প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৮

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৮
Writer Asfiya Islam Jannat

“এটা আপনার কাছে ছিল?”
প্রাণের শিথিল কন্ঠ। ছন্দ গার্লিক ব্রেডে কামড় বসিয়ে বলে, “হ্যাঁ! ওইদিন সুইমিংপুলের পাশ থেকে পেয়েছিলাম। জানতাম আপনারই কিন্তু সময়-সুযোগ না হওয়ায় দেওয়া হয়ে উঠেনি।”

প্রাণ কাঁপা কাঁপা হাতে ছন্দের মুঠো থেকে ঘড়িটা তুলে নিল। অতঃপর সন্তর্পণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষণ। নয়ন ধারে দেখা দিল প্রস্ফুটিত জল। সিক্ত হলো মসৃণ গাল দুটো। হয়তো অন্যের নিকট এটি সামান্য বস্তু ব্যতীত কিছুই না, তবে প্রাণের নিকট এটি অমূল্য রত্নের ন্যায়। যার সাথে জড়িয়ে আছে তার মায়ের ছোঁয়া,মোহ-ভালোবাসা,স্মৃতি। একমাত্র সেই জানে এটি হারিয়ে যাওয়ার পর তার উপর দিয়ে কি গিয়েছিল। নয়নের প্র’তা’র’ণাও তাকে এতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে পারেনি যতটা না ঘড়িটা হারিয়ে দিয়েছিল। আশা সব ছেড়ে দিয়েছিল এই ঘড়িটার পাওয়ার, অনুভূতি সব চাপা দিয়ে এগিয়ে চলছিল সামনে৷ কিন্তু আজ এভাবে ঘড়িটা পেয়ে যাবে তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। এবার সে বুঝতে পারছে কেন সেদিন সোনারগাঁও হোটেলে এত খোঁজার পরও ঘড়িটি পায়নি, ছন্দের কাছে ছিল বলেই হয়তো। প্রাণ দ্রুত অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে ছন্দের দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকায়, “থ্যাংকস আ লট ফর কিপিং ইট সেফ। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, আপনি আমায় কি ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘটনাক্রমে ছন্দ বিস্ময়বিমূঢ়,বাকরুদ্ধ। নিষ্পলক তার দৃষ্টি। প্রাণের নতুন রূপটা গ্রহণ করতে সময় লাগছে তার। প্রথমদিকে প্রাণের চাহনি দেখে ধারণা করেছিল ঘড়িটা হয়তো তার নিকট বিশেষ কোন অর্থ বহন করে৷ কিন্ত পরবর্তীতে প্রাণের অশ্রু দেখে বুঝতে বাকি নেই ঘড়িটা অমূল্য কিছু। কেন না, আর যাই হোক প্রাণের অশ্রু সহজে ঝরার না তা এতদিনে বেশ বুঝেছে সে। দৃঢ়তাই তার ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। ছন্দ নিজেকে সামলে বলে, “ঘড়িটা মনে হচ্ছে খুব স্পেশাল আপনার জন্য?”

প্রাণ ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে, “হু! আমার মায়ের এটা।”
ছন্দ ভাবলো ঘড়িটা হয়তো মেহরিমা শিকদার দিয়েছে তাকে। তাই বেশি প্রশ্ন না করে ছোট করে বলে, “অহ আচ্ছা।”
প্রাণ প্রত্যুত্তরে মৌন থাকে। ছন্দ এবার রসিকতা সুরে বলে, “আপনি কিন্তু আবারও ঋণী হয়ে গেলেন আমার নিকট। সময় হলে সবটা শোধ করতে পারবেন তো?”
প্রাণ মাথা তুলে বলে, “আমি ব্যতীত আপনার যাই দাবী থাকুক না কেন আমি সে-টা পূরণ করতে রাজি আছি। এটা প্রাণের ওয়াদা আপনার নিকট।”
ছন্দ দূর্লভ হেসে বলে, “জাস্ট রিলেক্স। আপনাকে চাইব না আমি।”
প্রাণ কথা বাড়ালো না। ঘড়িটা নিজের ব্যাগে রেখে পুনরায় খাওয়ায় ধ্যান দিল। অতঃপর খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে দুইজন চললো নিজ নিজ পথে।

ইন্টারনেটে কয়েকদিন ধরেই নয়ন,প্রাণ ও জেসিকাকে নিয়ে অবিশ্রান্ত নিউজ বের হয়েই চলেছে। থামাথামির কোন লক্ষণ নেই। এর মধ্যে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো নিহাল শিকদারের অফিশিয়াল নিউজটি। তিনি প্রেস কনফারেন্স ডেকে নয়ন ও প্রাণের এনগেজমেন্ট ভাঙ্গার খবরটি সকলকে জানান। সাথে এটাও জানান, নয়নের সাথে তিনি পরবর্তীতে আর কাজ করতে ইচ্ছুক না। কথাটা পাবলিশ হওয়ার কয়েক প্রহরের ব্যবধানেই বাকি ডিরেক্টররাও পিছিয়ে আসে এবং নয়নের সাথে সকল চুক্তি ভে’ঙে ফেলে।

এখানে কারই বা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে যে নয়নকে কাজ দিয়ে তারা নিহাল শিকদারের সাথে শত্রুতা করতে যাবে? নিহাল শিকদার নয়নকে নিজের সকল মুভি থেকে ব্যান করেছে মানে ইন্ডাস্ট্রি থেকেও সে ব্যান। নয়নের ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি হয়তো এভাবেই ঘটে যেত তবে বিষয়টাকে আরও জটিল করতে সন্ধ্যার দিকে ভাইরাল হলো জেসিকা আর নয়নের একটা ভয়েস ও ভিডিও ক্লিপ। ভয়েসটিতে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রত্যেকটি কথা সুস্পষ্ট। বস্তুত, এটা সেদিন হোটেল রুমে নয়ন ও জেসিকা যা যা কথা বলেছিল তারই অংশবিশেষ এটা।

সেদিন প্রাণ জানতো জেসিকা হয়তো বা কিছু প্ল্যান করেছে তাই নিজের সেফটির জন্য হোটেলে ঢুকার পর থেকে পুরোটা সময় সে চৈতিকে কলে রেখেছিল। যার দরুণ প্রাণ জ্ঞা’ন’হী’ন থাকলেও তার কল রেকর্ডে নয়ন ও জেসিকার সম্পূর্ণ কথোপকথন স্টোর হয়ে যায়৷ আর ভিডিওটি হচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজ, যার মধ্যে দেখা যাচ্ছে নয়ন ও জেসিকা মিলে প্রাণকে অ’চৈ’ত’ন্য অবস্থায় একটি রুমে নিয়ে যাচ্ছে। এই ফুটেজটার জন্যই প্রাণ সেদিন চৈতিকে এত তাড়া দিয়েছিল। কারণ সে জানতো নয়ন আর জেসিকা কাঁচা খেলোয়াড় না, তারা তাকে রুমে না পেয়ে সর্বপ্রথম ফুটেজটা ডিলিট করতে যাবে। তাই সে আগেই চৈতিকে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিল যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয় তাহলে ফুটেজটা আগে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ ফুটেজটা যেন ডিলিট করে দিতে। আর সেখানের স্টাফদের টাকা খায়িয়ে বলতে বলায়,” চতুর্থ তালার করিডরের সিসিটিভি নষ্ট ছিল তাই ফুটেজ রেকর্ড হয়নি।” আর হয়ও সব তার পরিকল্পনা মাফিকই।

এদিকে প্রমাণ দেখে এবার জনগণের আক্রোশ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। চারদিক হতে গুঞ্জন উঠে তাদের কু’ক’র্ম নিয়ে। অ্যান্টিফ্যানেরা তাদের উপর একেক পর এক হা’ল’মা চালায় সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, অ’শ্রা’ব্য ভাষায় যা নয় তাই বলে চলে। এমনকি তাদের পুরোপুরিভাবে ইন্ডাস্ট্রি থেকে ব’য়’ক’ট করার দাবিও জানায় তারা৷ এসব দেখে নয়নের বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেন। এতদিন সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি কিন্তু সর্বশেষ খবরটার জন্য আর সফল হতে পারেননি। দেখতেই দেখতে সব তার নাগালের বাহিরে চলে যায়। ছেলের উপর এখন তার রাজ্যসম ক্ষোভ, পারছে না শুধু বে’ল্ট দিয়ে পি’টি’য়ে ছা’ল সব তু’লে ফেলতে। এতটা বো’কা তার ছেলে কিভাবে হলো কে জানে? একমাত্র ছেলের বো’কা’মির জন্য সোনার হাঁস তার পিঞ্জরে ব’ন্দী হয়েও হলো না৷

ইজি চেয়ারে গা হেলিয়ে বসে আছে নয়ন। দৃষ্টি তার সিলিং-এর দিক নিবদ্ধ। কোন এক ভাবনায় বিভোর। পাশেই বিছানা পড়ে থাকা ফোনটি বার বার নোটিফিকেশনে সাউন্ডে বেজে বেজে উঠছে আর তার ভাবনায় বিঘাত ঘটাচ্ছে। বর্তমানে তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ঝড় উঠেছে তার প্রভাব এটা। ওয়াইফাই অফ করেও নিস্তার নেই তার, মেসেজ-কল সমানতালে এসেই চলেছে। নিজের রাগ এবার সংবরণ করতে না পেরে নয়ন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ফোনটা তুলে সামনের দেয়ালে সজোরে ছুঁ’ড়ে মা’র’লো। চোখ দুটি তার ঈষৎ র’ক্তি’ম৷ গত কয়েক রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়ার স্বাক্ষী যেন। সে পুনরায় পিছনের দিকে গা হেলিয়ে আঁখিপল্লব দু’টি এক করে।

ভাবতে থাকে সেই রাতের কথা, সেদিন জেসিকার পুরো পরিকল্পনা জানার পর তার মন সায় দিচ্ছিল না প্রাণের সাথে সেসব হতে দেওয়ার। তাই তো জেসিকার সাথে নিচে যাওয়ার পর সে তাকে ওয়াশরুমের কথা বলে চলে আসে উপরে, প্রাণকে অন্যরুমে শিফট করার জন্য। কিন্তু উপরে এসে যখন প্রাণকে পায় না তখন হন্য হয়ে প্রাণকে খুঁজে কিন্তু পায় না। এর মাঝে জেসিকাকে এসে রুমে প্রাণকে না পেয়ে ধরে নেয় নয়নই প্রাণকে সরিয়ে ফেলেছে। কেন না শুরু থেকেই নয়ন তার পরিকল্পনার বিপক্ষে ছিল। এই নিয়ে তাদের মাঝে তুমুল ঝ’গ’ড়া বেঁধে যেতেই জেসিকা নয়নকে কষে এক থা’প্প’ড় মেরে সেখান থেকে চলে যায়।

নয়ন তখনও দ্বিধায় ছিল প্রাণ গেল কোথায়, তাই সিসিটিভি দেখতে গিয়েছিল সে। কিন্তু সিসিটিভি নষ্ট থাকায় রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। তাই ধরে নিয়েছিল মাঝে হয়তো প্রাণের জ্ঞান ফিরেছিল আর তখন সে বেরিয়ে গিয়েছে। বাসায় আসার পর তার মনে ভয় ছিল প্রাণ কিছু শুনে ফেলেছিল কি-না, তবে দুপুর অব্দি প্রাণের ফোন না আসায় সে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল আর প্রাণের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতে নিচ্ছিল৷ ঠিক এমনই সময় তার আর জেসিকার নিউজটা আউট হয়ে যায়৷ তখন সে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারছিল না কে করেছে এই কাজটা। কিন্তু এখন তার নিকট সব জলের ন্যায় স্বচ্ছ। এসবই প্রাণের কারসাজি। সে আগে থেকেই জানতো তার আর জেসিকার সম্পর্কে।

আর সেদিন হোটেল রুমে তাদের কথাবার্তা সবই শুনেছিল। খুব ভালোই প্র’তি’শো’ধ নিয়েছে প্রাণ। একদম নিখুঁত। নয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে৷ সে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে প্রাণের পরিবর্তনগুলো ধরতে পারলো না? একবারও মাথায় আসলো না তার সহজ-দূর্বল মনের প্রাণ কিভাবে দৃঢ় হয়ে গেল? তার জন্য পাগল মেয়েটি হঠাৎ কেন দূরে সরে গেল? আচ্ছা, তার আর জেসিকার বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা’য় এই কি প্রাণের এই পরিবর্তনের কারণ? নাহলে আজ প্রাণকে এতটা অচেনা কেন লাগছে তার? কোন প্রশ্নেরই উত্তর জানা নেই নয়নের। তবে এতটুকু জানে নিজের পা’পে’র শা’স্তি’ই এখন তাকে পেতে হবে। একটু একটু করে।

পরবর্তীতে বোর্ডের একক নির্দেশে জেসিকা ও নয়নকে চিরকালের জন্য ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয় এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে। তাদের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে অবশেষে। সে সাথে সমাজে মুখ দেখানোর মত জোরও অবিশিষ্ট থাকে না আর। লাঞ্চিত হয়ে রয়ে যায় তারা। এর মধ্যে শিলাকে পুলিশ গ্রে’ফ’তা’র করে বে’ই’মা’নি’র ও তথ্য পা’চা’র করার অ’প’রা’ধে। প্রাণ সেবার শিলা ও নয়নের পুরো কনভারসেশনের স্ক্রিনশট নিজের ফোনে নিয়ে নিয়েছিল, আর এই ছবিগুলার উপর ভিত্তি করেই শিলাকে সে দোষী প্রমানিত করে৷

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৭

কিন্তু কাকে সে তথ্য পাচার করেছিল তার নাম গোপন রেখে প্রাণ। কেন না, নয়ন তখন পুরোপুরি নিঃস্ব এখন। নিজের কর্মের যথেষ্ট শাস্তি পাচ্ছে সে এবং ভবিষ্যতেও পেতেই থাকবে। জনগণ যে সহজে প্র’তা’র’ক’দে’র ভুলে না। আর যেহেতু ক্ষতির পরিমাণ নেহাত কম ছিল সেহেতু পুলিশও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাটে না।
প্রাণ এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পরিশেষে সে যেভাবে চাইছিল সেভাবেই সবটা হয়েছে৷ এখন সে পুরোপুরি মুক্ত। কোন কপটতার মায়াজালে আবদ্ধ নেই আর।

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৯