প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩২

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩২
Writer Asfiya Islam Jannat

“প্রাণ উঠো। তুমি আমার সাথে বাসায় যাচ্ছ।”
কথাটা শুনে প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নতজানু হয়ে বসে রইলো৷ এমতাবস্থায় ছন্দ পিছন থেকে বলে উঠলো,”প্রাণ আপনার সাথে কোথাও যাবে না।”

ছন্দের কথাটা শুনে নিহাল পিছন তাকালেন। তিনি জানেন, প্রাণের মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক কি রকম। এর আগেও এমন পরিস্থিতি এসেছিল তখন প্রাণের কি অবস্থা হয়েছিল তা দেখেছেন। এবার তো কেউ নেই ও ওকে সামলানোর জন্য, একা রাখলে উল্টাপাল্টা কিছু হতে যে সময় লাগবে না। তাই চাইছিলেন প্রাণকে নিজের সাথে নিতে। কিন্তু মাঝে ছন্দের বাঁধা দেওয়ায় মেজাজ বিগড়ে গেল তার। বুঝে উঠতে পারলেন না এত কিসের কর্তৃত্ব প্রাণের উপর তার। তাই রুষ্ট কন্ঠে বললেন, “আমাকে এটা বলার তুমি কে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছন্দ এগিয়ে এসে বলল, “আমি যাই হই, তা আপনার না জানলেও হবে। তবে আমার বর্তমানে আপনি উনাকে কোথাও নিতে পারবেন না। অধিকার নেই আপনার।”
নিহাল এবার রেগে উঠে বলেন, “আমি ওর বাবা হই, ওকে নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার৷ আর তুমি আমাকে থামাচ্ছো কোন সাহসে? কোন অধিকার আছে তোমার ওর উপর? নেই তো! তুমি এখানে বাহিরের মানুষ, আমাদের মেহমান। তাই নিজের সীমার মধ্যে থাকলে খুশি হবো।”
ছন্দ ঈষৎ সময় নীরব থেকে নত দৃষ্টিতে বলল, “আছে!”
ছন্দের কথা ঠিক বুঝতে না পেরে নিহাল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, “কি আছে?”
“প্রাণের ওপর আমার অধিকার আছে।”
“কি শুনি?”

ছন্দ দৃষ্টি তুলে তাকালো এবার। মৃদু হেসে শীতল কন্ঠে বলল, “শি ইজ মাই ওয়াইফ।”
কথাটা শুনে চৈতি মাথা তুললো তৎক্ষনাৎ। গোলগাল চোখে তাকালো ছন্দের পাণে। প্রাণ তখনও মাথা নত করে বসে। অন্তর্দাহে আবৃত মন বাস্তব জগতে কি হচ্ছে তার খোঁজ রাখতে আগ্রহী নয়। সে তো নিমজ্জিত অতীতের পাতায়, মধুর স্মৃতির সন্ধানে৷ এদিকে নিহাল ছন্দের কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলেন না। তিনি খানিকটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই বললেন, “যা তা বল না।”

“যা তা বলার মানুষও না।” কথাটা বলে ছন্দ পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে গ্যালারি থেকে কিছু ছবি বের করে নিহালের সামনে ধরে বলল, “টেক আ লুক।”
নিহাল শিকদার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন, ছবিগুলো হচ্ছিল রেজিস্ট্রার পেপারের, নিচের দিকে প্রাণ ও ছন্দ দুইজনের সই-ই স্পষ্ট। যা প্রমাণ করে তারা দুইজন আইনগতভাবে বিবাহিত৷ নিহাল শিকদার স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বললেন, “কবে হলো এসব?”
“তা জেনে আপনার কাজ নেই।”

নিহাল শিকদার বিহ্বল,বাক্যহীন। সে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না ছন্দ ও প্রাণের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এত বড় একটা বিষয় তার থেকে গোপন রইলো কিভাবে কে জানে? এর মাঝে ছন্দ বলে উঠলো, “প্রাণের দায়দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণ আমার। তাই আপনার হস্তক্ষেপ আর চাইছি না। আশা করি বুঝবেন।”
নিহাল প্রত্যুত্তর করার মত কিছু পেলেন না। আলগোছে শুধু তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। বুঝলেন তার এখানে কোন প্রয়োজন নেই৷ প্রাণকে সামলানোর মত মানুষ আছে, তার পাশে। বললেন, “বেশ! আসছি আমি।”
“আর একটা কথা, আমার আর প্রাণের সম্পর্কে কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে। আমি নতুন ঝামেলা কোন ঝামেলা চাইছি না।”

নিহাল শান্ত কন্ঠে বলেন, “চিন্তা নেই, জানবে না। তবে ওর খেয়াল রেখ।”
ছন্দ ঠেস মেরে বলে, “তা আপনার চেয়ে ভালোই রাখবো।”
নিহাল দ্বিরুক্তি করলেন না কোন। কিছুটা অপমানিতবোধ করলেন বিধায় বেরিয়ে গেলেন নৈঃশব্দ্যে। নিহাল যেতেই চৈতি বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ছন্দ স্যার এসব কি সত্যি? আপনি আর ম্যাম আসলেই…”
“হ্যাঁ সত্যি।”

নেত্রে চশমা থাকা সত্ত্বেও চৈতির বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলো সে, “কবে হলো এসব?”
“সে এক লম্বা কাহিনি। অন্য আরেকদিন বলব। এখন আমায় একটু সাহায্য করতে পারবে।”
চৈতি নিজের সিক্ত গাল দুটো মুছে নিয়ে বলল, “জি বলুন।”
“প্রাণের সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে দিবে একটু? তাকে আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। এই বাসায় থাকা তার জন্য ঠিক না।”

চৈতি বুঝলো বিষয়টা। আশা বেগমের স্মৃতিতে ‘সুখনীড় ভিলা’ ঠাসা। এখানে থাকলে প্রাণ কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে না, প্রতিক্ষণে মনে পড়বে তার আশা বেগমের কথা। ডিপ্রেসড হয়ে পড়বে। যা কি-না তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবেও আজ যে স্বভাবের বিপরীত ধারায় চলছে, কখন কি হয় বলাও যায় না। তাই চৈতি সম্মতি জানালো। উঠে দাঁড়ালো প্রাণের পাশ থেকে। ছন্দ পুনরায় বলল, “উনার ঔষধপত্র,মেডিক্যাল রিপোর্ট সব কিন্তু আলাদা করে প্যাক কর। আর পরে আমাকে স্ক্যাডিউল বুঝিয়ে দিও। কখন কোন মেডিসিন দিতে হবে।”
“আপনি জানেন এসব সম্পর্কে?”
“সবই জানি আমি। আন্টি বলেছেন আমায়।”

চৈতি মৌন রইলো। অতঃপর চলে গেল জিনিসপত্র গোছাতে। চৈতি যাওয়ার পর ছন্দ সোফায় গিয়ে বসলো। অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো প্রাণকে। সে সময় দিতে চাইছে তাকে, থাকুক একটু একা। চৈতির সব গোছগাছ করে ফিরলো আধা ঘন্টার মাঝে। ছন্দ নিজের ড্রাইভারকে কল করে ভিতরে আসতে বলল। অতঃপর তাকে দিয়ে সকল জিনিসপত্র গাড়িতে উঠিয়ে নিল। ছন্দ এবার প্রাণের সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলো। কোমল কন্ঠে বলল, “প্রাণ উঠুন! আমার সাথে যাবেন আপনি।”

