার রিয়া।
চারদিকে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠলো। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার হাতে রঙে বেরঙের বেলুন। আজকে তো আমার জন্মদিন। আমার তো মনেই ছিল না। কী অদ্ভুত ব্যাপার নিজের জন্মদিনের কথা নিজেরই মনে নেই।
পিছন থেকে কেউ একজন আমার চোখ বেধে দিল। আমি চোখের ওপর হাত রেখে কিছু বলতে যাব তার আগেই কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে কোলে তুলে নিল। আকস্মিক ঘটনায় আমি ভয়ও পেয়ে গেলাম, চমকেও ওঠলাম। আমার মাথা ঠেকল ঐ ব্যক্তির বক্ষে। শরীর থেকে আসা মনোমুগ্ধকর মাতাল করা ঘ্রাণ আমাকে জানান দিচ্ছে এই ব্যক্তিটা রুদ্র ছাড়া আর কেউ না। আমি ভয় পেয়ে রুদ্রর বাহুর কাছে শার্ট খামছে ধরলাম।
আমি অস্থির হয়ে বলে ওঠলাম,
আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
গেলেই দেখতে পারবা। এখন চুপ থাক।

উনি আমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামচ্ছেন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। উনি আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে এসে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। প্রায় সাথে সাথেই একটা ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,
এই তুমি কী খাওয়া দাওয়া কর না? নিজের স্বাস্থ্য দেখছ? একটা ক্লাস ফাইভের বাচ্চার ওজনও তোমার থেকে বেশি।
আমি উনার কথা শুনে গাল ফুলিয়ে বলে ওঠলাম, একদম অপমান করবেন না। আমার ওজন একদম ঠিক ঠাক আছে। আপনি স্লিম ফিগারের কী বুঝেন? নিজে তো দিন দিন ভুঁড়িওয়ালা হয়ে যাচ্ছেন।
রিদি আপু আমাদের দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তোরা একটু চুপ করবি। নে রিয়া এবার চোখের বাধনটা খুল।
আমি গিট খোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। আমি গিট খুলে দেওয়ার জন্য রিদি আপুকে ডাক দিলাম কিন্তু রিদি আপু প্রতিত্তর করলো না। আশেপাশে কারোও সাড়া শব্দ পাচ্ছি না। অনেক চেষ্টা করে গিট খুলতে সক্ষম হলাম। চোখের ওপর থেকে কাপড় সরাতেই আমি হালকা ভয় পেলাম। চারদিকে অন্ধকার। কেউ কোথায় নেই। হুট করে চারদিকে লাইট জ্বলে ওঠলো। বাজি ফাটানোর মতো শব্দ কানে এলো। চারদিকে বেলুন রঙ বেরঙের লাইট দিয়ে সাজানো।

ড্রয়িংরুমের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের ওপর বেশ বড় সাইজের একটা কেক।
আমি অবাক হয়ে চারদিক দেখছি। এভাবে বাসা কে সাজাল আর কখনই বা সাজাল? আমি তো কিছু টেরই পেলাম না। আমার অগোচরে এতকিছু ঘটে গেলো। আমার মনোভাব হয়তো নিয়াম ভাইয়া বুঝতে পারল। নিয়াম ভাইয়া হালকা হেসে বলে,
এসব কিছু তোমার বর মহাশয় করেছেন। আমরা তো শুধু সাহায্য করেছি। সেই সন্ধ্যা থেকে ডেকোরেশন করা হচ্ছে।
আশ্চর্যজনক ভাবে আজকে সন্ধ্যা থেকে আমি একবারের জন্যও রুম থেকে বের হয়নি। আমি রুদ্রর দিকে তাকালাম। রুদ্রর ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে অমায়িক হাসি। এই হাসিটা দেখার জন্য আমি এক জনম পার করে দিতে পারি।

সকাল ৯ টা বাজে। কলিংবেলের কর্কশ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো। গতকাল কেক কাটা, বার্থডে সেলিব্রেশন, খাওয়া-দাওয়া করে আড্ডা দিয়ে রাত ৩ টার দিকে ঘুমানোর জন্য সবাই সবার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে গিয়েছিল। এতো রাত অব্দি জেগে থাকার জন্যই হয়তো এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। কলিংবেলের আওয়াজটা আমার বিরক্ত লাগছে। বিরক্তি নিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম।
এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে খোপা করে। মাথায় উড়না দিয়ে ভালো করে ঘোমটা দিয়ে নিলাম। ড্রয়িংরুমে এসে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আমিই দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতেই দরজার সামনে দুইটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার ভ্রু কুচকে। ছেলে দুটোকে আমি চিনি না। আগে কোনো দিন দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না। মামুনিদের আত্নীয় হলে তো আমি চিনতাম। ছেলে দুটো আমাকে দেখেই সালাম দিল।
আসসালামু আলাইকুম ভাবি।

আমি চমকে ছেলে দুটোর দিকে তাকালাম। এর আগে কেউ কখনো আমাকে ভাবী ডাকেনি। আমি একটু বিব্রত হলাম। তবু হালকা হেসে বললাম,
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কেমন আছেন ভাবী?
আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলে দুটো যা বলছে দুজন একসাথে। জমজ ভাইদের মতো না না জমজ ভাইয়েরা তো আর এক সাথে কথা বলে না। মনে হচ্ছে আমি উনাদের টিচার আর উনারা আমার স্টুডেন্ট। আমি কিছু বলার সাথে সাথে উত্তর না দিলে উনাদের কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব।
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা আমাকে ভাবি ডাকছেন কেনো? আমরা কী পূর্ব পরিচিত? আমাদের কী আগে কোথাও দেখা হয়েছিল?

না ভাবি। আজকেই আমাদের প্রথম দেখা হলো ভাবী। ভাবী আমরা রুদ্রর ফ্রেন্ড।
উনাদের কথা বলার স্টাইল দেখে অবাক হচ্ছি। প্রতি লাইনে লাইনে ভাবি ডাকছে। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। আজকে রুদ্রর ফ্রেন্ড আসবে আমাকে তো রুদ্র আগে বলেনি।
আপনারা যে আসবেন রুদ্র তো আমাকে কিছু বলেনি। রুদ্র কী জানে না আপনারা আজকে আসবেন?
না। আমরা রুদ্রকে না বলে এসেছি। আমরা রুদ্রকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে চলে এসেছি। আমরা রুদ্রর বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আপনি আমাদের চিনেন না কারণ আমরা এতোদিন দেশে ছিলাম না।
রুদ্রর বন্ধুদের পিছনে এসে একটা মেয়ে দাঁড়াল। মেয়েটাকে দেখে আমি চমকে ওঠলাম। মেয়েটা দেখতে হুবহু অরি আপুর মতো।

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৪৮

(একে তো ফোন নষ্ট আবার এক পর্ব দুই বার লিখতে হয়েছে। তাই গল্প পোস্ট করতে লেইট হয়েছে। আপনাদের আর বেশি অপেক্ষা করাব না আর দুই তিন পর্বের মাঝেই গল্প শেষ করে দিব।)

পূর্ণিমাতিথি পর্ব ৫০

8 COMMENTS

  1. নেক্সট পার্ট কবে দেবেন অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি প্লিজ তারাতারি দিননা।

Comments are closed.