প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১১
রাজিয়া রহমান
ইরা স্কুল থেকে ফিরেছে খানিক আগে।ব্যাগ রেখে ফ্যানের নিচে বসেছে।এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে লিরা ইরার সামনে রাখলো।মুহুর্তেই ইরার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
যত্ন করে লিরা ছোট বোনের ব্যাগ,বই গুছিয়ে দিয়ে ভাত খেতে আসার জন্য তাড়া দেয়।
শারমিন সিরিয়াল দেখতে বসেছে।লিরাকে ডেকে বললো, “আমাকে এক কাপ চা দে লিরা।”
“ইরাকে ভাত খাইয়ে নিই আগে মা।”
ইরার ভীষণ আনন্দ লাগে যখন আপা তাকে ভাত খাইয়ে দেয়।আপার একটা হাত ধরে ইরা বললো, “আপা,আমাকে নতুন এক সেট প্যাস্টেল কালার কিনে দে না।”
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে লিরা চুপ করার ইঙ্গিত করে বললো, “আস্তে,মা শুনে ফেলবে।”
ইরার মন খারাপ হয়ে যায়। ইরার রাগের রংগুলো সব ফুরিয়ে এসেছে প্রায়।মা’কে কয়েক বার বলেছে ইরা।মা উল্টো রাগারাগি করে একথা শুনলে।
অকাজে এক পয়সা ও নষ্ট করতে দিবে না মা।
ছোট বোনের মন খারাপ দেখে লিরার ও খারাপ লাগে।সামান্য একটা রং -ই তো।অথচ লিরা দিতে পারছে না।
ইরাকে খাইয়ে দিয়ে লিরা মা’র জন্য চা নিয়ে যায়। চা’য়ের কাপ রেখে আসার সময় শারমিন বললো, “তুই কি আর নতুন কোনো স্টুডেন্ট পড়াস না?একজনকেই পড়াবি নাকি?মানুষের ছেলেমেয়েরা পাঁচ ছয়টা করায় টিউশন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মা,আমার সময় কুলায় না।”
“সময় সবার জন্য ৩৬ ঘন্টা শুধু তোর জন্য বুঝি ২৪ ঘন্টা যে তুই পারস না?”
“মা,তুমি সবসময় অন্যের সাথে তুলনা দিও না আমার। আমার এসব ভালো লাগে না।”
শারমিন ঠাস করে লিরার গালে থাপ্পড় মারে। এতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শারমিনের ভালো লাগে না।সাগরের বাবা হাশেম আলীর এক জীবনে সঞ্চয় বলতে ঢাকা শহরেন্তিন বেড রুমের একটা ফ্ল্যাট আর গ্রামের বাড়িতে কিছু পৈতৃক সম্পত্তি।
শারমিনের অন্য বোনেরা কতো সুখে আছে,টাকার বিছানায় ঘুমায়।অথচ শারমিনের কপাল!
লিরা চোখের পানি মুছে মা’য়ের সামনে থেকে চলে যায়। ইরাকে ঘুম পাড়াতে হবে।লিরার এখন অবসর আছে।এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে লিরা এবার। পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে।লিরা ছোট বোনকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলো।
সন্ধ্যায় বেলায় হাশেম আলী বাসায় ফিরলেন চিন্তিত হয়ে।
শারমিন তখনও টিভির সামনে।
লিরা বাবাকে লেবুর শরবত করে দিলো।
হাশেম আলী শারমিনের পাশে বসে চাপা গলায় বললেন, “একটা আলোচনা ছিলো তোমার সাথে?”
“কি আলোচনা? রাইতে ঘুমানোর সময় বইলেন।এখন সিরিয়াল দেখি।”
“টিভি বন্ধ কর।আগে কথা শুনো।”
হাশেম আলীর চিন্তিত মুখ দেখে শারমিন টিভি বন্ধ করে দেয়।
“লিরার জন্য এক জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসছে।”
শারমিন পানের খিলি মুখে পুরে বললো, “পোলা কী করে?”
“পোলা কিছু করে না।বাপ মা’র একমাত্র পোলা।বাপের ঢাকা শহরে বাড়ি আছে তিনটা। বাপ নাই।মা আর দুই বোন আছে।বোন দুইটা বিয়া দিয়ে দিছে।”
শারমিনের চোখ চকচক করে উঠে।
“লিরার সন্ধান পাইলো কই?”
“লিরা যে পোলারে পড়ায়।ওই পোলার মায়ের খালাতো ভাই। ওর মা লিরারে দেখাইছে পোলারে।পোলার মনে ধরছে।”
শারমিন আগ্রহী হয়।ফিসফিস করে বলে, “তাইলে দেরি কইরেন না।শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সাইরা ফেলা ভালো।”
“কিন্তু, মাইয়াটা মাত্র মেট্রিক দিলো।এতো তাড়াতাড়ি!”
“আপনের কী মাথা খারাপ? মাইয়া আর পইড়া কি হইবো?একটা ভালো পোলার লগে বিয়ে দেওন ছাড়া আর কি কাম?এখন যদি ভালো পোলা পাই তাইলে দেরি কিসের? ঘরে মাইয়া আরেকটা আছে।ইরা ৫ এ পড়ে। ৫ বছর পর আবার ওর বিয়া দেওয়া লাগবো।সাগরের পড়ালেখার খরচ আছে।
লিরার এইখানে বিয়া হইলে তো ভালোই। মাইয়াগো শ্বশুর বাড়ি বড়লোক হইলে বাপ মা’র আর অভাব থাকে না।”
“সাগরের লগে আলোচনা করে দেখি।”
“সাগরের আবার সিদ্ধান্ত কিসের?ও কি বুঝবে এসবের?আপনি ওদের আসতে বলেন।”
হাশেম আলী পরদিন ওদের আসতে বলে।
লিরা তখন রান্নাঘরে নাশতা বানাচ্ছে। শারমিন রান্নাঘরে ঢুকলো।রান্নাঘরে শারমিন খুবই কম আসে।আরো দুই বছর আগে থেকেই লিরা রান্নাবান্না সব কিছু করে।
আজকে হঠাৎ শারমিনকে আসতে দেখে লিরা কিছুটা অবাক হয়।শারমিন নিজেই বললো, “আজকে বাড়িতে মেহমান আসবে,তুই সেজেগুজে থাকিস।”
“মেহমান আসলে সাজতে হবে কেনো?”
“তোকে দেখতে আসবে তাই।”
লিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।এতো শীঘ্রই বাবা মা তার বিয়ের চিন্তা করছে!
লিরার গলা ধরে এলো। ছলছল দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি সবেমাত্র এসএসসি দিয়েছি মা।তোমরা এখনই…!”
“সারাজীবন কী ঘাড়ে বসাই রাখমু?ইরা বড় হইতেছে।তোরে বিয়া দিয়ে ওর বিয়ার জন্য টাকা পয়সা জমানো লাগবে না?ওরে পড়ালেখা করানো লাগবে না?তোর বাপের কী জাহাজের কামাই আছে না-কি যে এতো গুলোরে পালমু?আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না?”
লিরা কান্নাভেজা গলায় বললো, “কেনো জন্ম দিয়েছো তাইলে যদি ভরণপোষণ দিতে না পারো?”
শারমিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। লিরার পিঠে ধুম করে কিল দিয়ে বললো, “ভুল করছি।অনেক বড় ভুল করছি।এজন্য এখন বিয়া দিয়ে খেসারত দিমু।হইছে?”
লিরার এতো কষ্ট লাগলো মা’য়ের এমন কথা শুনে।আর একটা ও কথা বললো না লিরা।সোজা রুমে চলে গেলো।
বিকেলের দিকে মেহমান এলো।শারমিন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে একটা মাইক্রো নিয়ে এসেছে ওরা।
গাড়ি ও আছে না-কি ওদের!
শারমিনের কেমন আনন্দ লাগে।এতো বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দিবে!
তার মেয়ে এতো ভাগ্য নিয়ে এসেছে!
অথচ গর্দভ মেয়ে কিছুই বুঝে না।
হাশেম আলী শারমিনকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললো, “পোলার বয়স মনে হয় বেশি!”
“বয়স বেশি হইলে সমস্যা কি?এরকম পোলারা অল্পবয়সী বউরে মাথায় করে রাখে।”
হাশেম আলীর মনটা খচখচ করে। শারমিনের মুখের হাসি এক হাত চওড়া হয়।
লিরাকে ওরা আগেই পছন্দ করে রাখছে ওদের কোনো দাবি দাওয়া ও নেই।ওরা বেশি মেহমান ও খাবে না।৪-৫ জন এসে বউ নিয়ে যাবে।মেয়ের বাবার খরচ করাতে চায় না ওরা।
শারমিনের আনন্দ আর ধরে না।এরকম ঘর কোথায় পাবে আর!
এখনই ওরা মেয়ের বাবার কথা ভাবছে,বিয়ের পর তো জামাই ই তাহলে তাদের হাল ধরবে।
৩ দিন পরে বিয়ের দিন ঠিক হলো।মেহমান বিদায় নিতে শারমিন মোবাইল নিয়ে বসলো।আত্মীয় স্বজন সবাইকে কল দিয়ে জানাতে লাগলো লিরার জন্য কতো বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ আসছে।
সাগর শুনে হাশেম আলীকে নিষেধ করলো,কিন্তু শারমিনের এক কথা। এখানে মেয়ে বিয়ে দিতে না পারলে সে আর ছেলে মেয়ে কারো খবর জানে না।
লিরা ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আকুল হয়ে।অভিমানে বাবা মা’য়ের সাথে কথা বলে না। বাবা মা ও লিরাকে কিছু বলে না।
লিরাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি ৩ দিন পর বিয়ে হয়ে গেলো লিরার।লিরাদের দিক থেকেও মেহমান ছিলো হাতেগোনা কয়েকজন। পাত্রপক্ষ থেকে পাত্র,পাত্রের বন্ধু তিনজন আর দুই বোন এসেছে।
লিরাকে গহনা দেওয়া হলো ১৫ ভরির উপরে।
শারমিনের চোখ চকচক করে। এতো সোনা!!
লিরা পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। মা’য়ের বলা কথাটা এখনো কানে বাজছে।বিয়ে দিয়ে মা তার ভুলের খেসারত দিতে চায় যদি তো দিক।লিরা আর কক্ষনো বাবার বাড়ি আসবে না।
বিদায়ের বেলায় লিরা ইরাকে ধরে কাঁদলো শুধু। ইরার কানে কানে বললো, “এই দুনিয়ায় তুই আমার সবচেয়ে আপন বোন।জানি না আজকের পর থেকে আমাদের মধ্যে আর কখনো দেখা হবে কি-না। তোকে আমি অনেক ভালোবাসি।তুই ভালো থাকিস।অনেক ভালো থাকিস।”
ইরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।আপা চলে গেলে সে একেবারে একা হয়ে যাবে।
শ্বশুর বাড়ি গিয়ে লিরা আরেক সত্যির মুখোমুখি হলো।লিরার হাজব্যান্ড নাহিদ এর আগেও দুই বিয়ে করেছে।দুই বউ-ই শাশুড়ির অত্যাচারে টিকতে না পেরে সংসার ছেড়ে চলে গেছে।
লিরাকে এই তথ্য দিয়েছে লিরার মেজো চাচী শাশুড়ীর ঘরের কাজের মেয়েটা।
লিরা বুঝতে পারলো এজন্যই বিয়েতে কাউকে নেয় নি যাতে গোপন তথ্য ফাঁস না হয়ে যায়।
বিয়ের পর দিন থেকেই লিরার অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়ে যায়।
নাহিদ সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, জুয়া খেলায় মজে থাকে।বাসায় ফেরে রাত ১২টার পরে।লিরাকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়।খাওয়া দাওয়া করে সব গুছিয়ে বিছানায় পিঠ লাগাতে লাগাতে রাতের ১টা বাজে।
বিছানায় গেলে শুরু হয় নাহিদের আরেক অত্যাচার।
লিরার কাছে অত্যাচারই মনে হয় এই ব্যাপারটা।
যেখানে লিরার আগ্রহ, ইচ্ছা, শরীরের ক্লান্তি কোনো কিছুই বিবেচনায় নেয় না।শুধু নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করে সরে যায়।
সারাদিনে দুই মিনিট ভালো করে কথা ও বলে না লিরার সাথে নাহিদ।বাহিরে গেলে এক বার কল ও দেয় না।
লিরার কাছে জেলখানার মতো মনে হয়। লিরা সহ্য করতে পারে না।
ঘুমাতে ঘুমাতে রাতের দুটো বাজে।আবার সকালে উঠতে হয় ৫টা বাজে।
লিরার চোখের নিচে কালি জমে যায়।
শ্বশুর বাড়িতে কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই অথচ রাজ্যের কাজ সব করা লাগে। অথচ খাবার দেওয়া হয় মেপে মেপে।হাড়ি পাতিলের তদারক লিরার দুই ননদ।ওরা নির্ধারণ করে লিরা কোনটা খাবে,কোনটা খাবে না
নাহিদেরে দুই বোন,বোনদের ৫টা বাচ্চা,বোনের জামাই ২ জন,শ্বশুর শাশুড়ী সবার জন্য কাজের লোক একজনই,লিরা।
শাশুড়ী আর দুই ননদ সাক্ষাৎ জানোয়ার যেনো।লিরাকে প্রতিমুহূর্তে ওরা রক্তাক্ত করে দেয়।
অভিমানে লিরা বাবার বাড়ি যায় না বিয়ের পর থেকে,শাশুড়ী ও যেতে বলে না।
আর নাহিদ তো জানেই না লিরার যে বাবার বাড়ি আছে।
হাশেম আলী কল দেন মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নাহিদ বিরক্ত হয়ে লিরাকে এক দিন বলেই দিলো, “তোমার বাবাকে বলে দিও তোমাদের ওই দুই রুমের বাসায় আমি যাবো না।ওখানে বস্তির মতো বাসায় কোনো মানুষ থাকে!
তুমি গিয়ে একদিন দেখা করে এসো।থাকার দরকার নাই ওখানে,আম্মা রাগ করবে।”
লিরা বাবার বাড়ি গেলো গুনে গুনে ১ মাস ১৭ দিন পর। তাও একা।
শুক্রবার, ইরা বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ছে।লিরা বাসায় গেলো তখন।হাশেম আলী দরজা খুলে মেয়েকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে চমকে গেলেন।
এই কে?
লিরা!
এ যেনো একটা কংকাল দাঁড়িয়ে আছে।
লিরা হেসে বাবাকে সালাম দিয়ে বললো, “কেমন আছো বাবা?”
“আমি ভালো আছি,তোর এই অবস্থা কেনো?”
“কি অবস্থা বাবা?বড়লোক ঘরে মেয়ের বিয়ে দিছো,মেয়ে সুখে আছে।এটা সেই সুখের প্রমাণ বাবা।”
হাশেম আলীর বুক ভারী হয়ে উঠে। তার তিন সন্তান ফুলের মতো সুন্দর। সেই ফুল আজ শুকিয়ে এমন হয়ে গেলো কেনো?
শারমিন টিভি দেখছিলো।লিরার গলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এলো।লিরাকে দেখে শারমিন বললো, “তুই একা এলি?জামাই আসে নি?”
“না,তোমাদের এই ছোট বস্তির মতো বাসায় আসতে তার লজ্জা লাগে। এটা মানুষের বসবাসের যোগ্য না।”
“তা তো বলবেই।ওরা কতো বড় বাড়ির মানুষ।তুই আবার সেসব দোষ ধরিস না।বেডা মানুষ এমনই হয়।”
লিরা ইরার কাছে যায়।প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ছোট বোনটার জন্য পরান পুড়ে যায় লিরার।
শারমিন লিরার পেছন পেছন এসে বললো, “তুই কি থাকবি রাতে?”
“থাকলে অসুবিধা হবে তোমার? নাকি সুবিধা? তোমার যেটা সুবিধা হবে সেটাই করবো আমি।”
“উল্টো পালটা কথা বলিস না।জামাই আসে নি যখন, তোর থাকা শোভা পাবে না।”
লিরা করুণ হেসে বললো, “আমি থাকবো না মা।ভয় পেও না।তোমার সংসারের বাড়তি বোঝা ছিলাম,ছেঁটে ফেলে দিয়েছো।মরে গেলেও তোমার সংসারে আসবো না ফিরে।”
শারমিন রাগ হয়ে বললো, “হ,এখন তো আমি খারাপই হমু।বড় ঘরে বিয়া দিছি তো আমার সুখের জন্য। ওই বিশাল বাড়িতে আমি থাকি তো গিয়ে!”
“না,তুমি থাকো না।আমি থাকি।তবে কাজের মেয়ে হয়ে থাকি।বিনা বেতনের কাজের মেয়ে।তুমি জানো,ওই লোকটা এর আগেও দুই বিয়ে করেছে।ওই লোক আমার চাইতে ১৩ বছরের বড়।
এসব কিছুই তো আমার সুখ, না মা?”
শারমিন মেয়ের ব্যবহারে বিরক্ত হয়।দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ের মনে হয় বয়ষ্ক জামাইয়ের কাছে বিয়ে হয় না।আর কারো জামাই দুই বিয়ে করে না?
টাকা পয়সাওয়ালা মানুষের এরকম একটু আধটু দোষ থাকে সেসব তাদের টাকা পয়সার গুণ বলা যায়।
শারমিন চলে গেলো নিজের রুমে।
লিরা দুপুরে খেলো না।মা’য়ের কাছে মানুষ আসে একটু শান্তির জন্য। লিরার জন্য কোথাও শান্তি নেই।
ইরা বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপা,আজকে আমার সাথে থাকবে রাতে?”
“না রে বোন।”
ইরা বোনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
লিরা ইরার মাথায় হাত দিয়ে বলে, “ভাইয়া যখন বিয়ে করবে।ভাইয়ার বউকে কখনো কষ্ট দিবি না।আমি তো আজকের পর আর কখনো এউ বাসায় আসবো না।তুই কখনো ভাবীর সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না।মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ননদ আর শাশুড়ীর কাছে যদি শান্তি না পায় তাহলে তাদের জীবন নরক হয়ে যায়।”
ইরার মাথায় এসব কিছুই ঢুকে না।
সন্ধ্যা বেলায় লিরা চলে যায়।হাশেম আলী বারবার বলেও মেয়েকে রাখতে পারে না।
দুই মাস পর লিরা কনসিভ করে।লিরা বুঝতে পারে না ও কনসিভ করেছে।পরপর তিনমাস পিরিয়ড হয় না দেখে নাহিদকে বললো, “আমার পিরিয়ড হচ্ছে না কেনো?”
“আমি কিভাবে বলবো?এমনিতেই হচ্ছে না হয়তো। ভালো হয়েছে,পিরিয়ডের বাহানা দিয়ে রাতে আমাকে কাছে যাইতে দিতা না।এবার আর সেসব নাই।”
লিরার মাথা ঘোরা বিয়ের পরপর থেকেই ছিলো যথেষ্ট পরিমাণ খাবার না খেতে পারায়।
লিরাকে কেউ কখনো এসব ব্যাপারে কিছু বলে নি।বইতে যেটুকু পড়েছে সেটুকুই লিরার জানা আছে।
চতুর্থ মাসে ও পিরিয়ড না হওয়ায়, শরীর আস্তে আস্তে খারাপ বেশি লাগায় লিরার হঠাৎ করেই সন্দেহ হয়।
বড় ননদকে বললে কেউ পাত্তা দেয় না।
উপায় না পেয়ে লিরা ছোট চাচী শাশুড়ীর বাসার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে একটা প্রেগন্যান্সি টেস্টের জন্য স্ট্রিপ আনে।
টেস্ট করে পজিটিভ এলে রাতে নাহিদকে জানায়।
নাহিদ বিরক্ত হয়ে বললো, “এখনই বাচ্চা নেওয়ার কোনো দরকার ছিলো না।হয়ে গেছে যখন, তখন এতো মাতামাতির কিছু নাই।বাড়তি ঝামেলা একটা।”
লিরা ভেবেছিলো এবার হয়তো একটু শান্তি পাবে।
কিন্তু লিরা জানে না,সুখ-শান্তি এসব ভাগ্যে করে নিতে আসতে হয়।সবার ভাগ্যে থাকে না এসব।
বাচ্চা পেটে নিয়ে লিরাকে সবকিছু করতে হয়।নাহিদ কোনো কিছুই খবর রাখে না। তার সন্তান আসবে দুনিয়ায় তা ও নাহিদের কোনো ভাবনা নেই।
লিরার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় খাবারের। মা’য়ের উপর লিরার অভিমান থাকলেও প্রেগন্যান্সির সময় লিরা সেসব ভুলে গেলো।
নাহিদকে বললো কয়েকদিন বাবার বাড়ি গিয়ে থাকবে।
নাহিদের মা নাকচ করে দিলেন।লিরা চলে গেলে ঘরের এতো কাজ কিভাবে করবেন তিনি!
পুরো প্রেগন্যান্সির জার্নিতে লিরা একবার ও ডাক্তারের কাছে যেতে পারে নি। মাঝেমাঝে শারমিনকে কল দিয়ে বলতো ঝাল ঝাল চালতার আচার খেতে ইচ্ছে করে, শুঁটকি ভুনা খেতে ইচ্ছে করে,কচু শাক খেতে ইচ্ছে করে।
শারমিন দুই একবার হাশেম আলীকে দিয়ে পাঠিয়েছে ও।কিন্তু নাহিদের মা ওসব রাখে নি।এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যাবে না।
হাশেম আলী বাড়িতে গিয়ে বলে আফসোস করে।
ইরার কান্না পায়।তার আপার চাওয়া খুবই সীমিত অথচ তাও খেতে পারছে না।
সময় কেটে যায় নিজের গতিতে।ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা পেটটার দিকে তাকিয়ে লিরা নানা রকম গল্প করে।
লিরার মনে হয় তার শূন্য জীবনে খুশির ফোয়ারা হয়ে আসবে কেউ একজন।
মাঝেমাঝে ইরার সাথে কথা হয়।লিরার চাইতে ইরার আগ্রহ দ্বিগুণ বেশি।
ডেলিভারির দিন সকালে লিরা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রুটি বানাচ্ছে।হঠাৎ করেই টের পেলো তার পরনের মেক্সির নিচ দিক ভিজে গেছে।নিচে তাকিয়ে দেখে কোমর থেকে নিচে পা পর্যন্ত ভেজা।
লিরার ওয়াটার ব্রেক শুরু হয় কিন্তু লিরার এসব কিছু সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।উল্টো লিরা ভাবে সে এখানে কিভাবে প্রস্রাব করে দিলো,কেনো বুঝতে পারলো না তার প্রস্রাব পেয়েছে!
দ্রুত মেঝে পরিষ্কার করে নিলো লিরা।তারপর রুমে গেলো পোশাক পাল্টাতে। কিচেন রুম থেকে নিজের রুমে যেতে যেতে পুরোটায় দেখলো ভিজে গেছে।আস্তে আস্তে লিরার পেট ব্যথা শুরু হয়।
শারমিন লিরাকে বলে রেখেছে ব্যথা উঠলে তাকে কল দিতে।
ব্যথা উঠার মানে লিরা বুঝে না।তবুও মনে হচ্ছে আজকের কথা-ই বলেছে মা।লিরা হাতের আঙুলে হিসাব করে।
নাহিদ ঘুমিয়ে আছে।লিরা শারমিনকে কল দিয়ে জানালো সবকিছু শারমিন বললো, লিরার শাশুড়ীকে জানানোর কথা।
লিরা গিয়ে শাশুড়ীকে জানায়।
রেহানা শুনে লিরাকে বললো রুমে যেতে।সে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে বস্তি থেকে ধাত্রীকে আনতে বললো
ধাত্রী আসতে আসতে ৮টা বাজে।শারমিন আসে দশটার দিকে। ইরা ও আসে মা’য়ের সাথে। বোনের শ্বশুর বাড়ি ইরা এই দ্বিতীয় বার এসেছে।এর আগে বৌ ভাতের দিন এসেছিলো।
লিরার পেটে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে।শরীর কাঁপুনি দিয়ে মাংসপেশি শক্ত হয়ে উঠছে।
প্রচন্ড খিঁচুনিতে লিরার চোখ উল্টে আসছে।ঠকঠক করে দাঁত কাঁপছে।
কেউ বুঝলো না এটা ইক্ল্যাম্পসিয়ার খিঁচুনি।
ধাত্রী বললো, “বউয়ের ব্যথা আছে, হাসপাতালে নিবেন না-কি বাড়িতেই রাখবেন?”
রেহানা বিরক্ত হয়ে বললো, “হাসপাতালে নিলে আপনারে আনছি কেনো?বাড়িতেই হইবো।আমরা কি বাড়িতে পোলাপান জন্ম দিই নাই?ওরে বলেন শক্ত থাকতে,চাপ দিতে।
হাসপাতাল আবার কী?
দরকার হোক বা না হোক,সিজার করায় বসায় রাখে।”
শারমিন বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। রেহানা শারমিনের সাথে একটা কথা ও বলে নি।শারমিনের নিজেকে কেমন উদবাস্তু মনে হচ্ছে এখানে এসে।
ধাত্রী তার চেষ্টা চালিয়ে গেলো।প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে লিরার।
লিরার মনে হচ্ছে দুই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কেউ শুনলো না।লিরা ফিসফিস করে আল্লাহ পাককে ডেকে,কালেমা পড়তে লাগলো।
ধাত্রী চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু লিরার থেকে সাড়া পাচ্ছে না।আস্তে আস্তে লিরার সাড়া দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।
ধাত্রীর হাত থেমে গেলো।
এদিক ওদিক তাকিয়ে থমথমে সুরে বললো, “মা,বাচ্চা দুজনেই আল্লাহর দরবারে চলে গেছে।”
ইরা চুপচাপ বসে রইলো আগের জায়গায়।শুধু টের পেলো বুকের ভেতর আচমকাই যেনো ভীষণ খালি খালি লাগছে।
ইরার বারান্দার গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বোনের কথা ভাবতে থাকে।উপমা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। উপমার ক্লান্ত, করুণ চাহনির দিকে তাকিয়ে ইরার মনে হলো উপমা ভালো নেই।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কেউ যদি একবার কাঁটা হয়ে যায় আজীবন তাকে আর সুনজরে দেখতে ইচ্ছে করে না।
ইরা কারো সম্পর্কে কাঁটা হতে চায় না,কারো রাগের কারণ হতে চায় না।
তার জন্য কেউ কষ্ট পাক ইরা তা চায় না।মুনাজাতে হাত তুলে কেউ দোয়া না করুক তবুও বদদোয়া যাতে না দেয়।
উপমার জন্য ইরার চিন্তা হয়।লিরাকে হারানোর যন্ত্রণা ইরা এক জীবনে ভুলবে না।তবুও উপমা আসার পর থেকে ইরা চেষ্টা করছে ভাবীর সাথে মিলেমিশে থাকতে।লিরার বলে যাওয়া কথা ইরা কখনো ভুলবে না।
এজন্যই উপমার উপর ইরা রাগ করে না। ইরা ভাবে যদি লিরা এমন করতো তাহলে কি ইরা বোনের সাথে মনোমালিন্য করতে পারতো!
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১০
তাহলে উপমার সাথে কেনো করবে?
ইরা এটা জানে না,কারো সরলতা অন্যের কাছে দুর্বলতা হয়ে ধরা দেয়।উপমা ও জানে ইরা কেনো তাকে কখনো কষ্ট দেয় না।আর এই সুযোগটাই উপমা বারবার কাজে লাগায়।
ইরা জানে,বুঝে সব।কিন্তু ইরা বিশ্বাস করে ও হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য হেরে যাচ্ছে বিশ্বাসের কাছে।আখেরে লস তার না,যে ভালোবাসার সম্মান দিতে পারে না তারই হয়ে থাকে।