প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৯

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৯
Writer Asfiya Islam Jannat

গোধূলিতে মনখারাপি মিছিল। ধূসর-কালো মেঘ উড়ছে প্রজাপতির মত। বন্য হাওয়া ছুটেছে নিরুদ্দেশ পথে, লতা-পাতা ঝড়ে পড়ছে সমতলে। প্রস্ফুটিত কদমরানী দুলছে তালে তালে, শুভ বর্ষণের দেখা পাবে বলে। দোতলা বাড়িটি জুড়ে আজ নিস্তব্ধতার দা’পা’দা’পি। করিডর হতে মোলায়েম আলোর ছটা এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আঁধারে নিমজ্জিত কক্ষে মেঝেতে। নিভু নিভু দীপ্তির আদুরে ভাব। প্রাণ আশা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে। এ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির জায়গা। আশা বেগম খুব সন্তর্পণে হাত বুলাচ্ছেন প্রাণের মাথায়। তার হাতের ছোঁয়ায় খেলা করছে রেশমি চুলগুলো। প্রাণ নিভন্ত প্রায় কন্ঠে বলে, “জীবন কত বৈচিত্র্য না আশামা? হাজারটা মানুষের হাজারটা কাহিনি অথচ দিনশেষে সব এক সূত্রেই গাঁথা। অদ্ভুত না?”

আশা বেগম ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “অদ্ভুত না। পৃথিবীর নিয়মই এটা। অর্থ ছাড়া জীবন চলে না, জীবন ছাড়া মানুষ বাঁচে না।”
“এই নিয়মেই তো সব শেষ। অর্থের মোহ হারিয়ে দিচ্ছে সকল সম্পর্ককে, ছিনিয়ে নিচ্ছে সব। এর মধ্যে শান্তি কোথায়?”
আশা বেগম স্মিত হেসে বলে, “তৃপ্তি আর প্রশান্তি একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং, যেখানে তোমার অন্তর তৃপ্ত সেখানেই শান্তি আগত।”
প্রাণ আশা বেগমের আঁচলে মুখ গুঁজে বলে, “তাহলে আমার প্রশান্তি তুমি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আশা বেগম কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন তবে প্রাণের প্রফুল্লিত চেহেরার পাণে তাকিয়ে আর বলতে পারলেন না। মেয়েটা অনেকদিন পর নিঃসংকোচ ভাবনায় রয়েছে, কথাটা বলে তার মন বিষিয়ে দিতে চাইছেন না তিনি। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আশা বেগম বলে উঠেন, “তোর কিন্তু এখন একটু বেশি সাবধান থাকতে হবে। এসবের পর নয়ন,জেসিকা হাতে হাত রেখে বসে থাকবে বলে মনে হয় না।”

প্রাণ ভাবান্তরহীন কন্ঠে বলে, “তাদের নিয়ে ভাবতে আর ইচ্ছে করে না আশামা। অনেক তো হলো।”
“কিন্তু তবুও সাবধান থাকা ভালো। তাই ভাবছিলাম কয়েকদিনের জন্য বডিগার্ড..”
আশা বেগমের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রাণ বলে উঠে, “কোন বডিগার্ড রাখবো না আমি। তুমি জানো বডিগার্ড জিনিসটা অসহ্য লাগে আমার।”
“জানি তবে তোর নিরাপদ থাকাও এখন জরুরি।”

“যদি মৃ’ত্যু ভাগ্যে থাকে তাহলে এভাবেই হবে। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের প্রতি মোহ অবশিষ্ট নেই আমার।”
আশা বেগম রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “থা’প্প’ড় চিনিস? আমাকে সেদিন জ্ঞান দিয়ে এখন নিজেই বলছিস এগুলা? মানে নিজের বললে দোষ নাই অথচ আমি বললেই দোষ?”
প্রাণ হেসে বলে, “রেগে গেলে তোমাকে মারাত্মক লাগে। একদম নায়িকা!”
আশা বেগম প্রাণের ডান বাহুতে হালকা চা’প’ড় মেরে বলেন, “ঠিক মত রাগও করতে দিস না আমায়।”

প্রাণ হাসে। আশা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকান জানালার বাহিরে। ক্ষণেই গগনবিদারী শব্দে কেঁপে উঠলো অন্তরিক্ষ। কষ্টের মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে শহর জুড়ে, সবুজ পাতার হলুদবর্ণ দেয় সে নিমিষে সরিয়ে। ছড়িয়ে দেয় শুদ্ধ,স্নিগ্ধ কল্প। প্রাণ বাহিরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরবির করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আশা বেগমের কর্ণকুহরে ঠিকই প্রাণের কথাগুলো তরঙ্গিত হয়েছিল সুস্পষ্টভাবে। তিনি কিয়ৎক্ষণ ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন প্রাণের পাণে। মেয়েটা কবে যে এসব থেকে বেরিয়ে আসবে কে জানে?

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের জন্য বসে আছে প্রাণ। মাথায় ক্যাপ, চোখে ব্রাউন শেডের সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক। দৃষ্টিতে বিরক্তির ছাঁপ স্পষ্ট। নেটিজেনদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই বেশভূষায় আসা তার। নয়ন ও জেসিকার ভালোমানুষি মুখোশ খুলে পড়ার থেকেই প্রাণের প্রতি সকলের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। তার সম্পর্কে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র তথ্য জানার জন্য সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে। যার দরুণ তার প্রোফাইল লো রাখা এখন প্রায় দুরূহ হয়ে উঠেছে৷ ঠিক এই কারণেই সে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে কোন কন্ট্রোভার্সিতে জোড়ায়নি, আর না নিজের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য বাহির হতে দিয়েছে। কিন্তু শেষে নিজের স্বার্থের জন্যই সবটা প্রকাশে এনে বড্ড ঝামেলায় পড়েছে। তাই পুনরায় নিজের প্রোফাইল লো আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কতদিনে সব আবার স্বাভাবিক হবে কে জানে?

পাশেই চৈতি বসে মোবাইল ঘাটছে। হয়তো সিডিউল পরোক্ষ করছে। প্রাণ একবার পাশ ফিরে তাকিয়ে নিজেও মুঠোফোনের মিথ্যে মায়া ডুব দেওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তী এক সপ্তাহ তার চট্রগ্রামে কাটাতে হবে, নতুন মুভির শুটিংয়ের জন্য। বর্তমানে এই মুভিটার জন্য প্রায়ই তাকে বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা ট্র‍্যাভেল করতে হচ্ছে। যার দরুণ অবসর,বিশ্রাম কোনটাই তার মিলছে না। যান্ত্রিক মানবীর ন্যায় শুধু এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি আর কাজ করেই চলেছে।যদিও তার দাদীজান চলে যাওয়ার পর থেকেই তার জীবনে ব্যস্ততা নামক বস্তুটা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, তবে এবার চাপ বেশি পড়ে যাচ্ছে তার উপর। প্রাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে নেয়, কোলাহল হতে দূরে নিজের কাল্পনিক সাম্রাজ্যে অবগাঢ় হয়।

আজ দুদিন হতো চললো প্রাণ চট্রগ্রামে অবস্থান করেছে। শুটিং-ও চলছে জমপেশভাবে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ফ্রি হয় প্রাণ। হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। নেত্রপল্লব এক করতেই নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রাত দশটার নাগাদ দরজা ধাক্কানোর শব্দে তন্দ্রা কেটে যায় প্রাণের। সে উঠে বসে হামি দিয়ে মোবাইলে সময় দেখো নিল। অতঃপর খালি হাতে চুলে একটি খোঁপা করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে পেল চৈতি এসেছে৷ প্রাণ দরজা খুলে দিতেই চৈতি ধীর পায়ে ভিতরে আসে। কাঁচা ঘুম থেকে উঠার ফলে প্রাণের মেজাজ খানিকটা চড়ে ছিল। কথা বলা ছিঁটেফোঁটা ইচ্ছে নেই। তাই ছোট করে রুক্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”

চৈতি ক্ষীণ কন্ঠে বলে, “ম্যাম আজকে সকলে একসাথে ডিনার করার প্ল্যান করেছে৷ তাই রাজ স্যার চাইছেন আপনি যেন ডিনারে উপস্থিত থাকেন।”
প্রাণ কিছুটা অপ্রসন্ন হলে বটে৷ এসব গেদারিং এ তার কাজ কি সে-টা সে খুঁজে পায় না। উপরন্তু, তার এখন ঘুমের প্রয়োজন। মুভিতে সূর্যোদয়ের একটা দৃশ্য আছে বিধায় তাকে সকাল চারটায় উঠতে হয়েছে। ঘুম তো দূরে থাক, সারাদিন বিশ্রামও ঠিক মত হয়নি৷ তার উপর এসব। প্রাণ চাচ্ছিল না করে দিতে তবে রাজ সেনের আমন্ত্রণ বলে পারলো না। রাজ্যসম বিরক্তি নিয়ে বলল, “আচ্ছা! তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

চৈতি মাথা নেড়ে চলে যায়। প্রাণ মুখ-হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসে নিজের রুম থেকে। করিডরের পথ ধরে লিফটের দিকে যাওয়ার পথে আকস্মিক কারো সাথে ধাক্কা খায় প্রাণ। এভাবেই তার মেজাজ তুঙ্গে ছিল, ধাক্কা খাওয়ায় মেজাজ তার সম্পূর্ণ বিগড়ে গেল৷ উপরের দিক না তাকিয়েই অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো সে, “স্ক্রা’উ’ন্ডা’ল!”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে থাকলো, “এক্সকিউজ ইউ!”
কন্ঠস্বরটা রিচিত ঠেকতেই প্রাণ দৃষ্টি তুলে তাকায়। ছন্দকে নিজ সম্মুখে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সরু দৃষ্টিতে তাকায়, “হোয়াট?”

ছন্দ “প্রশ্ন করার অধিকার কি আজ আমার না মিস. ল্যাভেন্ডার? একটু আগে কি বললেন আমায়?”
প্রাণ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল, ‘কি বলেছি? কিছুই না।”
কথাটা বলে প্রাণ পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে ছন্দ তার পথ আঁটকে বলে, “পালিয়ে যেয়ে কিন্তু লাভ নেই মিস. ল্যাভেন্ডার, আমার প্রশ্নের উত্তর না দিকে দেওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়ছি না আপনার।”
প্রাণ বিরক্ত সহিত তাকায়, “আপনি এখানে কেন? স্টক করছেন আমায়?”
ছন্দ হেসে বলে, “আমার এত খারাপ দিনও আসেনি যে আপনাকে স্টক করতে যাব।”

“গুড ফর ইউ।”
কথাটা বলে প্রাণ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ছন্দ তা দেখে রসিকতা স্বরে বলে, “সাম ওয়ান ইজ ইন বেড মুড আই গেস।”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করে না শানিত দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর ছন্দের পাশ কাটিয়ে চলে আসে নিচে। ছন্দ এবার মাথার পিছে হাত গলিয়ে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলে, “আজব তো! মেয়েটা রেগে গেল কেন?”

লম্বা টেবিলটা জুড়ে ক্রিউ মেম্বাররা আড্ডার পসরা সাজিয়েছে৷ অনুচ্চে কথা বললেও গুঞ্জন ছড়িয়ে বাতাসে। প্রাণ মাথা নত করে একমনে খেয়ে চলেছে। অকস্মাৎ রাজ সেন বলে উঠে, “আরেহ মি. ছন্দ। হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ।”
ছন্দ পাশ ফিরে রাজ সেনকে অভিবাদন জানিয়ে মিষ্টি হাসে। সাথে সাথে তার গালে ফুটে উঠে অপার্থিব সেই গর্তটি। দুইজন পরিচিত হওয়ার পর রাজ জিজ্ঞেস করে, “এবার ম্যাচ কি চিটাগং হচ্ছে নাকি?”
ছন্দ আড়চোখে প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “জি! পরশুদিন ম্যাচ।”
“অহ আচ্ছা! তা একাই ডিনার করতে এসেছে না-কি পুরো টিম নিয়ে?”
“টিম নিয়েই। ওদিকে আছে সবাই।”
রাজ সেন অমায়িক হেসে বলে, “দ্যান প্লিজ জয়েন আস।”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৮

ছন্দ নাকচ করলেও রাজ সেনের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে যায়। ছন্দ তার দলের সবাইকে ডেকে এনে ফিল্ম ক্রিউদের সাথে যোগ দেয়। প্রাণের পাশের সিট ফাঁকা থাকায় ছন্দ কোনদিক না তাকিয়ে তার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। প্রাণ মাথা তুলে এক পলক ছন্দের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নত হয়ে খাওয়ায় অভিনিবেশ স্থাপন করে। ক্রিউ মেম্বারের সকলেই ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমকে পেয়ে উৎফুল্ল বেশ। খোশগল্পে মেতে উঠে সকলে। এর ফাঁকে ছন্দ কন্ঠস্বর নামিয়ে প্রাণের দিক কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলে, “ভাগ্যে দেখা লিখা থাকলে পালিয়ে-বেড়িয়েও লাভ হয় না মিস. ল্যাভেন্ডার।”
প্রাণ ভ্রু কুঁচকে ছন্দের দিক তাকাতেই ছন্দ মৃদু হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে, “সান্নিধ্য এড়িয়ে আমার যাবেন কই এখন?”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ২০