প্রিয়োসিনী পর্ব ৩

প্রিয়োসিনী পর্ব ৩
নীরা আক্তার

“আপনি ভালোবেসে চাইলে তো আমি নিজে থেকেই আপনার কাছে আসতাম আমাকে এভাবে জোর করার কি প্রয়োজন ছিলো?”
নওরিন বিছানা থেকে উঠতে উঠতে ইসরাককে উদ্দেশ্য করে কথা গুলো বলে উঠে।ইসরাক তখন চোখ বুজে উবু হয়ে শুয়ে আছে।

-আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না তাহলে ভালোবেসে কিভাবে চাইবো!আমি আমার অধিকারের বাহিরে তো কিছু করিনি নি?
-অধিকার?
-হুম্ম অধিকার।আমি আপনার স্বামী আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার উপর।আমি আপনার সাথে যা খুশি তাই করতে পারি!!
-ভালোবাসেন না আবার অধিকার ফলাতে এসেছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-অধিকারের সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই।আমি আপনাকে ভালোবাসলেও আপনি আমার স্ত্রী ভালো না বাসলেও আমারই স্ত্রী। আপনার সারা জীবনের দায়িত্ব আমার হোক সেটা কাছে থেকে কিংবা দূরে থেকে।
-স্ত্রী হোক বা পর নারী কোনো মেয়ের অনুমতি ছাড়া এইসব অধিকার ফলানোকে কি বলে জানেন?
ইসরাক মুচকি হেসে উওর দেয়

-আই ডোন্ট কেয়ার।আমি এমনই।
কথাটা বলেই ইসরাক গায়ে কাথা টেনে নিয়ে ঠিক করে শুয়ে পড়ে।রাতটা প্রায় নির্ঘুমই কেটে গেছে।তবে এখনো ভোর হতে কিছু সময় বাকি আছে।নওরিন লোকটাকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
গায়ে একটা ওড়না পেচিয়ে নওরিন ওয়াশরুমে চলে যায়।শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ইচ্ছা মতো কাঁদতে থাকে।পানির তালে তালে নওরিনের কান্নার শব্দও যেন বাড়েই চলেছে।শব্দটা ইসরাকের কান অব্দি পৌছালেও তাতে কি ইসরাকের সেদিকে কোনো ভুরুক্ষেপ ইনেই।সে দিব্যি চোখ বুঝে ঘোমানোর চেষ্টা করছে।

প্রায় ঘন্টাখানিক বাদে নওরিন ওয়াশরুম থেকে বার হলো।উকি দিয়ে দেখে ইসরাকের দিকে।ইসরাক একসাইডে সরে উবু হয়ে ঘুমাচ্ছে।পাশে নওরিনের জন্য জায়গা রাখা আছে।খোলা পিঠে নখের আচরের দাগগুলো স্পষ্ট।নওরিন ইসরাকের খোলা পিঠে হাত বুলায়। একবার ভাবে ইসরাকের পাশে গিয়ে শোবে।কিন্তু পরক্ষণে কিছু সময় আগের কথা মনে হতেই আর কাছে যায় না।গা ঘীন ঘীন করছে তার….

নওরিন বারান্দায় চলে যায়।বাকিটা রাত সে বারান্দায় রাখা রকিং চেয়ারে বসে বসেই কাটিয়ে দেবে।
প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছে।চারদিক সবে আলো ফুটছে,এরই মাঝে
নওরিনের ঘুম ভাঙ্গে পানির ঝাপটায়। এটা শুধু পানির ঝাপটা নয়।ইসরাক এক জাগ পানি ঢেলে দিয়েছে নওরিনের মুখের উপর।নওরিন ধর ফরিয়ে উঠে পড়ে।

-কি করলেন এটা?
-শাওয়ার নেবো চলো
-চলো মানে?
-চলো মানে চলো…তোমার সাথে শাওয়ার নেবো
-আমি শাওয়ার নিয়ে নিয়েছি।
-বাংলা বুঝো না?

কথাটা বলেই ইসরাক নওরিনকে কোলে তুলে নেয়।নওরিন ছটফট করছে ছোটার জন্য। তবে ইসরাকও ছাড়ার পাত্র নয় নওরিনকে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়ে শাওয়ারটা ছেড়ে দেয়।দুই হাতে নওরিনের কোমর জড়িয়ে একটা আলতো চুমু খায় কপালে।

নওরিন ইসরাকের গাল বরাবর ঠাটিয়ে একটা চড় মারে।ইসরাক থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে নওরিনের দিকে।নওরিন এমন কিছু করে বসবে তা সে ভুল করেও ভাবেনি।
-আপনি যদি মনে করেন আমাকে বিয়ে করেছেন বলে আমার সাথে যা খুশি তাই করবেন তাহলে ভুল ভেবেছেন।আমি মরে যবো।আমাকে জোর করিয়েন না।

নওরিন ভেজা গায়েই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে।ভিষণ অনুশোচনা হচ্ছে তার।তখন সে রাগটা কন্ট্রল করতে পারে নি।সারা রাতের রাগ ক্ষোভ একবারে উপরে দিয়েছে সে। বারান্দায় দাড়িয়ে কাঁদতে থাকে।সাওয়ার শেষে ইসরাকও রুমে আসে।রেডি হয়ে বাহিরে চলে যায়।
ইসরাক বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করে শিউলি পারভিন।
তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন কখন ইসরাক বার হয় ঘর থেকে।ঘরে ঢুকেই উকি দেন বারান্দার দিকে।নওরিন বারান্দার গ্রীল ধরে দাড়িয়ে আছে।

শিউলি পারভিন আস্তে আস্তে বিছানার কাছে গিয়ে দাড়ায়।সাদা বেডসিটটার কিছু কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে রয়েছে।শিউলি পারভিন ভ্রু কুচকে তাকায় ।দাগটা সে আশা করেনি।আজ রাতে তাদের বিছানায় সাদা চাদর বিছানোর বুদ্ধিটা সেই বার করেছিলো।তার ধারনা সাদা চাদর সাদাই থাকবে।মেয়েটার তো চরিত্র বলতে কিছুই নেই।কিন্তু……।তাতে কি বুবু তো আর নিজে দেখতে আসছে না

এটা দেখার দায়িত্বতো বুবু তাকে দিয়েছে….বোনকে জ্বালানোর আরেকটা পথ সে পেয়ে গেলো।
শিউলি পারভিন বেডের উপর থেকে চাদরটা তুলি নিয়ে চলে যেতে থাকে।পথের মাঝে দেখা হয় ইশার সাথে,
-কোই যাও খালামুনি?হাতে কি?

ইশাকে দেখে তিনি একটু ভ্যাব্যাচ্যাক্যা খেয়ে যান।নিজের মুখটা কিছুটা স্বাভাবিক করে বলে উঠেন,
-কি বলতো বিড শিটটা নোংরা হয়ে গেছে…কাল তো!এসব তো লজ্জার ব্যাপ্যার তাই ভোর ভোর লন্ড্রিতে দেবো।
ইশা আর কিছু বলে না। ঘরে গিয়ে দেখে নওরিন বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।পেছন থেকে নওরিনকে জরিয়ে ধরতেই অবাক হয়,

-কি ব্যাপ্যার রিনি ভেজা গায়ে দাড়িয়ে আছিস কেন
-তেমন কিছু না।
ইশা লক্ষ করে নওরিনের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।ইশা আর সবার মতন নওরিনকে প্রশ্নবদ্ধ করে না কি হয়েছে বলে….সোজা নওরিনকে জড়িয়ে ধরে।নওরিনকে তার চেয়ে বেশি হয়তো কেউ চিনে না।
-আমার ভাইটা এমনই।একটু কষ্ট করে মানিয়ে নে।তবে বিশ্বাস কর সে কখনো তোকে অসম্মান করবে না।
নওরিন একটু মুচকি হেসে উওর দেয়,

-আমান ভাইয়ার মতো?তখনও তো তুই একই কথা বলেছিলি?
ইশার মুখের রংটা পাল্টে যায়।
নওরিন ফ্রেশ হয়ে নেয়।ইশা নওরিনকে নিয়ে নিচে নামে।বিয়ের ধকলে বাড়ির কারো সাথে ঠিক করে আলাপটাও হয় নি নওরিনের।

[ইসরাকের বাবারা তিন ভাই।ইসরাকের বাবা বড়।ইসরাকের মেজো চাচা চাচী একটা রোড এক্সিডেন্টে ছোট বেলাতেই মারা গিয়েছে।সেবার রোড এক্সিডেন্টে তার মেজো চাচা -চাচী দুজনই মারা গেলেও তাদের এক মাত্র সন্তান আমান সিকদার বেঁচে গিয়েছিলো।জিনাত সিকদার আর ইমতিয়াজ শিকদারই সেই সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছিলো।নিজের সন্তানের মতো বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো।

ইসরাকের ছোট চাচা আর চাচী এ বাড়িতেই থাকে।তাদের এক মেয়ে আর এক ছেলে রয়েছে নোহা আর সোহাগ।নোহা আর ইশা পিঠোপিঠি। নোহা পড়াশোনার খাতিরে হোস্টেলে থাকে।আর সোহাগের বয়স সবে ৫ হতে চললো]
ইশা নওরিনকে ড্রইয়ং রুমে নিয়ে আসে।দাদু সেখানে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন পাশে দীদা ও বসা।নওরিন তাদের কাছে গিয়ে সালাম দেন।দাদু নওরিনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়।

-বসো।কেমন আছো মা।নতুন সংসার কেমনে লাগছে তোমার?
নওরিন মাথা নাড়ে,
-ভালো!
পাশ থেকে দীদা হেসে বলে উঠে,
-সংসার করলে কোথায় যে ভালো লাগলো!সবে তো এলে।সংসারের যাতাকলে পড়লে বুঝবা।আপাতোতো আনন্দ করো
দাদু দীদা একসাথে হেসে উঠে।
খাবার টেবিলে ডাক পড়ে সবার।ইশা নওরিনকে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেয়।ছোট চাচী আর জিনাত সিকদার কিচেনে কাজ করছে।
নওরিন কে টেবিলে বসতে দেখে শিউলি পারভিন এগিয়ে আসে।

-কি বউ ইসরাক বাবা কোথায়?
নওরিন মাথা নিচু করে উওর দেয়
-জানি না
তিনি একটু চেচিয়ে বলে উঠে
-সেকি ইসরাক বাবা তো কখনো সকালে ব্রেক লফাস্ট না করে বার হয় না প্রথম দিনেই বরকে ঘর ছাড়া করলে।কি বউ গো তুমি?
নওরিন কোনো উওর দেয় না।

-আহ ছাড়ো তো শিউলি।সব কথায় এতো ফোঁড়ন কাটো কেন! হয়তো ওর কোনো কাজ পরে গিয়েছে তাই বেরিয়েছে।বউ তুমি খেয়ে নাও দাদুভাই ঠিক চলে আসবে(দীদা)
হটাৎ ই জিনাত সিকদার এসে নওরিনের সামনে থেকে ছো মেরে প্লেট টা কেড়ে নেয়।
-খাবে না তুমি। স্বামী না খেলে বউদের খেতে নেই তুমিও খাবে না ইসরাক ফিরুক তারপর খাবে
-যদি সারা দিন না ফিরে?সারাদিন না খেয়ে থাকবো?
জিনাত সিকদার রাগী চোখে তাকায় নওরিনের দিকে।সেই চোখে যে শুধু রাগ নয়, রাগের সাথো সাথে ঘেন্নাও মেশানো আছে।

-তুমি যে সংসার স্বামী নিয়ে থাকার মতো মেয়ে ছেলে না এটা আমার জানা আছে….
-কি করে জানলে?আন্টি তুমিই তো….
পাশে থেকে ইসরাকের ছোট চাচী বলে উঠেন

-নওরিন তুমি না নতুন বউ।শ্বাশুড়ির মুখে মুখে এতো কথা বলতে নেই।হ্যা সে হয়তো তোমার বন্ধুর মা। তুমি তাকে আগে থেকেই চিনো কিন্তু আপাতোতো সে তোমার শ্বাশুড়ি।তোমার ইসরাকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না খেয়ে নাও।
নওরিনের ভিষন রাগ হচ্ছে বহু কষ্ট তার রাগ কন্ট্রোল চুপ চাপ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যায় সে।
পাশ থেকে শিউলি পারভিন বলে উঠে,
“-দেখেছো বুবু মেয়ের দেমাগ।চরিত্র খুইয়ে এসেও দেমাগ কমেনি”

নওরিন সারাদিন ঘরে বসে আছে।একবারও ঘর থেকে বার হয় নি।মাঝে ইশা এসে নওরিনকে খাবার দিয়ে গেছে।নওরিন খাবে না।শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিনের তিক্ত কথায় তার পেট ভরে গিয়েছে।
ইশা সাধা সাধি করলেও সে জীদ ধরে বসে আছে ইসরাক না আসা পর্যন্ত খাবে না।
ইশা জানে নওরিন বড্ড একগোয়ে।তার না কখনো হ্যা হয় না!!!

কারো একটা ফোনের রিং টোনের শব্দে নওরিনের ঘুম ভাঙ্গে।ঘরে বসে বসে কান্না করতে করতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো নওরিন।কেউ ডাকেনি তাকে। বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে সন্ধ্যে হতে চললো।
নওরিন বিছানা হাতরে দেখে বালিশের নিচে একটা ফোন। ফোনটা হয়তো ইসরাকের ভুলে রেখে গেছে।
ফোনটা বার দুয়েক বাজার পর কেটে যায়।একটু পর আবার বেজে উঠে…

নওরিন এবার ফোনটা হাতে তুলে নেয়।ফোনে নীলাঞ্জনা নামটা ভেসে উঠেছে।এবারও কল কেটে যায়।চতুর্থ বারের বেলায় নওরিন কল রিসিভ করে।নওরিন কিছু বলার আগেই অপর পাশ থেকে একটা মেয়ে ডুকরে উঠে,
-প্লিজ ইসরাক আমাকে ক্ষমা করো আমার ভুল হয়ে গিয়ছে জান!

-(…..)
-তুমি তো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে বলো?প্লিজ বলো, তুমি নিজের মুখে বলো তুমি আমাকে ছাড়া কাওকে বিয়ে করতে পারো না।
-(……)

প্রিয়োসিনী পর্ব ২

-ইসরাক আমি আজকেই বেবিটা এবোর্শান করিয়ে নেবো।তুমও চাইলো এক্ষুনি করাবো । ট্রাস্ট মি। প্লিজ সব ভুলে যাও…কথা বলো না কেন?আমার সত্যিই অনেকবড় ভুল হয়ে গিয়েছে।
-আমি আপনার বফ না আমি তার বিয়ে করা নতুন বউ।
-ইউ……

প্রিয়োসিনী পর্ব ৪