প্রণয়ের জলসাঘরে গল্পের লিংক || রেহানা পুতুল

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ১
রেহানা পুতুল

ক্লাস শেষে তুমি অফিসে আমার সাথে দেখা করবে।
স্যার আমরা ও কি আসব ?
না শুধু এই মেয়েটা যাবে। এখন তিনজনই হাত লম্বা করে মেলে ধরো।

প্রতিজনের দুইহাতে দুই বাড়ি করে চার বাড়ি বেতের আঘাত পড়লো । নতুন স্যারের হাতে বেত্রাঘাত খেয়ে ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল পিয়াসা। তারা তিন বন্ধু মিলেই মার খেয়েছে। ক্লাসের দরজার সামনে দিয়ে অন্য ক্লাসে যেতে রায়হান স্যার ও দেখে ফেলেছে। লজ্জায় মাথা কাটার মতো অবস্থা পিয়াসার । কারণ রায়হান স্যার তাকে ভালো জানে। তাদের অপরাধ তারা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লাউয়ের কচি ডগার মতো সরু হাতের তালুটার দিকে চেয়ে আছে পিয়াসা। লাল হয়ে আসা হাতের তালুর উপরে টপটপ করে কফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
হাতের ব্যথার চেয়ে গরম চোখে বলা নতুন স্যারের রুক্ষ কথাগুলো পিয়াসার হৃদয়টাকে বিদীর্ণ করে দিলো।
ক্লাস ছুটি হয়ে গিয়েছে। দুরু দুরু বক্ষে পিয়াসা অফিসে ঢুকল। পুরো অফিস ফাঁকা। অন্য স্যাররা চলে গিয়েছে। দেখল নতুন স্যার বসে আছে গম্ভীর মুখে।

স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমাকে আসতে বলেছেন। যদিও পিয়াসা জানে কারণটা। তবুও না জানার ভান করলো।
নতুন স্যার নিজের হাতের মুঠি থেকে একটি টিস্যু কাগজ বের করলো। মেলে ধরলো পিয়াসার চোখের সামনে।
অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলো,
এখানে কি লেখা পড়ো?
পিয়াসা নিঃশ্চুপ । আড়ষ্টভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের একপাশে।
কি হলো পড়ছনা কেন? নাকি অন্ধ? দেখতে পারছনা। তিন ঘন্টার সিনেমা কিভাবে দেখলে ? ষ্টুপিড মেয়ে কোথাকার। রাগত স্বরে বলল স্যার।

পড়েছিতো স্যার। নরম গলায় বলল পিয়াসা।
কই আমিতো শুনতে পাইনি। শব্দ করে পড়ো। যেন আমি শুনতে পাই।
” ডুবে ডুবে ভালোবাসি। ” পিয়াসা নিরুপায় হয়ে বাক্যটি উচ্চারণ করলো ক্ষীণ গলায়।
পিয়াসার চোখের দিকে চেয়ে হোয়াট ননসেন্স বলে উত্তেজিত হয়ে গেলো স্যার। পিয়াসা কেঁপে উঠলো মুরগীর ছানার মতো।

এই মেয়ে তোমার বয়স কত?
ষোল শেষের দিকে ।
আমার বয়স কত?
জানিনা স্যার।
তোমার চেয়ে মিনিমাম দশ বছরের সিনিয়র আমি। আর আমার নাম জানো?
এখন মনে পড়ছেনা স্যার।
আয়মান শেখ। নামটা মনে রেখো। তোমার এতটুকুন বয়সে এত দুঃসাহস হয় কিভাবে একজন নতুন টিচারকে প্রেমের প্রপোজাল করা? নিলজ্জ্ব বেহায়া কোথাকার!

স্যার বিশ্বাস করুন আমি এটা আপনাকে লিখিনি। এটা একটি সিনেমার নাম। লিখেছি এমনিতেই। আপনার থেকে নেয়া গাইড়ের ভিতরে বেখেয়ালবশত রাখা হয়ে গিয়েছে।
তুমি এখন মিথ্যে বলবে। এটাই স্বাভাবিক। কাল স্কুলে আসতে তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে। চাইলেই আমি তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করতে পারি। কিন্তু করুণা করলাম তোমাকে। কারণ সামনে এসএসসি পরিক্ষা তোমার। তবে তোমার বাবাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করবো। কিভাবে মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছে?

পিয়াসা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। এমনভাবে কাঁপছে যেন কচু পাতার উপরে জমে থাকা টলটলে একবিন্দু জলকণা। আলতো টোকাতেই হেলে পড়ে যাবে৷
বোবা স্বরে কেঁদে ফেলল সে। দুহাত জোড় করে অনুরোধ করল,
স্যার এমনটা করবেন না। অভিভাবক আমার নামে এমন অভিযোগ শুনলে মেরেই ফেলবে আমাকে। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন আপনার সাথে কোন ভুল হবেনা। আপনার দিকে চোখ তুলেও চাইবোনা। আপনার কথা মান্য করে চলব। আমাকে ক্ষমা করে দিন।

ওকে। অভিভাবক আনতে হবেনা। যাও ক্ষমা করে দিলাম। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।
জ্বি স্যার। বলে মাতা নত করে পিয়াসা অফিস ত্যাগ করল।
তারপর হতে পিয়াসা খুব সচেতনভাবে চলাফেরা করে স্কুলে। আয়মান স্যারের সামনে কোন ভুল ধরা পড়লে নিস্তার নেই। আয়মান স্যার ও পিয়াসাকে নজরে রাখে । ক্লাসে যেমন ভালো কোন স্টুডেন্ট কোন শিক্ষকের বিশেষ নজর কাড়ে।
তেমনি কোন বাজে স্বভাবের জন্যও নজরে পড়ে। পিয়াসাও তেমনি আয়মান স্যারের নজরে পড়ে গিয়েছে নেতিবাচকভাবে । ভীষণ ভয় পায় আয়মান স্যারকে পিয়াসা। রাশভারী টাইপের লোক। যেমন স্বল্পভাষী তেমনি স্পষ্টবাদী।

পরেরদিন ক্লাসে গেলে বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরলো স্যার কেন ডেকেছে শোনার জন্য। তাদের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার সাথে কৌতুহল মেশানো।
পিয়াসা বানানো কথায় ওদের ভুলালো। নয়তো এই লেজুড় বাহীনির হাত থেকে তার রক্ষা নেই।
দেখতে দেখতে এসএসসি পরিক্ষা শেষ হয়ে গেলো। রেজাল্ট ও দিয়ে দিল। পিয়াসাসহ অন্য বন্ধুরা একই কলেজেই ভর্তি হলো। পিয়াসা খুব করে অন্য কলেজে পড়তে চেয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার তার কোন ইচ্ছেই নেই, সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হতেই । কিন্তু বাসা থেকে তাকে বলে দিয়েছে এত লাফঝাঁপের দরকার নেই। জজ ব্যারিস্টারতো আর হবেনা। সুতরাং এখানেই যেন ইন্টার পাশ করে। পরে দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দিবে।

অগত্যা এখানেই ভর্তি হতে হলো পিয়াসার। আয়মান স্যার কলেজেও তাদের ক্লাস পেল।
পিয়াসা মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করে বলল , যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। কি আর করা। পড়েছি কুকুরের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে। আয়মান সারের সাথে ক্লাসের অন্যরা যতটুকু কথা বলে বা বলতে হয়। পিয়াসা ততটুকুও বলেনা। গুটিসুটি হয়ে থাকে স্যারের সামনে গেলে।

কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরিক্ষা চলছে। একদিন পরিক্ষা শেষে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ক্লাসের সবাই চলে যাচ্ছে। পিয়াসা দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান স্যার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো ,
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছ?
জ্বি স্যার।

এখন বর্ষাকাল। ছাতা সাথে রাখতে ভুলে যাও কেন? এর আগেও কয়েকদিন তোমাকে ভিজে যেতে দেখেছি।
পিয়াসা মাথা নিচু করে জানালো,বৃষ্টি থেমে গেলেই বাসায় যাব স্যার। আপনি যান।
স্কুল কলেজের সব স্টুডেন্ট চলে গিয়েছে। তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো।আমার ছাতার নিচে আস। তুমি রিকসা নিলেই আমি চলে যাব।

পিয়াসা নমনীয়ভাবে বলল,না স্যার লাগবেনা। আমার এসবে অভ্যাস আছে। একটু অপেক্ষা করে ভিজেই চলে যাব।
আজব তো। ভিজে যাওয়ার দরকার কি?
পিয়াসা নিরুত্তর। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। আজ পিঠের চামড়া আস্ত রবেনা বাসায় গেলে।
কাল আবার তোমাদের এক্সাম আছে। প্রস্তুতি নিতে হবেনা? তোমার বাসা কি বেশি দূরে?
বাসার ঠিকানা বলল পিয়াসা।
খুব দূরে নয়তো। আসো বলছি।

রায়হান স্যারের জোরাজুরিতে পিয়াসা তার ছাতার নিচে যেতে বাধ্য হলো। বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন ছেড়ে রাস্তার উপরে উঠল দুজন। প্রবল বৃষ্টির জন্য কোন রিকসা নেই। কিছুসময় অপেক্ষা করে একটা রিকসা পেল।
রায়হান স্যার পিয়াসাকে উঠতে বলল। পিয়াসা ভাড়া শুনেই কাঁচুমাচু শুরু করল। স্যারকে বলাও যাচ্ছেনা এই ভাড়া তার কাছে নেই।
চট করে তারা মাথা খেলে গেল। বুদ্ধি করে বলল,

স্যার আমি এ রিক্সা নিয়ে গেলে আপনি কিভাবে যাবেন? কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন। তারচেয়ে এই রিকসাতেই উঠুন। আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি একই রিকসায় চলে যেতে পারবেন।
শুনে রায়হান খুশি হলেন। বললেন,বাহ ভালো বললে তুমি। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে।
পিয়াসা রিকসায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। বৃষ্টির ছাঁটে তার মুখ হাত ভিজে যাচ্ছে। রায়হান পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে,

ঘাড় মুখ মুছে ফেল। ঠান্ডা লেগে যাবে।
মাথা নাড়িয়ে পিয়াসা রুমালটা নিল হাতে।
একতলা একটা পুরনো বাডির সামনে গিয়ে রিক্সা থামলো। পিয়াসা স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেটের ভিতরে চলে গেল। মোবাইল বেজে উঠল। রায়হান স্যার রিকশাওয়ালাকে বলল,

মামা একটু দাঁড়ান। রিকসা টানলে বাতাস আর বৃষ্টির জন্য মোবাইলে কথা বলতে অসুবিধা। রিসিভ করে জরুরী ফোনালাপ সেরে নিল রায়হান। মিনিট ব্যবধানেই তার কানে অচেনা গলার চিৎকার ভেসে এলো বাড়িটির ভিতর থেকে।
রায়হান নিবিড় দৃষ্টি দিয়ে চাইলো সেদিকে। পিয়াসাকে দেখা যাচ্ছে গেট বরাবর রুমটার মাঝে। এবং দেখতে পেলো মাঝবয়েসী এক মহিলা পিয়াসার চুলের ঝুঁটি ধরে বলছে,

জমিদারের বেটি। ঘরে কাম থাকে জানসনা? কলেজ থেইকা আসতে এতক্ষন লাগে? নাকি ভাতার যোগাইছো? ছাতা ছাড়া এই বাদলাকালে কি ভাতার নামায়া দিল? পিরিত করো? তোর মা মইরা আমার হইছে যত জ্বালা।
রায়হান বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। দ্রুত চলে এল সেখান থেকে কারণ পিয়াসা তাকে দেখতে পেলে কলেজে যাওয়াই ছেড়ে দিবে। এই অবস্থায় একটা মেয়েকে অহেতুক বিব্রতকর সিচুয়েশনে ফেলা কোন সভ্য মানুষের কাজ নয়।
এক পলক বাড়িটির দিকে চোখ বুলালো রায়হান । শরীরের নানা স্থানের ক্ষত’র মতো বাড়িটির দেয়ালের স্থানে স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। লাগোয়া বেশ কয়েকটি রুম দেখা যাচ্ছে খোলা গেটের ভিতর দিয়ে।

যেতে যেতে রায়হান ভাবতে থাকে, দূর থেকে কিছু মানুষের পারিবারিক জীবন আন্দাজ করা অকল্পনীয়। এত সুন্দর একটা মেয়ের জীবন এতটা বঞ্চনার? এতটা লাঞ্চনার? রায়হানের বুকের ভিতর পিয়াসার জন্য সহানুভূতির চর জেগে উঠলো।
পিয়াসা তার জন্য জমে থাকা সব কাজ সেরে নেয়। হাত মুখে ধুয়ে ভাত খেয়ে নেয়। পড়াশোনা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে সৎ ছোটবোনদের সাথে।

আজ পরিক্ষা শেষ। পিয়াসা উৎফুল্ল মনে কলেজের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পিছন থেকে পিয়াসার সামনে একটা তাজা গোলাপ এসে পড়লো। পিয়াসা ঝুঁকে গোলাপটি কুড়িয়ে নিতে যাবে,
অমনি একজন পুরুষের পায়ের স্যান্ডেলের নিচে চাপা পড়ে যায় ফুলটি। পিয়াসা মাথা তুলে চেয়ে দেখে আয়মান স্যার।

প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব ২