প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩৩

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩৩
Writer Asfiya Islam Jannat

আকাশে ঘন বাদল জমেছে। দূর হতে শোনা যাচ্ছে মৃদু মৃদু বজ্রধ্বনি। হাওয়ারা মেতেছে দুরন্তপনায়। উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। পরিবেশ প্রতিকূলে, যেকোন মুহূর্তে ঝড় নামবে। এমতাবস্থায় বাসায় থাকাটা বেশি উত্তম। অথচ ছন্দ প্রাণকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছে। বড়রাস্তার ধারে নির্দ্বিধায় ড্রাইভ করছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বের হওয়ার একমাত্র কারণ, প্রাণকে সে কথা দিয়েছিল আশা বেগমের সাথে দেখা করাবে।

আর সে চায় না কোনভাবে তার ওয়াদা ভঙ্গ করতে। অন্যথায় সম্পর্কের শুরুতেই সে প্রাণের বিশ্বাস হারাবে। তাই বাধ্য হয়েই ঝুঁকিটা নিল। ঘন্টারও অধিক পথ অতিক্রম করে তারা এসে পৌঁছালো কাঙ্ক্ষিত স্থানে। ছন্দ নামলো আগে, এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল প্রাণের জন্য। প্রাণ বের হতেই তার হাতটি শক্ত করে ধরলো ছন্দ। আশপাশ নিকষকৃষ্ণ আঁধারে নিমজ্জিত। দেখা যাচ্ছে না কিছু। ছন্দ মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল ভিতরে। নির্জন,নিস্তব্ধ পরিবেশ। সম্পূর্ণ জায়গায় গাছ-গাছালিতে আচ্ছাদিত। কেমন গা ছমছমে ভাব। ছন্দ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো। প্রত্যেকটি কদম ফেললো খুব সতর্কের সাথে। খেয়াল রাখলো প্রাণের দিক, সামান্যটুকু অবহেলা নেই এর মধ্যে। কয়েক মিনিট অন্বেষণ চালানোর পর ছন্দ খুঁজে পেল আশা বেগমের ক*ব*র। ছন্দ সামনে এগিয়ে বলল, “নিন! চলে এসেছি আমরা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রাণ এতক্ষণ যান্ত্রিক মানবের ন্যায় হাঁটছিল। অনুভূতিশূন্য হয়ে। শেষে ছন্দের কথা কর্ণরন্ধ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে চোখ তুলে তাকালো। অতঃপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো নতুন খো*ড়া ক*ব*র*টার দিকে। স্থির হলো সে। একমনে, একধ্যানে দেখতে থাকলো ক*ব*র*টা। প্রাণকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছন্দ তার সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “প্রাণ, আর চুপ থাকবেন না। এই দেখুন, আশামা আপনার সামনে। এবার মনে যা আছে তা নিঃসংকোচ বলে ফেলুন। মনে যত ক্ষোভ,দুঃখ, কষ্ট সব শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে দিন। এভাবে চুপ থেকে নিজেকে আর কষ্ট দিবেন না। কথা বলুন।”

প্রাণ সবই শুনলো কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর করলো না।কিয়ৎক্ষণ পর অনুভব করলো তার গলা জড়িয়ে আসছে। শরীর ঈষৎ কাঁপছে। আবেগহীন মন ডুকরে উঠছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল, “কেন ধোঁ*কা দিলে তুমি আমায় আশামা? কেন?”
প্রাণ একটু থেমে পুনরায় বলল, “তুমি না বলেছিলে সবসময় আমার পাশে থাকবে? আগলে রাখবে? তাহলে নিজের কথা ভাঙলে কেন তুমি? এমন প্র*তা*র*ণা, বি*শ্বা*স*ঘা*ত*ক*তা কেন করলে? কেন ছেড়ে চলে গেলে আমায়? কেন?”

কথাটা বলতে বলতে প্রাণ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লো৷ হাটু গেড়ে বসে পড়লো ক্ষণেই। ছন্দও বসলো তার সাথে। আগলে নিল তাকে অন্তঃস্থলের উপরিভাগে। প্রাণও দিগ্বিদিক না ভেবে আঁকড়ে ধরলো ছন্দকে। অবশেষে বাঁধ ভাঙ্গলো৷ নেত্রের কার্নিশে ভিড় করলো অশ্রুবিন্দু৷ টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। অন্তর্দাহে সিক্ত হলো মন।

ছোটবেলায় মাকে হারানো পর আশা বেগমকেই কাছে পেয়েছিল সে। মায়ের স্নেহ,আদর সব তার থেকেই পাওয়ায়। নিজ সত্তার অর্ধাংশ ছিলেন তিনি প্রাণের। আজ তাকে হারিয়ে প্রাণ নিঃস্ব,নিঃসঙ্গ যেন। পাষাণ মনের অধিকারী মানবটি যে কি-না এতক্ষণ ধরে পাথর হয়ে ছিল। সে ছন্দের হৃদয়ের উষ্ণতা পেতেই মোমের ন্যায় গলে গেল। বক্ষঃস্থল বাঁধা দুঃখের জমাট বরফ তরল কান্নায় রূপান্তরিত হলো। ছন্দকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠল। নিঃশব্দ কান্না আজ তার ভাষা খুঁজে পেল বোধহয় বহু বছর পর। অবরুদ্ধ আবেগ হারিয়ে যাওয়া পথ ফিরে পেল আবার অনেক অনেক দিন পর। ছন্দও আগলে নিল তাকে৷ খুব যত্নে।

প্রাণ আধভাঙ্গা গলায় বাচ্চাদের মত বিচার দিয়েই চলেছে ছন্দের নিকট। আশা বেগমকে নিয়ে কতশত অভিযোগ। ছেড়ে যাওয়ার আকুতি৷ ছন্দ মৌনতা পালন করে সব শুনছে অভিনিবেশ সহিত৷ মিনিট কয়েক না গড়াতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। মেঘ ডেকে উঠলো গম্ভীরভাবে৷ ভিজিয়ে দিয়ে গেল দু’জনকে। এর সাথে সাথে প্রাণও নীরব হয়ে এলো৷ অর্ধনিস্তেজ হয়ে পড়লো ছন্দের বক্ষঃস্থলে। ছন্দ ডাকলো তাকে কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। সে দ্রুত প্রাণকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো। তাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে নিজেও উঠে বসলো। পিছনে তার পুরনো একটা শার্ট রাখা ছিল ওটা নিয়ে প্রাণকে ভালোমত ঢেকে দিল। মেয়েটা এখনই কাঁপছে অথচ বাসায় যেতে ঘন্টারও উপরে সময় লাগবে। না জানি এর মাঝে তার জ্বর এসে পড়ে। এই পরিবেশে তাকে নিয়ে আসাটাই বোধহয় তার ভুল হয়েছে৷

বাসায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ছন্দের ভাবনাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো৷ প্রাণের সর্বোচ্চমাত্রা ছাড়িয়ে জ্বর এসেছে, তাপে শরীর তার ঝ*ল*সে যাচ্ছে তার। ছন্দ প্রাণকে শয়নকক্ষে শুয়ে দিয়ে তার জন্য জামাকাপড় বের করলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো পোশাক পরিবর্তন করা নিয়ে। ছন্দ এবং প্রাণ আইনগতভাবে বিবাহিত হলেও, ধর্মীয় দিক দিয়ে না। যার জন্য প্রাণকে সেভাবে স্পর্শ করার অধিকার নেই তার। এদিকে প্রাণও নিজের মধ্যে নেই, অর্ধচেতন সে। জ্ব*রে পুড়ে যাচ্ছে শরীর৷ ছন্দ পড়লো বিপাকে। কি করবে না করবে এই ভেবে৷ আশেপাশে চেনা জানা এমন কেউ নেই যে এই মুহূর্তে গিয়ে সাহায্য চাইবে। শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না পেয়ে ছন্দ প্রাণের কাছে এগুলো। প্রাণকে আস্তে আস্তে করে ডেকে তুললো। কিছুক্ষণ পর প্রাণের হুস ফিরলো। ছন্দ তাকে টেনে উঠে বসালো, ঠিক মত বসতেও পারছে না সে। হেলছে দুলছে৷ ছন্দ করুণ কন্ঠে বলল, “প্রাণ কষ্ট করে একটু চেঞ্জ করে নিন। ভেজা জামাকাপড়ে থাকা ঠিক না আপনার জন্য। এভাবেই জ্বর বাঁধিয়েছেন।”

প্রাণ ম্লানমুখে তাকালো। ছন্দ পুনরায় একই কথা বলতে বেসামাল হাতে তার থেকে কাপড়গুলো নিয়ে নিল। ছন্দ তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেন, “আমি বাহিরেই আছি। সমস্যা হলে ডাক দিবেন।”
কথাটা বলেই ছন্দ দরজা ভিড়িয়ে বাহিরে চলে গেল। তবে মিনিট দশকের পরও যখন প্রাণের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তখন ছন্দের ভয় হলো। সে দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু ওপাশ থেকে প্রত্যুত্তর এলো না৷ মনে কিঞ্চিৎ ভয় নিয়েই কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললো সে। দেখতে পেল প্রাণ জামাকাপড় বদলে বিছানার মাঝে গুটি-শুটি মেরে শুয়ে আছে। দূর থেকে দেখেও বুঝা যাচ্ছে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। প্রাণ ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। বিরবির করে বলল, “এই মেয়েটাও না। মন তো হরণ করেছেই, কবে না জানি জীবনটাও হরণ করে ফেলে।”

