প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে শেষ পর্ব 

প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে শেষ পর্ব 
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

দেহটা ইট পাথরের চারকোনা রুমে আবদ্ধ থাকলেও অন্বেষার মনটা পড়ে আছে ফুলতলী গ্রামের মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে বাঁশের বেষ্টনীর কবরটায়। মায়ের মমতায় ঘেরা মুখখানা কতদিন দেখে না। চোখ থেকে নদীর স্রোতের ন‍্যায় অশ্রু কণা গলগলিয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে।

অন্বেষা-সারফারাজের বিয়ের দুই মাস পেড়িয়ে তিনমাসে পড়েছে। সাইমা, সাইফার বিয়েরও একমাস পূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে তারা শশুরালয়ে সুখে দিন যাপন করছে আলহামদুলিল্লাহ্। বিয়ের মতামত জানার জন্য যখন দুবোন জিজ্ঞাসা করা হলো তারা এ প্রস্তাবে সম্মত কি না! সাইফা নিরবে সম্মতি দিলেও সাইমা কিছুটা অসম্মত ছিল। সে কিছুতেই ভার্সিটির লেকচারাল কে বিয়ে করবে না। তার বক্তব্যে, লোকটা রশকশহীন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দেখা যাবে বাসর ঘরেও গম্ভীর স্বরে শুধাবে, “পড়া বলেন!” সাইমার যুক্তিহীন কথা কেউ খুব একটা আমলে নেয়নি। এক পর্যায়ে সেও ভার্সিটির সুদর্শন স‍্যারের বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে। প্রায় সপ্তাহ খানিকের মধ্যে জমজ বোন দুটোর একসাথে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছিল।

সাইফা তার প্রণয় পুরুষ অনিকের হাত ধরে নব শশুরালয়ে এবং সাইমা তার ভার্সিটির গম্ভীর সল্পভাষী টিচারের পোক্ত হাতের ভাজে নিজের নরম হাতখানা গলিয়ে নব শশুরালয়ে উদ্দেশ্যে এবাড়ি ছেড়ে বিদায় নিয়েছিল। সাওদা বেগম দুই মেয়ের একসাথে বিদায় কালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কেঁদেছিল অন্বেষা ও হাসুর মাও। সারফারাজ তখনও আবেগকে দায়িত্বের বেড়াজালে বন্দি করে ব‍্যস্ত হাতে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করছিল। দু দুটো বোনের বিয়ে। কষ্ট যেমন তেমনি দায়িত্ব কর্তব্যের ভারটাও নিছক কম নয়।

সাইমা, সাইফার সাথে অন্বেষার বন্ধুসুলভ ভাব ছিল। ওদের বিদায়ে অন্বেষা মর্মাহত হয়েছে খুব। সারফারাজ শোরুমের কাজে ব‍্যস্ত দিন পার করছে ইদানিং। যতটুকু পারে সাওদা বেগমকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে অন্বেষা। সাথে হাসুর মাও থাকেন। উঠতি বয়সি দুটো মেয়ে বাড়িময় ঘুরেফিরে বেড়াতো। গমগমে ভাব বিরাজ করতো বাড়ি জুরে। সাইমা, সাইফার অবর্তমানে সুনশান নিরবতা বাড়িময়।

এজন্যই বুঝি বলা হয় ‘মেয়েরা হচ্ছে পরিবারের মেহমান স্বরুপ। নির্দিষ্ট কিছুদিন বাপের বাড়ির আদর আহ্লাদ ভোগ করে যেতে হয় সংসার ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে শশুরালয়ে। যেখানে সুখে দুঃখে মেয়েদের বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। অন্বেষা প্রায়শই ব‍্যালকনির সম্মুখে মেহগনি গাছটায় খানিক সময়ের জন্য আশ্রয় নেওয়া জোড়া পাখি দুটোকে মুগ্ধ নয়নে দেখে। আজও ব‍্যতিক্রম হয়নি। পাখি দুটো মিলনমেলায় সেও দুর থেকে দেখে।