প্রাণ নড়লো না। প্রত্যুত্তরও করলো না কোন। ছন্দ আস্তে করে ধরে তার মাথা তুললো। দেখতে পেল, নয়ন জোড়া আ*র*ক্ত হয়ে আছে৷ অধর যুগল শুকিয়ে শুষ্ক-রুক্ষ। মুখও ভার ভার দেখাচ্ছে ভীষণ। ছন্দ খুব সন্তর্পণে প্রাণের মুখশ্রীর উপর গড়াগড়ি খাওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুছিয়ে দিয়ে বলল, “যাবেন না?”
প্রাণ তখনও নিরুত্তর। ছন্দ প্রাণকে উঠানোর জন্য তার কাঁধে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো সে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। এতক্ষণ বসে থাকার জন্য বুঝা যায়নি বিষয়টা। ছন্দ অপেক্ষা করলো না। নিভৃতে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো।

চার রুম বিশিষ্ট ফ্ল্যাটটায় পিনপতন নীরবতা বিদ্যমান। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানের শা শা শব্দ কানে এসে লাগছে। পাশেই জানালা দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখা যাচ্ছে। প্রাণ বিছানার একপ্রান্তে নির্জীব ভঙ্গিতে বসে আছে। অন্যদিকে, ছন্দ ও চৈতি মিলে জিনিসপত্র ঠিক করছে। ছন্দের কথায় চৈতি তাদের সাথে এসেছে, সাহায্য করতে। কাজ শেষ হলে চলে যাবে সে।

এই ফ্ল্যাটটা ছন্দ লোকালয় হতে খানিকটা দূরেই বানিয়েছিল। বসুন্ধরা রিভার ভিউ নামে অনেকে চিনে আবার চিনেও না৷ চারদিকে গাছপালা, সামনেই ছোট নদী ও কাশবন। শান্ত,নিস্তব্ধ,নির্মল পরিবেশ। প্রকৃতি প্রেমী হওয়ায় জায়গাটা মনে ধরে তার। উপরন্তু, এদিকটা বেশি পরিচিত না হওয়ায় মানুষজনের আনাগোনাও ছিল নেহাৎ কম। তাই দ্বিতীয় ভাবনা আসার আগেই থাকার জন্য দোতলা একটি বাড়ি বানিয়ে ফেলে সুপ্তভাবে। জিহান ও তার বড় ভাই ব্যতীত কেউ জানে না এই বাসার সম্পর্কে। যার জন্য মাঝে মধ্যে শান্তি পেতে ও রিপোর্টারদের ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকে। ছন্দের মনে হলো প্রাণকে এখানে রাখলেই ভালো হবে। কেউ তাদের খোঁজ পাবে না সে সাথে পাপাজিদের ঝামেলাও তেমন থাকবে না। প্রাণ নিজের মত কিছুটা সময় শান্তিপূর্ণভাবে কাটাতে পারবে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছন্দ বারবার প্রাণকে লক্ষ্য করছে। তার মনে অজানা ভয় বাসা বেঁধে বসে আছে। এমন লাগছে প্রাণকে চোখের আড়াল করলেই বুঝি উড়াল দিবে। চলে যাবে তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।

কাজের মাঝে ড্রাইভার এসে কাঁচাবাজার দিয়ে গিয়েছে। সে সাথে শুকনো কিছু খাবার। মাস খানেক ধরে বাসাটা তালাবদ্ধ থাকায় ফ্রিজ ফাঁকা। খাওয়ার মত কিছু ছিল না বিধায় বাজার করে আনিয়েছে। ধুলোবালির স্তুপও জমেছিল যত্রতত্র, তাই আসার পূর্বে খবর দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে সব।
চৈতিকে বিকেলের দিকে নিজের গাড়িতে করেই পাঠিয়ে দিয়েছিল ছন্দ। এখান থেকে তার বাসার দূরত তিন থেকে চার ঘন্টার পথ। কতক্ষণ আর ধরে রাখা যায় তাকে? বিপদের সময় এগিয়ে এসেছে এই তো অনেক। অন্যথায় আজকাল দিনে বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে কে? সবাই তো মুখ ঝাপটা মেরে চলে যায়।

