প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব ১২

প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব ১২
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

সাইমা আজ ভার্সিটিতে যাবে না। কারণ হিসাবে জানিয়েছে, ‘তার মন চাইছে না আজ ভার্সিটিতে যেতে।’ এমনই সাইমা। মন নিয়ে কথা। মন না চাইলে কোথাও যাবে না সে। সাইফা অনেকবার বলেও রাজি করাতে পারেনি। অগ‍্যতা তাকে একাই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হলো। সাইমা, সাইফা এবার অর্থনীতি নিয়ে অনার্স করছে। দুজনেই প্রথম বর্ষে।

ভার্সিটিতে পৌঁছে সাইফা হাত ঘড়ি চেইক করে দেখলো অনেকটা দেরি করে ফেলেছে সে। অবশ্যই দেরিটা সাইমার জন্য হয়েছে। কিন্তু তাও তাকে আনতে পারলো না। হতাশা শ্বাস ফেলে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে দ্রুত পা চালালো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সাইফাদের প্রথম ক্লাস যে স‍্যার নেন তিনি বেশ গম্ভীর ও সল্পভাষী। সেই সাথে ভার্সিটির সবচেয়ে সুদর্শন অবিবাহিত টিচার। চেহারা সুন্দর হলেও কন্ঠে তার গম্ভীর কর্কশ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গ‍ম্ভীরতা ফুটিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করে, ‘কি ব‍্যাপার পড়া করে আসেননি কেন?’ তখন চঞ্চলা সাইমাও ভয় পেয়ে যায়। সে একপ্রকার এড়িয়ে চলে এই গম্ভীর স‍্যারকে। আড়ালে অন্তরালে স‍্যার সহ তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে জাহান্নামে পাঠাতে ভুলে না সে। সাইফা ক্লাসের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দেখলো স‍্যার ইতিমধ্যে ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। সাইফা দেরি না করে স‍্যারের উদ্দেশ্যে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। স‍্যার আসবো!”

শিক্ষার্থীদের থেকে মনোযোগ উঠিয়ে দরজায় জড়োসড়ো হয়ে দাড়ানো সাইফার দিকে তাকালো এক পলক। সাইফাকে একা দেখে কপাল কুচকে গেল সুদর্শন স‍্যারের। স্বভাবসুলভ গম্ভীর কন্ঠে শুধালেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি ব‍্যাপার আপনি একা কেন? আপনার সাথেরটা কই?”
সাইফা নিচু স্বরে বলল, “ও অসুস্থ স‍্যার। এজন্য আসেনি।”

“ওহ্ আচ্ছা। ভিতরে আসুন। পরবর্তীতে আর দেরি করবেন না। নচেৎ ভেতরে ঢুকতে দেওেয়া হবে না।”
সাইফা আর কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা ক্লাসরুমে ঢুকে পড়লো। স‍্যারের সাথে আলাপকালে বরাবরের মতোই তার বুক ভয়ে দুরু দুরু করে।

মগ্ন হয়ে রইলো অন‍্য ভাবনায় স‍্যার। চিন্তার রেশ ফুটে উঠলো। কি হলো সাইমার? ফাঁকিবাজ মেয়েটার জানা উচিত তাকে এক পলক না দেখলে এই গম্ভীরমুখো মাস্টারের কিছুই ভালো লাগে না। মনে মনে বলল, ‘জ্বালাময়ী বড্ড জ্বালাচ্ছো তুমি। এবার সময় এসেছে খাচায় পোড়ার। বাইরের হাওয়া লাগিয়ে নাও। আমায় জ্বালিয়ে শান্তিতে কি করে তোমায় থাকতে দেয় জ্বালাময়ী!’ অতঃপর অন্তরালের ভাবনা থেকে মনোযোগ উঠিয়ে শিক্ষার্থীদের দিকে মনোযোগ দিল।

“সুহাসিনী দাড়াও! আর কত পোড়াবে আমায়? এক চিলতে ভালোবাসা কি আমার তরে বিলিয়ে দেওেয়া যায় না সুহাসিনী!”
বিরক্ত হলো সাইফা। ক্লাস শেষ করে বাড়ির পথে হাটছিল। কাছেই বাসা। তাই গাড়ি বা রিকশার প্রয়োজন পড়ে না। পিছু ডাকে ফিরে তাকায় সেদিক।

বলল, “আপনাকে বলেছি না আমাকে ওই নামে ডাকবেন না। আর কতবার বলব আপনার সাথে কোন সম্পর্কে আমি যাবো না। আপনার মায়ের সাথে আমার মায়ের দারুণ বন্ধুত্ব। আমি চাই না আপনার বা আমার জন্য তাদের এত বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরুক। এভাবে কোন সভ‍্য ছেলে কোন মেয়ের পিছু নেয় না। আপনাকে যথেষ্ট ভদ্র বলে জানি। দয়াকরে তার উল্টা আচরণ করে আপনাকে অভদ্র ভাবতে বাধ্য করবেন না।”