এখন তার প্রতিদিনকার রুটিনের একটি অংশ হচ্ছে ব‍্যালকনিতে কিছু সময় কাটানো। অতীতের পাতায় বিচরণ কালে কতকিছুই তো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। অন্বেষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাশুড়ি মায়ের রুমে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো মনে মনে। কিছু সময় গল্প করা যাবে। তাতে যদি তার বিক্ষিপ্ত মনটা কিছুটা ভালো হয়। অতঃপর মাথায় ওড়নাটা ভালো করে টেনে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।

অন্বেষা সাওদা বেগমের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় হালকা শব্দে কড়া নেড়ে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম আম্মু।” তারপর আবারও বলল, “আম্মু আসবো!”
রুমের ভেতর থেকে সাওদা বেগম সালামের জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম।” তারপর দরজায় নত মস্তকে দাড়ানো অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন, “কে? অনু মা! আয় রুমে আয়। তোকে কতদিন বলেছি না, আমার রুমে আসতে অনুমতি নিতে হবে না। মায়ের রুমে মেয়ে আসবে এতে আবার অনুমতি কিসের রে!”

অন্বেষা সাওদা বেগমের কথা শুনে মুচকি হাসলো। রুমে প্রবেশ করে বিছানার এক কোণায় বসলো গিয়ে। সাওদা বেগম জানালার কর্ণারে বসে ছিলেন। হাতে একটি হাদিসের বই। পড়ছিলেন বোধহয়। অন্বেষার আগমনে হাত থেকে বই খানা রেখে দিলেন। চোখের চশমাটাও খুলে ফেললেন। হাতের বইটার আর চশমা অন্বেষা হাতে দিয়ে বললেন, “যা তো মা! ওয়ারড্রবের তাকের ওপর রেখে দিয়ে আয়।”

অন্বেষা সুবোধ বালিকার ন‍্যায় তাই করলো। তারপর আবার পূর্বের আসনে এসে বসলো। সাওদা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন, “আম্মু! সাইমা, সাইফা কতদিন হলো ও বাড়িতে রয়েছে। ওদের আসতে বলুন। ওদের ছাড়া ভালো লাগে না একটুও। কতদিন হলো দেখা হয় না।”

সাওদা বেগম পূত্র বউয়ের সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। বললেন, “বোকা মেয়ে আমার। ওরা যে পনেরো দিন আগেই বেরিয়ে গেল। এখন কি আসতে দিবে? তবুও বলে দেখবো।”
শাশুড়ি মায়ের আশ্বস্ত বাক‍্যে স্বস্তি পেল অন্বেষা। পুলকিত হয়ে উঠলো বিষণ্ণ মনটা।
“আমারে রাইখা থুইয়া শাশুড়ি, বেডার বউ গল্প করতাছো? রাগ করছি।” হঠাৎ তৃতীয় ব‍্যক্তির আবির্ভাবে চমকে উঠলো অন্বেষার। কথার উৎস খুজতে পিছন ফিরে দেখে হাসুর মা দাড়িয়ে। তাকে দেখে অন্বেষা বলল, “আরেহ্ খালা যে! আসুন বসুন।”

হাসুর মা এগিয়ে এসে বেতের মোড়ায় বসলেন। বললেন, “বৈকালের আড্ডা চা ছাড়া জমে নাকি। আমি চা বানায় নিয়া আসি।”
অন্বেষা বাধা দিয়ে বলল, “না থাক খালা। আপনার উঠতে হবে না। আমি বানিয়ে আনছি। আপনি বসুন।”
“তুমি বসো। আমি যামু আর আসমু।” অন্বেষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে চা বানানোর উদ্দেশ্যে কিচেনে।
হাসুর মা চলে যেতেই সাওদা বেগম অন্বেষাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, “অনু মা! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো। যেটুকু জানিস বলবি!”

অন্বেষা কিঞ্চিত ভয় পেল। কি জিজ্ঞাসা করবে তার প্রিয় শাশুড়ি মা! মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নেরা জড়ো হয়েছে। সাওদা বেগম বললেন, “তোর মামা বাড়ি কোথায় অনু?”
“মামা আমাদের পাশের জেলায় থাকেন। আমাদের গ্রাম থেকে ঘন্টা খানিকের দুরত্ব।”
“তোর নানা কি সরকারি চাকরি করতেন?”
“সেটা তো জানিনা আম্মু। হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

“আছে দরকার আছে। তোকে দেখতে অনেকটা ছোট বেলায় আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের মেয়েটার মত দেখতে লাগে। সে অবশ্যই আরও পঁচিশ বছর আগের কথা। মেয়েটা আমার থেকে কম করে হলেও সাত আট বছরের ছোট ছিল। অথচ মেয়েটার সাথে একদম বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল আমার। তারপর তার বাবার চাকরি অবসরে আসলে ওরা ওদের নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। তারপর থেকে বহুবার মনে মনে খুজেছি কিন্তু কোথাও দেখা পেলাম না।” কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সাওদা বেগম।

অন্বেষা বলল, “সেই মেয়েটার নাম মনে আছে?”
সাওদা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “অরনী না কি যেন নাম ছিল।”
‘অরনী নামটা শুনেই অন্বেষা চমকে ওঠলো। বিস্ময় নিয়ে শুধালো,”সত্যি বলছেন আম্মু?”
“মিথ‍্যা বলে কি লাভ মা?”
অন্বেষা খানিক নিরব থেকে বলল, “অরনী তো আমার মায়ের নাম ছিল।”

“সত‍্যি বলছিস মা? তুই আমার সেই ছোট্ট অরনীর মেয়েটা?” প্রতিটা কথায় যেন আবেগ ঝরে পড়ছিল সাওদা বেগমের।
অন্বেষা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বোঝালো ‘হ‍্যাঁ সে ই।’
“তোর এমন বিপদে নানু বাড়ির কেউ আসেনি তোকে দেখতে? শোনেনি এমন বিপদের কথা?”
“আমি ছোট থাকতেই নানাভাই মা’রা গিয়েছেন। আম্মু মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নানুও মা’রা গিয়েছেন। মামা তো একটাই। তারপর থেকে যোগাযোগ শিথিল। কখনও সেভাবে আমার খোঁজ খবর নেননি।”

সাওদা বেগম অন্বেষার মামার পাষণ্ডতায় কষ্ট পেলেন কিছুটা। আলগোছে অন্বেষাকে কাছে টেনে নিলেন। তিনি বেশ উপলব্দি করতে পারছেন মেয়েটার আল্লাহ আর তারা ছাড়া সাতকুলে কেউ থেকেও নেই। আশ্বাস ভরা কন্ঠে বললেন, “যা হয়েছে, হয়েছে। এখন তুই আমার ঘরের রাণী। আমার ঘর আর ছেলেকে ভালোবেসে আগলে রাখবি। দেখবি সুখ শান্তির অভাব হবেনা মা। আল্লাহর লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। ছোট বেলায় পরিচয় হওয়া আমার খেলার সাথী সেই ছোট্ট মেয়েটার মেয়ে তুই। আমারই ছেলের বউ হয়ে এ বাড়িতে এলি। একি আমি বা তুই কখনও ভেবেছি? তাইতো বলি আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন‍্যই করেন। আলহামদুলিল্লাহ্।”

অন্বেষা ছোট বাচ্চাটির ন‍্যায় সাওদা বেগমের বুকে চুপটি করে মুখ খুজে আছে। কেমন যেন মা মা গন্ধ তার গায়ে। অন্বেষা মুখ উচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। মনটা ভালোলাগার আবেশে ছেয়ে গেছে। মায়ের আদর পেয়ে অন্বেষার মনটা ফুরফুরে লাগছে। এর মধ্যে হাসুর মা চা নিয়ে হাজির। অতঃপর তিন রমনীর কথোপকথন চললো মাগরিবের কিছু পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।
রাতে সারফারাজ বাড়িতে ফেরার পর থেকে অন্বেষা উপায় খুজছিল কি করে মনের মধ্যে বহুদিনের বাসনা সারফারাজকে বলা যায়।

একটু আধটু ভয়ও করছিল। পাছে মানুষটা যদি রাগ করে! তবে সারফারাজ অন্বেষার সম্পর্কের বহুবছর না হলেও সারফারাজের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব সুন্দর সহজ আচরণ অন্বেষাকে অনেকটা সহজ করে তুলেছে সারফারাজের প্রতি। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সারফারাজ। অন্বেষার মনে হলো এটাই সঠিক সময় বলে দেওয়ার।
সারফারাজ রুমের এক্সট্রা সোফায় বসে ল‍্যাপটপে দোকানগুলোর হিসাব দেখছিল।

প্রতিদিনই এমন চিত্র দেখতে পাই অন্বেষা। অন্বেষা সারফারাজের কাছে গিয়ে বসলো। মোলায়েম স্বরে বলল, “বলছি আমার মন চাচ্ছে আম্মুর কবরটা দেখে আসতে। আপনি তো বলেছিলেন নিয়ে যাবেন। আমি যেতে চাই। শুধু আম্মুর কবরটা দেখে চলে আসবো।”

অন্বেষার কথায় ল‍্যাপটপ থেকে দৃষ্টি এবং মনোযোগ দুটোই উঠিয়ে অন্বেষার দিকে চাইলো সারফারাজ। সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত সৃষ্টি অন্বেষা। লাস‍্যময়ী রমনী। যার প্রতিটি অঙ্গে সারফারাজের মত সুদর্শন পুরুষকে বেসামাল করে দিতে যথেষ্ট। সারফারাজ দেখলো অন্বেষার চোখদুটো তিরতির করে কাঁপছে। যেকোনো সময় ওই ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। সারফারাজ ঝট করে ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলে অন্বেষার কপালে। তারপর অন্বেষাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “বেশ তো যাব। কবে যেতে চাও?”

অন্বেষা ভাবতে পারেনি সারফারাজ এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। অন্বেষার বিস্ময়কর দৃষ্টি দেখা এক দফা নিঃশব্দে হাসলো সারফারাজ। অতঃপর বলল, “আমার তিনটা না চারটা না একটা মাত্র বউ আমার। তার মন বাসনা পূর্ণ করা আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। বিবিসাহেবা তুমি চিন্তা করো না। শিঘ্রই ফুলতলী গ্রামে যাওয়া হবে। যদিও ও গ্রামকে ফুলতলী বলা চলে না। কারন ফুলটা তো আমি সেবার সঙ্গে করে নিয়েই এসেছিলাম। সেখানে আছে শুধু কাঁটা। বলা যায় কাঁটাতলী গ্রাম।”
অন্বেষা সারফারাজের অদ্ভূত যুক্তি শুনে হাসলো। বলল, “কি যে বলেন না আপনি। একদম যা তা।”

“শোন অনু এই সারফারাজ ঠিকই বলে। ও গ্রামে কোন ফুল টুল নেই। যে ছিল সে এখন সারফারাজের হৃদয় বাগানে সৌরভ ছড়াচ্ছে। শোন অনু, একটা কান্ড ঘটে গিয়েছে। শুনবে?”
অন্বেষা কৌতূহলী স্বরে বলল, “কি হয়েছে?”

সারফারাজ বলতে শুরু করলো, “আমার ম‍্যান’স ক্লথে ছেলেদের আনাগোনা বেশি বলা চলে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরাও আসে। এক মেয়ে গত ছমাস ধরে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন দোকানে নিয়ম করে আসে। কখনও কিছু কেনে কখনও ঘুরেফিরে চলে যায়। নিয়মিত ক্রেতা হওয়ায় ছোট খুব একটা কিছু বলে না। ছোট আমার দোকানের কর্মচারী। আমি ওই দোকানটাতে খুব কমই যায়।

মাঝেমধ্যে ওই মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। বুঝলে অন্বেষা জানতে পারলাম মেয়ে নাকি আমাকে দেখতেই শপে আসে। শুনে কতক্ষণ হেসে ছিলাম জানো? একদিন তো ছোটর থেকে আমার নাম্বার নিয়েই যাবে। হয়তো কোন বড়লোক বাপের বিগ্রে যাওয়া কন‍্যা। আমার বিয়ের খবর শুনে আসে না শপে। প্রচার করে বেড়াচ্ছে আমার শপের পোশাকগুলো নাকি স্বস্তা। ভালো না। অথচ সে কতগুলো মাস ধরে নিয়মিত ক্রয় করতো। যাক গে। আল্লাহ সহায় হলে ওরকম দু একটা চুনোপুটি আমার কিছুই করতে পারবে না।”

অন্বেষার মনক্ষুন্ন হলো। আহারে! বলল, “এতে যদি কোন ক্ষতি হয়?”
সারফারাজ অভয় দিয়ে বলল, “আল্লাহ্ থাকতে কিসের ভয়। এসব সামান্য বিষয়ে সারফারাজ ভিত হয় না। যখন দেখবে ওই মেয়ের এসব নিচু কাজে আমার কিছুই হচ্ছে না। তখন ও নিজ থেকেই থেমে যাবে। ওসব কথা এখন থাক। ঘুমাতে হবে না?”

“হ‍্যাঁ।”
সারফারাজ অন্বেষার আরেকটু কাছে এসে বলল, “ঘুমাবোতো কিন্তু তার আগে…..”
“অসভ‍্য লোক।” বলে অন্বেষা নিজেই সারফারাজ ঠোঁটজোরা বন্ধ করে দিল। দম্পতি ভাসলো সুখের জোয়ারে। হলো মধুময় আরেকটি রজনী। স্বর্গসুখ যেন বিরাজ করছে ইট সিমেন্টের ওই কক্ষটায়।

দুদিন পরে অন্বেষা, সারফারাজ ও সাওদা বেগম চললেন ফুলতলী গ্রামে। অন্বেষার বাসনার কথা শুনে সাওদা বেগম নিজেকে আর আটকাতে পারলেন না। তারও যে সখ জেগেছে ছোট বেলার খেলার সঙ্গীটির কবর দেখার। অনেক খুজেও যাকে পেলনা অবশেষে পেল তার কবর। চোখ মুছলেন সাওদা বেগম। তার নিজেরই কত কষ্ট লাগছে। না জানি অন্বেষার কতটা খারাপ লাগবে। মনে মনে প্রস্তুত হলেন অন্বেষাকে সামলানোর জন্য।

কবর ঠিক থাকলেও চারপাশের বাঁশের বেষ্টনী ভেঙ্গে পড়েছে। সারফারাজ অনুমতি নিয়ে চারপাশে প্লাস্টিকের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে দিল। কবর যিয়ারত করে ফিরতেই রাকিব, তৃণা হাজির। বহু অনুরোধের পর রাকিব তৃণার সাথে তাদের বাড়িতে যেতে হলো। খবর পেল অন্বেষার সৎ বোনটিকে মেম্বারের মাতাল ছেলেটি বিয়ে করেছে। খুবই করুণ অবস্থা। সারফারাজ কিছু বলল না। সাওদা বেগমও নিরব রইলেন।

অন্বেষার খারাপ লাগলো। তার সৎ মার করা জঘন্য অন‍্যায়ের মাশুল দিতে হচ্ছে বাচ্চা মেয়েটিকে। বয়স কতই বা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সকলের সাথে আলাপনে ব‍্যস্ত হলো সে। কারো প্রতি রাগ ক্ষোভ না থাকলেও ওদের কারো কথা আর ভাবতে চাই না অন্বেষা। সেখানে ওর কোন ভূমিকা নেই।

দুপুরের খাবার পর্ব সেরে সারফারাজ অন্বেষা ও সাওদা বেগমকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। অন্বেষা ফুলতলী গ্রাম থেকে সঙ্গে করে একটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে। ফুলতলী গ্রামের সুন্দর স্মৃতি হিসাবে রেখে দিবে সে। আদর যত্নের কমতি রাখবেনা কোন।

দুর থেকে মেয়ে জামাইকে ঝাপসা চোখে দেখছিল অন্বেষার হতভাগা পিতা। কাছে যাওয়ার সাহস তার হয়নি। সংসারে অশান্তির ভয়ে মেয়েটার ওপর তার দ্বিতীয় স্ত্রীর করা নির্যাতনে সে মুখে কুলুপ এটে বসেছিল। গাড়িটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত জলপূর্ণ চোখ সেদিক পানে তাকিয়ে ছিলেন। অতঃপর ফিরে গেলেন এক টুকরো জাহান্নামে। যেখানে অশান্তির অনলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।

সাইমা, সাইফাকে ফোন দেওেয়া হলো বাবার আসার জন্য। সাইফা জানালো সে অনিকের সাথে মালদ্বিপ যাচ্ছে দুদিন বাদে। আর সাইমা তার মাস্টারকে নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত মধুচন্দ্রীমায় গিয়েছে। সে ঘোরাঘুরি পছন্দ করে। অথএব : তারা কেউই আসতে পারবে না। একটু মন খারাপ হলেও অন্বেষা খুশিও হলো। মেয়ে দুটো তাহলে সুখে শান্তিতে আছে।
সপ্তাহ খানেক পরের কথা। হঠাত সারফারাজ জানালো তারাও মধুচন্দ্রীমায় যাচ্ছে।

সব তৈরী। দুদিন বাদে যাবে ইন শা আল্লাহ তারা। সারফারাজ অপরাধী স্বরে অন্বেষাকে বলল, “তোমায় নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরতে যেতেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আমি একা হাতে সবদিক সামলিয়ে বিদেশ যেতে পারছি না। বিশ্বাস ভরসা করার মত মানুষও আমার নেই। তুমি কষ্ট নিও না বিবিজান। কথা দিলাম সময় সুযোগ হলেই আমরা দেশ বিদেশ ঘুরবো।”

অন্বেষা মুচকি হেসে প্রতিত্তোতরে বলল, “আপনি আমাকে যেভাবে রেখে খুশি থাকবেন আমি সেভাবে থাকতে রাজী। কোথাও না নিয়ে গেলেও আমি অখুশি হতাম না। আমার সুখ শান্তি সব আপনার জন্য এবং আপনার মধ্যে নিহিত। আমি সুখই আমার সুখ। আপনার পাশে আজীবন থাকতে পারাটাই আমার বড় পাওয়া। আর আপনাকে সন্তুষ্ট করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারাটা হবে আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য।”

অন্বেষার সারল্য মুগ্ধ করলো সারফারাজকে। সে পরম আদরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো অন্বেষা। আচরণে বুঝিয়ে দিল অনেক কিছু। সারফারাজের উষ্ণ ছোঁয়া অন্বেষাকে ভরিয়ে তুলছে আদরে। ভাসছে সুখের সাগরে।
সুখ, শান্তি ভালোবাসা আজীবন থাকুক অন্বেষা সারফারাজের দাম্পত্য জীবনে।

সমাপ্ত

আসসালামু আলাইকুম। আমার কাঁচা হাতের লেখনী কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। ভুল ত্রুটি মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো। দোয়া করবেন। কৃতজ্ঞতা আমার পাঠক মহলের প্রতি। দোয়া ও ভালোবাসা অবিরাম।
জাযাকাল্লাহ্ খাইরন।

প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব ১২