ছন্দের নিজেরও ঠান্ডা লাগছিল বিধায় সে দ্রুত শুকনো কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে মাটি থেকে প্রাণের ভেজা কাপড় সব একটা বালতিতে তুলে রাখে৷ প্রাণের সান্নিধ্যে আসতেই সে দেখতে পায় তার চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। চাদর খানিকটা ভিজে গিয়েছে এতে। ছন্দ আরেকটা তোয়ালে বের করে প্রাণকে দ্বিতীয়বারের মত টেনে উঠে বসালো। আলতো হাতে তার চুল মুছে দিতে থাকলো৷ প্রাণ তখনও স্বাভাবিক নয়, হেলে-দুলে পড়ছে। তাই সে ছন্দের পেটের উপর মাথা ঠেস দিয়ে রাখলো। ছন্দ তা দেখে হেসে বলল, “আপনি আসলেই একটা বাচ্চা।”

নিজের কাজ শেষে ছন্দ সরে আসলো। পায়ের দিকে নজর যেতে দেখতে পেলো ব্যান্ডেজ ভিজে বিশ্রী অবস্থা। ছন্দ ড্রেসিংটেবিলের ছোট ড্রয়ার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসে৷ খুব সন্তর্পণে প্রাণের পায়ের ব্যান্ডেজ পাল্টে দেয়। অতঃপর সন্ধ্যায় করে রাখা রান্না থেকে অল্প একটু নিয়ে এসে প্রাণকে জোর করে খায়িয়ে দেয়। সাথে মেডিসিনও। চৈতি প্রাণের ঔষধপত্র গুছানোর সময় প্যারাসিটামল, এন্টিবায়োটিকও সাথে নিয়েছিল। যার জন্য এখন রক্ষা হলো। ছন্দ প্রাণকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ভারি কম্বলটা তার গায়ে জড়িয়ে দিল। সে রুম থেকে চলে যেতে নিলে প্রাণ অস্পষ্টস্বরে ডেকে উঠলো, “আশামা যেও না৷ যেও না তুমি। আমি একা থাকতে পারবো না। আশামা!”

ছন্দ থমকালো। ম্রিয়মাণ দৃষ্টি তার। সে নিভৃতে তার পাশে গিয়ে বসলো। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি যাচ্ছি না কোথাও। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”
প্রাণ তবুও বিরবির করে আশা বেগমের নাম আওড়াতেই থাকলো। তারপর একসময়টা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঘুমিয়ে পড়লো। আর ছন্দ? সে তো মগ্ন অন্যভাবনায়। মস্তিষ্কে তার কি চলছে একমাত্র সে আর উপরওয়ালাই জানে।

নব্য প্রত্যুষের আলোয় চারদিকে ডানা মেলতেই জিহান এসে হাজির হলো ছন্দের দুয়ারে৷ ছন্দই ডেকে আনিয়েছে, কথা আছে বলে। প্রাণ তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মাঝ রাতে ঘাম দিয়ে উঠায় জ্বর খানিকটা সেরে এসেছে তার। গতরাতের মত অবস্থা শোচনীয় নয়, বেশ ভালো। ছন্দ তাকে একবার ভালো মত দেখে রুমের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। জিহান সোফায় বসেছিল। ছন্দকে আসতে দেখে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে সাত-সকালে এভাবে ডাকলি কেন? তাও আবার এই ফ্ল্যাটে? কিছু কি হয়েছে?”

জিহান প্রাণ সম্পর্কিত কোন ঘটনাই জানতো না। খবর পায়নি। আর পাবেই কিভাবে? প্রাণ নিজের জীবন গোপন রেখে চলে। হাতে গোনা দুই-একটা খবর বাদে তার ব্যক্তিগত জীবনে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সবের কিছুই বাহিরের জগৎ-এর কেউ কস্মিনকালেও জানতে পারে না। যার জন্য আশা বেগম প্রাণের কি ছিলেন বা তার মৃত্যুর বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ অজানাই থেকে গিয়েছে। ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। শুরু থেকে সব খুলে বললো জিহানকে। সব শুনে জিহান আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো, “মানে প্রাণ এখন তোর কাছে?”

ছন্দ মাথা দুলালো। জিহান মাথায় হাত দিয়ে বসলো। তার বন্ধু যে এমন ধুরন্ধর প্রকৃতির বের হবে কল্পনায়ও ভাবেনি সে৷ জিহান বিমর্ষচিত্তে বলে উঠলো, “আমাকে না জানিয়ে এত বড় স্টেপ নিতে পারলি তুই?বিয়ে পর্যন্ত করে ফেললি।”
“বিয়ে করিনি রেজিস্ট্রার করিয়েছি শুধু।”
“একই তো হলো।”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩২

“না এক না। ইসলামিক শরিয়ত ছাড়া এই বিয়ে জায়েজ না।”
জিহান সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তো তুই এখন কি করতে চাইছিস?”
ছন্দ মেঝের দিক তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো, “কাজী খুঁজে আন। বিয়ে করব আমি।”

প্রাণেশ্বরী পর্ব ৩৪