“তোমায় ভালোবাসি। সেটাকি মিথ্যা?”
“ভালোবাসা সত্য না মিথ্যা সেটা আপনি ভালো জানেন। অন‍্যের মনের খবর আমি কি করে রাখবো। আবারও বলছি এভাবে আমার পিছু নিবেন না। কখনও মা বা ভাইয়ার চোখে পড়লে আমার ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দেবে।”
“তোমার প্রণয়ের অনলে আমার হৃদয় যে প্রতিনিয়ত ঝল’সে যাচ্ছে তার কি প্রতিকার হবে?”
“আমি বলিনি আমায় ভালোবাসুন। ভুলে গেলেই হয়। শান্তিতে থাকবেন।”

“সে ব‍্যার্থ চেষ্টা আমি কখনোই করবো না। মন দিয়ে মন উঠানো অসম্ভব ছাড়া কিছুই না। আমি কি করবো সুহাসিনী!”
সাইফা ক্রমেই নিজের কঠোর রূপ ধরে রাখতে ব‍্যার্থ হচ্ছে। খোলশে আবৃত কোমল দূর্বল মনটা সম্মুখে বেরিয়ে এসে বলতে চাচ্ছে, ‘পুরুষ প্রণয়ের হাওয়া শুধু আপনার একার লাগে নি। আমি অভাগিকেও সে হাওয়া দারুণ ভাবে ছুয়ে দিয়ে গেছে।’ কিন্তু মুখে বলল, “দেখুন।

আপনি যদি ভেবে থাকেন বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে জড়াবো তা হলে সে ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। আমি বরাবরই আমার মা ভাইয়ের বাধ্য। তারা কষ্ট পাবে এমন কাজ ইহ জীবনে আমার দ্বারা হবে না ইন শা আল্লাহ। তাছাড়া স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বিয়ের আগের সম্পর্ককে হারাম ঘোষনা করেছেন। সেখানে সামান্য জীব হয়ে কি করে তা অবমাননা করি?”

যুবক সাইফার জোড়ালো যুক্তিতে পরবর্তী কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। পুরুষ হয়েও প্রেয়সীকে না পাওয়ার বিরহে কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। ছলছল চোখে সাইফার পানে তাকালো সে। সাইফা সে দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে নামিয়ে নিল নিজের চোখ। বলল, “আমায় সত্যি ভালোবাসলে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। আশাকরি আর কিছু বলার বা শোনার নেই। আল্লাহ্ হাফেজ। ভালো থাকবেন।” কথার সমাপ্তি টেনে এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। পিছনে ফেলে গেল তার না হওয়া পুরুষটাকে।

সাজ বেলা সারফারাজ অন্বেষা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারফারাজ অন্বেষার জন্য ছোট্ট সারপ্রাইজ রেখেছে। অন্বেষা কৌতুহলবশত কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কাঙ্ক্ষিত কোন উত্তর না পেয়ে পরবর্তীতে রাগে দুঃখে আর কথায় বলেনি। অন্বেষার রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সারফারাজ মুচকি হেসেছে শুধু। কিন্তু মুখ থেকে কথা বের করেনি এক বর্ণও। তার মতে সারপ্রাইজ সেটা না দেখা পর্যন্ত অলক্ষে, অজান্তে থাকা উচিত। না হলে সেটা কি করে সারপ্রাইজ হলো!

সাওদা বেগমের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। যাওয়ার আগে সাওদা বেগম কঠিন স্বরে বলে দিয়েছেন, “যাচ্ছো ভালো কথা। সন্ধার আগে ফিরে এসো। মেঘলা আকাশ। এ সময় বেশিক্ষণ বাইরে না থাকাই ভালো। ছাতাটা নিয়েছো তো!”
প্রতিত্তোরে সারফারাজ বলেছিল, “নিয়েছি মা। তুমি চিন্তা করো না। যায় তবে!”
“যাও।”

বেশ বড়সড় মাদ্রাসার সামনে গাড়ি দার করালো সারফারাজ। ততক্ষণে অন্বেষা যা বোঝার বুঝে গেল। সারফারাজ গাড়ি থেকে নেমে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “আমি ভিতরে যাচ্ছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো।”
অন্বেষা ছোট্ট করে বলল, “আচ্ছা।”

