প্রিয়োসিনী পর্ব ১৪

প্রিয়োসিনী পর্ব ১৪
নীরা আক্তার

হটাৎ করে তাদের অবাক করে দিয়ে নওরিন পুকুরে ঝাপ দেয়।দুইজন বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পানির দিকে…..নওরিনকে দেখা যাচ্ছে না।
ইশা ভীষণ জোরে চিৎকার দেয়।ভয়ে কাঁপছে সে।বার বার নওরিন নওরিন করে চিৎকার করছে।

নোহা পাশ থেকে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,
-নওরিন দাঁড়াও আমি যাবো তোমার সাথে….
নওরিন পানির ভেতর থেকে মাথা বার করে বলে উঠে,
-কোথায় যাবা….?আমি তো এখানেই আছি
ইশা ভয়ে কান্না করে দিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-ভয় পাশ না ইশা আমি সাঁতার জানি তো।গ্রামে থাকতে কতো এ পুকুর সে পুকুর করে বেরিয়েছি। পানি আমায় বড্ড টানে।
নোহা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে নওরিনের দিকে।
-ঐভাবে কেউ লাফ দেয়?ভয় পেয়ে গিয়েছি।
-কি সুন্দর পানি দেখো….লোভ সামলাতে পারিনি।তুমিও আসো
কথাটা বলেই নওরিন মুচকি হাসি দেয়।নোহা পা ডুবিয়ে আবার বসে পড়ে।
এদিকে ইশাও কাঁদতে কাঁদতে ধপ করে বসে পরে।

-আমি তো ভাবলাম,আমায় ক্ষমা করে দিস নওরিন…….
নওরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইশার দিকে।মুখে তার মুচকি হাসি।
–আমি যদি মরতে চাইতাম তোর সামনে কি লাফ দিতাম বোকা কোথাকার!
নোহা মুখ বাকিয়ে বলে উঠে,
-যতোসব ন্যাক্যামো!!

এদিকে ইসরাক তিন জনকে এখানে সেখানে খুজতে থাকে।জিনাত সিকদার চাইছেন এক্ষুনি ইসরাককে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে।বাকিরা থাকতে চাইলে থাকুক।কিন্তু ইসরাককে সে নিয়ে যাবেন।ছেলে অসুস্থ।ডাক্তার দেখানো জরুরি।কিন্তু ইসরাক কিছুতেই যাবে না।তিনি মনে মনে চিন্তা করে নেন দরকার পরলে জোর করে নিয়ে যাবেন।
ইসরাক এদিকেই আসছিলো
মাঝ রাস্তায় আসতেই ইশার চিৎকার শুনে দ্রুত ছুটে আসে।উওেজিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,

-কি হয়েছে।চোখ যায় নওরিনের দিকে।
নওরিনকে পানিতে দেখে সে প্রথমে ভেবেছিলো নওরিন হয়তো পানিতে পড়ে গিয়েছে।সে নিজেও লাফ দিতে চায়…কিন্তু নোহা ইসরাকের হাত টেনে ধরে,
-দাভাই ও সাতার জানে ভয় নেই!থাকুক!
ইসরাক একটু শান্ত হয়।
নোহা নওরিনকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে….

-ওহে কলঙ্কিনী বধু, ভেবেছিলাম তুমি আর আমি দুই কলঙ্কিনী একসাথে গলায় কলসি বেধে এই জোড়া পুকুরে ডুবে মরবো।ইতিহাস সৃষ্টি করবো।কিন্তু তুমি তা হতে দিলে কোথায়।আগেই সাঁতার শিখে বসে আছো।এখন কি হবে?আমি কি একা একা মরবো?
নওরিন মুচকি হেসে উওর দেয়,
-পানিতে ডুবে মরলে বেশি কষ্ট হবে তার চেয়ে সহজ কিছু ভাবো….
-বিষ খাবে?নাকি গলায় দড়ি দেবে?নাকি উঁচু কোথাও থেকে লাফিয়ে পরবে?
নওরিন নোহাকে সায় দিয়ে বলে উঠে,
-চলো মাউন্টেনে যাই কিছুদিন ঘোরাঘুরি ও করা যাবে আবার লাফ দিয়ে মরাও যাবে….একবার পরলে হাড়গোড় সব গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে।বাঁচার চান্স জিরো পার্সেন্ট।
নোহা হেসে বলে