হাতে কাজ শেষ করে ছন্দ নামে রান্না করতে। ব্যাচেলর হওয়ার সুবাদে রান্নাটা রপ্ত করেছে ভালোভাবেই। যাতে রাত-বিরেতে খিদা লাগলে অনাহারে ম*র*তে না হয় তাকে। কাজের ফাঁকে সামনে নজর যেতেই, খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখিটি চুপটি করে বসে থাকতে দেখলো সে। আসার সময় পাখিটাকে নিয়ে এসেছিল সে। টিয়াটিকে দেখে লাগছে, মন যেন আজ তারও খারাপ। ধূসর আকাশে ঢাকা। আচ্ছা, পাখিটা কি কোনভাবে তার মালকিনের কষ্ট বুঝতে পেরেছে? যার জন্য সেও তার মত মৌনব্রত পালন করছে? কথাটা ভেবে ছন্দ স্মিত হাসলো। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে খাঁচার ভিতর খাবার আর পানি দিয়ে আসলো।

রান্না শেষ করতে করতে সন্ধ্যে হলো তার। কোনরকম মুখ-হাত ধুয়ে খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে গেল প্রাণের জন্য। মেয়েটা কাল রাত থেকে কিছু খায়নি। পানি পর্যন্ত না। চৈতি খুব চেষ্টা করেছিল তাকে খাওয়ানোর। কিন্তু প্রাণ বাধ্য মেয়ে হলে তো। শেষে চৈতিও হাল ছাড়ে।
খাবার নিয়ে প্রাণের সামনে বসলো ছন্দ। নিজের হাতে খায়িয়ে দিবে বলে ভাত মেখে তার সামনে ধরে বলল, “খেয়ে নিন। নাহলে শরীরে শক্তি পাবেন না।”

প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ছন্দ অনেক চেষ্টা করল তার মন ভুলাতে কিন্তু পারলো না। শেষে না পেরে ছন্দ বলল, “আশা আন্টি কিন্তু আপনাকে ভালো থাকতে বলেছিল। অথচ আপনি ভালো থাকছেন না, এটা কি ঠিক? আন্টি কষ্ট পাবে না?”
প্রাণ এবার যত দৃষ্টি তুলে তাকালো ছন্দের দিকে। দীর্ঘসময় প্রতিক্ষার পর অবশেষে মৌনতা ভেঙ্গে সে বলল, “আর আমি যে কষ্ট পাচ্ছি?”
“জানি পাচ্ছেন। কিন্তু এখানে আন্টির কি দোষ ছিল বলেন? তার কি হাত ছিল কোন কিছুতে?”
প্রাণ উত্তর দিল না। নীরব রইলো। ছন্দ পরবর্তীতে অনেক কিছুই বলল কিন্তু প্রাণ জবাব দিল না। ছন্দ এবার অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করলো। সে আদুরে কন্ঠ বলল, “আন্টির সাথে দেখা করতে চান?”
প্রাণ এবার উত্তর দিল, “হু?”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩১

ছন্দ প্রাণকে সম্পূর্ণ বাচ্চাদের মতই ট্রিট করছিল। সে বেশ বুঝতে পারছিল, তার জানা সেই বুঝদার,বাস্তববাদী প্রাণটা এখন নিজের মধ্যে নেই। হারিয়ে গিয়েছে অতুল সমুদ্রে। তাই স্বাভাবিক কথায় সে গলবে না, তাকে সামলাতে হবে নাজুক হাতে। ঠিক ছোট বাচ্চাদের মত। তা সে বলে উঠলো, “আপনি যদি এখন ভাত খান তাহলে আমি আন্টির সাথে দেখা করতে নিয়ে যাব আপনাকে। ইটস আ প্রমিস।”
পদ্ধতিটা আসলেই কাজে দিল। ছন্দ প্রাণের মুখের সামনে খাবার ধরতেই সে চুপচাপ খেয়ে নিল৷ ছন্দের ঠোঁটের কোণে এবার প্রশান্তির হাসি দেখা দিল।

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩৩