প্রাণেশ্বরী পর্ব ২০

প্রাণেশ্বরী পর্ব ২০
Writer Asfiya Islam Jannat

প্রাণ ভ্রু কুঁচকে ছন্দের দিক তাকাতেই ছন্দ মৃদু হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে, “সান্নিধ্য এড়িয়ে আমার যাবেন কই এখন?”
প্রাণ নিচের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বলে, “টু দি হেল!”
ছন্দ মুখ কুঁচকে বলে, “তেঁতো জবান অথচ দেখতে মায়াবিনী। নট ফেয়ার!”

প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। ছন্দকে এখন কিছু বলা মানেই কথা বাড়ানো। ছন্দও এবার প্রাণের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাকিদের সাথে মেশার চেষ্টা করলো। ছন্দ হচ্ছে প্রাণের বিপরীত চরিত্রের অধিকারী। প্রাণ ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট হলেও ছন্দ হচ্ছে পুরোই এক্সট্রোভার্ট। যার দরুণ সহজেই যে কাউকে আপন করে নিতে পারে সে৷ এই যেমন কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই সকলকে ফ্রি হতে বাধ্য করে ফেললো। বিশেষ করে রাজ সেনের সাথে তার ভাব হলো বেশ। রাজ সেন ক্রিকেট পাগল, তাই আড্ডা জমতে তাদের সময় লাগে নি। কথার ফাঁকে ছন্দ আসন্ন ম্যাচটির জন্য সকলকে স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণও জানালো। রাজ সেনের পাশাপাশি অনেকই সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। প্রাণ কিছু বলছে না দেখে ছন্দ ফিসফিসিয়ে বলল, “আপনি কিন্তু বিশেষভাবে আমন্ত্রিত মিস. ল্যাভেন্ডার। ম্যাচ দেখতে আসবেন কিন্তু।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রাণ নিজের খাওয়া শেষ করে বলে, “নট ইন্টারেস্টেড!”
কথাটা বলে ছন্দকে কথা বলার দ্বিতীয় কোন সুযোগ না দিয়ে রাজকে বলে সে উঠে পড়ে। ছন্দ সেদিক তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে, “লাইফলেস!”

রোদ্দুর ভেজা নীলাভ নভস্থল আচ্ছাদিত শুভ্র তুলোর সমোরোহে। কাক-পক্ষি উড়ছে স্বাধীনভাবে। স্নিগ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলতেই অন্তঃকরণের বি’ষা’ক্ত’তা ছুট দেয় ম্রিয়মাণ পথে। সাধারণত এমন প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়ে কারো মন খারাপ থাকে না। কিন্তু প্রাণের সেই সুযোগ কোথায়? কাজের পরিমাণ এত যে কোনদিক মুগ্ধ নজরে তাকানোর সময়ই নেই৷ ব্যস্ত এই সময়ের মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হয়ে গেল একদিন। উদয় হলো নতুন এক প্রত্যুষের। আজ দুপুরেই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ছন্দের ম্যাচ।

ছন্দের আমন্ত্রণে মোটামুটি ফিল্ম ক্রিউ এর সকলেই আগ্রহ দেখিয়েছে স্টেডিয়ামে গিয়ে ম্যাচ দেখার। তাই রাজ সেনও কাঙ্ক্ষিত প্রহরের পূর্বেই সকল শুট সম্পন্ন করে প্যাক আপ করে দিয়েছেন। অতঃপর হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে রওনা দিয়েছে ম্যাচ দেখার উদ্দেশ্যে। তবে প্রাণ বাদে। এতদিন অবিশ্রান্ত কষ্ট করার পর অবসর পেয়ে সে বিশ্রাম নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছে। উপরন্তু, কোলাহলপূর্ণ জায়গা তার পছন্দও না। লোকসমাগম সর্বদা এড়িয়ে চলে সে। তাই রাজকে বলে থেকে গিয়েছে সে। যদিও রাজ সেন এতে আপত্তি জানায়নি, প্রাণের স্বভাব সম্পর্কে তিনি কিছুটা হলেও অবগত এখন। রুমে লাঞ্চ শেষ করে চেয়ারে গা হেলিয়ে বসতেই চৈতি রিফ্রেশমেন্টের জন্য লেমোনেড নিয়ে আসে। চৈতির কাছ থেকে লেমোনেডের গ্লাসটা হাতে নিয়ে প্রাণ জিজ্ঞেস করে, “তুমি যাওনি কেন তাদের সাথে?”

চৈতি মাথা নত করে বলে, “এভাবেই ম্যাম! ইচ্ছে করেনি।”
প্রাণ অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় চৈতির দিকে। সে যায়নি বলেই যে চৈতি এখানে থেকে গিয়েছে সে-টা ভালো করেই জানে। অথচ স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার ইচ্ছে তার বহুদিনের। কথায় কথায় বলেছিল তাকে একবার। কিন্তু দেখো সুবর্ণ সুযোগটা পেয়েও হাত ছাড়া করলো মেয়েটা। কাজের জন্য বুঝি কেউ এভাবে নিজের ইচ্ছা মাটি চাপা দেয়? মাঝে মধ্যে কাজের প্রতি চৈতির এমন মনোনিবেশ দেখে প্রাণ অভিপ্রেত না হয়ে পারে না। কিন্তু সে-টা কখনো প্রকাশ করে না। বলতে প্রকাশ করতে জানে না সে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো প্রাণ। শান্ত কন্ঠে বলে, “যাই হোক! পার্কিং লটে কোম্পানির একটি গাড়ি আছে, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি তোমায় যাতে স্টেডিয়াম নিয়ে যায়।”

চৈতি তৎক্ষনাৎ বলে উঠে, “না! না! ম্যাম, এসবের প্রয়োজন নেই। আমি যাব না। মোবাইলে এভাবেই লাইভ দেখা যাবে, খামাখা কষ্ট করে যাওয়ার মানে হয় না।”
প্রাণ ভারী কন্ঠে বলে, “বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না তুমি জানো। তাই যা বলেছি তা কর।”
চৈতি দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে বলে, “কিন্তু ম্যাম…”
“নো মোর ওয়ার্ডস।”
প্রাণের ধমকে চৈতি নিভে যায়। জড়সড়ো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। প্রাণ কলে সব নিশ্চিত করে বলে, “নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। যাও!”
চৈতি চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। মৌন থেকে মাথা নাড়লো। প্রাণ জিজ্ঞেস করে, “টাকা আছে নাকি লাগবে?”
“নাহ! নাহ! আছে। লাগবে না ম্যাম।”

চৈতির কন্ঠ তটস্থ শোনালো। প্রাণ স্বল্প পরিসরে হাসলো। নম হলো কন্ঠ তার, “দ্যান গো এন্ড ইঞ্জয়।”
চৈতি এবার কৃতজ্ঞচিত্ত দৃষ্টিতে তাকায়, অধর জুড়ে তার স্নিগ্ধ হাসি। সে খুব করে চাইলো প্রাণকে কিছু বলতে কিন্তু আফসোস শব্দভাণ্ডার তার শূন্যের কোঠায়। কথায় আছে, নীরবতা তখনই কথা বলে যখন ভাষা কথা বলতে পারে না। চৈতির বেলায়ও ঠিক তাই হলো, নীরবতা তার বলতে চাওয়া কথাগুলোর প্রস্ফুটন ঘটালো। অতঃপর কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চৈতি ত্যাগ করলো রুমটি। চৈতি যেতেই প্রাণ দরজা লাগিয়ে পুনরায় চেয়ারে গা হেলিয়ে বসে।

হাতে গ্লাস উঠিয়ে কিছুক্ষণ নিউজফিড ঘুরতে থাকে৷ নিজের অফিশিয়াল পেজে ঢুকে একবার লাস্ট পো’স্ট’টা দেখে নেয়, এখনো তাতে অজস্র মন্তব্যের সমাহার। নয়ন আর জেসিকা যে সেই রাতে তার ড্রিং’ক স্পা’ই’ক করেছিল এবং তার সাথে হী’ন কিছু করতে চেয়েছিল সে-টার কনফার্মেশন পো’স্টই এটা। প্রাণের নিকট থেকে এই পো’স্ট’টা পাওয়ার পর পরই নেটিজেনরা ক্ষে’পে উঠেছিল এবং তো’পে’র মুখে পড়েছিল জেসিকা ও নয়ন। এখনো কম হে’ন’স্তা হচ্ছে না তারা। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাদের নিয়ে অজস্র মিমস এবং কনটেন্টস বিদ্যমান। মাঝে-সাঝে প্রাণ এইগুলা দেখে, ক্লান্ত মন তার তখন এটা ভেবে তৃপ্তি পায় প্র’তা’র’ক’রা ভালো নেই। তবে যে ভ’ঙ্গু’র হৃদয় তাকে তারা উপহার দিয়েছে, তাতে আর কখনো কারো জন্য অনুভূতি জন্ম নিবে কি-না কে জানে? আর কে-ই বা চাইবে দ্বিতীয়বার মন ভা’ঙ্গা’র তীক্ত স্বাদ নিতে?

আচ্ছা, খুব কি ক্ষতি হতো বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা’টা না করলে? সব স্বাভাবিক থাকলে? বাকি আট-দশটা মেয়েদের মতই তার জীবন হলে? তার সাজানো-গুছানো স্বপ্নগুলো সত্যি হলে? এত এত প্রশ্নের ভিড়ে উত্তরের দেখা নেই কোন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে প্রাণ। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর সে উপলব্ধি করতে পারে তার চোখ দুটো বেশ জ্ব’ল’ছে, কণ্ঠনালী ধরে আসছে। ফোনটা রেখে প্রাণ আঁখিপল্লব বন্ধ করে নেয়, নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু অবাধ্য জলগুলো শেষ পর্যন্ত আদেশ অমান্য করে ঝরে পড়ে।

কিয়ৎক্ষণ লাগে তার সামলে উঠতে, সিক্ত গাল মুছে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলই কিন্তু কিছুটা একটা ভেবে মুঠোফোনটা পুনরায় হাতে নেয় এবং জনপ্রিয় এক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে চলমান ক্রিকেট ম্যাচটির লাইভ টেলিকাস্ট প্লে করল সে। প্রথমে ব্যাটিং করার সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েছে, ছন্দ ও শ্রাবণ নেমেছে মাঠে। দুর্দান্ত খেলছে তারা দু’জন। ছন্দের ব্যাটিং স্কিল আসলেই প্রশংসনীয়। একটা বলও ফাঁকা যেতে দিচ্ছে না সে৷ অকস্মাৎ ছন্দ ছক্কা মারতেই স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে সকলে। পরক্ষণেই ম্যাচটা জমে উঠে৷ সে সাথে প্রাণের সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে স্থির হয়ে গেল মুঠোফোনের কৃত্রিম স্ক্রিনটিতে। রাখতে পারলো না আর সে ফোনটি হাত থেকে। তার ঘুমিয়ে অবসর কাটানোর পরিকল্পনাটি মাটি হয়ে গেল পলকেই।

আঁধার পালায় নব্য অরুণোদয়ের আগমনে। ষোড়শী লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাওয়ার মতো মেঘের একটা কিনারা লাল হয়ে উঠছে৷ পাহাড়ের সীমা পেড়িয়ে আনকোড়া সূর্যের আলতো রশ্মি পরশ বুলাচ্ছে ধরণী গায়ে। জানা-অজানা পক্ষী সব ডেকে উঠছে গুনগুন করে, বুনো ফুলের সতেজ সুবাস মুখরিত করে পরিবেশ৷ হাইওয়ের রাস্তা ধরে চলছে গাড়ি। গন্তব্য পতাঙ্গা সি বিচ। আজকে শুট সেখানেই হবে। তবে সকল ক্রিউ মেম্বারদের ক্লান্ত চেহারা সুস্পষ্ট। কাল খেলায় বাংলাদেশ জিতেছে বলে হোটেল এসে ছন্দ ও তার টিম মেম্বাররা মিলে তা সেলিব্রেট করেছে৷ তাতে ফিল্ম ক্রিউ মেম্বাররাও ছিল। শুধু উপস্থিত ছিল না প্রাণ। ইচ্ছাকৃতভাবে না, অনিচ্ছাকৃতভাবেই। খেলা শেষ হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুম এতই গাঢ় ছিল যে কারো ডাক তার কান অবধি পৌঁছায়নি। ফোনও সাইলেন্ট করা ছিল। যার দরুণ সেলিব্রেশনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। যদিও তার ইচ্ছা ছিল ছন্দকে শুভেচ্ছা জানানোর কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। রাতে ছিল ঘুমিয়ে, সকালে উঠে চলে এলো কাজে। শুভেচ্ছা জানাতো কখন? উপরন্তু, সেই রাতের পর আর মুখোমুখি হয়নি তারা। তাই কে কোন রুমে আছে তা জানাও হয়নি।

প্রাণেশ্বরী পর্ব ১৯

শুট শেষ করে প্রাণ যখন হোটেল ফিরলো তখন অবসন্ন অপরাহ্ণ। প্রাণ ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের রুমেরদিকে। করিডরের শেষ প্রান্তের আসা মাত্র পিছন থেকে ছন্দ ডেকে উঠে, “কাল আপনি কোথায় নিরুদ্দেশ হলেন বলুন তো মিস. ল্যাভেন্ডার? হারিকেন দিয়ে খুঁজেও আপনাকে কোথাও পেলাম না আমি। স্ট্রেঞ্জ না?”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ২১