-হুম্ম চলো, রূপসী আপুর বিয়েটা হয়ে যাক তারপর যাই।বিয়ে না খেয়ে গেলে আপু রাগ করবে।যাওয়ার আগে শেষ বিয়েটা খেয়েই যাই
-হুম্ম তাই করো।যা করবে দ্রুত কর এই জীবন আর ভাল লাগছে না…মা ভালোবাসে না বাবা ভালো বাসে না একটা মাত্র বর সেও ভালোবাসে না।কথায় কথায় মেরে তক্তা বানিয়ে দেয়।শ্বাশুড়ির কথা নাই বা বলি।
ঐযে দেখো একটা মাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড সে ঠকালো….এই জীবন আর রাখতে চাই না।
কথাগুলো বলে নোহা আর নওরিন দুজনেই ইশার দিকে তাকায়।ইশা হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুট লাগায়।
ইশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নোহা হাসতে থাকে।

ইসরাকের মাথা ভনভন করছে।একোন পাগলদের পাল্লাই পড়লো সে।এসব কথা শুনতে ভীষন বিরক্ত লাগছে তার।
ইসরাক নোহা কে ধমক দেয়….
-কিসব কথা বলিস পাগলের মতো!
-মেয়েদের কষ্ট তুমি কি বুঝবা হে পুরুষ।তোমরা তো স্বার্থপর জাতি শুধু নিজেরটা বুঝো!
ইসরাক নোহাকে আরেকটা ধমক দেয়।

-মাথা ঠিক আছে?….ঘরে চল আম্মা ডাকে।এক্ষুনি বাড়ি ফিরবো আমরা….
ইসরাকর আর নোহা দুই কদম এগিয়ে গিয়ে ইসরাক পেছন ফিরে নওরিনের দিকে তাকায়,
-এই যে মৎস্যকুমারী আপনি জমিনে উঠে আসবেন না সারাজীবন পানিতেই ভাসতে থাকবেন?বিছানা পত্র এনে দিই?
নওরিন মুখ কালো করে তাকায়..

—-আমি যেখানে খুশি থাকি তাতে আপনার কি?
–আমারই তো সব।নিজে থেকে উঠবে না তো?আমি কি জেলে ডেকে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবো?তুমি তো আবার নিজে থেকে কিছু করা পছন্দ করো না?উঠে আসো বলছি….
নওরিন ইসরাকের ধমক শুনে মুখ বাঁকিয়ে উঠে আসে।

নোহা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।ইসরাক নওরিনের জন্য সেখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে নওরিনের জন্য।নওরিনের
কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে।হালকা রং হওয়ায় শরীরের সবগুলো ভাজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।ইসরাককে তাকাতে দেখে নওরিন ভেজা ওড়নাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে নেয়…..
-তাতে কি যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছি নতুন করে কিছু দেখা বাকি আছে?
ইসরাক পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবারও চোখ বেলায়!

-এভাবে রাস্তা দিয়ে হেটে যাবে?
-কিছু হবে না চলুন!
ওড়নাটা আরেকটু টেনে দেয় নওরিন…টানাটানি করার জন্য গায়ের সাথে আরো চিপকে গেছে।
ইসরাক একটু বিরক্ত হয়। বিরক্তের স্বরে বলে উঠে…
-এটা টানলেই নিশ্চয়ই শুকিয়ে যাবে না…..
নওরিন মুখ ভেংচি কাটে।ইসরাকের এবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

-মৎস্যকুমারীরা জামা কাপড় পরে না তুমি পড়ছো কেন?খ
-কি সব বলেন?
-ইডিয়েট। সাথে তোয়ালে নেই পানিতে নামছো কেন?কোনো কোমনসেন্স নাই?এটা যে গ্রাম এতোটুকু মাথায় থাকে না?মাথায় কি গোবর পুরা?
নওরিন মুখ বাঁকায়
-শুধুতো এটাই পারো।এতোটুকু রাস্তা কিভাবে যাবে কোনো সেন্স আছে তোমার?
নওরিন কোনো উওর দেয় না!

ইসরাক গা থেকে শার্টটা খুলে নওরিনকে পড়িয়ে দেয়।তারপর হাটা দেয় বাড়ির পথে।নওরিন ও ইসরাকের পিছু পিছু আসতে থাকে
নওরিন বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ধাক্কা খায় জিনাত সিকদারের সাথে।নওরিনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়,
-তোমার গা ভেজা কেন?
নওরিন মৃদুস্বরে উওর দেয়,

-পুকুরে নেমেছিলাম।
-কোন পুকুর?
-জোড়া পুকুরে….
পাশ থেকে ইসরাকের নানী হায় হায় করে উঠে,
ইসরাক আর নওরিন মুখ তাকাতাকি করে…
ইসরাক প্রশ্ন করে,
-কি হয়েছে নানু…..

-ঐ পুষ্করিণীতে পেত্নী থাকে।তোমার পাও ধরে টাইনা নিয়া গেলে কি হইবো?
ইসরাক উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে বলে উঠে,
-ভয় নাই নানু….ঐ পেত্নী এই পেত্নীকে দেখেই ভয়ে পালাবে….হাত পা ধরে টানা টানি তো পরের কথা।
জিনাত সিকদার নিজের অজান্তেই ছেলের কথায় হেসে দেয়।
নওরিন আর ইসরাক ভেতরে চলে যায়!
পাশ থেকে নানুমুনি বলে উঠেন….
-হাইসো না….!যদি কোনো পোয়াতি বউ তেনাদের ক্ষপরে পড়ে তইলে আর ছাওয়ালের মুখ দেহন লাগবো না!আমি কবিরাজ চাচারে খবর পাঠাই…আইস্যা একবার বউডারে ফুক দিয়া যাক।

নোহা ইশার পেছনই ছাড়ছে না।ইশা পালাই পালাই করছে আর নোহা একটু পর পর চেপে ধরছে।ইশা কিছুতেই মুখ খুলবে না আর নোহাও ছাড়বে না।নওরিনের অতীতের সব রহস্য ইশার মাঝেই লুকানো আছে এটা নোহার ধারণা।শুধু ধারণা নয় বিশ্বাস।ইশা সাজুগুজু করার সময় নোহা ইশার জুয়েলারি বক্সে একটা খুব দামী ঘড়ি আবিষ্কার করে….
নোহা ইশার সামনে উচিয়ে ধরে,

-এটা কে দিয়েছে তোকে?
ইশা এক পলক দেখে নোহার হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়,
-কে আবার দিবে আমি কিনেছি!কেন কিনতে পারি না?
-মিথ্যে বলিস না ইশা এটা আমি নিজে আমান ভাইকে পছন্দ করে দিয়েছিলাম….।
ইশা একপলক নোহার দিকে তাকায়….
-এমন জিনিস কি আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না?
-কেন যাবে না কিন্তু আমার বিশ্বাস এটা সেই ঘড়িটাই।
ইশা মুচকি হাসি দেয়,

-তুই যে ভাবে আমার থেকে আমার সব স্বপ্নগুলো কেড়ে নিয়েছিলি আমিও তাই করেছি।ভালোবাসা আর যুদ্ধে সব কিছুই সম্ভব।
ইশা সেখান থেকে দৌড়ে পালায়…..
নোহা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।
“ইশা আমার প্রতি তোর এতো হিংসে?”

রূপসী আপুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে।সবাই নাচ গান করছে তবে ইসরাক ঘরে শুয়ে আছে।মিউজিকের শব্দে মাথা যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাচ্ছে
ইসরাক ঘরের আলোটা নিভিয়ে
বিছানায় শুয়ে ফোন চাপছিলো।রং নাম্বারটা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরো কয়েকটা ছবি রিসিভ হলো।ইসরাক জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে….