কিছু সময় পরে শুভ্র পাঞ্জাবী পায়জামা পরিহিত রিফাতকে দেখে আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠলো অন্বেষার চোখ মুখ। রিফাতকে পেছনের সিটে বসিয়ে সারফারাজ নিজের ড্রাইভিং সিটে বসে পূনরায় গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।
রিফাতকে দেখে অন্বেষার মুখে যেন খই ফুটলো। কথার ফোয়ারা বইছে মুখ থেকে। সারফারাজের প্রতি এখন তার কোন রাগ নেই।
রিফাত নিজেই জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছেন খালামনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুমি কেমন আছো? নতুন জায়গা কেমন লাগছে?”
“আমিও ভালা আছি। সবাই আদর করে আমারে। হুজুরও অনেক ভালো জানে।”
স্বস্তির শ্বাস নিল অন্বেষা। যাক ছেলেটা ভালো আছে তবে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সারফারাজের পানে চাইলো অন্বেষা। সারফারাজ ছোট্ট করে বলল, “সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”

“মাশা আল্লাহ্। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।”
“তোমারও আমার প্রিয় বিবিজান।”
বড় রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালো সারফারাজ। রিফাত অবাক চোখে রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। কত স্বাদ ছিল মায়ের সাথে এমন হোটেলে এসে খাবে। সে স্বাদ অপূর্ণই থেকে গেল। ছলছল করে উঠলো রিফাতের চোখ যুগল। অন্বেষা বলল, “মায়ের কথা মনে পড়ছে?

আল্লাহ মাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তোমাকে অনেক বড় আলেম হতে হবে। মায়ের জন্য অনেক অনেক দোয়া করতে হবে। ইনশাআল্লাহ জান্নাতে মায়ের দেখা পাবে সোনা। এসো!” কথা শেষ করে ছোট্ট করে চুমু একে দিল রিফাতের কপালে। গাড়ি দরজা খুলে রিফাতের লিকলিকে হাতখানা ধরে অন্বেষা সারফারাজের সাথে রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করলো।

সপ্তাহ খানিক পরের কথা।
সাওদা বেগম চিন্তিত মনে বসে আছেন তার রুমে। এমন সময় সারফারাজও অনেকটা চিন্তিত মন নিয়ে মায়ের রুমে প্রবেশ করলো। অন্বেষা, সাইমা, সাইফা ও হাসুর মা সবাই লুডু খেলায় ব‍্যস্ত। সারফারাজ তার চিন্তার কারণ মায়ের কাছে ব‍্যক্ত করে বলল, “আমাকে কাল জানিয়েছে। শোরুম থেকে আসার সময় ভদ্রলোক নিজে বলে গিয়েছেন।”

সাওদা বেগম বললেন, “আমাকেও তোর রওশনারা আন্টি কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়ে বললেন সাইফাকে আবিদের বউ করে নিতে চান। অনেক দিনের স্বাধ তার। এখন সাইফা বড় হয়েছে তাই এখন প্রস্তাব দিলেন।”
“মা আমি বুঝতে পারলাম না। ভার্সিটির টিচার হয়ে শেষে কিনা তার সাইমাকে পছন্দ হলো!” হেসে ফেলল সারফারাজ।
সাওদা বেগমও ছেলের কথায় হেসে ফেললেন। সাইমা তার চঞ্চলা অষ্টাদশী কন‍্যা। আর ভার্সিটির গম্ভীরমুখো কঠোর ব‍্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকের কিনা তার ডান পিটে মেয়েটাকেই পছন্দ হলো। বাবাকে দিয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়েছে কাল।

“মা, ভদ্রলোক খোলাখুলি সব বলে দিয়েছেন। একটাই ছেলে তাদের। মেয়ে বছর পাঁচেক আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। এখন এক ছেলে নিয়ে আছেন। পছন্দের কথা বাড়িতে জানাতেই ভদ্রলোক তাৎক্ষণিক আমার শোরুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। বুঝলাম ওনাদের আগ্রহ আছে। তোমাকে জানানোর আগে আমি নিজ দায়িত্বে সব খবরাখবর নিয়েছি। মা শা আল্লাহ্ সবই ভালো।”

সাওদা বেগম বললেন, “তোর রওশনা আন্টির কথা তো জানিস। আবিরকেও চিনিস। এখন তোর যা ভালো মনে হয় সেটাই কর।”
“সেকি কথা মা। তুমি যা বলবে সেটাই হবে। তুমি বলো কি করা উচিত?”
“তোর সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আজ পর্যন্ত বোনেদের জন্য সবচেয়ে সেরাটা বেছে এনেছিস। এ ব‍্যাপারেও সেটাই করবি। বাবা, তোর বুদ্ধিতে যা ভালো মনে হয় সেটাই কর।”

প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব ১১

তারপর মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চিন্তিত মুখেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল সারফারাজ। মা তো তার ওপর ভরসা করে দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু এতবড় দায়িত্ব সে কতটুকু পালন করতে পারবে সে নিয়ে চিন্তার যেন শেষ নেই। বোনেদের জন্য পাত্র নির্বাচন করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সারাজীবনের ভালো মন্দের ব‍্যাপার যেখানে বিদ‍্যমান। সেখানে সামান্য হেরফের হলে বোনেদের ভালো থাকা খারাপ থাকা নির্ভর করবে।

প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে শেষ পর্ব