ছবিগুলো না দেখেই কনটাক্টটা ব্লক করে দেয়।
ইসরাক উপর হয়ে বালিসে মুখ গুজে।আবার অস্বস্তি হচ্ছে।মাথা যন্ত্রণা কিছুতেই ছাড়ছে না।শরীর ঝিম মেরে আছে।তবে এবার মেজাজ হারালে চলবে না……
“অতীত সবারই থাকে।হয় সেটাকে মেনে নিয়ে বর্তমানটাকে উপভোগ করতে হবে নাহয় অতীতের আগুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হতে হবে”ইসরাক বর্তমানটা চায়।

নওরিন ঘরে আসে,ইসরাককে উবু হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে উদ্বিগ্নতার সাথে ইসরাকের পাশে এসে বসে,
-শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
ইসরাক মুখ তুলে তাকায়…
-নাহ্ ঠিক আছি।তোমাদের একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করলো না।ঘরে এলে কেন?সবাই আনন্দ করছে সেখানে যাও!
নওরিন ইসরাকের পাশ থেকে উঠে জ্বানালার কাছে যায়।বাহিরে উঁকি দেয়।সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে।এই ঘরে আলো না জ্বালানো থাকলেও চারদিকের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে

–আপনাকে দেখতে আসলাম।ঠিক আছেন কি না….!
-কেন?আমায় ভালোবাসো নওরিন?
নওরিন কোনো উওর দেয় না….
ইসরাক নওরিনের পাশে এসে দাড়ায়,
-তোমায় একটু জড়িয়ে ধরবো?

নওরিন ইসরাককে পা থেকে মাথা পযর্ন্ত দেখে,
-গিরগিটিও আপনাকে দেখে লজ্জা পাবে!আপনার কতো রং ঢং আর দেখবো!কাল এই সময় আমাকে ইচ্ছে মতো আঘাত করলেন আজ এসেছেন আদর করতে?লজ্জা লাগে না?
ইসরাক মুচকি হাসে….
-কখন মারলাম?
-শরীররে আঘাতের চেয়ে কথার আঘাত বেশি যন্ত্রণা দেয়।

-একটু জড়িয়ে ধরি?
–আমি যদি বলি ধরিয়েন না তাহলে কি ধরবেন না?
ইসরাক নওরিনকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে….
–আমার বউ আমি ধরবো।এতো ফর্মালিটি মানতে পারবো না।
-(…)

-নওরিন…আমায় ক্ষমা করো।বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে।
নওরিন একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,
-বাদ দিন।এমনটাই হয়…যখন ইচ্ছে আঘাত করবেন,যন্ত্রণা দেবেন আবার মন চাইলেই কাছে টানবেন….মেয়েদের জীবনেট গল্পগুলো এমনই হয়।
-কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না,
-বাদ দিন দিন শেষে আমরা সবাই একা

-মৃত্যু ছাড়া আর কেউ তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।একা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
ইসরাক নওরিনের কপালে আলতো করে চুমু খায়।নাকে নাক ঠ্যাক্যায়….এমন সময়,কোথা থেকে নোহা ছুটতে ছুটতে ঘরে আসে।দুম করে আলোটা জ্বালিয়ে দেয়,
নওরিন আর ইসরাক ছিটকে দূরে সরে যায়,নোহা মাথা নিচু করে নেয়,

-নওরিন তোমার সাথে কথা আছে…দ্রুত আমার সাথে আসো।
কথাগুলো বলেই নওরিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে নোহা।
ইসরাক খোলা জ্বানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।নওরিনের সাথে ভুলবোঝাবুঝি মেটানো দরকার।নাহলে পরবর্তী পরিস্থিতি সে সামলাতে পারবে না।
ইসরাকের ফোনটা বেজে উঠে।হাতে নিতেই দেখে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।ইসরাক ফোনটা কানে ধরতেই কানে বাজে সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর…

-দাভাই তুমি ভালো আছে?
ইসরাক চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়…

প্রিয়োসিনী পর্ব ১৩

(বেশি বিরক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই… চেষ্টা করবো দ্রুত গল্পটা শেষ করে দিতে।যাই হোক ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

প্রিয়োসিনী পর্ব ১৫